বিষয়বস্তুতে চলুন

লঘুগুরু প্রবন্ধাবলী/ভদ্র জীবিকা

উইকিসংকলন থেকে

ভদ্র জীবিকা

 বাংলার ভদ্রলোকের দুরবস্থা হইয়াছে তাহাতে দ্বিমত নাই। দেশের অনেক মনীষী প্রতিকারের উপায় ভাবিতেছেন এবং জীবিকানির্বাহের নূতন পন্থা নির্দেশ করিতেছেন। কিন্তু বর্তমান সমস্যার সমাধান যে উপায়েই হউক, তাহা শীঘ্র ঘটিয়া উঠিবে না। রোগের বীজ ধীরে ধীরে সমাজে ব্যাপ্ত হইয়াছে, ঔষধনির্বাচন মাত্রই রোগমুক্তি হইবে না। সতর্কতা চাই, ধৈর্য চাই, উপায়ের প্রতি শ্রদ্ধা চাই। রোগের নিদান একটি নয়, নিবারণের উপায়ও একটি হইতে পারে না। যে যে উপায়ে প্রতিকার সম্ভবপর বোধ হয় তাহার প্রত্যেকটি সাবধানে নির্বাচন করা উচিত, নতুবা ভুল পথে গিয়া দুর্দশার কালবৃদ্ধি হইবে।

 দুর্দশা কেবল ভদ্রসমাজেই বর্তমান এমন নয়। কিন্তু সমগ্র বাঙালীসমাজের অবস্থার বিচার আমার উদ্দেশ্য নয়, সেজন্য কেবল তথাকথিত ভদ্রশ্রেণীর কথাই বলিব। ‘ভদ্র’ বলিলে যে শ্রেণী বুঝায় তাহাতে হিন্দু মুসলমান খ্রীষ্টান সকলেই আছেন। অন্যধর্মীর ভদ্রসমাজে ঠিক কি ভাবে পরিবর্তন ঘটিয়াছে তাহা আমার জানা নাই, সেজন্য হিন্দু ভদ্রের কথাই বিশেষ করিয়া বলিব। প্রতিকারের পন্থা যে সকলের পক্ষেই সমান তাহা বলা বাহুল্য।
 শতাধিক বৎসর পূর্বে ‘ভদ্র’ বলিলে কেবল ব্রাহ্মণ বৈদ্য কায়স্থ এবং অপর কয়েকটি সম্প্রদায় মাত্র বুঝাইত। ভদ্রের উৎপত্তি প্রধানত জন্মগত হইলেও একটা গুণকর্মবিভাগজ বিশিষ্টতা সেকালেও ছিল। ভদ্রের প্রধান বৃত্তি ছিল— জমিদারি বা জমির উপসত্ত্ব ভোগ, জমিদারের অধীনে চাকরি, অথবা তেজারতি। বহু ব্রাহ্মণ যাজন ও অধ্যাপনা দ্বারা জীবিকানির্বাহ করিতেন, অধিকাংশ বৈদ্য চিকিৎসা করিতেন। ভদ্রশ্রেণীর অল্প কয়েকজন রাজকার্য করিতেন, এবং কদাচিৎ কেহ কেহ নবাগত ইংরেজ বণিকের অধীনে চাকরি লইতেন। বাণিজ্যবৃত্তি নিম্নতর সমাজেই আবদ্ধ ছিল। ভদ্র গৃহস্থ প্রতিবেশী ধনী বণিককে অবজ্ঞার চক্ষুতেই দেখিতেন। উভয় গৃহস্থের মধ্যে সামাজিক সদ্ভাব থাকিলেও ঘনিষ্ঠতা ছিল না। উচ্চবর্ণের লোকেরা জমিদারি এবং মামলা পরিচালনের দক্ষতাকেই বৈষয়িক বিদ্যার পরাকাষ্ঠা মনে করিতেন, প্রতিবেশী বণিক কোন্ বিদ্যার সাহায্যে অর্থ উপার্জন করিতেছেন তাহার সন্ধান লইতেন না। বণিকের জাতিগত নিকৃষ্টতা এবং অমার্জিত আচারব্যবহারের সঙ্গে তাঁহার অর্থকরী বিদ্যাও ভদ্রসমাজে উপেক্ষিত হইত। এই সামাজিক বিচ্ছিন্নতা এখনও বর্তমান, কেবল প্রভেদ এই–বাঙালী বণিকও তাঁহাদের বংশপরম্পরালব্ধ বিদ্যা হারাইতে বসিয়াছেন। আর, যাঁহারা ভদ্র বলিয়া গণ্য তাহারা এতদিন তাঁহাদের অতি নিকট প্রতিবেশীর কার্যকলাপ সম্বন্ধে অন্ধ থাকিয়া আজ হঠাৎ আবিষ্কার করিয়াছেন যে ব্যবসায় না শিখিলে তাহাদের আর চলিবে না।

 একালের তুলনায় সেকালের ভদ্রলোকের আর্থিক অবস্থা ভাল ছিল না। কিন্তু তখন বিলাসিতা কম ছিল, অভাব কম ছিল, জীবনযাত্রাও অল্প ব্যয়ে নির্বাহ হইত। ইংরেজী শিক্ষার প্রবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে দেশে এক যুগান্তর আসিল। বাঙালী বুঝিল—এই নূতন বিদ্যায় কেবল জ্ঞানবৃদ্ধি নয়, অর্থাগমেরও সুবিধা হয়। কেরানীযুগের সেই আদি কালে সামান্য ইংরেজী জ্ঞান থাকিলেই চাকরি মিলিত। অনেক ভদ্রসন্তানেরই সেরেস্তার কাজের সহিত বংশানুক্রমে পরিচয় ছিল, সুতরাং সামান্য চেষ্টাতেই তাঁহারা নূতন কর্মক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠালাভ করিলেন। জনকতক অধিকতর দক্ষ ব্যক্তির ভাগ্যে উচ্চতর সরকারী চাকরিও জুটিল। আবার যাঁহারা সর্বাপেক্ষা সাহসী ও উদ্যোগী তাহারা নূতন বিদ্যা আয়ত্ত করিয়া ওকালতি ডাক্তারি প্রভৃতি স্বাধীন বৃত্তি অবলম্বন করিলেন। তখন প্রতিযোগিতা কম ছিল, অর্থাগমের পথও উন্মুক্ত ছিল।

 এইরূপে ইংরেজী শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে ভদ্রশ্রেণী নূতন জীবিকার সন্ধান পাইলেন। বাঙালী ভদ্রসন্তানই ইংরেজী শিক্ষার অগ্রণী ছিলেন, সুতরাং ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ হইতে তাঁহাদের সাদর নিমন্ত্রণ আসিতে লাগিল। অর্থাগম এবং ইংরেজের অনুকরণের ফলে বিলাসিতা বাড়িতে লাগিল, জীবনযাত্রার প্রণালীও ক্রমশ পরিবর্তিত হইতে লাগিল। এইসকল নূতন ধনীর প্রতিপত্তি সকলেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করিল। ইঁহাদের উপার্জনের পরিমাণ যাহাই হউক, কিন্তু কি বিদ্যা! কেমন চালচলন! ভদ্রসন্তান দলে দলে এই নূতন মার্গে ছুটিল। সেকালে নিষ্কর্মা ভদ্রলোকের সংখ্যা এখনকার অপেক্ষা বেশী ছিল, কিন্তু একান্নবর্তী পরিবারে একজনের রোজগারে অনেক বেকারের ভরণপোষণ হইত। সভ্যতা ও বিলাসিতা বৃদ্ধির সঙ্গে উপার্জকের নিজ খরচ বাড়িয়া চলিল, বেকারগণ অবজ্ঞাত হইতে লাগিলেন। এতদিন যাঁহারা আত্মীয়ের উপর নির্ভর করাই স্বাভাবিক মনে করিতেন, অভাবের তাড়নায় তাঁহারাও চাকরির উমেদার হইলেন। অপর শ্রেণীর লোকেরাও পৈতৃক ব্যবসায় ছাড়িয়া সম্মান বৃদ্ধির আশায় ভদ্রের পদানুসরণ করিতে লাগিলেন।

 ভদ্রের প্রাচীন সংজ্ঞার্থ পরিবর্তিত হইল। ভদ্রতার লক্ষণ দাঁড়াইল—জীবনযাত্রার প্রণালীবিশেষ। ভদ্রতালাভের উপায় হইল—বিশেষ প্রকার জীবিকা গ্রহণ। এই জীবিকার বাহন হইল স্কুল কলেজের বিদ্যা, এবং জীবিকার অর্থ হইল—উক্ত বিদ্যার সাহায্যে যাহা সহজে পাওয়া যায়, যথা চাকরি।

 নূতন কূপের সন্ধান পাইয়া কয়েকটি ভদ্রমণ্ডুক সেখানে আশ্রয় লইয়াছিল। কিন্তু কূপের মহিমা ব্যাপ্ত হইয়া পড়িল, মাঠের মণ্ডুক হাটের মণ্ডুক দলে দলে কূপের মধ্যে ঝাঁপ দিয়া ভদ্রতালাভ করল। কূপমণ্ডুকের দলবৃদ্ধি হইয়াছে কিন্তু আহার্য ফুরাইয়াছে।
 ভদ্রের সংখ্যা বাড়িয়া গিয়াছে। সকল জীবিকা ভদ্রের গ্রহণীয় নয়, কেবল কয়েকটি জীবিকাতেই ভদ্রতা বজায় থাকিতে পারে। সেকালের তুলনায় এখন ভদ্রোচিত জীবিকার সংখ্যা অনেক বাড়িয়াছে, কিন্তু ভদ্রের সংখ্যাবৃদ্ধির অনুপাতে বাড়ে নাই। কেতাবী বিদ্যা অর্থাৎ স্কুল-কলেজে লব্ধ বিদ্যা যে জীবিকায় প্রয়োগ করা যায় তাহাই সবাপেক্ষা লোভনীয়। কেরানীগিরির বেতন যতই অল্প হউক, ওকালতিতে পসারের সম্ভাবনা যতই কম হউক, তথাপি এসকলে একটু কেতাবী বিদ্যা খাটাইতে পারা যায়। মুদিগিরি পুরানো লোহা বিক্রয় বা গরুর গাড়ির ঠিকাদারিতে বিদ্যাপ্রয়োগের সুযোগ নাই, সুতরাং এসকল ব্যবসায় ভদ্রোচিত নয়। কিন্তু কেতাবী বৃত্তিতে যখন আর অন্নের সংস্থান হয় না, তখন অপর বৃত্তি গ্রহণ ভিন্ন উপায় নাই। নিতান্ত নাচার হইয়া বাঙালী ভদ্রসন্তান ক্রমশ অকেতাবী বৃত্তিও লইতে আরম্ভ করিয়াছে, কিন্তু খুব সন্তর্পণে বাছিয়া লইয়া। যে বৃত্তি পুরাতন এবং নিম্নশ্রেণীর সহিত জড়িত তাহা ভদ্রের অযোগ্য। কিন্তু যাহার নূতন আমদানি হইয়াছে কিংবা যাহার ইংরেজী নামই প্রচলিত, সেরূপ বৃত্তিতে ভদ্রতার তত হানি হয় না। ছুতারের কাজ, কামারের কাজ, ধোবার কাজ, কোচমানি, মুদিগিরি চলিবে না; কিন্তু ঘড়ি বা বাইসিকেল মেরামত, নকশা আঁকা, ডাইং-ক্লিনিং, চাএর দোকান, মাংসের হোটেল, স্টেশনারি-শপ—এসকলে আপত্তি নাই, কারণ সমস্তই আধুনিক বা ইংরেজী নামে পরিচিত।
  কিন্তু এইসকল নূতন বৃত্তিতে বেশী রোজগার করা সহজ নয়। দরিদ্র ভদ্রসন্তান উহা গ্রহণ করিয়া কোনও রকমে সংসার চালাইতে পারে, কিন্তু যাহাদের উচ্চ আশা তাহারা কি করিবে? চাকরি দুর্লভ, উকিলে দেশ ছাইয়া গিয়াছে, ডাক্তারিতে পসার অনিশ্চিত, এঞ্জিনিয়ার প্রফেসার প্রভৃতি বিদ্যাজীবীর পদও বেশী নাই। বিলাতে অনেকে পাদরী হয়, সৈনিক হয়, নাবিক হয়; কিন্তু বাঙালীর ভাগ্যে এসকল বৃত্তি নাই।

 বাঙালী ভদ্রলোক অন্ধকূপে পড়িয়াছে, তাহার চারিদিকে গণ্ডি। গণ্ডি অতিক্রম করিয়া বাহিরে আসিতে সে ভয় পায়, কারণ সেখানে সমস্তই অজ্ঞাত অনিশ্চিত। কে তাহাকে অভয়দান করিবে?

 অনেকেই বলিতেছেন—অর্থকরী বিদ্যা শেখাও, ইউনিভার্সিটির পাঠ্য বদলাও। ছেলেরা অল্পবয়স হইতে হাতেকলমে কাজ করিতে শিখুক, তাহার পর একটু বড় হইয়া বৈজ্ঞানিক প্রণালীতে শিল্প-উৎপাদন শিখুক। যাহারা বিজ্ঞান বোঝে না তাহারা banking, accountancy, economics প্রভৃতিতে মন দিক। দেশে শিল্প ও বাণিজ্যের প্রসার হইলেই বেকারের সমস্যা কমিবে।

 উত্তম কথা, কিন্তু অতি বৃহৎ কার্য। রোগ নির্ণয় হইয়াছে, ঔষধের ফর্দও প্রস্তুত, কিন্তু এখনও অনেক উপকরণ সংগ্রহ হয় নাই, মাত্রাও স্থির হয় নাই, রোগীকে কেবল আশ্বাস দেওয়া হইতেছে। ঔষধসেবনে যদি বাঞ্ছিত সুফল না হয় তবে সে নিরাশায় মরিবে। অতএব প্রত্যেক উপকরণের ফলাফল বিচার কর্তব্য, যাহাতে রোগীর কাছে সত্যের অপলাপ না হয়।

 প্রথম ব্যবস্থা—সাধারণ বিদ্যার সঙ্গে সঙ্গে ছেলেদের হাতেকলমে কাজ শেখানো। আমার যতটা জানা আছে, এই কাজের প্রচলিত অর্থ—ছুতারের কাজ, কামারের কাজ, দরজীর কাজ, সুতা কাটা, তাঁত বোনা, নক্‌শা করা ও কৃষি। যেসকল ছাত্রের ঐ জাতীয় কাজ কৌলিক ব্যবসায়, কিংবা যাহারা ভবিষ্যতে ঐ কাজ বৃত্তিস্বরূপ গ্রহণ করিবে, তাহাদের পক্ষে উক্ত প্রকার শিক্ষা নিশ্চয় হিতকর। যাহারা অবস্থাপন্ন এবং রোজগার সম্বন্ধে উচ্চ আশা রাখে, তাহারাও উপকৃত হইবে, কারণ মনুষ্যত্ববিকাশের জন্য যেমন বুদ্ধির পরিচর্যা ও ব্যায়ামশিক্ষা আবশ্যক, হাতের নিপুণতা তেমনই আবশ্যক। কিন্তু উচ্চাভিলাষী ছাত্রের পক্ষে এইপ্রকার শিক্ষা কেবল গৌণভাবেই হিতকর, মুখ্যভাবে উপার্জনের কোনও সহায়তা করিবে না।

 দ্বিতীয় ব্যবস্থা—বৈজ্ঞানিক প্রণালীতে শিল্পশিক্ষা। Mechanical ও electrical engineering, agriculture, surveying, banking, accountancy ইত্যাদি শিখাইবার ব্যবস্থা অল্পবিস্তর আছে। এখন কয়েকপ্রকার নূতন শিল্প শিখাইবার চেষ্টা হইতেছে, যথা—চামড়া, সাবান, কাচ, চীনামাটির জিনিস, বিবিধ রাসায়নিক দ্রব্য প্রভৃতি তৈয়ারি এবং সুতা ও কাপড় রং করার প্রণালী। উদ্দেশ্য এই যে, দেশে অনেক নূতন ব্যবসায় ও শিল্পের প্রতিষ্ঠা দ্বারা শিক্ষিত ভদ্রসন্তানের কর্মক্ষেত্র প্রসারিত হইবে। উল্লিখিত কয়েকটি বিদ্যা, যথা—engineering, accountancy ইত্যাদি শিখিলে চাকরির ক্ষেত্র কিঞ্চিৎ বিস্তৃত হয় সন্দেহ নাই। কিন্তু ব্যবসায় ও শিল্পের প্রতিষ্ঠা কি পরিমাণে হইবে তাহা ভাবিবার বিষয়।

 চল্লিশ পঞ্চাশ বৎসর পূর্বে উচ্চশিক্ষা বলিলে সাধারণত সাহিত্য ইতিহাস দর্শন প্রভৃতি বুঝাইত। ছাত্র ও অভিভাবকগণ যখন দেখিলেন যে কেবল এইপ্রকার শিক্ষায় জীবিকালাভ দুর্ঘট, তখন অনেকের মন বিজ্ঞানের দিকে ঝুঁকিল। একটা অস্পষ্ট ধারণা জন্মিল যে, বিজ্ঞানই হইল প্রকৃত কার্যকরী বিদ্যা; বিজ্ঞান শিখিলেই শিল্পজাত পণ্য উৎপাদন করিবার ক্ষমতা হইবে এবং ভদ্রসন্তানের জীবিকাও জুটিবে। তখন কাব্য সাহিত্য দর্শনের মায়া ত্যাগ করিয়া ছাত্রগণ দলে দলে বিজ্ঞান শিখিতে আরম্ভ করিল, বি. এস-সি এম. এস-সিতে দেশ ছাইয়া গেল। কিন্তু কোথায় শিল্প, কোথায় পণ্য? আত্মীয়স্বজন ক্ষুণ্ণ হইয়া বলিলেন—এত সায়েন্স শিখিয়াও ছোকরা শেষে কেরানী বা উকিল হইল! হায়, ছোকরা কি করিবে? বিজ্ঞান ও কার্যকরী বিদ্যা এক নয়। কেমিস্ট্রি ফিজিক্স পড়িলেই পণ্য উৎপাদন করা যায় না, এবং কোনও গতিকে উৎপন্ন করিলেই তাহা বাজারে চলে না।
 এখন আমরা ঠেকিয়া শিখিয়াছি যে বিজ্ঞানে পণ্ডিত হইলেই বিজ্ঞানের প্রয়োগে দক্ষতা জন্মে না। সে বিদ্যা আলাদা, যাহাকে বলে technical education। অতএব উপযুক্ত শিক্ষকের কাছে উপযুক্ত সরঞ্জামের সাহায্যে বৈজ্ঞানিক প্রণালীতে শিল্প শিখিতে হইবে। শিক্ষার পদ্ধতি নির্বাচনে ভুল করিয়া পূর্বে হতাশ হইয়াছি, এবারেও কি আশা নাই? সাবান কাচ চামড়া শিখিয়াও কি শেষে কেরানীগিরি বা ওকালতি করিতে হইবে?

 আশা পূর্বেও ছিল, এখনও আছে। কিন্তু আশার মাত্রা অসংগত ছিল তাই ঠিক যাহা চাহিয়াছিলাম তাহা পাই নাই, এবং এবারেও হয়তো সম্ভাব্যের অতিরিক্ত ফল কামনা করিতেছি।

 বিজ্ঞানে শিল্পজাত দ্রব্যের যে উল্লেখ থাকে তাহা উদাহরণরূপেই থাকে, উৎপাদনের প্রণালী তন্ন তন্ন করিয়া বলা হয় না এবং ব্যবসায় সম্বন্ধে কোনও উপদেশ দেওয়া হয় না। বিজ্ঞানপাঠে কয়েকটি শিল্প সম্বন্ধে একটা স্থূল জ্ঞান লাভ হয়, এবং দেশবাসীর মধ্যে এই জ্ঞান যত বিস্তৃত হয় শিল্পবৃদ্ধির সম্ভাবনাও তত অধিক হয়। যেসকল কারণ বর্তমান থাকিলে দেশে শিল্পবৃদ্ধি সহজ হয়, বিজ্ঞানশিক্ষা তাহার অন্যতম কারণ, প্রধান কারণও বটে, কিন্তু একমাত্র কারণ নয়।

 তাহার পর technical education বা শিল্পশিক্ষা। ইহার অর্থ—যে প্রণালীতে শিল্পদ্রব্য উৎপন্ন হয় সেই প্রণালীর সহিত সাক্ষাৎ পরিচয়। অনেকে মনে করেন ইহাই শিল্পপ্রতিষ্ঠার চূড়ান্ত ব্যবস্থা। এই বিশ্বাস কতদূর সংগত তাহা বিচার করিয়া দেখা উচিত।

 বিজ্ঞানে খাদ্য সম্বন্ধে অনেক কথা আছে, কিন্তু খাদ্য তৈয়ারি বা রন্ধন সম্বন্ধে বিস্তারিত উপদেশ নাই। বিজ্ঞান পড়িলে রন্ধন শেখা যায় না, তাহার জন্য দক্ষ ব্যক্তির কাছে হাতা-খন্তির ব্যবহার অভ্যাস করিতে হয়। এই শিক্ষা লাভ করিলে পাচকের চাকরি মিলিতে পারে এবং অবস্থা অনুসারে অভ্যস্ত রীতির একটু আধটু বদল করিলে মনিবকেও খুশী করা যায়। আয়ব্যয়ের কথা ভাবিতে হয় না, তাহা মনিবের লক্ষ্য। কিন্তু যদি কোনও উচ্চাভিলাষী লোক রন্ধনবিদ্যাকে একটা বড় কারবারে লাগাইতে চায়, অর্থাৎ হোটেল খুলিয়া জনসাধারণকে রন্ধনশিল্পজাত পণ্য বিক্রয় করিতে চায়, তবে কেবল পাচকের অভিজ্ঞতাতেই কুলাইবে না, বিস্তর নূতন সমস্যার সমাধান করিতে হইবে। মূলধন চাই, উপযুক্ত জায়গায় বাড়ি চাই, উপযুক্ত স্থানে উপযুক্ত মূল্যে কঁচামাল খরিদ চাই, লোক খাটাইবার ক্ষমতা চাই, যথাকালে বহুলোকের আহার্য সরবরাহ চাই, হিসাব রাখা, টাকা আদায়, আয়ব্যয় খতাইয়া লাভ-লোকসান নির্ণয় প্রভৃতি নানা বিষয়ে সূক্ষ্মদৃষ্টি চাই। এই অভিজ্ঞতা কোনও শিক্ষালয়ে পাওয়া যায় না।

 সর্বপ্রকার শিল্প এবং ব্যবসায়ের পথই এইরূপ অল্পাধিক দুর্গম। শিল্পদ্রব্য উৎপাদন করা যাহার ব্যবসায়, সে ঠিক কি প্রণালী অবলম্বন করে এবং কোন্ উপায়ে ব্যবসায়ের কঠোর প্রতিযোগিতা হইতে আত্মরক্ষা করে তাহা অপরকে জানিতে দেয় না। সুতরাং technical education পাইলেই ব্যবসায়বুদ্ধি জন্মিবে না এবং শিল্পের প্রতিষ্ঠা হইবে না। চাকরি মিলিতে পারে, কিন্তু তাহার ক্ষেত্র সংকীর্ণ, কারণ দেশে প্রতিষ্ঠিত শিল্পের সংখ্যা অল্প। শিক্ষা শেষ হইলেই অধিকাংশ যুবক স্বাধীন কারবার আরম্ভ করিতে পারিবে ইহা দুরাশা মাত্র।

 যাহা বলা হইল তাহার ব্যতিক্রমের উদাহরণ অনেক আছে। অনেক দৃঢ়সংকল্প উদ্যোগী ব্যক্তি কেবল পুঁথিগত বিজ্ঞান চর্চা করিয়া কিংবা বিজ্ঞানের কোনও চর্চা না করিয়া এবং অপরের সাহায্য না পাইয়াও শিল্পপ্রতিষ্ঠার সুযোগ লাভ করিয়াছেন। বিজ্ঞানচর্চা এবং কার্যকরী শিক্ষার বিস্তারের ফলে এই সুযোগ বর্ধিত হইবে তাহাতে সন্দেহ নাই। অর্থাৎ পূর্বে যদি এক লক্ষ শিক্ষিত ব্যক্তির মধ্যে একজন শিল্পপ্রতিষ্ঠায় কৃতকার্য হইয়া থাকেন, তবে এখন হয়তো দশজন হইবেন। নূতন শিক্ষাপদ্ধতি হইতে আমরা এইমাত্র আশা করিতে পারি যে কয়েকজনের নূতনপ্রকার চাকরি মিলিবে এবং কয়েকজন অনুকূল অবস্থায় পড়িলে স্বাধীন ব্যবসায়ের প্রতিষ্ঠা করিতে পারিবে। কিন্তু অধিকাংশের ভাগ্যে কোনও প্রকার সুবিধালাভ হইবে না।

 Technical educationকে নিরর্থক প্রতিপন্ন করা আমার উদ্দেশ্য নয়। কেবল ইহাই বলিতে চাই—যদি ছাত্রগণ অত্যধিক সংখ্যায় নির্বিচারে এই পথে জীবিকার সন্ধানে আসেন তবে তাঁহাদের অনেকেই বিফলমনোরথ হইবেন। কারণ, নূতন শিল্পের প্রতিষ্ঠা সহজসাধ্য নয়, এদেশে কারখানাও এত নাই যাহাতে যথেষ্ট চাকরি মিলিতে পারে। বিজ্ঞান সকলের রুচিকরও নয়। অতএব জীবিকালাভের অপেক্ষাকৃত সুগম পন্থা আর কিছু আছে কিনা দেখা উচিত।

 বাংলাদেশ পরদেশীতে ভরিয়া গিয়াছে। তাহাদের এক দল এদেশের কুলী মজুর ধোবা নাপিত কামার কুমার মাঝী মিস্ত্রীকে স্থানচ্যুত করিতেছে, আর এক দল দেশী বণিকের হাত হইতে ছোট বড় সকল ব্যবসায় কাড়িয়া লইতেছে এবং নূতন ব্যবসায়ের পত্তন করিতেছে। শিক্ষিত বাঙালী লোলুপ নেত্রে এই শেষোক্ত দলের কীর্তি দেখিতেছে কিন্তু তাহাদের পদ্ধতিতে দন্তস্ফুট করিতে পারিতেছে না। এইসকল পরদেশী ইংরেজী বিদ্যা জানে না, economics বোঝে না, ইহাদের হিসাবের প্রণালীও আধুনিক book-keeping হইতে অনেক নিকৃষ্ট, অথচ বাণিজ্যলক্ষ্মী ইহাদের ঘরেই বাসা লইয়াছেন। ইহারা বিজ্ঞানের খবর রাখে না, নূতন শিল্প প্রতিষ্ঠা করিতেও খুব ব্যস্ত নয়, কারণ ইহারা মনে করে পণ্য উৎপাদন অপেক্ষা পণ্য লইয়া কেনাবেচা করাই বেশী সহজ এবং তাহাতে লাভের নিশ্চয়তাও অধিক। ইহারা নির্বিচারে দেশী বিলাতী প্রয়োজনীয় অপ্রয়োজনীয় উপকারী অপকারী সকল পণ্যের উপরেই ব্যবসায়ের জাল ফেলিয়াছে। উৎপাদকের ভাণ্ডার হইতে ভোক্তার গৃহ পর্যন্ত বিস্তৃত ঋজুকুটিল নানা পথের প্রত্যেক ঘাটিতে দাঁড়াইয়া ইহারা পণ্য হইতে লাভ আদায় করিয়া লইতেছে।

 শিক্ষিত বাঙালী কতক ঈর্ষার বশে কত অজ্ঞতার জন্য এইসকল পরদেশীর কার্যপ্রণালী হেয় প্রতিপন্ন করিতে চেষ্টা করেন। ইহারা বর্বর অশিক্ষিত দুর্নীতিপরায়ণ, টাকার জন্য দেশের সর্বনাশ করিতেছে। ইহারা লোটাকম্বল সম্বল করিয়া এদেশে আসে; যা-তা খাইয়া যেখানে সেখানে বাস করিয়া অশেষ কষ্ট স্বীকার করিয়া কৃপণের তুল্য অর্থসঞ্চয় করে। ধনী হইলেও ইহারা মানসিক সম্পদে নিঃস্ব। ভদ্র বাঙালী অত হীনভাবে জীবিকানির্বাহ আরম্ভ করিতে পারে না, তাহার ভব্যতার একটা সীমা আছে যাহার কমে তাহার চলে না। অতএব দগ্ধোদরের জন্য সে খোট্টার শিষ্য হইবে না।

 অনেক বৎসর পূর্বে ইংরেজের মহিমায় মুগ্ধ হইয়া বাঙালী ভাবিয়াছিল—ইংরেজের চালচলন অনুকরণ না করিলে উন্নতির আশা নাই। সে ভ্রম এখন গিয়াছে, বাঙালী বুঝিয়াছে মোটা চালচলনের সঙ্গে বিদ্যা বুদ্ধি উদ্যমের কোনও বিরোধ নাই। এখন আবার অনেকে ভ্রমে পড়িয়া ভাবিতেছেন—খোট্টার অধিকৃত ব্যবসায়ে প্রতিষ্ঠালাভ করিতে হইলে জীবনযাত্রার প্রণালী অবনত করিতে হইবে এবং মানসিক উন্নতির আশা বিসর্জন দিতে হইবে।
 যাহারা বাঙালীর মুখের গ্রাস কাড়িয়া লইতেছে তাহাদের অনেক দোষ থাকিতে পারে, কিন্তু এমন মনে করার কোনও হেতু নাই যে ঐসকল দোষের জন্যই তাহারা প্রতিযোগে জয়ী হইয়াছে। নিরপেক্ষ বিচারে ইহাই প্রতিপন্ন হইবে যে বাঙালীর পরাভব তাহার নিজের ত্রুটির জন্যই হইয়াছে।

 এইসকল পরদেশী বণিকের শিক্ষা ও পরিবেষ্টন সযত্ন অনুসন্ধানের যোগ্য। ইহারা জন্মাবধি বণিগ্বৃ‌ত্তির আবহাওয়ায় লালিত হইয়াছে এবং আত্মীয়স্বজনের নিকটেই দীক্ষা লাভ করিয়াছে। বাঙালী কেরানী মার্চেণ্ট অফিসে গিয়া নির্লিপ্ত চিত্তে invoice voucher day-book ledger লিখিয়া দিনগত পাপক্ষয় করিয়া আসে, মনিবের সহিত তাহার কেবল বেতনের সম্পর্ক। সে নিজের নির্দিষ্ট কর্তব্য পালন করে মাত্র, মনিবের সমগ্র ব্যবসায় বুঝিবার তাহার সুযোগও নাই স্বার্থও নাই। ভারতীয় বণিকের অনেক কাজ গৃহেই নিষ্পন্ন হয়। তাহার সহায়তা করিয়া বণিকপুত্র অল্প বয়সেই পৈতৃক ব্যবসায়ের রস গ্রহণ করিতে শেখে, এবং কেনা বেচা আদায় উসুল জাবেদা রোকড় খতিয়ান হাতচিঠা হুণ্ডি মোকাম বাজারের গূঢ় তত্ত্বে অভিজ্ঞতা লাভ করে।

 এই business atmosphere বাঙালী ভদ্রের গৃহে দুর্লভ। উকিল ব্যারিস্টার ডাক্তার প্রোফেসার কেরানীর সন্তান ইহাতে বঞ্চিত। বণিগ্বৃ‌ত্তির বীজ বাঙালী ভদ্রের গৃহে নূতন করিয়া বপন করিতে হইবে। অনেক অঙ্কুর নষ্ট হইবে, কিন্তু অভিভাবকের উৎসাহ ও তীক্ষ্ণ দৃষ্টি থাকিলে ফলবান বিটপীও অচিরে দেখা দিবে।

 দালাল আড়তদার ব্যাপারী পাইকার দোকানী প্রভৃতি বহু মধ্যবর্তীর হাত ঘুরিয়া পণ্যদ্রব্য ভোক্তার ঘরে আসে। পণ্যের এই পরিক্রমপথে অগণিত ব্যক্তির অন্নসংস্থান হয়। এই মহাজন-অনুসৃত পথই জীবিকার রাজপথ। বাঙালী ভদ্রলোককে এই পথের বার্তা সংগ্রহ করিয়া যাত্রা আরম্ভ করিতে হইবে।

 আরম্ভ দুরূহ সন্দেহ নাই। অভিজ্ঞ অভিভাবকের উপদেশ পাইলে নূতন ব্রতীর পন্থা সুগম হইবে। কিন্তু যেখানে এ সুযোগ নাই সেখানেও শুভাকাঙ্ক্ষী অভিভাবক অনেক সাহায্য করিতে পারেন। পুত্রের শিক্ষার জন্য খরচ করিতে বাঙালী কুণ্ঠিত নয়। সাধারণ শিক্ষার জন্য যে অর্থ ও উদ্যম ব্যয় হয় তাহারই কিয়দংশে ব্যবসায় শিক্ষা আরম্ভ হইতে পারে। অনেক উদার অভিভাবক এই উদ্দেশ্যে অর্থব্যয় করিয়া বাঞ্ছিত ফল পান নাই, ভবিষ্যতেও অনেকে পাইবেন না। কিন্তু সাধারণ শিক্ষার ব্যয়ও সকল সময়ে সার্থক হয় না।

 সকল যুবকই অবশ্য ব্যবসায়ী হইবে না। কিন্তু যে হইতে চাহিবে তাহার সংকল্প স্থির করিয়া পঠদ্দশাতেই বণিগ্বৃ‌ত্তির সহিত পরিচয় আরম্ভ করা ভাল। এজন্য অধিক আড়ম্বর অনাবশ্যক। আগে অর্থবিদ্যা শিখিব তাহার পর ব্যবসায় আরম্ভ করিব এরূপ মনে করিলে শিক্ষা অগ্রসর হইবে না। আগে ভাষা, তাহার পর ব্যাকরণ—ইহাই স্বাভাবিক রীতি। দোকান হাট বাজার আড়ত ব্যবসায়শিক্ষার সুগম বিদ্যাপীঠ। এইসকল স্থানে নিত্য যাতায়াত করিলে শিক্ষার্থী অনেক নূতন তথ্য শিখিবে; আমদানি, রপ্তানি, আড়তের বিক্রয়প্রথা, পণ্যের ক্রয়মূল্য ও বিক্রয়মূল্য, দালালের করণীয়, হিসাবের প্রণালী, পাওনা আদায়ের উপায়—ইত্যাদি বহু জটিল বিষয় সরল হইয়া যাইবে। অভিভাবক যদি শিক্ষার্থীর নিকট এইসকল সংবাদ গ্রহণ করেন তবে তিনিও উপকৃত হইবেন এবং শিক্ষার্থীকেও সাহায্য করিতে পারিবেন। সাধারণ শিক্ষা—অর্থাৎ স্কুল কলেজের শিক্ষা শেষ হইলে শিক্ষার্থী দিনকতক কোনও ব্যবসায়ীর কর্মচারী হইয়া হাতেকলমে কাজ শিখিতে পারে। এদেশে ব্যবসায় শিখিবার জন্য premium দেওয়ার প্রথা নাই। কিন্তু যদি দিতেও হয় তাহা অপব্যয় হইবে না। যদি পছন্দমত কোনও নির্দিষ্ট ব্যবসায় শিখিবার সুযোগ না থাকে, তথাপি যেকোনও সমজাতীয় ব্যবসায়ে শিক্ষানবিশি করায় লাভ আছে, কারণ সকল ব্যবসায়েরই কতকগুলি সাধারণ মূলসূত্র আছে। খুব বড় ব্যবসায়ীর অফিসে সুবিধা হইবে না। সেখানে নানা বিভাগের মধ্যে দিগ্ভ্রম হইবে, সমগ্র ব্যাপারে শৃঙ্খলিত ধারণা সহজে জন্মিবে না।

 শিক্ষানবিশি শেষ হইলে সামান্য মূলধন লইয়া কারবার আরম্ভ হইতে পারে। সুবিধা হইলে অভিজ্ঞ অংশীদারের সহিত বখরার বন্দোবস্ত হইতে পারে। অবশ্য প্রথম হইতেই জীবিকানির্বাহের উপযোগী লাভ হইবে না। কলেজে উচ্চশিক্ষা বা কার্যকরী বিদ্যা লাভ করিতে যে সময় লাগে, ব্যবসায় দাঁড় করাইতে তাহা অপেক্ষা কম সময় লাগিবে এরূপ আশা করা অসংগত। প্রথমে যে ছোট কারবার আরম্ভ হইবে তাহা হাতেখড়ি বলিয়াই গণ্য করা উচিত। তাহার পর অভিজ্ঞতা ও আত্মনির্ভরতা জন্মিলে কারবার সহজেই বৃদ্ধি পাইবে।

 এইপ্রকার শিক্ষার জন্য এবং সামান্য মূলধনে ব্যবসায় আরম্ভ করিতে হইলে যে কষ্টসহিষ্ণুতা আবশ্যক, শৌখিন বাঙালীর ধাতে তাহা সহিবে কি? নিশ্চয় সহিবে। বাঙালী যুবক অশেষ পরিশ্রম করিয়া রাত জাগিয়া মড়া ঘাঁটিয়া ডাক্তারি শেখে। উত্তপ্ত লোহার ঘরে জ্বলন্ত হাপরের কাছে লোহা পিটিয়া এঞ্জিনিয়ারিং শেখে। প্রখর রৌদ্রে মাঠে মাঠে ঘুরিয়া ক্ষুধা তৃষ্ণা দমন করিয়া সার্ভেয়িং শেখে। আইনপরীক্ষা পাস করিয়া বহু দিন মুরব্বী উকিলের বাড়িতে ধরনা দেয়। ভোরে অর্ধসিদ্ধ ভাত খাইয়া ডেলি-প্যাসেঞ্জার হইয়া সমস্ত দিন অফিসে কলম পিশিয়া বাড়ি ফেরে। এসকল কাজকে সে শ্লাঘ্য বা ভদ্রোচিত মনে করে সেজন্য কষ্ট সহিতে পারে। যেদিন সে বুঝিবে যে বণিগ্বৃ‌ত্তি হীন নয়, ইহাতে অতি উচ্চ আশা পূরণেরও সম্ভাবনা আছে, সেদিন সে এই বৃত্তির জন্য কোনও কষ্ট গ্রাহ্য করিবে না।
 আশার কথা—পূর্বের তুলনায় বাঙালী এখন ব্যবসায়ে অধিকতর মন দিতেছে। আজকাল অনেক দেশহিতৈষী কুটীরশিল্প উন্নত কৃষি এবং কার্যকরী শিক্ষা লইয়া আলোচনা করিতেছেন। তাঁহারা যদি বণিগ্বৃ‌ত্তির উপযোগিতার প্রতি মন দেন তবে অনেক যুবক উৎসাহিত হইয়া ব্যবসায়ে প্রবৃত্ত হইবে। বণিগ্বৃ‌ত্তি সহজেই সংক্রামিত হয়, ইহার ক্ষেত্রও বিশাল। দোকানদার না থাকিলে সমাজ চলে না। জনকতক অগ্রগামীর উদ্যম সফল হইলে তাহাদের দৃষ্টান্তে পরবর্তী অনেকেই সিদ্ধিলাভ করিবে। বাঙালীর বুদ্ধির অভাব নাই, নিপুণতা ও সৌষ্ঠবজ্ঞানও যথেষ্ট আছে। এইসকল সদ্গুণ ব্যবসায়ে লাগাইলে প্রতিযোগিতায় সে নিশ্চয় জয়ী হইবে।

 বণিগ্বৃ‌ত্তির প্রসারে বাঙালীর মানসিক অবনতি হইবে না। মসীজীবী বাঙালীর যে সদ্গুণ আছে তাহা কলমপেশার ফল নয়। পরদেশী বণিকের যে দোষ আছে তাহাও তাহার বৃত্তিজনিত নয়। অনেক বাঙালী বিদেশী বণিকের গোলামি করিয়াও সাহিত্য ইতিহাস দর্শনের চর্চা করিয়া থাকেন। নিজের দাঁড়িপাল্লা নিজের হাতে ধরিলেই বাঙালীর ভাবের উৎস শুখাইবে না।

১৩৩২