বিষয়বস্তুতে চলুন

লিপিকা/বাণী

উইকিসংকলন থেকে

বাণী

 ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি হয়ে আকাশের মেঘ নামে,—মাটির কাছে ধরা দেবে বলে’। তেমনি কোথা থেকে মেয়েরা আসে পৃথিবীতে বাঁধা পড়তে।

 তাদের জন্য অল্প জায়গার জগত্‍‌, অল্প মানুষের। ঐটুকুর মধ্যে আপনার সবটাকে ধরানো চাই—আপনার সব কথা, সব ব্যথা, সব ভাবনা। তাই তাদের মাথায় কাপড়, হাতে কাঁকন, আঙিনায় বেড়া। মেয়েরা হল সীমাস্বর্গের ইন্দ্রাণী।

 কিন্তু, কোন্‌ দেবতার কৌতুকহাস্যের মত অপরিমিত চঞ্চলতা নিয়ে আমাদের পাড়ায় ঐ ছোট মেয়েটির জন্ম? মা তাকে রেগে বলে “দস্যি,” বাপ তাকে হেসে বলে “পাগলী”।

 সে পলাতকা ঝরণার জল, শাসনের পাথর ডিঙিয়ে চলে। তার মনটি যেন বেণুবনের উপরডালের পাতা, কেবলি ঝির্ ঝির্ করে কাঁপচে।

 আজ দেখি সেই দুরন্ত মেয়েটি বারান্দায় রেলিঙে ভর দিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে—বাদলশেষের ইন্দ্রধনুটি বল্লেই হয়। তার বড় বড় দুটি কালো চোখ আজ অচঞ্চল, তমালের ডালে বৃষ্টির দিনে ডানা-ভেজা পাখীর মত।

 ওকে এমন স্তব্ধ কখনো দেখিনি। মনে হল, নদী যেন চল্‌তে চল্‌তে একজায়গায় এসে থম্‌কে সরোবর হয়েচে।

 কিছুদিন আগে রৌদ্রের শাসন ছিল প্রখর; দিগন্তের মুখ বিবর্ণ; গাছের পাতাগুলো শুক্‌নো, হল্‌দে, হতাশ্বাস।

 এমন সময় হঠাত্‍‌ কাল আলুথালু পাগ্‌লা মেঘ আকাশের কোণে কোণে তাঁবু ফেললে। সূর্য্যাস্তের একটা রক্ত-রশ্মি খাপের ভিতর থেকে তলোয়ারের মতো বেরিয়ে এল।

 অর্দ্ধেক রাত্রে দেখি দরজাগুলো খড়্খড়্ শব্দে কাঁপ্‌চে। সমস্ত সহরের ঘুমটাকে ঝড়ের হাওয়া ঝুঁটি ধরে ঝাঁকিয়ে দিলে।

 উঠে দেখি, গলির আলোটা ঘন বৃষ্টির মধ্যে মাতালের ঘোলা চোখের মতো দেখতে। আর গির্জ্জের ঘড়ির শব্দ এল যেন বৃষ্টির শব্দের চাদর মুড়ি দিয়ে।

 সকাল বেলায় জলের ধারা আরো ঘনিয়ে এল—রৌদ্র আর উঠ্‌ল না।

 এই বাদলায় আমাদের পাড়ার মেয়েটি বারান্দায় রেলিঙ ধরে চুপ করে দাঁড়িয়ে।

 তার বোন এসে তাকে বললে, ‘মা ডাক্‌চে’। সে কেবল সবেগে মাথা নাড়ল, তার বেণী দুলে উঠ্‌ল; কাগজের নৌকো নিয়ে তার ভাই তার হাত ধরে টান্‌লে। সে হাত ছিনিয়ে নিলে। তবু তার ভাই খেলার জন্যে টানাটানি করতে লাগ্‌ল। তাকে এক থাপড় বসিয়ে দিলে।

 বৃষ্টি পড়ছে। অন্ধকার আরো ঘন হয়ে এল। মেয়েটি স্থির দাঁড়িয়ে।

 আদি যুগে সৃষ্টির মুখে প্রথম কথা জেগেছিল জলের ভাষায়, হাওয়ার কণ্ঠে। লক্ষ কোটি বছর পার হয়ে সেই স্মরণ বিস্মরণের অতীত কথা আজ বাদ্‌লার কলস্বরে ঐ মেয়েটিকে এসে ডাক দিলে। ও তাই সকল বেড়ার বাইরে চলে গিয়ে হারিয়ে গেল।

 কত বড় কাল, কত বড় জগত্‍‌, পৃথিবীতে কত যুগের কত জীবলীলা। সেই সুদূর সেই বিরাট, আজ এই দুরন্ত মেয়েটির মুখের দিকে তাকাল, মেঘের ছায়ায়, বৃষ্টির কলশব্দে।

 ও তাই বড় বড় চোখ মেলে নিস্তব্ধ দাঁড়িয়ে রইল,—যেন অনন্তকালেরই প্রতিমা।