বিষয়বস্তুতে চলুন

লিপিকা/কর্ত্তার ভূত

উইকিসংকলন থেকে

কর্ত্তার ভূত

বুড়ো কর্ত্তার মরণকালে দেশসুদ্ধ সবাই বলে উঠ্‌ল, “তুমি গেলে আমাদের কি দশা হবে?”

শুনে তারও মনে দুঃখ হল। ভাব্‌লে, “আমি গেলে এদের ঠাণ্ডা রাখ্‌বে কে?”

তা’ বলে মরণ ত এড়াবার জো নেই। তবু দেবতা দয়া করে বললেন, “ভাবনা কি? লোকটা ভূত হয়েই এদের ঘাড়ে চেপে থাক্‌ না। মানুষের মৃত্যু আছে, ভূতের ত মৃত্যু নেই।”

দেশের লোক ভারি নিশ্চিন্ত হল।

কেননা, ভবিষ্যৎকে মান্‌লেই তার জন্যে যত ভাবনা, ভূতকে মান্‌লে কোনো ভাবনাই নেই; সকল ভাবনা ভূতের মাথায় চাপে। অথচ তার মাথা নেই, সুতরাং কারো জন্যে মাথাব্যথাও নেই।

তবু স্বভাব-দোষে যারা নিজের ভাবনা নিজে ভাব্‌তে যায় তারা খায় ভূতের কানমলা। সেই কানমলা না যায় ছাড়ানো, তার থেকে না যায় পালানো, তার বিরুদ্ধে না চলে নালিশ, তার সম্বন্ধে না আছে বিচার।

দেশসুদ্ধ লোক ভূতগ্রস্ত হয়ে চোখ বুজে চলে। দেশের তত্ত্বজ্ঞানীরা বলেন, “এই চোখ বুজে চলাই হচ্চে জগতের সবচেয়ে আদিম চলা। এ’কেই বলে অদৃষ্টের চালে চলা। সৃষ্টির প্রথম চক্ষুহীন কীটাণুরা এই চলা চল্‌ত; ঘাসের মধ্যে গাছের মধ্যে আজও এই চলার আভাস প্রচলিত।”

শুনে ভূতগ্রস্ত দেশ আপন আদিম আভিজাত্য অনুভব করে। তাতে অত্যন্ত আনন্দ পায়।

ভূতের নায়েব ভূতুড়ে জেলখানার দারোগা। সেই জেলখানার দেয়াল চোখে দেখা যায় না। এই জন্যে ভেবে পাওয়া যায় না সেটাকে ফুটো করে কি উপায়ে বেরিয়ে যাওয়া সম্ভব।

এই জেলখানায় যে-ঘানি নিরন্তর ঘোরাতে হয় তার থেকে একছটাক তেল বেরোয় না যা হাটে বিকোতে পারে,—বেরোবার মধ্যে বেরিয়ে যায় মানুষের তেজ। সেই তেজ বেরিয়ে গেলে মানুষ ঠাণ্ডা হয়ে যায়। তা’তে করে’ ভূতের রাজত্বে আর কিচ্ছুই না থাক্‌,—অন্ন হোক্‌, স্বাস্থ্য হোক্‌,—শান্তি থাকে।

কত যে শান্তি তার একটা দৃষ্টান্ত এই যে, অন্য সব দেশে ভূতের বাড়াবাড়ি হলেই মানুষ অস্থির হয়ে ওঝার খোঁজ করে। এখানে সে চিন্তাই নেই। কেননা ওঝাকেই আগেভাগে ভূতে পেয়ে বসেচে।

এই ভাবেই দিন চল্‌ত, ভূতশাসনতন্ত্র নিয়ে কারো মনে দ্বিধা জাগ্‌ত না; চিরকালই গর্ব্ব কর্‌তে পার্‌ত যে এদের ভবিষ্যৎটা পোষা ভ্যাড়ার মত ভূতের খোঁটায় বাঁধা, সে ভবিষ্যৎ ভ্যা-ও করে না, ম্যা-ও করে না, চুপ করে পড়ে থাকে মাটিতে; যেন একেবারে চিরকালের মত মাটি!

কেবল অতি সামান্য একটা কারণে একটু মুস্কিল বাধ্‌ল। সেটা হচ্চে এই যে, পৃথিবীর অন্য দেশগুলোকে ভূতে পায় নি। তাই অন্য সব দেশে যত ঘানি ঘোরে তার থেকে তেল বেরোয় তাদের ভবিষ্যতের রথচক্রটাকে সচল করে রাখ্‌বার জন্যে, বুকের রক্ত পিষে ভূতের খর্পরে ঢেলে দেবার জন্যে নয়। কাজেই মানুষ সেখানে একেবারে জুড়িয়ে যায় নি। তারা ভয়ঙ্কর সজাগ আছে।

এদিকে দিব্যি ঠাণ্ডায় ভূতের রাজ্য জুড়ে “খোকা ঘুমোলো, পাড়া জুড়োলো।”

সেটা খোকার পক্ষে আরামের, খোকার অভিভাবকের পক্ষেও; আর পাড়ার কথা ত বলাই আছে।

কিন্তু “বর্গি এল দেশে।”

নইলে ছন্দ মেলে না, ইতিহাসের পদটা খোঁড়া হয়েই থাকে। দেশে যত শিরোমণি চূড়ামণি আছে সবাইকে জিজ্ঞাসা করা গেল “এমন হল কেন?”

তারা একবাক্যে শিখা নেড়ে বললে, “এটা ভূতের দোষ নয়, ভূতুড়ে দেশের দোষ নয়, একমাত্র বর্গিরই দোষ। বর্গি আসে কেন?”

শুনে সকলেই বল্‌লে, “তা ত বটেই!” অত্যন্ত সান্ত্বনা বোধ কর্‌লে।

দোষ যারই থাক্, খিড়্‌কির আনাচে-কানাচে ঘোরে ভূতের পেয়াদা, আর সদরের রাস্তায়-ঘাটে ঘোরে অভূতের পেয়াদা; ঘরে গেরস্তর টেঁকা দায়, ঘর থেকে বেরোবারও পথ নেই। একদিক থেকে এ হাঁকে, “খাজমা দাও” আরেক দিক থেকে ও হাঁকে “খাজনা দাও।”

এখন কথাটা দাঁড়িয়েছে, “খাজনা দেব কিসে?”

এতকাল উত্তর দক্ষিণ পূব পশ্চিম থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে নানা জাতের বুলবুলি এসে বেবাক ধান খেয়ে গেল, কারো হুঁস ছিল না। জগতে যারা হুঁশিয়ার এরা তাদের কাছে ঘেঁষতে চায় না, পাছে প্রায়শ্চিত্ত কর্‌তে হয়। কিন্তু তারা অকস্মাৎ এদের অত্যন্ত কাছে ঘেঁষে, এবং প্রায়শ্চিত্তও করে না। শিরোমণি চূড়ামণির দল পুঁথি খুলে বলেন, “বেহুঁস্‌ যারা তারাই পবিত্র, হুঁসিয়ার যারা তারাই অশুচি, অতএব হুঁসিয়ারদের প্রতি উদাসীন থেকো, প্রবুদ্ধমিব সুপ্তঃ।”

শুনে সকলের অত্যন্ত আনন্দ হয়।

কিন্তু তৎসত্ত্বেও এ প্রশ্নকে ঠেকানো যায় না; “খাজ্‌না দেব কিসে?”

শ্মশান থেকে মশান থেকে ঝোড়ো হাওয়ায় হাহা করে’ তার উত্তর আসে, “আব্রু দিয়ে, ইজ্জৎ দিয়ে, ইমান্‌ দিয়ে, বুকের রক্ত দিয়ে।”

প্রশ্নমাত্রেরই দোষ এই যে, যখন আসে এক আসে না। তাই আরো একটা প্রশ্ন উঠে পড়েছে; “ভূতের শাসনটাই কি অনন্তকাল চল্‌বে?”

শুনে ঘুম-পাড়ানী মাসি পিসি আর মাস্‌তুত পিস্‌তুতোর দল কানে হাত দিয়ে বলে, “কি সর্ব্বনাশ! এমন প্রশ্ন ত বাপের জন্মে শুনি নি। তা হলে সনাতন ঘুমের কি হবে, সেই আদিমতম, সকল জাগরণের চেয়ে প্রাচীনতম ঘুমের?”

প্রশ্নকারী বলে, “সে ত বুঝ্‌লুম, কিন্তু আধুনিকতম বুল্‌বুলির ঝাঁক, আর উপস্থিততম বর্গির দল, এদের কি করা যায়?”

মাসি পিসি বলে, “বুলবুলির ঝাঁককে কৃষ্ণনাম শোনাব, আর বর্গির দলকেও।”

অর্ব্বাচীনেরা উদ্ধত হয়ে বলে ওঠে, “যেমন করে পারি ভূত ছাড়াব।”

ভূতের নায়েব চোখ পাকিয়ে বলে, “চুপ! এখনো ঘানি অচল হয় নি।”

শুনে দেশের খোকা নিস্তব্ধ হয়, তারপরে পাশ ফিরে শোয়।

মোদ্দা কথাটা হচ্চে বুড়ো কর্ত্তা বেঁচেও নেই, মরেও নেই, ভূত হয়ে আছে। দেশটাকে সে নাড়েও না অথচ ছাড়েও না।

দেশের মধ্যে দুটো একটা মানুষ—যারা দিনের বেলা নায়েবের ভয়ে কথা কয় না,—তারা গভীর রাত্রে হাত জোড় করে বলে “কর্ত্তা, এখনো কি ছাড়্‌বার সময় হয় নি?”

কর্ত্তা বলেন, “ওরে অবোধ, আমার ধরাও নেই ছাড়াও নেই, তোরা ছাড়্‌লেই আমার ছাড়া।”

তারা বলে, “ভয় করে যে কর্ত্তা!”

কর্ত্তা বলেন, “সেইখানেই ত ভূত।”