লিপিকা/গলি
গলি
আমাদের এই শান-বাঁধানো গলি, বারে বারে ডাইনে বাঁয়ে এঁকে বেঁকে একদিন কি যেন খুঁজ্তে বেরিয়েছিল। কিন্তু সে যে দিকেই যায় ঠেকে যায়। এ দিকে বাড়ি, ও দিকে বাড়ি, সাম্নে বাড়ি।
উপরের দিকে যেটুকু নজর চলে তাতে সে একখানি আকাশের রেখা দেখ্তে পায়—ঠিক তার নিজেরই মতো সরু, তার নিজেরই মতো বাঁকা।
সেই ছাঁটা আকাশটাকে জিজ্ঞাসা করে, “বলো তো দিদি, তুমি কোন্ নীল সহরের গলি?”
দুপুরবেলায় কেবল একটু খনের জন্যে সে সূর্য্যকে দেখে আর মনে মনে বলে, “কিচ্ছুই বোঝা গেল না!”
বর্ষামেঘের ছায়া দুই সার বাড়ির মধ্যে ঘন হয়ে ওঠে, কে যেন গলির খাতা থেকে তার আলোটাকে পেন্সিলের আঁচড় দিয়ে কেটে দিয়েচে। বৃষ্টির ধারা শানের উপর দিয়ে গড়িয়ে চলে, বর্ষা ডমরু বাজিয়ে যেন সাপ খেলাতে থাকে। পিছল হয়, পথিকদের ছাতায় ছাতায় বেধে যায়, ছাদের উপর থেকে ছাতার উপরে হঠাৎ নালার জল লাফিয়ে পড়ে’ চম্কিয়ে দিতে থাকে।
গলিটা অভিভূত হয়ে বলে, “ছিল খট্খটে শুক্নো, কোনো বালাই ছিল না। কিন্তু কেন অকারণে এই ধারাবাহী উৎপাত?”
ফাল্গুনে দক্ষিণের হাওয়াকে গলির মধ্যে লক্ষ্ণীছাড়ার মতো দেখ্তে হয়; ধুলো আর ছেঁড়া কাগজগুলো এলোমেলো উড়্তে থাকে। গলি হতবুদ্ধি হয়ে বলে, “এ কোন্ পাগ্লা দেবতার মাৎলামি!’”
তার ধারে ধারে প্রতিদিন যে-সব আবর্জনা এসে জমে—মাছের আঁশ, চুলোর ছাই, তরকারির খোসা, মরা ইঁদুর—সে জানে এই সব হচ্চে বাস্তব। কোনোদিন ভুলেও ভাবে না, “এ সমস্ত কেন?”
অথচ, শরতের রোদ্দুর যখন উপরের বারান্দায় আড় হয়ে পড়ে, যখন পূজোর নহবত ভৈরবীতে বাজে, তখন ক্ষণকালের জন্যে তার মনে হয়, “এই শান-বাঁধা লাইনের বাইরে মস্ত একটা কিছু আছে বা!”
এ দিকে বেলা বেড়ে যায়; ব্যস্ত গৃহিণীর আঁচলটার মত বাড়িগুলোর কাঁধের উপর থেকে রোদ্দুরখানা গলির ধারে খসে পড়ে; ঘড়িতে ন’টা বাজে; ঝি কোমরে ঝুড়ি করে বাজার নিয়ে আসে; রান্নার গন্ধে আর ধোঁয়ায় গলি ভরে’ যায়; যারা আপিসে যায় তারা ব্যস্ত হতে থাকে।
গলি তখন আবার ভাবে, “এই শান-বাঁধা লাইনের মধ্যেই সব সত্য। আর, যাকে মনে ভাব্চি মস্ত একটা কিছু, সে মস্ত একটা স্বপ্ন।”