শান্তিনিকেতন (প্রথম খণ্ড)/কী চাই?

উইকিসংকলন থেকে

কী চাই?

আমরা এতদিন প্রত্যহ আমাদের উপাসনা থেকে কী ফল চেয়েছিলুম? আমরা চেয়েছিলুম শান্তি। ভেবেছিলুম এই উপাসনা বনস্পতির মতো আমাদের ছায়া দেবে, প্রতিদিন সংসারের তাপ থেকে আমাদের বাঁচাবে।

 কিন্তু শান্তিকে চাইলে শান্তি পাওয়া যায় না। তার চেয়ে আরও অনেক বেশি না চাইলে শান্তির প্রার্থনাও বিফল হয়।

 জ্বরের রোগী কাতর হয়ে বলে আমার এই জ্বালাটা জুড়োেক; হয়তো জলে ঝাঁপ দিয়ে পড়ে। তাতে যেটুকু শান্তি হয় সেটা তো স্থায়ী হয় না— এমন কি তাতে তাপ বেড়ে যেতে পারে। রোগী যদি শান্তি চায়, স্বাস্থ্য না চায়, তবে সে শাস্তিও পায় না স্বাস্থ্যও পায় না।

 আমাদেরও শান্তিতে চলবে না, প্রেম দরকার। বরঞ্চ মনে ওই-যে একটুকু শান্তি পাওয়া যায়, কিছুক্ষণের জন্যে একটা স্নিগ্ধতার আবরণ আমাদের উপরে এসে পড়ে, সেটাতে আমাদের ভুলায়— আমরা মনে নিশ্চিন্ত হয়ে বলি, আমাদের উপাসনা সার্থক হল— কিন্তু ভিতরের দিকে সার্থকতা দেখতে পাই নে।

 কেননা, দেখতে পাই ব্যাধি যে যায় না। সমস্ত দিন নানা ঘটনায় দেখতে পাই সংসারের সঙ্গে আমাদের সম্বন্ধ সহজ হয় নি। রোগীর সঙ্গে তার বাহিরের প্রকৃতির সম্বন্ধ যে রকম, সেই রকম হয়ে আছে। বাহিরে যেখানে সামান্য ঠাণ্ডা রোগীর দেহে সেখানে অসহ্য শীত; বাহিরের স্পর্শ যেখানে অতি মৃদু রোগীর দেহে সেখানে দুঃসহ বেদনা। আমাদেরও সেই দশা; বাহিরের সঙ্গে ব্যবহারে আমাদের ওজন ঠিক থাকছে না। ছোটো কথা অত্যন্ত বড়ো করে শুনছি, ছোটো ব্যাপার অত্যন্ত ভারী হয়ে উঠছে।

 ভার বাড়ে কখন? না, কেন্দ্রের দিকে ভারাকর্ষণ যখন বেশি হয়। পৃথিবীতে যে হাল্কা জিনিস আমরা সহজেই তুলছি, যদি বৃহস্পতি-গ্রহে যাই তবে সেখানে সেটুকুও আমাদের হাড় গুঁড়িয়ে দিতে পারে। কেননা, সেখানে এই কেন্দ্রের দিকের আকর্ষণ পৃথিবীর চেয়ে অনেক বেশি। আমরাও তাই দেখছি, আমাদের নিজের কেন্দ্রের দিকের টানটা অত্যন্ত বেশি— আমাদের স্বার্থ ভিতরের দিকেই টানছে, অহংকার ভিতরের দিকেই টানছে, এইজন্যেই সব জিনিসই অত্যন্ত ভারী হয়ে উঠছে। যা তুচ্ছ তা কেবলমাত্র আমার ওই ভিতরের টানের জোরেই আমাকে কেবলই চাপছে— সব জিনিসই আমাকে ঠেসে ধরেছে, সব কথাই আমাকে ঠেলে দিচ্ছে, ক্ষণকালের শান্তির দ্বারা এটাকে ভুলে থেকে আমাদের লাভটা কী?

 এই চাপটা হাল্কা হয় কখন? প্রেমে। তখন যে ওই টানটা বাহিরের দিকে যায়। আমাদের জীবনে অনেকবার তার পরিচয় পেয়েছি। যেদিন প্রণয়ীর সঙ্গে আমাদের প্রণয় বিশেষভাবে সার্থক হয়েছে সেদিন কেবল যে আকাশের আলো উজ্জ্বলতর, বনের শ্যামলতা শ্যামলতর হয়েছে তা নয়, সেদিন আমাদের সংসারের ভারাকর্ষণের টান একেবারে আলগা হয়ে গেছে। অন্যদিন ভিক্ষুককে যখন একপয়সামাত্র দিই সেদিন তাকে আধুলি দিয়ে ফেলি। অর্থাৎ, অন্যদিন এক পয়সার যে ভার ছিল আজ বত্রিশ পয়সার সেই ভার। অন্যদিন যে কাজে হয়রান হয়ে পড়তুম আজ সে কাজে ক্লান্তি নেই— হঠাৎ কাজ হাল্কা হয়ে গেছে। পয়সা সেই পয়সাই আছে, কাজ সেই কাজই আছে— কেবল তার ওজন কমে গেছে। কেননা টান যে আজ আমার নিজের কেন্দ্রের দিকে নয়; প্রেম যে আমাকে বাইরে টান দিয়ে একেবারে এক মুহূর্তে সমস্ত জগতের বোঝা নামিয়ে দিয়ে গেছে।

 আমাদের সাধনা যেমনই হোক আমাদের সংসার সেই সঙ্গে যদি হাল্কা হতে না থাকে তবে বুঝব যে হল না। যদি বুঝি টাকার ওজন তেমনি ভয়ানক আছে, উপকরণের বোঝা তেমনিই আমাকে চেপে আছে, তার মধ্যে অতিছোটোটুকুকেও ফেলে দিতে পারি এমন বল আমার নেই, যদি দেখি কাজ যত বড়ো তার ভার যেন তার চেয়ে অনেক বেশি, তা হলে বুঝতে হবে প্রেম জোটে নি— আমাদের বরণসভায় বর আসে নি।

 তবে আর ওই শান্তিটুকু নিয়ে কী হবে? ওতে আমাদের আসল জিনিসটা ফাঁকি দিয়ে অল্পে সন্তুষ্ট করে রাখবে। প্রেমের মধ্যে শুধু শান্তি নেই, তাতে অশাস্তিও আছে। জোয়ারের জলের মতো কেবল যে তার পূর্ণতা তা নয়, তারই মতো তার গতিবেগও আছে। সে আমাদের ভরিয়ে দিয়ে বসিয়ে রাখবে না, সে আমাদের ভাঁটার মুখের থেকে ফিরিয়ে উল্টো টানে টেনে নিয়ে যাবে— তখন এই অচল সংসারটাকে নিয়ে কেবলই গুণ-টানাটানি লগি-ঠেলাঠেলি করে মরতে হবে না— সে হুহু করে ভেসে চলবে।

 যতদিন সেই প্রেমের টান না ধরে ততদিন শান্তিতে কাজ নেই ততদিন অশান্তিকে যেন অনুভব করতে পারি। ততদিন যেন বেদনাকে নিয়ে রাত্রে শুতে যাই এবং বেদনাকে নিয়ে সকালবেলায় জেগে উঠি— চোখের জলে ভাসিয়ে দাও, স্থির থাকতে দিয়ো না।

 প্রতিদিন প্রাতে যখন অন্ধকারের দ্বার উদ্ঘাটিত হয়ে যায়, তখন যেন দেখতে পাই বন্ধু দাঁড়িয়ে আছ— সুখের দিন হোক, দুঃখের দিন হোক, বিপদের দিন হোক, তোমার সঙ্গে আমার দেখা হল, আজ আমার আর ভাবনা নেই, আমার আজ সমস্তই সহ্য হবে। যখন প্রেম না থাকে, হে সখা, তখনই শান্তির জন্যে দরবার করি। তখন অল্প পুঁজিতে কোনো আঘাত সইতে পারি নে। কিন্তু যখন প্রেমের অভ্যুদয় হয় তখন যে দুঃখ যে অশান্তিতে সেই প্রেমের পরীক্ষা হবে সেই দুঃখ সেই অশান্তিকেও মাথায় তুলে নিতে পারি। হে বন্ধু, উপাসনার সময় আমি আর শান্তি চাইব না, আমি কেবল প্রেম চাইব। প্রেম শান্তিরূপেও আসবে অশান্তিরূপেও আসবে, সুখ হয়েও আসবে দুঃখ হয়েও আসবে— সে যে-কোনো বেশেই আসুক তার মুখের দিকে চেয়ে যেন বলতে পারি: তোমাকে চিনেছি বন্ধু, তোমাকে চিনেছি।

 ৩০ অগ্রহায়ণ ১৩১৫