বিষয়বস্তুতে চলুন

শিক্‌ওয়া ও জবাব-ই-শিক্‌ওয়া

উইকিসংকলন থেকে

শিক্‌ওয়া ও জবাব-ই-শিক্‌ওয়া
গোলাম মোস্তফা অনূদিত

শিক্‌ওয়া

জবাব-ই-শিক্‌ওয়া

মূল : আল্লামা ইকবাল

অনুবাদ : গোলাম মোস্তফা

কর্ডোভা লাইব্রেরী, ৪৬ নং জিন্দাবাহার ফার্ষ্ট লেন, ঢাকা হইতে

বেগম মাহফুজা খাতুন কর্তৃক প্রকাশিত


প্রথম মুদ্রণ

অক্টোবর, ১৯৬০


মূল্য: দুইটাকা


ইডেন প্রেস, ৪২/এ, হাটখোলা রোড, ঢাকা হইতে

আলিমুর রহমান খান কর্তৃক মুদ্রিত

ভূমিকা

[ ডক্টর জাবিদ ইকবাল, এম-এ, পি-এইচ্-ডি ]

 ১৯১১ খৃষ্টাব্দের এপ্রিল মাসে লাহোর ইসলামিয়া কলেজে আঞ্জুমান-ই-হিমায়েৎ-ই-ইসলামের বার্ষিক অধিবেশনে কবি ইকবাল সর্বপ্রথম ‘শিকওয়া’ কবিতা পাঠ করেন। কবির পিতা সেই সভায় উপস্থিত ছিলেন। ‘শিকওয়া’ কবিতা শ্রবণে অন্যান্য সকলের ন্যায় তিনিও অতিমাত্রায় অভিভূত হইয়া পড়েন। ইহার কয়েক মাস পরেই এই কবিতার অপরাংশ ‘জবাব-ই-শিকওয়া’ রচিত হয়। লাহোরে মোচি গেটের সন্নিকটে প্রশস্ত ময়দানে অনুষ্ঠিত এক বিরাট জনসভায় কবি এই কবিতা আবৃত্তি করেন। কবিতা দুইটির তাৎপর্য সম্যক বুঝিতে হইলে ইহাদের পশ্চাতে যে ঐতিহাসিক পটভূমি রহিয়াছে, তাহার প্রতি দৃষ্টি রাখিতে হইবে। ২২ বৎসর বয়সে ইকবাল শিয়ালকোট ছাড়িয়া পড়াশুনার জন্য লাহোরে আসেন। অনভূতি-প্রবণ অন্যান্য তরুণদের মত তিনিও বহির্জগতের পরিস্থিতি দেখিয়া মনে মনে হতাশ হইতেছিলেন। মুসলিম-জগতের শোচনীয় অধঃপতনের কথা তাঁহার অজানা ছিল না।

 তুর্কী-সাম্রাজ্য তখন নামে মাত্র ইসলামিক রাষ্ট্র ছিল। পূর্ব-ইউরোপ হইতে ইসলাম ধীরে ধীরে নির্বাসিত হইতেছিল। দক্ষিণ-রাশিয়ার মুসলিম রাষ্ট্রগুলি একে একে রুশ-সম্রাট গ্রাস করিতেছিলেন। চীনের মুসলমানেরাও নিজেদের রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা হারাইয়া হতাশ হইয়া পড়িয়াছিল। বৃটিশ মিসর দেশ করায়ত্ত্ব করিয়া রাখিয়াছিল। ফ্রান্স মোরক্ক দখল করিবার মতলবে ছিল। ইরান মুমূর্ষ অবস্থায় দিন কাটাইতেছিল। ওলন্দাজদিগের উৎপীড়নে ইন্দোনেশিয়ার মুসলমানেরাও মাথা তুলিতে পারিতেছিল না। ১৮৫৭ সালের সিপাই-বিপ্লবের পর হইতে পাক-ভারতীয় মুসলমানদের ভাগ্যেও দুর্দিন নামিয়া আসিয়াছিল।

 এই ব্যাপক পরাজয় এবং নিঃসহায় অবস্থার মধ্যে পাক-ভারতীয় মুসলমানদের আশা-ভরসার উৎস-মূল ছিল অটোম্যান সাম্রাজ্য। তুর্কীরাই তখন কিয়ৎ পরিমাণে নিজেদের স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ রাখিতে পারিয়াছিল। কিন্তু পাশ্চাত্য শক্তিপুঞ্জের লোলুপ দৃষ্টি সেখানেও গিয়া পড়িল; মুসলমানদের এই শেষ স্বাধীন রাষ্ট্রকেও তাহারা গ্রাস করিতে উদ্যত হইল। বৃটিশেরা তুর্কীর বিরুদ্ধে গ্রীকদিগকে লেলাইয়া দিল। ইহাতে পাক-ভারতীয় মুসলমানেরা বৃটিশরাজের উপর অত্যন্ত কূপিত হইয়া উঠিল।

 স্যর সৈয়দ আহমদ তখন অস্তগামী সূর্যের মত ম্লান। ১৮৫৭ খৃষ্টাব্দের সিপাই বিপ্লবের কঠোর বাস্তবতা তখনও তিনি ভুলিতে পারেন নাই। তিনি মনে মনে এই আশঙ্কা করিলেন যে, তুর্কীর প্রতি সহানুভূতি দেখাইয়া বৃটিশকে চটাইয়া দিলে পাক-ভারতীয় মুসলমানেরাও বৃটিশের অনুগ্রহ হইতে বঞ্চিত হইবে। ফলে এত কষ্ট করিয়া তিনি বৃটিশের সহিত ভারতীয় মুসলমানদের মিতালির যে সৌধ রচনা করিয়াছেন, তাহা ধূলায় বিলুণ্ঠিত হইবে। কাজেই তিনি পাক-ভারতীয় মুসলমানদিগকে মুসলিমজাহানের রাজনীতিতে কোনরূপ সক্রিয় অংশ গ্রহণ না করিবার উপদেশ দিলেন।

 ১৮৮২ খৃষ্টাব্দে বৃটিশ যখন জামালুদ্দীন আফগানীকে মিসর হইতে নির্বাসিত করিয়া পাক-ভারতে আটক রাখিল, তখন স্যর সৈয়দ আহমদ ও তাঁহার ভক্তবৃন্দ জামালুদ্দীন আফগানীকে একই কারণে কোনরূপ সাহায্য করিলেন না। জামালুদ্দীন আফগানী মুসলিম জাহানে ঐক্য-আন্দোলন চালাইতেছিলেন। তাঁহার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, জগদ্ব্যাব্যাপী মুসলমান জাতির এই পতন রোধ করিতে হইলে সকল মুসলমানকে এক হইয়া দাঁড়াইতে হইবে, অন্যথায় ইউরোপের বিশ্বগ্রাসী সাম্রাজ্যবাদের কবল হইতে মুসলমানদিগকে রক্ষা করা যাইবে না। ইসলামের এই অগ্নিপুরুষ শুধু মুখে মুখেই ঐকোর বাণী প্রচার করেন নাই; কার্যতঃও তিনি বিভিন্ন দেশে মুক্তি-আন্দোলন দাঁড় করাইয়াছিলেন। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল—এই পথেই মুসলিম-জাহানের আযাদী আসিবে।

 স্যর সৈয়দের উপদেশ সত্ত্বেও পাক-ভারতে কিন্তু একদল মুক্তি-পিয়াসী মুসলিম তরুণ জামালুদ্দীনের বলিষ্ঠ ভাবধারায় অনুপ্রাণিত হইয়া উঠিলেন। এই তরুণ দলেরই পরোভাগে ছিলেন মহম্মদ ইকবাল।

 ১৮৮৯ হইতে ১৯০৪ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত ইকবাল-কাব্যে ধ্বনিত হইয়াছে ব্যর্থতার সুরে। ‘তসবীর-ই-দর্‌দ্‌’ (ব্যথার চিত্র), ‘নালা-ই-এতিম’ (এতিমের ক্রন্দন) ‘ফরিয়াদ্ বহুযুরে সারওয়ার-ই-কায়েনাৎ’ (আঁ-হযরতের নিকট ফরিয়াদ) ইত্যাদি কবিতাগুলি এই সময়ের রচনা। নিরাশার একটা করুণ সুর তখন যেন মুসলিম-ভারতের আকাশ-বাতাসকে আচ্ছন্ন করিয়া রাখিয়াছিল।

 ১৯০৫ হইতে ১৯০৮ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত ইকবাল ছিলেন ইউরোপে। যখন তিনি দেশে ফিরিলেন, তখন তিনি পরিষ্কার বুঝিতে পারিলেন—ঐক্য ও সংহতি ছাড়া মুসলমানদিগের বাঁচিবার আর কোন আশা নাই। ইকবাল এইবার বলিষ্ঠ কণ্ঠে তাঁর জাতিকে আহ্বান করিলেন। তখন বলকান হইতে মুসলমান বিতাড়িত হইয়াছে। ইরাণ মরণাপন্ন। ত্রিপলী মুসলিম-শোণিতে অনুরঞ্জিত। এই সময়ে ইকবাল-কাব্যে ধ্বনিত হইল অগ্নিসুর—যার স্পর্শে মুসলিম-মনে লাগিল প্রচণ্ড দোলা। এই পরিবেশের মধ্যেই তিনি রচনা করিলেন ‘শিকওয়া’, ‘জবাব-ই-শিকওয়া’ আর ‘তারাবালুস্ কি শহীদুঁ কা লহু’ (ত্রিপলীর বীরশহীদানের রক্ত)।

 কবি গোলাম মোস্তফা ইকবালের সেই ‘শিকওয়া’ ও ‘জবাব-ইশিকওয়া’কে বাংলা ভাষায় অনুবাদ করিতেছেন জানিয়া অত্যন্ত আনন্দিত হইলাম। ইতিপূর্বে ইকবালের বিভিন্ন কবিতার অনুবাদ করিয়া তিনি যশস্বী হইয়াছেন। তিনি নিজেই বলিয়াছেন: মূলের ভাব ও প্রেরণা বজায় রাখিয়া দ্বিতীয় সৃষ্টি (second creation) করিতে না পারিলে অনবাদ সার্থক হয়না। আমার দৃঢ় বিশ্বাস—কবি গোলাম মোস্তফার অনুবাদে সে বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান থাকিবে এবং তাঁর অনুবাদ পাঠক-পাঠিকার অন্তর স্পর্শ করিবে।

 —(অনুবাদ)

৩, আল্লামা ইকবাল রোড

লাহোর

জুলাই ৩, ১৯৬০

পরিচয়

 মহাকবি ইকবালের কাব্য-দিগন্তে ‘শিক্ওয়া’ ও ‘জবাব-ই-শিকওয়া’ দুই উজ্জ্বল নক্ষত্র। কবিতা দুইটির প্রেরণা ও পরিকল্পনা অদ্ভুত সন্দের। এমন কালজয়ী ও রসোত্তীর্ণ মৌলিক কাব্য-সৃষ্টি এ যুগে অত্যন্ত বিরল।

 ‘শিকওয়া’র বিষয়বস্তু মূলতঃ অধঃপতিত মুসলিম জাতির জন্য আল্লার দরগায় মুনাজাত। কিন্তু অভিমানী কবি অন্য সকলের মত অশ্রুসিক্ত নয়নে আল্লার নিকট করুণা ‘ভিক্ষা’ করেন নাই; তিনি করিয়াছেন করুণার ‘দাবী’। আল্লার কোর্টে আল্লার বিরুদ্ধেই তিনি নালিশ আনিয়াছেন! কেন তুমি করুণা করিবেনা? কেন তোমার দান হইতে আমরা বঞ্চিত হইব? আমরা তোমার জন্য এত করিলাম, তার প্রতিদান কি এই লাঞ্ছনা—এই অনাদর—এই অপমান? তোমাকে আগে কে চিনিত? কে মানিত? আমরাই ত তোমার নাম সারা জগতে প্রচার করিয়াছি! তোমার তৌহীদের ঝাণ্ডা আমরাই ত যুগে যুগে বহন করিয়া ফিরিতেছি। তোমার প্রেমে আমরা ঘর ছাড়িয়াছি, দেশ ছাড়িয়াছি, আগুনে পুড়িয়াছি, সাগরে ঝাঁপ দিয়াছি! এত করিয়াও তার পরিণাম-ফল এই!— এমনই অভিনব বিপ্লবী ভঙ্গীতে কবি তাঁহার ফরিয়াদ পেশ করিয়াছেন। কবিতাটি কিরূপ জোরালো এবং বাচন-ভঙ্গী কিরূপ তীক্ষ্ণ, দুই একটি নমুনা দেখিলেই পাঠক তাহা বুঝিতে পারিবেন:

দৃষ্টান্ত

“ক্ষতিই কেন সইব বল? লাভের আশা রাখব না?
অতীত নিয়েই থাকব বসে? ভবিষ্যৎ কি ভাবব না?
চুপটি করে বোবার মতন শুনব কি গান বুলবুলির?
ফুল কি আমি? ফুলের মতই রইব নীরব-নম্রশির?
কণ্ঠে আমার অগ্নিবাণী! সেই সাহসেই আজকে ভাই
খোদার নামে করব নালিশ! মুখে আমার পড়ুক ছাই!”

 তারপর কবি এক এক করিয়া তাঁহার দাবীর স্বপক্ষে যুক্তি-প্রমাণ দিয়াছেন। সেই সব যুক্তি-প্রমাণ কাব্য-রসে সিক্ত হইয়া এক এক স্থানে পরম উপভোগ্য হইয়া উঠিয়াছে:

“অজুদ তোমার মজুদ ছিল আযল্‌ থেকেই সে নিশ্চয়
কিন্তু ছিলে সমীর-হারা গুলবাগে ফুল যেমন রয়!
ইন্‌সাফেরই দোহাই দিয়ে শুধুই তোমায়—কও আমায়
খুশ্-বু তোমার ছড়াত কে না এলে এই প্রভাত-বায়?”

* * *

“বলতে পার: এই দুনিয়ায় নিত কি কেউ তোমার নাম?
মুসলমানের বাজুর জোরেই করলে হাসিল সেই সে কাম!”

* * *
“রত্ন-মাণিক হতই যদি মোদের কাছে খুব দামী,

বুৎ না বেচে বুৎ-শিকানির নিলাম কেন বদনামী?”

* * *
“তোমার সভায় কথা বলার নাইক যাদের যোগ্যতাই

পাচ্ছে তারাও ধন-দৌলৎ! বেশ ত! তাতেও দুঃখ নাই!
কিন্তু একী! কাফিররা পায় এই ধরাতেই ‘হর-কসুর’
মসলমানের বেলায় শুধুই ওয়াদা হরের—স্বর্গপুর!”

 এমনি ফরিয়াদে ‘শিক্‌ওয়ার’ আগাগোড়া ভরপুর!

 “জবাব-ই-শিক্‌ওয়াও” তুল্যরূপে অদ্ভুত সন্দর ও প্রাণস্পর্শী। এই কবিতায় আল্লাহ্ কবির ‘শিক্‌ওয়া’র জবাব দিয়াছেন। মুসলমানদিগকে কেন পূর্বের ন্যায় এখন আর করুণা করা হয় না, তাহার নানা কারণ ও যুক্তি দেখাইয়া আল্লাহ্‌ আত্মপক্ষ সমর্থন করিয়াছেন। মুসলমানদিগের অধঃপতনের যে-সব কারণ তিনি নির্দেশ করিয়াছেন, সেগুলি গভীর ভাবে সত্য। মুসলমানদিগের জাতীয় চরিত্রের এ যেন একখানি নিখুঁৎ আলেখ্য! এই কবিতাতেও কাব্য-সম্পদ প্রচুর। কবির ফরিয়াদ যখন আকাশে উঠিতেছে, তখনকার চিত্র চমৎকার!

“আকাশ-বুড়ো সে চমকিয়া কয়: কার কথা শুনি এইখানে?
তারারা কহিল: তাই ত! দেখত উপর-তলার আসমানে।
চাঁদ কহে: হাঁ! হাঁ! মাটির মানুষ হবেই এ ঠিক! তারি এ স্বর!
কয় ছায়াপথ: আমাদেরই মাঝে লূকালো কি সেই ধূর্ত নর!
রিদওয়ানই শুধু চিনিল আমারে আমার করুণ কান্নাতে
দেখেছিল সে যে আমারে সেদিন—ছাড়িনু যেদিন জান্নাতে!

 এমনই ভাবে কবির ফরিয়াদ যখন আল্লার আরশে গিয়া উপস্থিত হইল, তখন আল্লাহ্‌ কথা বলিতে বাধ্য হইলেন। তিনি এক এক করিয়া ‘শিকওয়ার’ জবাব দিলেন। সে জবাবের ধরণ এইরূপ:

“দান-ভাণ্ডার খোলাই ত মোর, সে-দান নেবার সায়েল কই?
কারে আমি বল পথ দেখাইব, পথ-চলা সেই পথিক বই?”

* * *
“বুৎ-ভাঙা দল বিদায় নিয়েছে, বাকী যারা তারা গড়িছে বুৎ

ইব্রাহিমের ছেলেরা এখন ‘আযর’ সেজেছে—কী অদ্ভুত!”

* * *

“কী বলিলে তুমি? মুসলমানের ‘হুর’-—সে শুধুই ‘ওয়াদা’ সার?
কান্না যতই করুণ হোক না—থাকা চাই কিছু যুক্তি তার!
শাশ্বত মোর আইন-কাননে, শাশ্বত মোর নীতি-বিধান
কাফির যখন মুসলিম হয়—সেও পাবে হুর এক-সমান!
তোমাদের মাঝে কারা বল চায় সত্যিকারের ‘হুর-কসর’?
মুসাই ত নাই! ‘তুর’ পাহাড়ে ত তেমনি করিয়া জ্বলিছে নূর!”

 এই ধরণের বহু যুক্তি দেখানোর পর আল্লাহ কবিকে এই বলিয়া আশ্বাস দিতেছেন:

“জ্ঞান হোক্, তব বর্ম, প্রেমের তলোয়ার লও হস্তে ফের
ওরে বেখেয়াল! জানোনা কি—তুমি খলিফা আমার মাখ্‌লূকের?
অগ্নিবাণী সে তক্‌বীর তব, উজল করিবে সারা জাহান
মুসলিম হলে ‘তদ্‌বীরই’ তব হইবে ‘তক্‌দীরের’ সমান।
মুহম্মদেরে ভালোবাসো যদি, ভালোবাসা পাবে তবে আমার
‘লউহ-কলম’ লভিবে তোমরা—মাটির পৃথিবী সে কোন ছার!”

 এমনই কাব্য-ভঙ্গীতে সওয়াল-জবাব শেষ হইয়াছে। বলা বাহুল্য, প্রার্থনার এই আঙ্গিক সম্পূর্ণ অভিনব এবং হৃদয়গ্রাহী।

বিদ্রোহের সুর?

 আপাতঃ দৃষ্টিতে মনে হইবে: ‘শিক্‌ওয়া’য় বিদ্রোহের সুর বিদ্যমান। কবি এমন অনেক কথা বলিয়াছেন যাহা সাধারণ বিচারে ধর্মদ্রোহিতা বা খোদাদ্রোহিতার পর্যায়ে পড়ে। ‘শিক্‌ওয়া’ কবিতা প্রকাশিত হইলে ধর্মনিষ্ঠ অনেক মুসলমান কবির প্রতি অত্যন্ত রুষ্ট হইয়া উঠেন। শোনা যায়, কেহ কেহ কবিকে ‘কাফির’ ফতোয়া দিতেও কুণ্ঠিত হন নাই। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কবি আল্লার বিরুদ্ধে কোনই বিদ্রোহের বাণী শুনান নাই। এ বিদ্রোহ আসলে “বিদ্রোহ” নয়—গভীর খোদা-প্রেম ও প্রজ্বলন্ত ঈমান হইতে এ বিদ্রোহ উৎসারিত। ইহাকে তাই ‘বিদ্রোহ’ না বলিয়া ‘অভিমান’ বলাই সঙ্গত। সাধারণ লোকে এ সত্য সহজে উপলব্ধি করিতে পারে নাই। ‘শিক্ওয়া’র প্রতিক্রিয়া দেখিয়া কবি যখন “জবাব-ই-শিক্‌ওয়া” লিখিলেন, তখন লোকে জানিতে পারিল ‘শিক্‌ওয়া’র সাচ্চা পরিচয়। “জবাব-ই-শিক্‌ওয়ায়” কবি আল্লার মুখে দিয়া তাই ঠিকই বলাইয়াছেন:

“‘শিক্‌ওয়া’ এ নয়—প্রশস্তি মোর—এমন বাচন-ভঙ্গী তার
মানুষ এবং খোদার মাঝারে রচিয়াছ সেতু চমৎকার!”

 সত্যি, আল্লার সাথে মানষের যোগস্থাপনার এ এক অভিনব পন্থা!

কাব্যের আলোকে

 অনেকের মনে অহেতুক একটা ধারণা বদ্ধমূল হইয়া আছে যে, ইকবাল যত বড় দার্শনিক, তত বড় কবি নহেন। দার্শনিক হওয়াতেই তাঁর কবি-প্রতিভা নাকি ম্লান হইয়া গিয়াছে। কিন্তু এ ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। দার্শনিক হইলে কবি না হইতে পারে, কিন্তু কবি অনায়াসে দার্শনিক হইতে পারে। বরং এ কথাই সত্য যে, যে-কবি দার্শনিক নয়, সে-কবি কোন বড় কবি নয়। কাজেই, ইকবাল যদি দার্শনিক কবিই হইয়া থাকেন, তবে সে তাঁহার দোষ নহে,—গুণ। আলোচ্য “শিক্‌ওয়া” ও “জবাব-ই-শিক্‌ওয়া” কবিতা হইতেই প্রমাণিত হইবে: দর্শনের পটভূমিকায় কাব্য কত গভীর, মর্মস্পর্শী ও মনোরম হইতে পারে।

 ইকবাল সন্বন্ধে আর একটি অভিযোগ শোনা যায়: তাঁর সমস্ত চিন্তা ও অনভূতি ইসলাম ও মুসলমান জাতিকে আশ্রয় করিয়া আছে; কাজেই তাঁর কাব্যে বৃহত্তর মানবতার (humanism) আবেদন নাই। এ অভিযোগও সম্পূর্ণ অলীক ও উদ্ভট। রস ও সৌন্দর্যের ক্ষেত্রে মুসলিম-অমুসলিমের কোন প্রশ্ন নাই। কাব্যে, সাহিত্যে বা শিল্পে ব্যক্তি বড় কথা নয়। ব্যক্তি এখানে নৈর্ব্যক্তিক হয়, বিশেষ এখানে নির্বিশেষ হয়; আত্মসত্যই বিশ্বসত্যে রূপান্তরিত হয়। কাজেই, ইসলাম সম্বন্ধে বা মুসলমান জাতি সম্বন্ধে কিছু বলিলেও তাহা জীবন, জগৎ এবং মানবতা সম্বন্ধেই বলা হয়। বিদগ্ধ জনেরা জানেন, ইকবালের মূল কাব্য-প্রেরণা আসিয়াছে কুরআন হইতে। কুরআন কোন অলীক বা সাম্প্রদায়িক ধর্মগ্রন্থ নয়। গোটা মানব জাতির কল্যাণ ও পথপ্রদর্শনের জন্যই কুরআন শরীফের অবতারণা। মানুষের নৈতিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, পারিবারিক, সামাজিক ও আন্তর্জাতিক জীবনকে সুষ্ঠুভাবে গঠন ও পরিচালন করাই কুরআন শরীফের মূল লক্ষ্য। একমাত্র কুরআনই শুনাইয়াছে বিশুদ্ধ মানবতার কথা, অনন্ত জীবনের কথা,—মানুষের অন্তহীন শক্তি ও সম্ভাবনার কথা। বস্তুতঃ কুরআনই হইতেছে একমাত্র বিশ্বগ্রন্থ—যাহার মধ্যে জাতিবর্ণ নির্বিশেষে বিশ্বের সকল মানুষ সত্য, সুন্দর ও কল্যাণের পথ খুঁজিয়া পাইতে পারে। ইকবাল যদি সেই চিরন্তন মানবতার উৎস-মুখ হইতেই প্রেরণা লইয়া কাব্য রচনা করিয়া থাকেন, তবে অন্যায় কিছু করিয়াছেন। কি? কুরআন যদি ‘ইসলামী’ হইয়াও বিশ্বজনীন হইতে পারে, তবে ইকবালকাব্যও বিশ্ব-মানষের কাব্য হইতে পারে। মুসলমান বা ইসলামের প্রসঙ্গ আছে বলিয়াই তাঁর কাব্য মানব-গণ্ডীর বাহিরে চলিয়া যায় নাই। এ কথা তাই নিঃসন্দেহে বলা যায়: কবির সৃষ্টিতে দোষ নাই, দোষ আছে পাঠকের দৃষ্টিতে!

 আমাদের মধ্যে একটা জঘন্য হীনমন্যতা আছে। আল্-কুরআন হইতে আমাদের কবি-সাহিত্যিকেরা কোন উপকরণ বা প্রেরণা লইতে চান না। অথচ অমুসলমানেরা অনায়াসে তাহার মধ্যে প্রেরণা খুঁজিয়া পায়। মহাকবি গ্যেটে এই কুরআন সম্বন্ধেই বলিয়াছেন:

 “You see, this teaching (of the Holy Quran) never fails; with all our systems we cannot go and generally speaking, no man can go, farther than that.”

 শুধু তাই নয়, গ্যেটে “প্রতীচ্য-প্রাচ্য দিওয়ান” (West-Eastern Divan) নামক কাব্য-গ্রন্থ লিখিয়াও যশস্বী হইয়াছেন। তাহাতে আল্লাহ, মুহম্মদ, ফিরিশতা, হুর ইত্যাদির বিবরণ আছে। মহাকবি দ্যান্তে (Dante) তাঁর “ডিভাইন কমেডি”র প্রেরণা লাভ করেন কুরআন হইতে। কবি Ezra Pound কুরআন শরীফের সুরা “আল-আরাফ”-এর ছায়া অবলম্বনে “Al Araaf” কবিতা লিখিয়া সুনাম অর্জন করিয়া গিয়াছেন। আল্লার ৯৯টি নামের উপরে ৯৯টি কবিতা সম্বলিত সুন্দর গ্রন্থ “পারল্‌স্ অফ ফেথ” (Pearls of Faith)-এর রচয়িতা হইতেছেন খ্যাতনামা ইংরাজ মনীষী Sir Edwin Arnold. এরূপে বহু দৃষ্টান্ত দেওয়া যায়। সা’দী, হাফিজ, রুমী, ওমর খৈয়াম—ইঁহারাও ত ইসলামী আঙ্গিকে ইসলামী উপাদান লইয়া কাব্যসৃষ্টি করিয়া গিয়াছেন। সেগুলি কি বিশ্বসাহিত্য হয় নাই? তাহাদের মধ্যে কি মানবীয় আবেদন নাই?

 ধর্ম ও ঐতিহ্য-ভিত্তিক হইলেই যদি কাব্য মারা যায়, তবে এ যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি T.S. Elliot-কে কী বলা যাইবে? তিনি ত ধর্মে একজন গোঁড়া রোমান ক্যাথলিক! তাঁর প্রায় সমস্ত কবিতাই ত ঐতিহ্যবাহী।

 রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধেই বা কী বলা যাইবে? তাঁর সমস্ত কাব্য ও দর্শনের উৎসমূখ হইতেছে উপনিষৎ। হিন্দুর রামায়ণ, মহাভারত, বেদ, পুরাণ ও ইতিহাস হইতেই তিনি তাঁর কাব্যের উপকরণ সংগ্রহ করিয়াছেন। রাম, লক্ষ্মণ, সীতা, যুধিষ্ঠির, দ্রৌপদী, অহল্যা, উর্বশী, মেনকা, শিবাজী―সমস্তই ত সাম্প্রদায়িক। অথচ ‘উর্বশী’ বিশ্ব-সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কাব্য। হোমার, ভার্জিল, কালিদাস, হাফিজ, রুমী, ওমর খৈয়াম, শেক্‌স্‌পিয়ার প্রত্যেকের সম্বন্ধেই এ কথা সত্য। প্রত্যেকেই অল্প-বিস্তর সাম্প্রদায়িক; অথচ এঁদের সাহিত্যই বিশ্ব-সাহিত্য।

 বস্তুতঃ জগতের কোন কবি, কোন শিল্পীই এই চিরন্তন রীতি ও নীতির ব্যতিক্রম নহেন। প্রত্যেক শিল্পীই আপন মনের মাধুরী মিশাইয়াই তাঁর শিল্পকে রচনা করেন। আবেষ্টনকে অস্বীকার করিয়া কোন শিল্পসৃষ্টিই সম্ভব নয়। শিল্পের পূর্ণ-বিকাশের পথে আবেষ্টন বা গণ্ডীসংকীর্ণতা কোন বাধাও সৃষ্টি করে না। একটা ‘এটম’-ই সমগ্র জগতের প্রতিনিধিত্ব করে। গোষ্পদের বুকেই আকাশের চন্দ্র-সূর্য প্রতিবিম্বিত হয়। ‘ম্যাডোনা’র মাতৃমূর্তি বা ‘মনালিসা’র স্নিগ্ধ হাসি খৃষ্টানী গণ্ডী অতিক্রম করিয়া আজ তাই বিশ্বের সম্পদ হইতে পারিয়াছে।

 অতএব এই সিদ্ধান্তে আমরা উপনীত হইতেছি যে, ইকবাল-কাব্যে ইসলামী রূপ ও রস বিদ্যমান থাকিলেও তাহা মানবীয় উপাদানে পূর্ণ এবং বিশ্ব-সাহিত্যের লক্ষণাক্রান্ত। ইসলামী রূপ-সজ্জায় কাব্য কত সুন্দর হইতে পারে, তাহার প্রমাণ স্বরূপই আমরা ‘শিকওয়া’ ও ‘জবাব-ই-শিকওয়া’ কবিতা দুইটি উপস্থাপিত করিতেছি। বিপক্ষ দলকে চ্যালেঞ্জ দিয়াই বলিতেছি: কাব্যের কষ্টিপাথরে রীতিমত যাচাই করিয়াই তাঁহারা দেখুন এই দুইটি কবিতার কাব্য-মূল্য কত।

 আমাদের দঢ় বিশ্বাস: শব্দ-সঙ্গীতে, দার্শনিকতায়, চিন্তার মৌলিকতায়, অনভূতির গভীরতায়, উপমার চমৎকারিতায়, কাহিনী-সৃষ্টির নিপুণতায় (myth-making power) এবং ঐতিহ্যের প্রয়োগ-কুশলতায় কবিতা দুইটির তুলনা নাই।

দর্শনের আলোকে

 কবিতা দুইটির পশ্চাদভূমিতে গভীর দার্শনিক সত্য নিহিত আছে। ‘শিকওয়া’ কবিতা কোন্ অবস্থার মধ্যে লেখা হয়, তাহা প্রণিধানযোগ্য। সমগ্র মুসলিম জাহান তখন বিচ্ছিন্ন ও শক্তিহীন। বৈদেশিক শক্তিপুঞ্জ চারিদিক হইতে তাহাকে ঘিরিয়া ধরিয়াছে। যে যেরূপে পারিতেছে, সেই রূপেই এক একটি মুসলিম রাজ্য গ্রাস করিয়া চলিয়াছে। মুসলিম জাতি তার পূর্বের মনোবল হারাইয়াছে। ইকবাল দেখিলেন এই অবসাদগ্রস্ত কর্মবিমুখ জাতিকে জাগাইতে হইলে তার অতীতের সমস্ত গৌরব ও মহিমার স্মৃতি তাহার মনে জাগাইতে হইবে। ঐক্য, সংহতি ও মনোবল জাগাইবার পক্ষে জাতীয় ঐতিহ্য ও গৌরব-গাথার আবেদন অত্যন্ত প্রবল। ইকবাল তাই মুসলমানের গ্রহণযোগ্য সুরে বলিষ্ঠ ভঙ্গীতে ‘শিকওয়া’র গান গাহিলেন। মুসলমানের সুপ্ত হৃদয়তন্ত্রীতে স্পন্দন জাগিল। ‘শিকওয়া’কবিতা পাঠে তুমুল প্রতিক্রিয়া আরম্ভ হইল। আল্লার শানে গোস্তাকি করা হইয়াছে বলিয়া একদল গোঁড়া মুসলমান ইকবালের উপর রুষ্ট হইলেও সাধারণ সমাজ কিন্তু কবিতাটিকে অভিনন্দিত করিল। সমস্ত দোষ খোদার ঘাড়ে চাপাইয়া মুসলমানরা নিশ্চেষ্ট বসিয়া থাকিবার একটা মওকা পাইল! তাহারা ত ইহাই চাহিয়াছিল। বাপদাদাদের কীর্তিগাথা ভাঙাইয়া এখন তাহারা বসিয়া খাইবে; এই ত ছিল তাহাদের অন্তরের কামনা। তাহাদের কবি সেই কামনারই প্রতিধ্বনি করিয়াছেন। কাজেই কবিতাটি খুব জনপ্রিয় হইয়া উঠিল।

 কিন্তু সাধারণ সমাজ কবিকে ঠিক বুঝিতে পারে নাই। ‘শিক্‌ওয়া’ কবিতার ভিতরে একটা অন্ধ অদৃষ্টবাদের সুর আছে; জীবন-যুদ্ধ হইতে পশ্চাদপসরণের (escapism) ভঙ্গী আছে। শক্তিবাদের কবি ইকবাল সে দর্শন কেন প্রচার করিবেন? তিনি তাহা করিতে পারেন না। আত্মশক্তিতে বলীয়ান হইয়া সমস্ত বাধা-বিঘ্নকে অতিক্রম করিয়া সম্মুখের পানে অগ্রসর হইতে হইবে—ইহাই ত ইকবালের পয়গাম! এই পয়গাম অতি সুন্দর আর্টিষ্টিক আঙ্গিকে তিনি মুসলমান জাতির প্রাণের দুয়ারে পৌঁছাইয়া দিয়াছেন। ‘শিক্‌ওয়ায়’ কবি তাঁহার প্রাণের কথা কিছুই বলেন নাই; সে কথা গোপন রাখিয়া মোহগ্রস্ত মুসলমানেরা কী ভাবে, তাহারই একটা সুন্দর চিত্র তিনি আঁকিয়াছেন। তারপর “জবাব-ই-শিকওয়ায়” আল্লার মুখ দিয়া তিনি সেই শক্তিমত্র মুসলমানের কানে দিয়াছেন। “জবাব-ই-শিক্‌ওয়ার” মূলে যক্তিই হইল: আল্লাহ্, পূর্বের মতই পরম দাতা ও দয়ালু আছেন; কিন্তু মুসলমানেরা তাঁর দান-গ্রহণের যোগ্যতা হারাইয়াছে। মুসলমানেরা যদি শক্তিসঞ্চয় করিয়া জ্ঞানে-গুণে সজ্জিত হইয়া আবার বিশ্বের বুকে উন্নত-মস্তকে দাঁড়াইতে পারে, তবে সমস্ত জগৎ আবার তাহাদের পায়ে লুটাইয়া পড়িবে। যাহারা শক্তিহীন, তাহারা করুণা লাভেরও অযোগ্য।

 এই বাণী কি বিশ্বজনীন নয়? এ কি শুধুই মুসলমানের জন্য সুনির্দিষ্ট? কিছুতেই নয়। জগতের সকল অনুন্নত ও অবসাদগ্রস্ত জাতির প্রতিই এ বাণী সমানভাবে প্রযোজ্য।

অনুবাদ

 ইকবাল ‘শিক্‌ওয়া’ ও ‘জবাব-ই-শিক্‌ওয়া’ কবিতা দুইটি রচনা করেন বলকান-যুদ্ধের প্রাক্কালে (১৯১১)। মুসলিম জাতির চরম দুর্দিনে গভীর নিরাশার মধ্যে ‘শিক্‌ওয়া’ কবিতার জন্ম। তখনকার রাজনৈতিক পরিস্থিতির একটি সুন্দর চিত্র পাঠক দেখিতে পাইবেন এই পুস্তকের ভূমিকায়।

 কবিতা দুইটি বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হইয়াছে। ‘শিকওয়ার’ সর্ব—প্রথম বাংলা তর্জমা করেন (যতদূর মনে পড়ে) কলিকাতা বেকার হোষ্টেলের জনৈক দ্বিতীয় বার্ষিক ছাত্র: নাম ছিল তাঁর এ-এইচ কলিমুল্লাহ। অনুবাদটি ‘সাহিত্যিক’ মাসিক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। (১৯২৮?) ইহার কিছুদিন পরে মরহুম আশরাফ্ আলী খান ‘শিকওয়ার’ একটি ভাবানুবাদ প্রকাশ করেন (১৯৩১?)। জনাব মোহাম্মদ সুলতানের ‘শিকওয়া ও জবাব-ই-শিকওয়া’ পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয় ১৯৪৬ সালে। এতদ্ব্যতীত ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, জনাব মীজানুর রহমান এবং আরও কয়েকজন তাঁহাদের অনুবাদ পুস্তকাকারে প্রকাশ করিয়াছেন।

 এতগুলি অনুবাদ থাকা সত্ত্বেও আমি কেন আর একটি অনুবাদ বাড়াইলাম, তাহা আমি নিজেই বুঝি না। এর গূঢ় কারণ হয়ত এই: অনেকেরই যখন আছে, আমারও একটা থাক! প্রত্যেকের অনুবাদেই কিছু-না-কিছ বৈশিষ্ট্য আছে, আমারও আছে। আমার বৈশিষ্ট্য হইল: মূলে যেমন ছয় পংতি-বিশিষ্ট স্তবক আছে, আমারও সেইরূপ আছে এবং প্রত্যেক লাইনের ভাব ও তাৎপর্য আমি প্রত্যেক লাইনে রাখিতে চেষ্টা করিয়াছি। কতটুকু সফলকাম হইয়াছি পাঠক তাহা বিচার করিবেন।

 ছন্দ-নির্বাচনেও আমার কিছু বিশেষত্ব আছে। ‘শিকওয়ার’ অভিযোগ মানবীয়; কাজেই এর অনুবাদে আমি স্বরবৃত্ত চটুল ছন্দ ব্যবহার করিয়াছি। কিন্তু “জবাব-ই-শিকওয়ার” অনুবাদে অপেক্ষাকৃত গম্ভীর ছন্দের আশ্রয় লইয়াছি, কারণ সেখানে আল্লাহ কথা বলিতেছেন। আমার অনুবাদ মুলের সহিত এবং অন্যান্য অনুবাদের সহিত মিলাইয়া পড়িলে উহার বৈশিষ্ট্য বোঝা পাঠকের পক্ষে সহজ হইবে। দুই একটি দৃষ্টান্ত দিতেছি:—

‘শিকওয়া’র প্রথম স্তবক:
(মূল)

کیوں زیاں کار بنو سود فراموش رھوں؟
فکر فردا نہ کروں محو غم دوش ھوں
نالے بلبل کے سنوں اور همه تن گوش رھوں
همنوا! مین بھی کوی گل هو که خاموش رھوں ؟
حرات آموز مری تاب سخس ھے مجھ کو
شکوہ اللہ سے خاکم بدھی ھے مجھ کو

আশরাফ আলী খানের অনুবাদ:

“সর্বহারা চিত্ত আমার এই কথাটি বলতে চাহে
নোক্‌সানেরি সওদা করি চল্‌ছি খোদা তোমার রাহে
বর্তমানের ক্ষেত্র আমার শস্যবিহীন, শুধুই ফাঁকি
দূর অতীতের শব-দেহকে সামনে রেখেই তুষ্ট থাকি।”

মোহাম্মদ সুলতানের অনবাদ:

“কেন বল ত্যাজি লাভের আশা
ক্ষতিই সহিব নির্বিকার?
ভবিষ্যতের ভুলিয়া ভাবনা
অতীত চিন্তা করিব সার!
বিভোর হিয়ায় শুনে যাব আর
গাবে বুলবুল ব্যথা-বেভুল;
রব নির্ব্বাক জড়ের মতন
আমি কি গো মুক ফুল-মুকুল?
কণ্ঠে আমার শক্তি অপার
সেই সে সাহসে করিব ভাই
এ মাটির মুখে নিন্দা খোদার!
ধিক! মোর মুখে পড়ুক হাই।”

ডক্টর শহীদল্লার অনুবাদ:

“কেন ক্ষতি সইব বসে, করব না কো লভ্যে যতন?
ভবিষ্যৎ আর ভাবব না কো? অতীত-শোকে রইব মগন?

শুনব শুধু বুলবুলি-তান সর্বদেহ হয়ে শ্রবণ!
বন্ধু, ওগো ফল কি আমি? চুপটি রব কিসের কারণ?
মুখ থেকে মোর ফুটছে ভাষা বক্ষ ফেটে মরম দুখে,
নালিশ আমার খোদার নামে, ছাই পড়ুক গে আমার মুখে।”

মীজানূর রহমানের অনুবাদ:

“রহিব নীরব কেন
ছেড়ে দিয়ে মুনাফার আশ?
আগামের আশা ছাড়ি
অতীতের বুকে শুধু বাস?
কেন গো পাতিয়া কান
শোনা শুধু পাপিয়ার তান?
ওগো সাথী! আমরা কি
ফুলকলি নাহি যার গান?
অধরে গুঞ্জর ভাষা
অন্তরেতে বিপুল বেদন
হে খোদা! তোমারি নিন্দা,
ভস্মে ভরি উঠুক আনন!”

আমার অনুবাদ:

ক্ষতাই কেন সইব বল? লাভের আশা রাখব না?
অতীত নিয়েই থাকব বসে? ভবিষ্যৎ কি ভাবব না?
চুপটি করে বোবার মতন শুনব কি গান বুলবুলির?
ফুল কি আমি? ফুলের মতই রইব নীরব নম্রশির?
কণ্ঠে আমার অগ্নিবাণী! সেই সাহসেই আজকে ভাই
খোদার নামে করব নালিশ! মুখে আমার পড়ুক ছাই!”

জবাব্‌-ই-শিকওয়ার প্রথম স্তবক

(মূল)

دل سے جو بات نکلتی ھے اسر رکھتی ھے
پر نہیں طاقت پرواز مگر رکھتی ہے
قدسی الاصل هے رفعت په نظر رکھتی هے
خاک سے اٹھتی ہے گردوں پہ گزر رکھتی هے
عشق تھا فتنه گرو سرکش و چالاک مرا
آسمان چیر گیا ناله بیباک مرا

মোহাম্মদ সলতানের অনুবাদ :

“মরম হইতে বাহিরিলে বাণী
প্রভাব তাহার হয় না লয়,
পক্ষ-বিহীন তবু যে তাহার
ঊর্ধ্বে উড়িতে শকতি রয়।
স্বরগের বুকে জনম তাহার
তাইত স্বর্গ লক্ষ্য ভূমি
মলিন মাটির বক্ষ ছাড়িয়া
ধেয়ে চলে দূর বিমান চুমি।
যে সুর ধ্বনিল বক্ষে আমার
গগনের গায় গেল সে উড়ি
দিল’ এ ধরার কুসম-গন্ধ
খোদার আরশ আকুল করি’।”

ডক্টর শহীদল্লার অনুবাদ :

দিল থেকে যে বেরোয় কথা, প্রভাব সে তার রাখেই রাখে
নাই বা হল ডানা জোড়া, শক্তি ওড়ার রাখেই রাখে।
পবিত্র যার জনম, লক্ষ্য ঊর্ধ্বে ওড়ার রাখেই রাখে
ধূলি হ’তে আকাশ পরে শক্তি চলার রাখেই রাখে।
প্রেম ছিল মোর একরোখা আর বিপজ্জনক বেগবান
নিডর ভাবে বিলাপ হ’ল আকাশ চিরে ধাবমান।

আমার অনুবাদ :

“দিল্ থেকে যদি আসে কোন বাণী প্রভাব রাখে সে সুনিশ্চয়
পাখ্‌না না থাক্, তবুও তাহার ঊর্ধ্বে উড়ার তাকৎ রয়।
পাক্‌-বিহিশ্‌তে জন্ম তাহার, টান থাকে তার তাই সেথায়
ধরার ধুলায় রয় না সে বাঁধা—নীল আকাশের গান সে গায়।
প্রেম ছিল মোর বেয়াড়া ভীষণ, কোঁদল-পাকানো স্বভাব তার
বাগ মানিলনা, তীব্র গতিতে চলিল ছুটিয়া আকাশ-পার।”

আমার একটি কবিতা

 ‘শিক্ওয়া’ ও ‘জবাব-ই-শিক্‌ওয়া’র অনুবাদ করিতে গিয়া আজ আমার ৩৩ বৎসর আগেকার রচিত একটি কবিতার কথা মনে পড়িতেছে। ১৯২৭ সালের মার্চ মাসে আমি “শবে-বরাত” কবিতা লিখি। কবিতাটি আমার কাব্যগ্রন্থ “খোশরোজে” স্থান পাইয়াছে। ইকবালের ‘শিকওয়া’ কবিতার সহিত এই কবিতার মূল সুর ও ভাবের চমৎকার মিল রহিয়াছে। বলা বাহল্য তখনও আমি ‘শিকওয়া’ কবিতা পড়ি নাই। লোকমুখে ইকবাল সম্বন্ধে যাহা কিছু শুনিয়াছিলাম মাত্র। তখনকার কথা কেন, আমার এই বর্তমান অনুবাদের পূর্ব পর্যন্ত আমি কোনদিনই ‘শিক্‌ওয়া’ বা ‘জবাব-ই-শিক্‌ওয়া’ (মূল) পাঠ করি নাই। ৩৩ বৎসর পূর্বেকার সেই কবিতা তাই এখানে উদ্ধৃত করিবার লোভ সম্বরণ করিতে পারিলাম না। আশা করি পাঠক ইহাতে কিছু কৌতুক অনুভব করিবেন।

শবে-বরাত

সারা মুসলিম দুনিয়ায় আজি এসেছে নামিয়া ‘শবে-বরাত’
রাজি-রোজগার-জান-সালামৎ বণ্টন-করা পউণ্য রাত।
এস বাংলার মুস্‌লেমিন্
হৃত বঞ্চিত নিঃস্ব দীন!
ভাগ্য-রজনী এসেছে মোদের, কর মোনাজাত―পাতো দু’হাত।

ভাণ্ডার-দ্বার খুলেছে আজিকে দয়াময় রহমান-রহিম,
বিশ্ব-দানের উৎসব আজি চিরপবিত্র মহামহিম!
শত ফেরেশ্‌তা দলে দলে
দিকে দিকে আজি ওই চলে,
নিখিল বিশ্বে এ কী কলরোল―এ কী প্রীতি-প্রেম-স্নেহ অসীম!

আকাশ-তোরণে রশন-চৌকি—উৎসব-নিশি আলো-জ্বালা,
ঝালর-ঝুলানো ঝাড়-লণ্ঠন পূর্ণিমা-চাঁদ সুধা-ঢালা!
নীল-ফিরোজার গালিচা-গা’য়
কারু-কলা-আঁকা কোটী তারায়,
আসন-বিছানো সে মহাসভায় বসিয়াছে খোদ খোদাতালা!

রহমৎ আজি যেতেছে লুটিয়া-কোটী ফেরেশ্‌তা ভারে ভারে
খোদার শিরণী-ফিরণী বাঁটিয়া ফিরিতেছে ওই দ্বারে দ্বারে!
মলয়-সমীরে সুরভি তার—
নহে এ গন্ধ ফুল-বালার,
বেহেশ্‌তী সেই খোশ্‌-বু যেন গো ভেসে আসে আজ বারে বারে!

ওরে হতভাগা নাদান মূর্খ, তন্দ্রা-অলস মোহ-বিভল,
গাফিল হইয়া র’বি কি আজিকে? এ মহারজনী যাবে বিফল?
রাজার প্রাসাদে মহাদানের
উৎসব আজি আলো-গানের!
রিক্ত কাঙাল, যাবিনা কি সেথা? প’ড়ে রবি হেথা চিরবিকল?

আয় আয় ওরে উঠে আয় সবে, দলে দলে তোরা আয় ছুটে,
ভাগ্য-সভায় যেতে হ′বে আজ—শত নিয়ামত নেব লুটে।
নেব নাকো দান খয়রাতি
ভিক্ষুক সম হাত পাতি′—
দাবী-করা দান লইব আমরা একসাথে আজি সবে জুটে!

বলিব আমরা—“এয়, খোদা, মোরা কাফের নহিত—মুসলমান!
সারা দুনিয়ায় যুগে যুগে মোরা তোমার মহিমা ক’রেছি গান।
তোমারে বল ত চিনিত কে?
চিনায়েছি মোরা লোকে লোকে!
মোরা দলে দলে সৈন্য সাজিয়া উড়ায়েছি তব জয়-নিশান!

তোমার বারতা প্রচার করিতে ছেড়েছি আমরা সুখ-এরেম,
ধরার ধূলায় আসন পেতেছি ছাড়ি’ বেহেশ্‌তী হুর-হেরেম!
হ’য়েছি তোমার প্রতিনিধি
মানিয়া চলেছি তব বিধি,
তোমার নামের বিনিময়ে মোরা চাহিনি মুকুট মুক্তা-হেম!

সৃষ্টি তোমার বাঁচায়ে রেখেছি—ডুবিতে দেইনি বন্যাতে,
মরু-গিরি-দরি পার হ’য়ে গেছি—টলিনি বিপদ-ঝঞ্ঝাতে!
দণ্ডে এ দেহ মণ্ডিত—
করাতে-কাটা দ্বি-খণ্ডিত!
অনল-কুণ্ডে পুড়েছি আমরা—ভেসেছি সাগর-শয্যাতে!

পুত্রেরে মোরা কোরবাণী দিছি, ফেলিনি অশ্রু-বিন্দু তা’য়,
দান্দান্ ভেঙে লহু ঝরিয়াছে—লুকায়ে ফিরেছি গিরি-গুহায়!
সহিয়া কত না অত্যাচার
মুক্তি এনেছি ‘খানেকাবা’র
পশ-শিমারের হস্তে আমরা শহীদ হ’য়েছি কারবালায়!

তোমারি কলেমা ঘোষণা ক’রেছে—আজান দিয়েছে শত বেলাল!
শত নিপীড়ন তীব্র দহন মৃত্যুরে নাহি করি’ খেয়াল
ছুটেছি আমরা দিকে দিকে
‘কোহ্‌কাফে’, ‘আটলাণ্টিকে’
হস্তে লইয়া তলোয়ার আর খঞ্জর―নব আল্-হেলাল।

ভ্রান্ত পথিকে দেখায়েছি মোরা তব ‘সিরাতল্ মোস্তাকিম’
‘বোৎ-পোরোস্তী’ দূর করি’ সবে তোমার মন্ত্রে দিছি তালিম।
আলোকের জয় অভিযানে
যুঝেছি আমরা মনে প্রাণে,
তোমারি হকুম তামিল করেছি, দীন্-দুনিয়ার ওগো হাকিম!

আজিও তোমার সুধার সওদা বিশ্বে আমরা করি ফেরী;
ওই শোন আজি দিকে দিকে তাই তোমার নামের বাজে ভেরী!
জেলেছি নূরের নব শিখা
এশিয়া য়ুরোপ আমেরিকা,
আমাদেরি হাতে সারা ধরণীর মুক্তি আসিছে—নাহি দেরী!

এত সেবা আর এত প্রাণপাত—সকলি কি আজি বৃথা হ’বে?
প্রতিদান কিছু পাব না আমরা? বঞ্চিত হ’য়ে র’ব সবে?
হ’য়ে থাকি যদি অপরাধী,
তাই ব’লে এত বাদাবাদি?
সবাই মোদেরে মেরে যাবে, আর তুমি দূর হ’তে চেয়ে র’বে?

হ’বে না তা কভু—হ’বে না তা’—আজি এ মহাদানের শুভ রাতে
আমাদের পানে চাহিতে হইবে করুণ-কোমল আঁখি-পাতে।
করে যারা তব অসম্মান
তাহাদেরে দাও কত না দান!
আমাদেরি কি গো নাই অধিকার তব প্রেম-সুধা-করুণাতে?

বল, কথা কও, সাড়া দাও আজি, জবাব দাও এ প্রার্থনার,
যদি নাহি দাও—খাবোনা আমরা আজি এ ফির্‌ণী-রুটি তোমার!
না জাগে আজিকে যদি এ জাত্‌
মিথ্যা তোমার ‘শবে বরাত’!
মিথ্যা তোমার ভুবনে ভুবনে এত আয়োজন দান-করার।

শবে-বরাতের রাত্রিতে আজি চাহি নাকো শুধু ধন ও মান,
সবার ভাগ্যে দিও যাহা খুশী―জাতিরে দিওগো মুক্তি-দান!
জাগরণ লিখো নসিবে তার,
দিও সাধ প্রাণে বড় হবার,
নব-গৌরবে বিশ্বে আবার দাঁড়ায় যেন এ মুসলমান!

ফাল্গুন, ১৩৩৩
১৯২৭

উপসংহার

 ‘শিকওয়া’ ও ‘জবাব-ই-শিকওয়ার’ অনুবাদে যাঁহারা আমাকে সাহায্য করিয়াছেন, তাঁহাদের মধ্যে জনাব মওলানা মুহী-উদ্‌দীন খান (মুমতাজুল মুহাদ্দিসীন্‌), জনাব মওলানা আমিনুল ইসলাম (মুমতাজুল-মুহাদ্দিসীন্‌) ও জনাব রফি আহ্‌মদ ফিদায়ীর নাম বিশেষ উল্লেখযোগ্য। তাঁহাদিগকে আমার আন্তরিক ধন্যবাদ।

 আল্লামা ইকবালের সুযোগ্য পত্র ডক্টর জাবিদ ইকবাল (এম-এপি-এইচ্-ডি) এই পুস্তকের যে মূল্যবান ভূমিকা লিখিয়া দিয়াছেন, সে জন্য তাঁহাকে অন্তরের অকুণ্ঠ শুক্‌রিয়া ও মুবারকবাদ।

 পূর্বে বলিয়াছি, ইকবাল শক্তিবাদের কবি। তাঁর কাব্যের গভীরতা, তাৎপর্য ও সৌন্দর্য সম্যক বুঝিতে হইলে তাঁহার দার্শনিক মতবাদ সম্বন্ধে কিছু জানা একান্ত প্রয়োজন। সেইজন্য ইকবাল-দর্শন সম্বন্ধে একটি স্বতন্ত্র প্রবন্ধ পুস্তকের শেষে মুদ্রিত করা হইল। আশাকরি ইহা হইতেই পাঠক-পাঠিকা ইকবালের জীবন-দর্শন সম্বন্ধে মোটামুটি একটা ধারণা করিতে পারিবেন।

মোস্তফা-মঞ্জিল
বিনীত— 
শান্তিনগর, ঢাকা।
১০ই অক্টোবর, ১৯৬০
গোলাম মোস্তফা

ইকবালের জীবন-দর্শন

 ইকবাল-কাব্যের সৌন্দর্য ও তাৎপর্য ভালরূপে বুঝিতে হইলে তাঁর দার্শনিক মতবাদ সম্বন্ধে পাঠকের মোটামুটি জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। এই প্রবন্ধে তাই দেওয়া হইল ইকবাল-দর্শনের একটা সংক্ষিপ্ত পরিচয়। ইকবাল দার্শনিক কবি। কিন্তু অনেকের কাছেই এটা তাঁহার গুণের কথা নয়,—দোষের। তাঁরা বলেন: দর্শন এক, কাব্য এক। কাব্যের বিচার তত্ত্বকথায় নয়: রূপ রস ও আনন্দে। এই তিন গুণ কোন্ কবির মধ্যে কতখানি আছে, তাহাই দেখিয়া তাহার কাব্যের মূল্যমান নির্ধারণ করিতে হইবে।

 কথাটা আংশিক সত্য হইলেও সম্পূর্ণ সত্য নয়। দার্শনিকতা ফলাইলেই কাব্য হয় না, ইহা সত্য। হাজার দার্শনিকতা থাকিলেও রসোত্তীর্ণ না হইলে তাহাকে কাব্য বলা যায় না। কিন্তু দর্শন না থাকিলেও ত কাব্য হয় না! সত্যিকার কাব্যে যে দর্শন থাকিবেই না, এমনও ত কোন কথা নাই! দর্শনের কাছে শেষ কালে আসিতেই হয়। যে কবির কাব্যে কোন জীবন-দর্শন নাই, সে কবি ‘ভাল কবি’ (good poet) হইতে পারেন, কিন্তু ‘বড় কবি’ (great poet) হইতে পারেন না। Coleridge বলেন: “No man was ever yet a great poet without being, at the same time, a profound philosopher.” (অর্থাৎ বড় দার্শনিক ছাড়া কেউ বড় কবি হইতে পারে না।) Browning বলেন: “Philosophy first and poetry, which is its outcome, afterwards.” (অর্থাৎ দর্শন আগে, তারপর তার ফলস্বরূপ আসিবে কাব্য) বিশিষ্ট কাব্য-সমালোচক Landor বলেন:

“We may write little things well and accumulate one upon another, but never will any be justly called a great poet, unless he has treated a great subject worthily. He may be the poet of the lover and the idler, he may be the poet of green fields and gay society; but whoever is this can be no more.”

 (অর্থাৎ: আমরা ছোটখাটো জিনিস খুব ভাল করিয়া লিখিতে পারি, কিন্তু কোন গুরুতর বিষয় ভালভাবে লিখিতে না পারিলে কেউ কখনো বড় কবি হইতে পারে না। সে অলস প্রেমের গান গাহিতে পারে, সবুজ মাঠের বর্ণনা দিতে পারে; কিন্তু যে-কবি শুধু এই সব লইয়াই মগ্ন থাকে, সে ইহা অপেক্ষা আর বড় হইতে পারে না।)

 কাজেই দেখা যাইতেছে, কবি হইলে যে আর দার্শনিক হইতে নাই, একথা ভুল। জগতের সমস্ত বড় কবিরা কোন-না-কোন একটা দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গীকে রূপে দিয়া গিয়াছেন; তাহাতেই তাঁহাদের কাব্য বাঁচিয়া রহিয়াছে। দ্যান্তে, মিল্‌টন, গ্যেটে, শেলী, বায়রণ, সেক্সপিয়ার, ওয়ার্ডসওয়ার্থ, ওমর খৈয়াম, রুমী, রবীন্দ্রনাথ, ইকবাল—প্রত্যেকের কাব্যের পশ্চাখভূমিতেই কোন না কোন দার্শনিক প্রেরণা আছে; আর ইহাতেই তাঁহাদের কাব্য বিশিষ্ট রূপ লাভ করিয়াছে। বস্তুতঃ, দার্শনিকতা কাব্যের একটা প্রধান গুণ। আশ্চর্যের বিষয়, ইকবালের যাহা গুণ, সমালোচকেরা তাহাকেই দোষ বলিয়া প্রচার করেন!

 ইকবাল-কাব্য পড়িতে হইলে তাঁর দর্শন সম্বন্ধে আমাদের তাই কিছু জানিতেই হয়।

ইকবাল-দর্শনের পটভূমি

 ইকবালের আবির্ভাবকালে দার্শনিক বিভ্রান্তিতে সমস্ত জগৎ আচ্ছন্ন হইয়া ছিল। জগতে তিনটি স্বতন্ত্র কৃষ্টি বা কালচারের ধারা বহিয়া চলিতেছে: (১) হেলেনিক বা গ্রীক-কালচার (২) সেমিটিক কালচার এবং (৩) আর্য কালচার। ইউরোপ প্রধানতঃ গ্রীক কালচার দ্বারাই প্রভাবিত। গ্রীক কালচারের মূলে আছে প্লেটো ও এরিষ্টটলের চিন্তাধারা। দর্শন, বিজ্ঞান, শিক্ষা, রাষ্ট্রনীতি ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে সর্বপ্রথম আলোক পাত করেন প্লেটো। তিনি বলেন: এই পরিদৃশ্যমান জগতের সবকিছই অলীক বা মায়া (Illusion) ইহাদের কোন সত্যিকার অস্তিত্ব নাই; ইহারা মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই বিলীন হইয়া যাইবে: থাকিবে কেবল সেই পরম সত্ত্বা (Idea or Absolute Idea)। বস্তু-জগত সেই পরম সত্ত্বারই লীলা। কাজেই অনিত্য। মানুষের আত্মাও সেই পরমাত্মারই বাহ্য প্রকাশ; কাজেই সে যে-পথ দিয়া আসিয়াছিল, সেই পথ দিয়াই তাহার আপন উৎস-মূলে ফিরিয়া যাইবে। মানষের যে স্বতন্ত্র অস্তিত্ব বা ব্যক্তিত্ব আছে, মৃত্যুকে অতিক্রম করিয়া সে যে অনন্ত-জীবনে বাঁচিয়া থাকিবে, এ সব কথা প্লেটো বলেন নাই। এক বিরাট মহামৃত্যুই যে এই সুন্দর ধরণীর পরিসমাপ্তি টানিয়া দিবে, এই নিরাশার বাণীই তিনি জগতকে দিয়া গিয়াছেন।

 গ্রীক দার্শনিকদের এই ভাবধারা ইউরোপকে যথেষ্ট প্রভাবান্বিত করিয়াছে। পরবর্তী দার্শনিকেরা এই একই সুরের প্রতিধ্বনি তুলিয়াছেন। বর্তমান যুগেও এ প্রভাব অব্যহত রহিয়াছে। ‘ফিশার’ ঠিকই বলিয়াছেন: “We Europeans are the children of Hellas. প্লেটো ও এরিষ্টটলের পরে যত দার্শনিক ইউরোপে আবির্ভূত হইয়াছেন, তাঁহাদের সকলেই ঈশ্বর ও জগৎ সম্বন্ধে প্রায় একই কথা শুনাইয়াছেন। ডেকার্ট লেবনীজ বার্কলী ক্যাণ্ট হেগেল্ রুশো ভলটেয়ার লক্ হিউম—সবাই সেই মূল ধারাকেই পরিপুষ্ট করিয়াছেন মাত্র।

 ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে জার্মান দার্শনিক নীট্‌শে এবং ফরাসী দার্শনিক বার্গোসঁ কিছুটা নূতন কথা শুনাইলেন। নীট্‌শে বলিলেন, এই জগৎ মৃত্যুর সঙ্গেই বিলীন হইয়া যাইবে না। মানুষ বারে বারে এখানে ফিরিয়া আসিবে (eternal recurrence) এবং সাধারণ মানষে না হইয়া Superman বা অতি-মানুষ হবার সাধনা করাই হইবে আমাদের লক্ষ্য। সাধারণ মানুষকে তিনি ঘৃণার চক্ষে দেখিতেন। খৃষ্টান ধর্মের প্রচলিত বিশ্বাস, সংস্কার ও নীতিজ্ঞানকেও তিনি আঘাত করিলেন। ঈশ্বর বলিয়া কেউ নাই। এই মানুষই Superman বা নব-ঈশ্বর রূপে জন্মলাভ করিবে—ইত্যাদি ধরণের অনেক অদ্ভুত কথা তিনি বলিলেন। কিন্তু নীট্‌শের এই মতবাদ ইউরোপ গ্রহণ করিল না। গ্রীক্ মতবাদকেই খৃষ্টজগৎ প্রাধান্য দিল। Pantheistic Idealism ইউরোপের মন ও মস্তিষ্ককে আচ্ছন্ন করিয়া রাখিল।

 প্রাচ্য দেশেও একই অভিশাপ নামিয়া আসিয়াছিল। ভারতীয় ঋষিরা মানুষের সঙ্গে ঈশ্বর এবং জগতের সম্বন্ধ কী, তাহা নির্ণয় করিতে গিয়া একই মায়াবাদ ও অদ্বৈতবাদ প্রচার করিয়াছিলেন। ভারতীয় ষড়দর্শনের প্রায় সবগুলিই নিরীশ্বরবাদের উদ্‌গাতা। সাংখ্য পাতঞ্জল ন্যায় বৈশেষিকা কপিল—কোনও দর্শনেই ঈশ্বর অঙ্গীকৃত হয় নাই। এ জগত শুধু মায়া, শুধু মরীচিকা, এর কিছুই বাস্তব নয়, নিত্য নয়, এই মতই প্রাচ্য দেশে শিকড় গাড়িয়া বসিয়া ছিল। এক মাত্র বেদান্ত-দর্শনই ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করিয়াছিল। কিন্তু সে স্বীকৃতিও গ্রীক-দর্শন হইতে বিভিন্ন নয়। ‘একমেবাদ্বিতীয়ম্’ অর্থাৎ ‘এক ছাড়া দুই নাই’—এই হইল বেদান্ত-দর্শনের সার কথা। এর নাম ‘অদ্বৈতবাদ’। বলা বাহুল্য এই অদ্বৈতবাদ কিন্তু ‘তৌহীদ’ নয়। ‘এক ছাড়া দুই নাই’—এর অর্থ এ নয় যে, এক আল্লাহ্ ছাড়া ছাড়া দুই আল্লাহ্ বা বহু আল্লাহ নাই। এর অর্থ হইল: আল্লাহ ছাড়া আর কিছুই নাই। অন্য কথায়—সবকিছুই আল্লাহ্-ময়। গ্রহ-নক্ষত্র, মানুষ, পশুপক্ষী, তৃণলতা, পাহাড়-পর্বত—যাহা-কিছু দেখিতেছ—সবই সেই একের প্রকাশ, অথবা সেই একেরই অংশ। অদ্বৈতমতে স্রষ্টা ও সৃষ্টি স্বতন্ত্র নয়; স্রষ্টা ও সৃষ্টি এক এবং অভিন্ন। ‘জীবই শিব’, ‘অয়মাত্মা ব্রহ্ম’, (এই আত্মাই ব্রহ্ম) ‘অহং ব্রহ্মাস্মি’ (আমিই ব্রহ্ম) ‘সোহ্‌হং’ (সে-ই আমি) ইহাই হইল বেদান্ত মত। শঙ্করাচার্যের হাতে এই মত একটা বিশিষ্ট দার্শনিক ভঙ্গী লাভ করিয়াছিল।

 বৌদ্ধদিগের ‘নির্বাণ’ও অনুরূপ প্রেরণা হইতেই উৎসারিত। জীবন ও জগতকে তাঁহারা স্বতন্ত্র দৃষ্টিতে দেখেননি। বরং বুদ্ধের সংশয়বাদ বা নিরীশ্বরবাদ মানব-মনে আরও গভীর নিরাশার রেখাপাত করিল। অনিশ্চিত মহাশূন্যে বিলীন হইয়া যাওয়াই ছিল বৌদ্ধধর্মের জীবন-দর্শন।

 তাহা হইলে দেখা যাইতেছে, কি গ্রীক কি হিন্দু কি বৌদ্ধ―কোন দর্শনই জীবন, জগত বরং ঈশ্বর সম্বন্ধে কোন পরিচ্ছন্ন ধারণা দিতে পারে নাই। মানবাত্মার চিরমৃত্যুর কথাই তাহারা প্রচার করিয়াছে। মানব-জীবনকে তাহারা মূর্ত্তিমান অভিশাপ বলিয়া মনে করিত। জীবনের অভিশাপ হইতে কি করিয়া মুক্তি বা মোক্ষ লাভ করা যায়, এই ছিল তাঁহাদের প্রধান চিন্তা। এর ফলে মানুষ নিষ্ক্রিয় উদাসীন ও সন্ন্যাসী সাজিয়াছে, জীবন-সংগ্রামে নামে নাই, সকল বাধা জয় করিয়া অগ্রসর হইতে চাহে নাই; জীবনকে পূর্ণরূপে কেহ উপভোগ করে নাই। জীবন-প্রদীপকে চিরতরে নির্বাপিত করিয়া দেওয়াই ছিল তাহাদের জীবন-ধর্ম। জীবনের এই অস্বীকৃতি (Negation of life) অথবা জীবন-যুদ্ধে হইতে এই ভীরু পশ্চাদপসরণের দরুণ মানব-সমাজের যে সমূহ ক্ষতি হইয়াছে, তার প্রগতির পথ যে রুদ্ধ হইয়াছে, এ কথা বলাই বাহুল্য।

 সেমিটিক কালচারের ধারক ও বাহক মুসলমানদের মধ্যেও একই বিভ্রান্তি দেখা দিল। রসুলুল্লাহ্ যদিও নূতন জীবন-দর্শন লইয়া আসিলেন; আল্লাহ্, মানুষ এবং জগতের পারষ্পরিক সম্বন্ধ নির্ণয় করিয়া মানুষকে নব-গৌরব ও নব-মহিমা দান করিলেন এবং নিষ্ক্রিয় ভাবালুতা বর্জন করিয়া জীবনকে সংগ্রাম-মুখর করিয়া তুলিলেন, তবু নিতান্ত আফসোসের কথা, তাঁর ইন্তিকালের তিন শত বৎসরের মধ্যেই মুসলমানদের একটি বিশিষ্টদল গ্রীক এবং ভারতীয় দর্শনের প্রভাবে একই অদ্বৈতবাদের মোহজালে জড়াইয়া পড়িলেন। জন্নুন মিস্‌রী, বায়েজিদ বুস্তামী ও অন্যান্য সাধকেরা শীঘ্রই একটা নূতন মতবাদ প্রচার করিলেন। তার নাম হইল সুফী মতবাদ। সফীবাদও অদ্বৈতবাদ ছাড়া কিছু নয়। এ জগতের সব কিছু অলীক ও অসার, একমাত্র আল্লাই নিত্য বস্তু; তাঁর মধ্যে লয়প্রাপ্ত হওয়াই আমাদের একমাত্র কাম্য ও লক্ষ্য, স্রষ্টা ও সৃষ্টি অভিন্ন—এই কথাই সুফীরা প্রচার করিলেন। ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রথমাংশে স্পেনদেশীয় ইবনে-আরাবী এই সুফীমতকে একটা বিশিষ্ট দার্শনিক রূপ দান করিলেন। ইহার নাম দিলেন ‘ওহাদাতুল্-অজুদ’ বা Sufistic Pantheism. প্লেটোর মায়াবাদ, শঙ্করের অদ্বৈতবাদ এবং ইবনে-আরাবীর সুফীবাদ মূলতঃ এক ও অভিন্ন। তিনটি মতেই দেখা যায় জীবনের অস্বীকার, কর্মসন্যাস, স্রষ্টা ও সৃষ্টির অভিন্নতা এবং পরম সত্ত্বার মধ্যে নিজেকে বিলীন করিয়া দিবার (ফানা-ফিল্লার) সুতীব্র আকাঙ্ক্ষা। বৈদান্তিকেরা যেমন বলিলেন “অয়মাত্মা ব্রহ্ম”, “অহং ব্রহ্মাস্মি” বা ‘সোহহং’, সাফীসাধক মনসুর হাল্লাজ তেমনি বলিলেন “আনাল হক্” অর্থাৎ আমিই আল্লাহ।

 অবশ্য সপ্তদশ শতাব্দীতে মুজাদ্দিদ আলফ্-সানি আসিয়া ইব্‌নে-আরবীর এই মতবাদকে খণ্ডন করিলেন এবং বলিলেন যে সাধনার এ চরম স্তর নয়. এর পরও আরও দুইটি স্তর আছে। শেষ স্তরে পৌঁছিলে দেখা যাইবে: স্রষ্টা ও সৃষ্টি এক নয়। কিন্তু সে হইল ধর্ম বা শরীয়তের দিক দিয়া সংস্কার। দর্শনের দিক দিয়া বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে এই প্যানথিজ্‌ম্‌কে খণ্ডন করার গুরু দায়িত্ব সঞ্চিত হইয়া ছিল দার্শনিক কবি ইকবালের জন্য।

ইকবালের মতবাদ

 ইকবাল যখন দর্শনের ছাত্র হইয়া ইউরোপে গেলেন, তখন মানবাত্মার এই গুরু লাঞ্ছনায় তিনি ব্যথিত হইলেন। প্রাচ্য ও প্রতীচ্য উভয় দর্শনের সঙ্গেই তিনি নিজেকে নিবিড়ভাবে পরিচিত করিলেন; তারপর ঘোষণা করিলেন: শুধু যে সেই পরম সত্ত্বা (Absolute Idea) ই সত্য আর জগৎ মিথ্যা―তাহা নহে; এ জগৎও সত্য; তবে পূর্ণ সত্য নয়। উভয় জগৎকে মিলাইলে পূর্ণ সত্য পাওয়া যায়। তিনি প্রচার করিলেন এক নূতন দর্শন, তাকে বলা যায় আত্মার দর্শন (Egoism)। মানুষের আত্মা যে প্রতিবিম্বের মত আল্লার অস্তিত্ব-সাগরে মিলাইয়া যাইবে না, তার যে ব্যক্তিত্ব ও স্বাতন্ত্র্য আছে, মৃত্যুর পরেও যে সে অনন্ত জীবনে বাঁচিয়া থাকিবে—এই কথা তিনি উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা করিলেন। তিনি বলিলেন: মানুষের মধ্যে অসীম শক্তি ও সম্ভাবনা লুকাইয়া আছে; সাধনা দ্বারা সেই শক্তি ও সম্ভাবনার পূর্ণ জাগরণ আনিতে পারিলে এই মানুষই আল্লার ‘খলিফার’ গৌরবময় আসন লাভ করিতে পারে। এই পূর্ণ-মানুষকে ইকবাল ‘Superman’ (অতিমানুষ) না বলিয়া বলিয়াছেন ‘মরদ্-ই-মুমীন’ বা ‘ইনসান-ই-কামিল’। ইকবালের দর্শন তাই আত্ম-বিকাশের দর্শন—আত্ম-শক্তির দর্শন। ‘আসরার-ই-খুদীতে’ তিনি এই নূতন দর্শনকে কাব্যরূপ দিয়াছেন। তিনি দেখাইয়াছেন যে জগতের প্রত্যেক বস্তুই ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য রক্ষা করিয়া চলে। এই ব্যক্তিত্বকে (individuality) যে যতখানি সুদৃঢ় ও শক্তিশালী করিতে পারিয়াছে, সৃষ্টিতে সে ততখানি স্থিতিবান হইয়াছে এবং তত পরিমাণে তার মূল্যমান বাড়িয়াছে। তাঁহার মতে ব্যক্তিত্বের ক্রমবিকাশের সাধনা প্রত্যেক অনুপরমাণুর মধ্যেও চলিতেছে। প্রত্যেকেই শক্তির সাধক। প্রত্যেকেই বলিতে চায়: ‘আমি আছি।’ ইকবাল তাই কি সুন্দরই না বলিয়াছেন:

"Only that truly exists which can say ‘I am’,
It is the degree of the intuition of ‘I-am-ness’
That determines the place of a thing in the scale of being.”

 অর্থাৎ: সে-ই সত্যিকার ভাবে বাঁচিয়া থাকে—যে বলিতে পারে ‘আমি আছি।’

 এই ‘আমি আছি’—চেতনার কমবেশীতেই প্রত্যেক জিনিসের অস্তিত্ব বা মূল্য পরিমিত হয়।

 পর্বত ও ধূলিকণার দৃষ্টান্ত দিয়া এই সত্যকে ইকবাল অতি সুন্দর ভাবে ব্যাখ্যা করিয়াছেন:

“পর্বত যখন ব্যক্তিত্বকে হারায়
তখন সে ধূলিতে পরিণত হয়
এবং সাগর তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়।
পৃথিবীর চেয়ে সূর্য অধিকতর বলবান
কাজেই, বন্দী চাঁদ চিরকাল তারি চারিপাশে ঘুরে।
পৃথিবীর চেয়ে সূর্য্য অধিকতর বলবান
তাইত পৃথিবী সূর্যের দৃষ্টিতে সম্মোহিত!”

 অন্যত্র বলিয়াছেন:

“একটা তরঙ্গ সমুদ্রের বুকের উপর দিয়ে বয়ে গেল, এবং ব’লে গেল, চললে আমি আছি, না চললে নেই।”

 খুদীকে মহানির্বাণের (ফানা-ফিল্লার) পথে টানিয়া লইবার সাধনা তাই ইকবালের নয়। তার সাধনা—বাকা-বিল্লার সাধনা, অর্থাৎ আল্লার অস্তিত্ত্বের ছায়ায় অনন্ত জীবনে বাঁচিয়া থাকার সাধনা। বলা বাহুল্য ইহাই খাঁটি ইসলামী দর্শন। ইসলামের কোথাও নাই যে পুণ্যাত্মারা গিয়া আল্লার মধ্যে লয় প্রাপ্ত হইবে। অথবা পাপীদের আত্মাগুলিকে আল্লাহ্ দোজখের আগুনে পুড়াইয়া নিশ্চিহ্ন করিয়া ফেলিবেন। পুণ্যাত্মারা ত অনন্ত কাল বিহিশ্‌তে বাস করিবেই, (আস্‌হাবুল জান্নাত ওয়াহুম ফিহা খালেদুন,) পাপীরাও অনন্ত কাল দোজখে বাস করিবে (আস্‌হাবুন্ নার্ ওয়া হুম ফিহা খালেদুন)। দোজখ যদি অনন্তপ্রসারী নাও হয়, তবু নির্দিষ্ট মেয়াদের পর পাপীরা বিহিশ্তে উন্নীত হইবে এবং তথায় অনন্ত কাল বাস করিবে। কাজেই যে-কোন অবস্থায় আত্মার অমরত্ব ইসলামে সুনির্দিষ্ট হইয়া আছে।

 খুদীর সঙ্গে খোদার সম্বন্ধ তবে কী? সেকি বিদ্রোহের সম্বন্ধ? না মিলনের? ইকবাল বলেন: আল্লাহ্ আমাদের স্রষ্টা, আমরা তাঁরই সৃষ্টি। কিন্তু সৃষ্টি করিবার পর হইতেই তিনি আর আমাদিগকে নিশ্চিহ্ন করিয়া মারিয়া ফেলিতে চান না; তাঁর স্নেহচ্ছায়ায় আমাদিগকে চিরকাল বাঁচাইয়া রাখিতে চান। এটা তাঁর প্রেম-সুন্দর রূপে। মানুষেরও তাই কর্তব্য স্রষ্টার সঙ্গে যোগ রাখিয়া চলা―স্রষ্টাকে ভালবাসিয়া তাঁর কাছে নতি স্বীকার করিয়া তাঁর শক্তিতে শক্তিমান হইয়া খুদীকে বলিষ্ঠ করিয়া তোলা। খুদীর শক্তি আল্লার নৈকট্য ও অনুরাগ হইতে আসে। এ সম্বন্ধে ইকবাল বলেন: “আল্লার ভিতরে নিজেকে বিলীন করিয়া না দিয়া, নিজের ভিতরেই আল্লাকে আয়ত্ব করা।” (Instead of absorbing yourself unto God, absorb God unto yourself).

 অন্যত্র তিনি বলিয়াছেন:

“Abandon thyself and flee to God
Being strengthened by God, return to thyself.”

অর্থাৎ :  নিজকে ছাড়িয়া আল্লার নিকট ছুটিয়া যাও
তাঁর শক্তিতে শক্তিমান হইয়া পুনরায় নিজের মধ্যে
ফিরিয়া আইস।

 এখানে মি’রাজের প্রতি ইংগিত আছে। মিরাজ-রাত্রে রসুলুল্লাহ আল্লার নৈকট্য লাভ করিয়া তাঁর মধ্যে নিজকে বিলীন করিয়া দেন নাই, সেখান হইতে প্রচুর শক্তি সঞ্চয় করিয়া আবার তিনি জগতে ফিরিয়া আসিয়াছিলেন এবং অধিকতর উৎসাহে কর্মক্ষেত্রে ঝাঁপাইয়া পড়িয়াছিলেন।

 আমাদেরও ঠিক তেমনই করিতে হইবে। স্বাতন্ত্র্য রাখিয়াই আল্লার সঙ্গে মিলিতে হইবে। অন্য কথায়: তাঁর গুণাবলী আমাদের আপন জীবনে রূপায়িত করিয়া তুলিতে হইবে:

‘তাখাল্লাকু বি আখলাকিল্লাহ’

 অর্থাৎ: আল্লার গুণাবলীর অননুসরণ কর।

 অতএব আল্লার সঙ্গে আমাদের সহযোগিতা করিতেও হইবে, আপনার স্বাতন্ত্র্য্যও বজায় রাখিতে হইবে। এই স্বাতন্ত্র্য প্রেমে মধুর হইবে, আনুগত্যে মহীয়ান হইবে। সম্রাটের রাজপ্রতিনিধি হইতে হইলে তাঁর সঙ্গে ঠুকাঠুকি করিয়া নিশ্চয়ই তাহা হওয়া যায় না। প্রেম ও আনুগত্য দিয়াই সে পদগৌরব লাভ করিতে হয়। ‘মর্‌দ্-ই-মুমীনের’ দর্জায় পৌছিলে মানুষের মর্যাদা হয় অপূর্ব-মহীয়ান। এই মর্‌দ্-ই-মুমীনদের সম্বন্ধে ইকবাল বলিতেছেন:

“খুদীকো কর্ বুলন্দ এ্যায়ছা কে হর তক্‌দীর-সে পহলে
খোদা বান্দাসে খোদ পুঁছে বাতা তেরী রেজা কিয়া হায়।”

অর্থাৎ: খন্দীকে এমন শক্তিশালী কর যে, ভাগ্যলিপি লিখিবার আগে খোদা নিজেই তোমাকে জিজ্ঞাসা করেন: বল, তোমার ভাগ্যে কী লিখিব। নীটশের Superman অপেক্ষা ইকবালের এই ‘মর্‌দ্-ই-মুমীন’ কত গরীয়ান। হেয়ালিপূর্ণ Superman না হইয়া পুণ্যে প্রেমে গরীয়ান ‘মর্‌দ্-ই-মুমীন’ (Perfect man) হওয়া কি অধিকতর বাঞ্ছনীয় নয়!

 তাহা হইলে দেখা যাইতেছে: আল্লাহ্ মানুষ এবং জগতের মধ্যে কার কি সম্বন্ধ এবং কার কি কর্তব্য, তাহার মীমাংসাই ইকবাল দর্শনের মূল সুর। জগতজোড়া মহামৃত্যুর ক্রন্দনের মধ্যে তিনি গাহিয়াছেন অমর জীবনের গান; নিরাশার অন্ধকারে তিনি আনিয়াছেন নব-প্রভাতের আলো। এতদিন মানুষ জীবন হইতে মৃত্যুর দিকে তাকাইয়া ছিল, এবার মানুষ মৃত্যু হইতে মহাজীবনের পানে দৃষ্টি ফিরাইল। এতদিনকার অবজ্ঞাত জীবন ও জগতের প্রতি তার মমত্ব ও আকর্ষণ আসিল। নূতন মূল্যবোধ লইয়া সে সম্মুখের দিকে অগ্রসর হইল। ইহাই হইল ইকবালের জীবন-দর্শনের বৈশিষ্ট্য।

ব্যক্তি ও সমাজ

 কিন্তু ইকবালের দর্শন এখানেই শেষ হইল না। এই সমাজতন্ত্রের দিনে বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্ববাদ (Individuality) খাপ খায় না। প্রত্যেকেই হিট্‌লার সাজিলে সেও আর এক বিপদ! শুধু ব্যক্তিই সত্য নয়, সমাজও ত সত্য। প্রত্যেক মানুষের যেমন ব্যক্তি-জীবন আছে, তেমনি আছে তার সমাজ-জীবন। সমাজের সঙ্গে ব্যক্তির সম্বন্ধ নির্ণয়ের তাই প্রয়োজন দেখা দিল। “রমুয-ই-বেখুদী” লিখিয়া তাই ইকবাল তাঁর দর্শনকে পূর্ণ করিলেন। তিনি বলিলেন: ব্যক্তি যতই শক্তিশালী হউক না কেন, বিচ্ছিন্ন অবস্থায় একা সে কিছুই করিতে পারে না। মানুষ সামাজিক জীব, কাজেই সমাজ লইয়া তাহাকে চলিতে হইবে। এখানে ব্যক্তিকে খানিকটা ত্যাগ, সেবা, সহনশীলতা ও সহযোগিতা দেখাইতেই হইবে। ব্যক্তি ও সমাজ তাই পরস্পরের উপর নির্ভরশীল। ব্যক্তিও সমাজ দ্বারা উপকৃত হয়, সমাজও ব্যক্তি দ্বারা উপকৃত হয়। কতকগুলি উপমা দিয়া এই সত্যকে তিনি অতি সুন্দর ভাবে ফুটাইয়া তুলিয়াছেন। সমদ্রের বুকে থাকিলেই তরঙ্গমালা শক্তিমান, কিন্তু সমুদ্রের বাইরে আসিলে তাহাদের কোনই মূল্য নাই। একটা সুন্দর কবিতার কথাগুলি শৃঙ্খলার সঙ্গে দলবদ্ধ হইয়া দাঁড়াইলেই অপরূপ কাব্য-সৌন্দর্য প্রকাশ পায়; কিন্তু তারা যদি প্রত্যেকে এলোমেলো ভাবে মাথা তুলিয়া দাঁড়ায়, তবে তখন না থাকে ছন্দ, না থাকে কাব্য। আকাশের তারারা দল বাঁধিয়া এক-লাইনে দাঁড়ায় বলিয়াই সুন্দর ছায়াপথ রচিত হয়। এমনি ভাবেই তিনি সমাজের প্রতি ব্যক্তির দায়িত্ব ও কর্তব্য, এবং ব্যক্তির প্রতি সমাজের দায়িত্ব ও কর্তব্য নির্ধারণ করিয়া দিয়াছেন।

 বলা বাহুলা, এই যে অভিনব জীবন-দর্শন, এ নূতন নয়; ইসলামী সত্যের উপরেই এর বুনিয়াদ। ইসলামের প্রতি অন্ধ অনুরাগের জন্যই যে ইকবালের কাব্য ও দর্শন ইসলামাশ্রয়ী হইয়াছে, তাহা নহে; তাঁর দার্শনিক মতবাদ কার্যকরী করার পক্ষে ইসলামী জীবন-ধারা ও ইসলামী সমাজ-বিধান সম্পূর্ণ উপযোগী; কাজেই তিনি ইসলামের মহিমা কীর্তন করিয়াছেন। ইকবাল-কাব্যে তাই ইসলামিকতা মুখ্য নয়—গৌণ। এই বিরাট বিপ্লবী দার্শনিক মতবাদকে তিনি প্রতিষ্ঠিত করিয়াছেন কাব্যের মাধ্যমে। কবি হিসাবে এখানেই তাঁর কৃতিত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব। এমন কাব্য-ভঙ্গিতে তিনি কথা বলিয়াছেন যে, তাহা অন্তর স্পর্শ না করিয়াই যায় না। কাব্য ও আর্টের লক্ষণ হইতেছে সংক্রামকতা। শিল্পী যাহা আপন প্রাণে উপলব্ধি করেন, তাহা যদি তাঁর শিল্পের মধ্য দিয়া অপর হৃদয়েও যথাযথভাবে সঞ্চারিত হয়, তবেই বলা যাইতে পারে তার শিল্প সার্থক হইয়াছে। এই পরীক্ষায় ইকবাল সম্পূর্ণ বিজয়ী হইয়াছেন। নিকলসন ঠিকই বলিয়াছেন:

“He is no mean poet, and his verse can rouse or persuade even if his logic fail to convince.”

 অর্থাৎ: ইকবাল ছোটখাটো কবি নন; তাঁর যুক্তি ব্যর্থ হইলেও তাঁর কাব্য হৃদয়কে জয় করে।”


পরিচ্ছেদসমূহ (মূল গ্রন্থে নেই)

সূচীপত্র

পরিচ্ছেদ 
 পৃষ্ঠা