লেফ্‌টেন্যাণ্ট সুরেশ বিশ্বাস/মাদ্রাজ যাত্রা

উইকিসংকলন থেকে

অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ।

মান্দ্রাজ যাত্রা।

 রেঙ্গুন হইতে সুরেশ কলিকাতায় ফিরিলেন না। রেঙ্গুনে মান্দ্রাজীর সংখ্যাই অধিক; এমন কি রেঙ্গুনের রাজপথে মগ অপেক্ষা মান্দ্রাজী বারবণিতা অধিক দেখিতে পাওয়া যায়। তিনি রেঙ্গুনে থাকা কালীন অনেক নারীর সহিত পরিচিত হইয়াছিলেন, এই সকল কারণে উহার একবার মান্দ্রাজ দেখিবার ইচ্ছা হল। মান্দ্রাজকে সকলই “অন্ধকারকৃত দেশ বলিত,— তখনও মান্দ্রাজে উন্নতির কোন লক্ষণ দেখা যায় নাই; কাজেই সুরেশ মনে মনে ভাবিলেন, সম্ভবত মান্দ্রাজে চেষ্টা করিলে তিনি কোন না কোন চাকুরি জোগাড় করিতে পারিবেন। এই সকল ভাবিয়া তিনি একটু সুস্থ হইয়া উঠিবা মাত্রই মান্দ্রাজের একখানি ডেক টিকিট কিনিয়া জাহাজে উঠিলেন।

 কয়েকদিন পরে তিনি মান্দ্রাজে পৌছিলেন। এ সেই সহর যে সময়ে ভারত সাম্রাজ্যে স্থাপরিতা ক্লাইব প্রথমে কেরাণীর কার্য করিয়া পরে সৈনিক কার্য্যে অক্ষয় কীর্ত্তি লাভ করিয়াছিলেন। যেখানে তিনি নিজ জীবনে বিরক্ত হইয়া গুলি করিয়া আত্মহত্যা করিতে উদ্যত হইয়াছিলেন।

আজ হতাশ সাগরে ভাসিতে আসিতে সুরেশও সেই প্রাচীন ইংরেজ অভিনিবেশ মান্দ্রাজ শহরে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। কিন্তু এ সহরেও তিনি সম্পূর্ণ অপরিচিত, কেহ তাহাকে চিনে না, তিনিও কাহাকে চিনেন না। যাহা হউক তিনি দিন কয়েক এখানে বাস করিবার জন্য একটা অতি সস্তায় বাসা স্থির করিয়া লইলেন। সহরের অতি জঘন্য পল্লিতে এই বাসস্থান মিলিল এবং যে ক্ষুদ্র গৃহে তিনি বাস করিতে লাগিলেন, সেখানে শূকরও থাকিতে লজ্জাবোধ করিত। কিন্তু সুরেশের ন্যায় কষ্টসহিষ্ণু বোধ হয় আর জগতে কেহ ছিল না, তিনি সহস্র কষ্ট ব্যথিত হইতেন না।

 মান্দ্রাজে থাকিবার জন্য কোন প্রলোভন সুরেশের ছিল না মান্দ্রাজে দেখিবার মত কিছুই নাই; তবে যদি কোন চাকুরী মিলে এই আশায় তিনি মান্দ্রাজের সমস্ত সরকারি ও বেসরকারি আপিসে ঘুরিলেন, কিন্তু রেঙ্গুনে তাহার যে অবস্থা হইয়াছিল, এখানেও তাহাই হইল; কোথায়ও কোন চাকুরী মিলিল না। বিশেষতঃ তিনি এদেশের ভাষা তামিল ও তেলুগু একেবারে জানিতেন না। এ ভাষা যে তিনি মাসে দুইমাসে শিখিতে সক্ষম হইবেন, এ সম্ভাবনাও একেবারে ছিল না; কাজেই এখানে কোন কাজ পাইবার সম্ভাবনা উাঁহার নাই তাই তিনি বুঝিলেন। তবে খ্রীষ্টান পরিবারে কোন চাকুরী জুটিলেও জুটিতেও পারে, এই আশায় তিনি কয়েক দিন মান্দ্রাজে থাকিয়া সেই চেষ্টাই করিতে লাগিলেন।

 বাল্যকাল হইতেই তিনি অতিশয় সহিষ্ণু, তাহার এই অত্যাশ্চর্য্য সহিষ্ণুতার বলেই তিনি এক্ষণে জগতে এরূপ খ্যাতি লাভ করিতে সক্ষম হইয়াছেন। সেই সহিষ্ণুতার বলে তিনি মান্দ্রাজের প্রতি খ্রীষ্টান পরিবারের দ্বারে উপস্থিত হইয়া যে কোন কাজ করিতে প্রস্তুত বলিয়া দণ্ডায়মান হইলেন, কিন্তু কোথায়ও কোন কাজ জুটল না। তিনি এমন কি একটা বাড়ীও দেখিতে বাদ রাখিলেন না; মান্দ্রাজে যত খ্রীষ্টান পরিবার ছিল, তাহায় প্রত্যেকের নিকট গেলেন, কিন্তু কোথায়ও কিছু হইল না। তিনি ক্রমে হতাশ হইতে লাগিলেন, তাহার নিকট যে কয়টী মাত্র টাকা ছিল তাহাও ক্রমে ফুরাইয়া আসিল। শেষ কয়েক আমা মাত্র অবশিষ্ট আছে—এই কয়টী পয়সা ব্যয় হইয়া গেলে তাহাকে এই বিদেশে অনাহারে রাজপথের ধারে পড়িয়া মরিতে হইবে। কলিকাতায় ফিরিয়া যাইবায় তার আর উপায় নাই, তাহার জাহাজ ভাড়া নাই; খাটিয়া কোন চাকুরী করিয়া জাহাজ ভাড়া সংগ্রহ করিতে না পারিলে তাহার পর দেশে ফিয়িবার উপায় নাই! তিনি কি করবেন, কোথায় যাইবেন, কিছুই স্থির করিতে পারিয়া অন্য মনে সমুদ্রের তীরে আসিলেন। সম্মুখে নীল সমূদ্র ফেনমালায় ভূষিত হইয়া পর্ব্বতাকার তরঙ্গে গড়াইতে গড়াইতে বেলাভূমে আসিয়া পড়িতেছে-সুরেশ জীবনে হতাশ হইয়াছেন, সমুদ্রের এই ভীম ভাব তাহার নয়ন পখে পতিত হইলে তিনি মনে মনে ভাবিলেন, জীবনে আর প্রয়োজন কি? এত কষ্ট পাইয়া কষ্টের জীবন রাখার লাভ কি। এই ত সমুখে সমুদ্র নাচিতেছে। লাফাইয়া যায় শীতল গর্তে পতিত হইলেই ত সকল জ্বালা জুড়ায়? কতবার তিনি এই ভাব মন হইতে দূর করিলেন, তিনি সমুদ্রের নিকট হইতে দূরে গমন করিলেন, কিন্তু আবার সেই ভাব মনে আসিল, আবার কে যেন তাঁহাকে সমুদ্রের নিকট আনিল। তিনি প্রাণের সহিত যুদ্ধ করিতেছিলেন। প্রাণের ভিতর কে যেন উহাকে বলিতেছিল, “সুরেশ, মরিও না। তোমার ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল।’'

 এইরূপ নানা চিন্তায় উৎপীড়িত হইয়া সুরেশ ধীরে ধীরে হতাশ পদে সমুদ্র তীরে পদচারণ করিতে ছিলেন। তাঁহার সাহেবী পোষাক পরিধান ছিল, কিন্তু সে পরিচ্ছদের অবস্থা এমনই হইয়াছে যে, তাহা দেখিলেই স্পষ্টই প্রতীয়মান হয় যে তাহার অবস্থা অতি শোচনীয় হইয়াছে। তাহার পাদুকা ছিন্ন, সার্ট ময়লা, কোট ছেঁড়া, পেণ্টুলেনে তালি দেওয়া, তাহার সোলা হ্যাট ধূলায় ধূলায় কৃষ্ণবর্ণ। উহার চেহারা ও বেশ দেখিলে অপরিচিত লোকে যে বিশ্বাস করিয়া তাহাকে কোন কাজ দিবে না তাহাকে বাড়ীতে রাখিবে, এরূপ কোন সম্ভাবনা ছিল না।

 সমুদ্রতীরে সাহেবের ছেলেমেয়েগণ নাচিয়া নাচিয়া খেলিয়া বেড়াহতেছিল —তাহাদের দেখিয়া সুরেশের নাথপুরের কথা মনে পড়িল। কত সুখে বাল্যকালে তিনি নাথপুরে মেলা করিয়া বেড়াইতেন,—আর আজ বিদেশ বিভূমে মাদ্রাজ উপকূলে তাঁহার কি দুর্দশা’ সহসা তাহার জননীর স্নেহমাখা মুখ মনে উদিত হইল। না জানি তাহার এইরূপ নিরুদ্দেশে তিনি কত কষ্টে কাল কাটাইতেছেন। না জানি তিনি কত কাঁদিতেছেন, কত কষ্ট পাইতেছেন!, তিনি দূর মাদ্রাজে অনাহারে মৃত্যুমুখে পতিত; —তিনি তাহা নিতেও পারিলেন না! এই সকল চিন্তায় সুরেশ উন্মত্ত প্রায় হইলেন। হয়ত তিনি আত্মহত্যা করিতেন; এইরুপ সময় সহসা তাঁহার দৃষ্টি এক ব্যক্তির প্রতি পড়িল;—অমনি তাঁহার মনের ভাব পরিবর্তিত হইল। তিনি এই ভদ্রলোকের সহিত কথা কহিতে ব্যগ্র হইলেন।

 ইনি একটি বৃদ্ধ ফিরিঙ্গি সাহেব। ইহার সমস্ত কেশ ও লম্বমান শ্বশ্রু শ্বেত হইয়া গিয়াছে। অতি সৌম্যভাব, দেখিলে ভক্তি হয়। দেখিলেই বোধ হয় যেন ইনি শান্তির ক্রোড়ে বিরাজ লাভ করিতেছেন। সুরেশ ইহাকে দেখিয়া সসম্ভ্রমে মস্তকস্থ টুপি খুলিয়া অভিবাদন করিলেন। সাহেব তাঁহাকে সস্নেহে আশীর্বাদ করিয়া কিয়ৎক্ষণ তার দিকে চাহিয়া থাকিয়া বলিলেন, “আমি কি তোমায় কোন সাহায্য করিতে পারি? “সুরেশ বলিলেন, “আমি বিদেশী। “

 সাহেব। তোমার চেহারা দেখিয়া তা স্পষ্ট বুঝা যায়। মাদ্রাজে কি জন্য আসিয়াছ?

  সুরেশ। কোন চাকুরি পাইবার আশায় এখানে আসিছিলাম, কিন্তু যদিও আমি সর্ব্বত্র চেষ্টা করিয়াছি, তবুও কোথাও কিছু জোগাড় করিতে পারি নাই।

 সাহেব। সময়ের পরিবর্তন হইয়াছে। চাকুরী পাওয়া এখন বড়ই কঠিন। আমি বৃদ্ধ হইয়া কার্য্য হইতে অবসর লইয়াছি, আমি যে তোমাকে কোন সাহায্য করিতে পারিব এরূপ বোধ হয় না।

 সুরেশ। মহাশয়। আমি প্রায় অনাহারে আছি; আমার নিকট যে অর্থ আছে, তাতে কাল আমি একখানি রুটী কিনিতেও সক্ষম হইব না।

 সাহেব। তুমি দেশে যাও না কেন?

 সুরেশ। আমার দেশ কলিকাতা।

 সাহেব। কলিকাতা ছেড়ে মাদ্রাজে এলে কেন?

 সুরেশ। আমি কলিকাতায় স্পেন্সেস হোটেলে চাকুরী করিতাম। সেখান হইতে রেঙ্গুনে যাই। সেখানে কোন চাকুরী জোগাড় করতে না পারিয়া মাদ্রাজে আসি। এখানেও কিছুই জোগাড় করিতে পারিতেছি না।

 সাহেব। এখানে যে কেহ তোমার সাহায্য করিবে এমত বোধ হয় না।

 সুরেশ। তা আমি বুঝিয়াছি। এক্ষণে আমাকে অনাহারে মরিতে হইবে!

 সাহেব। কতদূর লেখা পড়া করিয়াছ?

 লণ্ডন মিশন কলেজে কয় বৎসর লেখা পড়া করিয়াছি। কিছু কিছু ইংরাজী ও বাঙ্গলা জানি।

 সাহেব। তুমি কি খ্রীষ্টান?

 সুরেশ। হাঁ মহাশয়! আসটন সাহেব আমাকে খ্রীষ্টান করেন।

 বৃদ্ধসাহেব কিয়ৎক্ষণ নীরবে রহিলেন। তাঁহারা উভয়েই কথা কহিতে কহিতে চলিতেছিলেন। যদিও সুরেশ সাহেবকে আরও অনেক কথা বলিতে ইচ্ছুক হইলেন, কিন্তু মনের সে ইচ্ছা মনেই রাখিলেন, সাহেবকে বিরক্ত করা কর্ত্তব্য বিবেচনা করিলেন না। বহুক্ষণ নীরবে থাকিয়া সাহেব বলিলেন, “তুমি কি কাজ করিতে পার, মনে কর?”

 সুরেশ। যাতে আমি বাড়ী ফিরে যাবার ভাড়া সংগ্রহ করিতে পারি, আর প্রত্যহ এক মুঠা খেতে পাই, সেই কাজই আমি করিতে সক্ষম।

 সাহেব। বেড়াইবার সখ মিটেছে? বাড়ীর চেয়ে স্থান নেই।

 আবার সাহেব বহুক্ষণ নীরবে রহিলেন—পরে সুরেশের দিকে ফিরিয়া রহিলেন, “তুমি দুটী ছেলেকে দেখতে শুনতে পারো? আমি উপস্থিত তোমাকে অন্য কোন কাজ দিতে পারি না। অন্য কোন কাজ হাতে নাই। আমি তোমাকে চিনিনা, কাজেই আমি তোমার জন্য অন্যত্র অনুরোধ করিতে পারি না। দিন কতক গেলে তোমাকে দেখিলে নিলে হয়ত তোমাকে আমি কার কোন ভাল কাজ জোগাড় করিয়া দিতে পারিব।

 সুরেশ। মহাশয়! আমি আমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করিতে পারি, এরূপ ক্ষমতা আমার নাই।

 সুরেশ সাহেবের সহিত তাহার বাড়ী গমন করিলেন। সেই দিন হইতে তিনি বৃদ্ধ সাহেবের দুটী ক্ষুদ্র পৌত্রের রক্ষণাবেক্ষণের ভার গ্রহণ করিলেন। সুরেশ শীঘ্রই সকলের প্রিয় হইতে পারিতেন। এখানে অতি শীঘ্র তিনি সাহেব ও মেমদিগের প্রিয়পাত্র হইলেন।

 এই পরিবারে সুরেশ কয়েক মাস রহিলেন। যখন তাহার কলিকাতা যাইবার ভাড়া ও সেখানে গিয়া কিছু দিন থাকিবার খরচ সংগ্রহ হইল, তখন তিনি বৃদ্ধ সাহেবের নিকট বিদায় গ্রহণ করিয়া কলিকাতায় চলিলেন।