শারদোৎসব/গ্রন্থপরিচয়

উইকিসংকলন থেকে

গ্রন্থপরিচয়

শারদোৎসব ১৩১৫ সালে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। ‘এই নাটিকাটি বোলপুর-ব্রহ্মচর্যাশ্রমের শারদোৎসব উপলক্ষে ছাত্রদের দ্বারা অভিনীত হইবার জন্য রচিত হয়।’ ১৩২৬ সালে শাস্তিনিকেতন আশ্রমে শারদোৎসব অভিনয় উপলক্ষে কবি এই নাটকের ‘ভিতরের কথাটি’ শান্তিনিকেতন পত্রে (১৩২৬ আশ্বিন ও কার্তিক) মুদ্রিত একটি প্রবন্ধে লিপিবদ্ধ করেন—

 আগামী ছুটির পূর্বরাত্রে আশ্রমে শারদোৎসব অভিনয়ের প্রস্তাব হইয়াছে। তাহার আয়োজনও চলিতেছে। শারদোৎসব নাটকটি বিশেষভাবে ছেলেদের উপযোগী করিয়াই তৈরি হইয়াছিল; তাহার বাহিরের ধারাটি ছেলেদের বুঝিবার পক্ষে কঠিন নহে, কেবল তাহার ভিতরের কথাটি হয়তো ছেলেরা ঠিক বোঝে না।

 সমস্ত নাটককে ব্যাপ্ত করিয়া যে ভাবটা আছে সেটা আমাদের আশ্রমের বালকদের পক্ষে সহজ। বিশেষ বিশেষ ফুলে ফলে হাওয়ায় আলোকে আকাশে পৃথিবীতে বিশেষ বিশেষ ঋতুর উৎসর চলিতেছে। সেই উৎসব মানুষ যদি অন্যমনস্ক হইয়া অন্তরের মধ্যে গ্রহণ না করে তবে সে পার্থিব জীবনের একটি বিশুদ্ধ এবং মহৎ আনন্দ হইতে বঞ্চিত হয়। মানুষের সঙ্গে মানুষের নানা কাজে নান। খেলায় মিলনের নানা উপলক্ষ আছে। মিলন ঠিকমতো ঘটিলেই, অর্থাৎ তাহা কেবলমাত্র হাটের মেলা বাটের মেলা না হইলে, সেই মিলন নিজেকে কোনো না কোনো উৎসব-আকারে প্রকাশ করে। আমরা এই সংখ্যায় শান্তিনিকেতনে অন্য প্রবন্ধে বলিয়াছি, মিলন যেখানেই ঘটে, অর্থাৎ বহুর ভিতরকার মূল ঐক্যটি যেখানেই ধরা পড়ে, যাহারা বাহিরে পৃথক বলিয়া প্রতীয়মান তাহাদের অন্তরের নিত্য সম্বন্ধ যেখানেই উপলব্ধ হয়, সেখানেই সৃষ্টির অহেতুক অনির্বচনীয় লীলা প্রকাশ পায়। বছর বিচিত্র ঐক্যসম্বন্ধই সৃষ্টি। মানুষ যেথানে বিচ্ছিন্ন সেখানে তাহার স্বজনকার্য দুর্বল। সভ্যতা শব্দের অর্থই এই, মানুষের মিলনজাত একটি বৃহৎ জগৎ; এই জগতে ঘরবাড়ি রাস্তাঘাট বিধিব্যবস্থা ধর্মকর্ম শিল্পসাহিত্য আমোদ-আহ্লাদ সমস্তই একটি বিরাট সৃষ্টি, এই সৃজনের মূলশক্তি মানুষের সত্য সম্বন্ধ। মানুষ যেখানে বিচ্ছিন্ন, যেখানে বিরুদ্ধ, সেখানে তাহার সৃজনকার্য নিস্তেজ। সেখানে সে কেবল কলেচালানো পুতুলের মতো চিরাভ্যাসের পুনরাবৃত্তি করিয়া চলে, আপন জ্ঞান প্রাণ প্রেমকে নব নব আকারে প্রকাশ করে না। মিলনের শক্তিই স্বজনের শক্তি।

 মানুষ যদি কেবলমাত্র মানুষের মধ্যেই জন্মগ্রহণ করিত তবে লোকালয়ই মানুষের একমাত্র মিলনের ক্ষেত্র হইত। কিন্তু মানুষের জন্ম তো কেবল লোকালয়ে নহে, এই বিশাল বিশ্বে তাহার জন্ম। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সঙ্গে তাহার প্রাণের গভীর সম্বন্ধ আছে। তাহার ইন্দ্রিয়বোধের তারে তারে প্রতি মুহূর্তে বিশ্বের স্পন্দন নানা রূপে রসে জাগিয়া উঠিতেছে।

 বিশ্বপ্রকৃতির কাজ আমাদের প্রাণের মহলে আপনিই চলিতেছে, কিন্তু মানুষের প্রধান সৃজনের ক্ষেত্র তাহার চিত্তমহলে। এই মহলে যদি দ্বার খুলিয়া আমরা বিশ্বকে আহ্বান করিয়া না লই, তবে বিরাটের সঙ্গে আমাদের পূর্ণ মিলন ঘটে না। বিশ্বপ্রকৃতির সঙ্গে আমাদের চিত্তের মিলনের অভাব আমাদের মানবপ্রকৃতির পক্ষে একটা প্রকাণ্ড অভাব।

 যে মানুষের মধ্যে সেই মিলন বাধা পায় নাই, সেই মানুষের জীবনের তারে তারে প্রকৃতির গান কেমন করিয়া বাজে, ইংরেজ কবি ওয়ার্ড‍্স‍্ওয়ার্থ্ Three Years She Grew নামক কবিতায় অপূর্ব সুন্দর করিয়া বলিয়াছেন। প্রকৃতির সহিত অবাধ মিলনে ‘ল্যুসি’র দেহমন কী অপরূপ সৌন্দর্যে গড়িয়া উঠিবে তাহারই বর্ণনা উপলক্ষে কবি লিখিতেছেন, ‘প্রকৃতির নির্বাক্ ও নিশ্চেতন পদার্থের যে নিরাময় শান্তি ও নিঃশব্দতা তাহাই এই বালিকার মধ্যে নিশ্বসিত হইবে। ভাসমান মেঘসকলের মহিমা তাহারই জন্য, এবং তাহারই জন্য উইলো বৃক্ষের অবনম্রতা। ঝড়ের গতির মধ্যে যে-একটি শ্রী তাহার কাছে প্রকাশিত তাহারই নীরব আত্মীয়তা আপন অবাধ ভঙ্গীতে এই কুমারীর দেহখানি গড়িয়া তুলিবে। নিশীথরাত্রির তারাগুলি হইবে তাহার ভালোবাসার ধন। আর, যে-সকল নিভৃতনিলয়ে নির্ঝরিণীগুলি বাঁকে বাঁকে উচ্ছ্বলিত হইয়া নাচিয়া চলে সেইখানে কান পাতিয়া থাকিতে থাকিতে কলধ্বনির মাধুর্যটি তাহার মুখশ্রীর উপরে ধীরে সঞ্চারিত হইতে থাকিবে।’

 পূর্বেই বলিয়াছি, ফুল-ফল-ফসলের মধ্যে প্রকৃতির সৃষ্টিকার্য কেবলমাত্র একমহলা; মানুষ যদি তাহার দুই মহলেই আপন সঞ্চয়কে পূর্ণ না করে তবে সেটা তাহার পক্ষে বড়ো লাভ নহে। হৃদয়ের মধ্যে প্রকৃতির প্রবেশের বাধা অপসারিত করিলে তবেই প্রকৃতির সহিত তাহার মিলন সার্থক হয়, সুতরাং সেই মিলনেই তাহার প্রাণমন বিশেষ শক্তি বিশেষ পূর্ণতা লাভ করে।

 মানুষের সঙ্গে মানুষের মিলনের উৎসব ঘরে ঘরে বারে বারে ঘটিতেছে। কিন্তু প্রকৃতির সভায় ঋতু-উৎসবের নিমন্ত্রণ যখন গ্রহণ করি তখন আমাদের মিলন আরও অনেক বড়ো হইয়া উঠে। তখন আমরা আকাশ-বাতাস গাছপালা পশুপক্ষী সকলের সঙ্গে মিলি— অর্থাৎ যে প্রকৃতির মধ্যে আমরা মানুষ তাহার সঙ্গে সত্য সম্বন্ধ আমরা অন্তরের মধ্যে স্বীকার করি। সেই স্বীকার করা কখনোই নিষ্ফল নহে। কারণ পূর্বেই বলিয়াছি, সম্বন্ধেই সৃষ্টির প্রকাশ। প্রকৃতির মধ্যে যখন কেবল আছি মাত্র তখন তাহা না থাকারই শামিল, কিন্তু প্রকৃতির সঙ্গে আমাদের প্রাণমনের সম্বন্ধ-অনুভবেই আমরা সৃজনক্রিয়ার সঙ্গে সামঞ্জস্য লাভ করি; চিত্তের দ্বার রুদ্ধ করিয়া রাখিলে আপনার মধ্যে এই সৃজনশক্তিকে কাজ করিবার বাধা দেওয়া হয়।

 তাই নব ঋতুর অভ্যুদয়ে যখন সমস্ত জগৎ নূতন রঙের উত্তরীয় পরিয়া চারি দিক হইতে সাড়া দিতে থাকে তখন মানুষের হৃদয়কেও সে আহ্বান করে; সেই হৃদয়ে যদি কোনো রঙ না লাগে, কোনো গান না জাগিয়া উঠে, তাহা হইলে মানুষ সমস্ত জগৎ হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া থাকে।

 সেই বিচ্ছেদ দূর করিবার জন্য আমাদের আশ্রমে আমরা প্রকৃতির ঋতু-উৎসবগুলিকে নিজেদের মধ্যে স্বীকার করিয়া লইয়াছি। শারদোৎসব সেই ঋতু-উৎসবেরই একটি নাটকের পালা। নাটকের পাত্রগণের মধ্যে এই উৎসবের বাধা কে। লক্ষেশ্বর— সেই বণিক আপনার স্বার্থ লইয়া, টাকা উপার্জন লইয়া, সকলকে সন্দেহ করিয়া, ভয় করিয়া, ঈর্ষা করিয়া, সকলের কাছ হইতে আপনার সমস্ত সম্পদ গোপন করিয়া বেড়াইতেছে। এই উৎসবের পুরোহিত কে। সেই রাজা যিনি আপনাকে ভুলিয়া সকলের সঙ্গে মিলিতে বাহির হইয়াছেন, লক্ষ্মীর সৌন্দর্যের শতদল পদ্মটিকে যিনি চান। সেই পদ্ম যে চায় সোনাকে সে তুচ্ছ করে। লোভকে সে বিসর্জন দেয় বলিয়াই লাভ সহজ হইয়া সুন্দর হইয়া তাহার হাতে আপনি ধরা দেয়।

 কিন্তু এই যে সুন্দরকে খুঁজিবার কথা বলা হইল, সে কী। কোথায়। সে কি একটা পেলব সামগ্রী, একটা শৌখিন পদার্থ। এই কথারই উত্তরটি এই নাটকের মাঝখানে রহিয়াছে।

 শারদোৎসবের ছুটির মাঝখানে বসিয়া উপনন্দ তার প্রভুর ঋণ শোধ করিতেছে। রাজসন্ন্যাসী এই প্রেমঋণ-পরিশোধের, এই অক্লান্ত আত্মোৎসর্গের সৌন্দর্যটি দেখিতে পাইলেন। তাঁর তখনই মনে হইল, শারদোৎসবের মূল অর্থটি এই ঋণশোধের সৌন্দর্য। শরতে এই যে নদী ভরিয়া উঠিল কূলে কূলে, এই যে খেত ভরিয়া উঠিল শস্যের ভারে, ইহার মধ্যে একটি ভাব আছে, সে এই—প্রকৃতি আপনার ভিতরে যে অমৃতশক্তি পাইয়াছে সেইটাকে বাহিরে নানা রূপে নানা রসে শোধ করিয়া দিতেছে। সেই শোধ করাটাই প্রকাশ। প্রকাশ যেখানে সম্পূর্ণ হয় সেইখানেই ভিতরের ঋণ বাহিরে ভালো করিয়া শোধ করা হয়; সেই শোধের মধ্যেই সৌন্দর্য।

 দেবতা আপনাকেই কি মানুষের মধ্যে দেন নাই। সেই দানকে যখন অক্লান্ত তপস্যার অকৃপণ ত্যাগের দ্বারা মানুষ শোধ করিতে থাকে তখনই দেবতা তাহার মধ্য হইতে আপনার দান অর্থাৎ আপনাকে নূতন আকারে ফিরিয়া পান, আর তখনই কি তাহার মনুষ্যত্ব সম্পূর্ণ হইয়া উঠে না। সেই প্রকাশ যতই বাধা কাটাইয়া উঠিতে থাকে ততই কি তাহা সুন্দর, তাহা উজ্জ্বল হয় না। বাধা কোথায় কাটেনা। যেখানে আলস্য, যেখানে বীর্যহীনতা, যেখানে আত্মাবমাননা। যেখানে মানুষ জ্ঞানে প্রেমে কর্মে দেবতা হইয়া উঠিতে সর্বপ্রযত্নে প্রয়াস না পায় সেখানে নিজের মধ্যে সে দেবত্বের ঋণ অস্বীকার করে। যেখানে ধনকে সে আঁকড়িয়া থাকে, স্বার্থকেই চরম আশ্রয় বলিয়া মনে করে, সেখানে দেবতার ঋণকে সে নিজের ভোগে লাগাইয়া একেবারে ফুঁকিয়া দিতে চায়; তাহাকে যে অমৃত দেওয়া হইয়াছিল, সে অমৃতের উপলব্ধিতে সে মৃত্যুকে তুচ্ছ করিতে পারে, ক্ষতিকে অবজ্ঞা করিতে পারে, দুঃখকে গলার হার করিয়া লয়, জীবনের প্রকাশের মধ্য দিয়া সেই অমৃতকে তখন সে শোধ করিয়া দেয় না। বিশ্বপ্রকৃতিতে ও মানবপ্রক্বতিতে এই অমৃতের প্রকাশকেই বলে সৌন্দর্য; আনন্দরূপমমৃতম্।

 রাজসন্ন্যাসী উপনন্দকে দেখাইয়া দিয়া বলিয়াছেন, এই ঋণশোধেই যথার্থ ছুটি, যথার্থ মুক্তি। নিজের মধ্যে অমৃতের প্রকাশ যতই সম্পূর্ণ হইতে থাকে ততই বন্ধন মোচন হয়, কর্মকে এড়াইয়া তপস্যায় ফাঁকি দিয়া পরিত্রাণ লাভ হয় না। তাই তিনি উপনন্দকে বলিয়াছেন, ‘তুমি পংক্তির পর পংক্তি লিখছ আর ছুটির পর ছুটি পাচ্ছ।’

 এই লইয়া সন্ন্যাসীতে ঠাকুরদাদাতে যে কথাবার্তা হইয়াছে নীচে তাহা উদ্ধ‌ৃত করিলাম—

 সন্ন্যাসী। আমি অনেকদিন ভেবেছি জগৎ এমন আশ্চর্য সুন্দর কেন?... আজ স্পষ্ট প্রত্যক্ষ দেখতে পাচ্ছি— জগৎ আনন্দের ঋণ শোধ করছে। বড়ো সহজে করছে না, নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে সমস্ত ত্যাগ ক’রে করছে।... কোথাও সাধনার এতটুকু বিশ্রাম নেই, সেইজন্যই এত সৌন্দর্য।

 ঠাকুরদাদা। এ কদিকে অনন্ত ভাণ্ডার থেকে তিনি কেবলই ঢেলে দিচ্ছেন, আরএক দিকে কঠিন দুঃখে তারই শোধ চলছে।... এই দুঃখের জোরেই পাওয়ার সঙ্গে দেওয়ার ওজন বেশ সমান থেকে যাচ্ছে, মিলনটি সুন্দর হয়ে উঠেছে।

 সন্ন্যাসী। ঠাকুরদা, যেখানে আলস্য, যেখানে কৃপণতা, যেখানেই ঋণশোধে ঢিল পড়ে যাচ্ছে, সেইখানেই সমস্ত কুশ্রী...!

 ঠাকুরদাদা। সেইখানেই যে এক পক্ষে কম পড়ে যায়, অন্য পক্ষের সঙ্গে মিলন পুরো হতে পায় না।

 সন্ন্যাসী। লক্ষ্মী যখন মানবের মর্ত্যলোকে আসেন তখন দুঃখিনী হয়েই আসেন; তাঁর সেই সাধনার তপশ্বিনীবেশেই ভগবান মুগ্ধ...; শত দুঃখেরই দলে তাঁর সোনার পদ্ম সংসারে ফুটে উঠেছে...।


 লক্ষ্মী সৌন্দর্য ও সম্পদের দেবী; গৌরী যেমন তপস্যা করিয়া শিবকে পাইয়াছিলেন, মর্ত্যলোকে লক্ষ্মীও তেমনি দুঃখের সাধনার দ্বারাই ভগবানের সহিত মিলন লাভ করেন। যে-মানুষ বা যে-জাতির মধ্যে এই ত্যাগ নাই তপস্য নাই, দুঃখস্বীকারে জড়তা, সেখানে লক্ষ্মী নাই, সুতরাং সেখানে ভগবানের প্রেম আরষ্ট হয় না।

 উপনন্দ তাহার প্রভুর নিকট হইতে প্রেম পাইয়াছিল, ত্যাগস্বীকারের দ্বারা প্রতিদানের পথ বাহিয়া সে যতই সেই প্রেমদানের সমান ক্ষেত্রে উঠিতেছে ততই সে মুক্তির আনন্দ উপলব্ধি করিতেছে। দুঃখই তাহাকে এই আনন্দের অধিকারী করে। ঋণের সহিত ঋণশোধের বৈষম্যই বন্ধন এবং তাহাই কুশ্রীতা।


শারদোৎসবের ‘ভিতরকার ধুয়ো’ সম্বন্ধে “আমার ধর্ম” প্রবন্ধে কবি লিখিয়াছেন:

 শারদোৎসব থেকে আরম্ভ করে ফাল্গুনী পর্যন্ত যতগুলি নাটক লিখেছি, যখন বিশেষ করে মন দিয়ে দেখি তখন দেখতে পাই প্রত্যেকের ভিতরকার ধুয়োটা ওই একই। রাজা বেরিয়েছেন সকলের সঙ্গে মিলে শারদোৎসব করবার জন্যে। তিনি খুঁজছেন তার সাথী। পথে দেখলেন ছেলেরা শরৎপ্রকৃতির আনন্দে যোগ দেবার জন্যে উৎসব করতে বেরিয়েছে। কিন্তু একটি ছেলে ছিল— উপনন্দ— সমস্ত খেলাধুলো ছেড়ে সে তার প্রভুর ঋণ শোধ করবার জন্যে নিভৃতে বসে একমনে কাজ করছিল। রাজা বললেন, তার সত্যকার সাথী মিলেছে, কেননা ওই ছেলেটির সঙ্গেই শরৎপ্রকৃতির সত্যকার আনন্দের যোগ— ওই ছেলেটি দুঃখের সাধনা দিয়ে আনন্দের ঋণ শোধ করছে— সেই দুঃখেরই রূপ মধুরতম। বিশ্বই যে এই দুঃখ-তপস্যায় রত; অসীমের যে-দান সে নিজের মধ্যে পেয়েছে, অভ্রান্ত প্রয়াসের বেদনা দিয়ে সেই দানের সে শোধ করছে। প্রত্যেক ঘাসটি নিরলস চেষ্টার দ্বারা আপনাকে প্রকাশ করছে, এই প্রকাশ করতে গিয়েই সে আপন অন্তর্নিহিত সত্যের ঋণ শোধ করছে। এই যে নিরস্তর বেদনায় তার আত্মোৎসর্জন, এই দুঃখই তো তার শ্রী এই তো তার উৎসব, এতেই তো সে শরৎপ্রকৃতিকে সুন্দর করেছে, আনন্দময় করেছে। বাইরে থেকে দেখলে একে খেলা মনে হয় কিন্তু এ তো খেলা নয়, এর মধ্যে লেশমাত্র বিরাম নেই। যেখানে আপন সত্যের ঋণশোধে শৈথিল্য, সেখানেই প্রকাশে বাধা, সেইখানেই কদর্যতা, সেইখানেই নিরানন্দ। আত্মার প্রকাশ আনন্দময়, এইজন্যেই সে দুঃখকে মৃত্যুকে স্বীকার করতে পারে—ভয়ে কিংবা আলস্যে কিংবা সংশয়ে এই দুঃখের পথকে যে লোক এড়িয়ে চলে জগতে সেইই আনন্দ থেকে বঞ্চিত হয়। শারদোৎসবের ভিতরকার কথাটাই এই—ও তো গাছতলায় বসে বসে বাঁশির সুর শোনবার কথা নয়।


ভাহসিংহের পত্রাবলীতে প্রকাশিত একটি চিঠিতে (২৪ ভাদ্র ১৩২৯) কবি শারদোৎসব সম্বন্ধে লিখিতেছেন:

 ওটা হচ্ছে ছুটির নাটক। ওর সময়ও ছুটির, ওর বিষয়ও ছুটির। রাজা ছুটি নিয়েছে রাজত্ব থেকে, ছেলেরা চুটি নিয়েছে পাঠশালা থেকে। তাদের আর কোনো মহৎ উদ্দেশ্য নেই, কেবল একমাত্র হচ্ছে— ‘বিনা কাজে বাজিয়ে বাঁশি কাটবে সকল বেলা।’ ওর মধ্যে একটা উপনন্দ কাজ করছে, কিন্তু সেও তার ঋণ থেকে ছুটি পাবার কাজ।


 ১৩২৯ সালে কলিকাতায় শারদোৎসব অভিনয়ের সময় উহার একটি “ভূমিকা” কবি রচনা করেন। অভিনয়-পত্রী হইতে তাহা নীচে মুদ্রিত হইল:

 রাজা। আমাদের সব প্রস্তুত তো?

 মন্ত্রী। হাঁ। মহারাজ, একরকম প্রস্তুত, কিন্তু—

 রাজা। কিন্তু! কিন্তু আবার কিসের। আমাদের শারদউৎসবের ভিতরেও কিন্তু এসে পড়ে! এ তো রাষ্ট্রনীতি নয়।

 মন্ত্রী। উৎসবের আয়োজনের মধ্যে একটি কবি আছেন যে, কাজেই কিন্তুর অভাব হয় না।

 রাজা। আমাদের কবিশেখরের কথা বলছ? তা তাঁর উপরে তো ভার ছিল উৎসব উপলক্ষে একটা যাত্রার পালা তৈরি করবার জন্যে।

 মন্ত্রী। আপনি তো তাঁকে জানেন, সুবিধা-অসুবিধা, স্থানকাল-পাত্র এ-সবের দিকে তাঁর একেবারেই দৃষ্টি নেই। তিনি আপন খেয়ালমতোই চলেন।

 রাজা। তা হয়েছে কী। লোকটা পালিয়েছে নাকি?

 মন্ত্রী। একরকম পালানোই বইকি। সভাপণ্ডিত-মশায় ঠিক করে দিয়েছিলেন, এবারকার উৎসবের জন্যে শুম্ভ-নিশুম্ভ-বধের পালা তৈরি করে দিতে হবে। এ কথা হয়েছিল সেই মহাদ্বাদশীর দিনে। কাল শুনি কবি সে পালা তৈরিই করে নি।

 রাজা। কী সর্বনাশ। এ মানুষকে নিয়ে দেখছি আর চলল না। সখা, তুমি কেনারাম পাঁচালিওয়ালার উপর ভার দিলে না কেন— তা হলে তো এ বিভ্রাট ঘটত না। পুরবাসীরা সবাই এসে জুটেছেন, এখন উপায়?

 মন্ত্রী। কবি বলছেন, তিনি তাঁর মনের মতো ছোটো একটা পালা লিখেছেন।

 রাজা। তাতে আছে কী।

 মন্ত্রী। তা তো বলতে পারি নে। সংক্ষেপে যা বর্ণনা করলেন তাতে ভাবটা কিছুই বুঝতে পারলেম না। বললেন যে, সেটা গানেতে গন্ধেতে রঙেতে রসেতে মিশিয়ে একটা কিছুই-না গোছের জিনিস।

 রাজা। কিছুই-না গোছের জিনিস! এ কি পরিহাস, না কি?

 মন্ত্রী। শুধু পরিহাস নয়, মহারাজ, এ দুর্দৈব।

 রাজা। তাতে গল্প কিছু আছে?

 মন্ত্রী। নেই বললেই হয়!

 রাজা। যুদ্ধ?

 মন্ত্রী। না।

 রাজা। কোনোরকমের রক্তপাত?

 মন্ত্রী। না।

 রাজা। আত্মহত্যা? পতন ও মূর্ছা

 মন্ত্রী। একেবারেই না।

 রাজা। আদিরস? বীররস? করুণরস?

 মন্ত্রী। না, কোনোটাই না। কবি বলেন, তিনি যা রচনা করেছেন তা শরৎকালের উপযোগী খুব হালকা রকমের ব্যাপার। তার মধ্যে ভার একটুও নেই।

 রাজা। তাকে শরৎকালের উপযোগী বলবার মানে কী হল?

 মন্ত্রী। কবি বলেন, শরৎকালের মেঘ যে হালকা, তার কোনো প্রয়োজন নেই, তার জলভার নেই, সে নিঃসম্বল সন্ন্যাসী।

 রাজা। এ কথা সত্য বটে।

 মন্ত্রী। কবি বলেন, শরৎকালের শিউলিফুলের মধ্যে যেন কোনো আসক্তি নেই, যেমন সে ফোটে তেমনি সে ঝরে পড়ে।

 রাজা। এ কথা মানতে হয়।

 মন্ত্রী। কবি বলেন, শরৎকালের কাশের স্তবক না বাগানের না বনের; সে হেলাফেলার মাঠে ঘাটে নিজের অকিঞ্চনতার ঐশ্বর্য বিস্তার করে বেড়াচ্ছে। সে সন্ন্যাসী।

 রাজা। এ কথা কবি বেশ বলেছে।

 মন্ত্রী। কবি বলেন, শরতের কাঁচাধানের যে খেত দেখি, কেবল আছে তার রঙ, কেবল আছে তার দোলা। আর কোনো দায় যদি তার থাকে সে কথা সে একেবারে লুকিয়েছে।

 রাজা। ঠিক কথা।

 মন্ত্রী। তাই কবি বলেন, তাঁর শারদোৎসবের যে পালা সে ওইরকমই হালকা, ওইরকমই নিরর্থক। সে-পালায় কাজের কথা নেই, সে-পালায় আছে ছুটির খুশি।

 রাজা। বাঃ, এ তো মন্দ শোনাচ্ছে না। ওর মধ্যে রাজা কেউ আছে?

 মন্ত্রী। একজন আছেন। কিন্তু তিনি কিছুদিনের জন্যে রাজত্ব থেকে ছুটি নিয়ে সন্ন্যাসীবেশে মাঠে ঘাটে বিনা কাজে দিন কাটিয়ে বেড়াচ্ছেন।

 রাজা। বাঃ বাঃ, শুনে লোভ হয় যে! আর কে আছে?

 মন্ত্রী। আর আছে সব ছেলের দল।

 রাজা। ছেলের দল? তাদের নিয়ে কী হবে?

 মন্ত্রী। কবি বলেন, ওই ছেলেদের প্রাণের মধ্যেই তো আসল ছুটির চেহারা। তারা কাঁচাধানের খেতের মতোই নিজে না জেনে, কাউকে না জানিয়ে ছুটির ভিতরেই, ফসলের আয়োজন করছে।

 রাজা। তা ওই ছেলের দলকে ভালো করে শেখানো হয়েছে?

 মন্ত্রী। একেবারেই না।

 রাজা। কী সর্বনাশ! তা হলে—

 মন্ত্রী। কবি বলেন, বুড়োরা ছেলেদের যদি শেখাতে যায়, তা হলে তো ছেলেরা পেকে যাবে— ছেলেই থাকবে না। সেইজন্যে ওদের নাট্য শেখানোই হয় নি। কবি বলেন, সহজে খুশি হবার বিদ্যে ওদের কাছ থেকে আমরাই শিখব।

 রাজা। কিন্তু মন্ত্রী, সহজে খুশি হবার বিদ্যা তো পুরবাসীদের বিদ্যা নয়। এই-সব হালকা, এই-সব কাঁচা, এই-সব না-শেখা ব্যাপারের মূল্য কি তাঁদের কাছে আছে?

 মন্ত্রী। সে কথা আমি কবিকে জিজ্ঞাসা করেছিলুম—তিনি বললেন, ওজন যার কিছু নেই তার আবার মূল্য কিসের? হেমস্তের পাকা ধানেরই মূল্য আছে, ভাদ্রের কাঁচা খেতের আবার মূল্য কী। একটুখানি হাসি, একটুখানি খুশি, এই হলেই দেনাপাওনা চুকে যাবে।

 রাজা। আচ্ছা বেশ, শুম্ভ-নিশুম্ভ তা হলে এখন থাক্‌— আসুক ছেলের দল, আসুক সন্ন্যাসীবেশে রাজা। তা হলে কবিকে একবার ডেকে দাও-না, তার সঙ্গে একবার কথা কয়ে নিই।

 মন্ত্রী। তাঁকে ডাকব কী মহারাজ, তিনি নিজেই যে এই পালায় সাজছেন।

 রাজা। বল কী, তার শিক্ষা হল কোথায়?

 মন্ত্রী। তার শিক্ষা হয়ই নি।

 রাজা। তবে? সে কি হাত-পা নেড়ে গলা ছেড়ে দিয়ে আসর জমাতে পারবে? সে যে আনাড়ি।

 মন্ত্রী। পাছে যারা হাত-পা নাড়তে শিক্ষা পেয়েছে তাদের ডাকা হয় এই ভয়েই সে নিজেই সন্ন্যাসী সাজবার ভার নিয়েছে। সে বলে, পালার বিষয়টা যেমন অনর্থক পালার নটের দলও তেমনি অশিক্ষিত।

 রাজা। তা, এ নিয়ে এখন পরিতাপ করে কোনো লাভ নেই। তা হলে আরম্ভ করে দাও। একটা সুবিধে এই যে বেশি কিছু আশা করব না সুতরাং বেশি কিছু নৈরাশ্যের আশঙ্কা থাকবে না। গোড়ায় একটা গান হবে তো?

 মন্ত্রী। হবে বইকি। এই যে গানের দল আপনার পাশেই বসে।

শান্তিনিকেতনে শারদোৎসবের প্রথম অভিনয় (১৩১৫) উপলক্ষে কবি এই নাটকের জন্য একটি নান্দী রচনা করিয়াছিলেন (ভারতী, কার্তিক ১৩১৫)। উহা গ্রন্থে মুদ্রিত হয় নাই, নীচে সেটি উদ্ধৃত হইল:

শরতে হেমস্তে শীতে বসন্তে নিদাঘে বরষায়
অনন্ত সৌন্দর্যধারে ধাহার আনন্দ বহি যায়
সেই অপরূপ, সেই অরূপ, রূপের নিকেতন
নব নব ঋতুরসে ভরে দিন সবাকার মন।

প্রফুল্ল শেফালিকুঞ্জ যাঁর পায়ে ঢালিছে অঞ্জলি,
কাশের মঞ্জরীরাশি যাঁর পানে উঠিছে চঞ্চলি’,
স্বর্ণদীপ্তি আশ্বিনের স্নিগ্ধ হাস্তে সেই রসময়
নির্মল শারদরূপে কেড়ে নিন সবার হৃদয়।

 শারদোৎসব নানা স্থানে পরিবর্তিত ও পরিবর্ধিত হইয়া, নূতন ভূমিকা ও চরিত্র সংবলিত হইয়া “ঋণশোধ” নাটক (১৯২১) প্রকাশিত হয়।