বিষয়বস্তুতে চলুন

লেখকের কথা/বক্সা ক্যাম্পে শিল্পী-সাহিত্যিক

উইকিসংকলন থেকে

“ব ক্সা ক্যা ম্পে শি ল্পী - সা হি ত্যি ক”


 আমি বিশ্বাস করি, বিনা বিচারে মানুষকে আটক রাখার আইনটা এদেশের মানুষকে পরাধীনতার গ্লানি সব চেয়ে বেশি অনুভব করায়। একপেশে স্বেচ্ছাচারিতার, শাসক ও শাসিতের মধ্যে অসৎ সম্পর্কের এমন সুস্পষ্ট নগ্ন অভিব্যক্তি আর আছে কিনা সন্দেহ। গণতন্ত্র এবং ব্যক্তিস্বাধীনতা যে সম্পূর্ণ বাতিল করা হয়েছে তার তর্কাতীত প্রমাণ হলো প্রকাশ্য বিচার ছাড়াই মানুষকে বন্দী করার আইন।

 অনেকে এই আইনটির স্বরূপ তুলে ধরতে রাজবন্দীর সংখ্যা তুলে ধরেন। আমার মতে, বন্দীর সংখ্যাটা আন্দোলনের ব্যাপ্তির স্বরূপ নির্দেশ করে: বন্দীর সংখ্যা লক্ষ হোক বা একজন হোক বিনাবিচারে আটক রাখার আইন চালু থাকার আসল তাৎপর্যের এতটুকু এদিকওদিক তাতে হয় না।

 মনে আছে, ছাত্রাবস্থায় ও সাহিত্যিক জীবনের প্রথমদিকে ইংরেজের নিরাপত্তা আইনটা মনে করতাম আমার দেশের চরম অপমান, এ দেশের লোকের বিচারবুদ্ধি, মানবতা ও ন্যায়বোধ সম্পর্কে সীমাহীন অবজ্ঞার ঘোষণা। মনে হতো, আমরা আইন ও শৃঙ্খলা মানি, গণ-আন্দোলনের পথে ছাড়া অন্যায় আইন পর্যন্ত ভাঙি না, প্রকাশ্য বিচার মানি, তবু বিনা বিচারে আটক রাখার আইন দরকার— এ মিথ্যা নিন্দা আর অপমান কেন? এ প্রশ্নের আসল মানে ক্রমে ক্রমে স্পষ্ট হলো। ক্রমে বুঝতে পারলাম, বিনা বিচারের আইনটা, দেশবাসীর আইন ও শৃঙ্খলার প্রতি স্বভাবনিষ্ঠ, ন্যায়বোধ, যুক্তিবোধ, নীতিবোধ ইত্যাদি সম্পর্কে শাসকগোষ্ঠির অবজ্ঞার নিদর্শন নয়, সভয় শ্রদ্ধারই প্রমাণ! জনসাধারণের ন্যায়বোধ, নীতিবোধ, বিচারবুদ্ধিতে ভেজাল থাকে না, গোষ্ঠিস্বার্থ ঠিক সেই জন্যেই প্রকাশ্য বিচার এড়িয়ে চলতে চায়। ইচ্ছা বা সংকল্প থাকে মানুষের মনের গহনে। ধ্বংসাত্মক কাজের ইচ্ছা বা সংকল্প আছে—শুধু এইটুকু ঘোষণা করে একজন মানুষের স্বাধীনতা হরণ করা চলে কিন্তু গহন মনের নিছক ইচ্ছা বা সংকল্পকে তো প্রকাশ্য আদালতে প্রমাণ করা যায় না। কিছু বাস্তব প্রমাণ দরকার হয়।

 যে অজুহাতেই হোক, একটা অন্যায়কে পোষণ করলে তা থেকে যে শাখা প্রশাখা গজায়, তার নিদর্শন পাই বহু নিরাপত্তা-বন্দীকে বক্সা ক্যাম্পে প্রেরণ করার মধ্যে। সরাসরি ইংরাজ আমলের সেই বক্সা ক্যাম্প, যার স্মৃতি আজও আমাদের মনে কাঁটার মতো বেঁধে, ক্ষোভ জাগায়। দূরে সরিয়ে নিয়ে গেলে নিরাপত্তা বন্দীদের সম্পর্কে দেশবাসীর উদাসীনতা আসবে, এই হীন মনোবৃত্তি ও আজগুবি ধারণা থেকে আবার সেই বক্সা ক্যাম্পকে ব্যবহার করা হবে, ইংরেজের তৈরি সেই বক্সা ক্যাম্পটাই আবার আমাদের জাতীয় আত্মসম্মান বোধকে আঘাত করার সুযোগ পাবে, এটা সত্যই অবিশ্বাস্য ছিল।

সুভাষ মুখোপাধ্যায়, ননী ভৌমিক, চিন্মোহন সেহানবীশ, পারভেজ শহিদী, সুনীল বসু, দ্বিজেন্দ্র নন্দী প্রমুখ লেখক, কবি, শিল্পী ও সংস্কৃতি-কর্মীদেরও বক্সায় পাঠানো হয়েছে। প্রগতি লেখক ও শিল্পী সংঘে, এবং বহু সাহিত্য-সভায়, শিল্প-সাহিত্যের আদর্শ বিচারের আলোচনা বৈঠক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মারফতে এঁদের সঙ্গে আমার পরিচয়। আমি সাহিত্যিক মানুষ, একটু তাড়াতাড়ি মানুষের ভেতরটা খানিক গভীরভাবে জানবার ক্ষমতা দাবি করলে কি অহঙ্কার প্রকাশ করা হবে? শিল্প-সাহিত্যে নতুন প্রাণের সঞ্চার করা, মানুষের সেরা সম্পদ সংস্কৃতিকে ক্ষয় ও অপঘাতের বিপদ থেকে বাঁচিয়ে, নূতনতর মহত্তর বিকাশের পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চিন্তা ও কল্পনাই এঁদের মনপ্রাণ জুড়ে ছিল। বাংলার শিল্প-সাহিত্যে নতুন সৃষ্টি দিয়ে এঁরা প্রতিভার প্রমাণ দিয়েছেন, আলোচনায় সমালোচনায় অংশ নিয়ে প্রমাণ দিয়েছেন গভীর ও তীক্ষ্ণ চিন্তাশক্তির এবং নিয়মিত অক্লান্ত পড়াশোনার, সাংস্কৃতিক কাজে হাতে-নাতে খেটে পরিচয় দিয়েছেন কর্মশক্তির। সত্য কথা বলি, এঁদের অক্লান্ত কর্মপ্রেরণা ও বই পড়ার আগ্রহ ও বহর দেখে রীতিমতো ঈর্ষা বোধ করেছি।

 শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি চর্চা একাস্তভাবেই প্রকাশ্য ব্যাপার। গোপন ষড়যন্ত্রের এতটুকু স্থান নেই। ছবি আঁকি, গল্প-কবিতা-প্রবন্ধ লিখি, গান গাই, অভিনয় করি, বক্তৃতা দিই—গোপনে করা দূরে থাক, পাঠক শ্রোতা দর্শক পর্যন্ত বেছে নেবার উপায় নেই! সোজাসুজি খোলাখুলি আমার দেশের সকল মতের সকল রুচির সকল মানুষের সামনে তুলে ধরে দিতে হবে আমার সকল রকম সাংস্কৃতিক প্রচেষ্টা। দেশের মানুষই তাই শিল্প সাহিত্য সাংস্কৃতিক প্রচেষ্টার একমাত্র বাহক এবং বিচারক: দেশবাসীর গ্রহণ ও বর্জনই এক্ষেত্রে একমাত্র গ্রহণযোগ্য আইন। সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় আইনের প্রয়োগ তাই সভ্যজগতে এত বড় অনিয়ম বলে গণ্য হয়।

 বাংলার একজন সাহিত্যিক হিসাবে আমি এই প্রশ্ন ও প্রতিকারের দাবি তুলছি: সাধারণ আইনে প্রকাশ্য আদালতের বিচার যখন দেশের মানুষ আমরা মেনে নিতে প্রস্তুত, তখন বিনা বিচারে আটক রাখার আইন কেন? বিদেশী শাসকের নামে রাস্তার নাম পর্যন্ত যখন অপমানজনক বিবেচিত হচ্ছে, তখন জাতীয় অপমানের প্রতীক ইংরেজের তৈরি বক্সা ক্যাম্পে বন্দীদের আটক রাখার ব্যবস্থাই বা কেন? শিল্পী-সাহিত্যিক-সংস্কৃতিবিদেরা যখন সম্পুর্ণরূপে গণমত ও গণবিচারের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, গোপন কার্যকলাপের কিছুমাত্র সুযোগ সুবিধা যখন তাঁদের বিশেষ পেশায় নেই, এবং শিল্প সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রাণটাই যখন নির্ভর করে শিল্পী-সাহিত্যিক-সংস্কৃতিবিদের পরিপূর্ণ স্বাধীনতার উপর— তখন বাংলার প্রিয়তম শিল্পী-সাহিত্যিক-সংস্কৃতিকর্মীরা বক্সা ক্যাম্পে আটক কেন?