শিশু/নদী
নদী
ওরে তোরা কি জানিস কেউ
জলে কেন ওঠে এত ঢেউ।
ওরা দিবস রজনী নাচে,
তাহা শিখেছে কাহার কাছে।
শোন্ চলচল ছলছল
সদাই গাহিয়া চলেছে জল।
ওরা কারে ডাকে বাহু তুলে,
ওরা কার কোলে ব'সে দুলে।
সদা হেসে করে লুটোপুটি,
চলে কোন্খানে ছুটোছুটি,
ওরা সকলের মন তুষি
আছে আপনার মনে খুশি॥
আমি বসে বসে তাই ভাবি
নদী কোথা হতে এল নাবি।
কোথায় পাহাড় সে কোন্খানে,
তাহার নাম কি কেহই জানে।
কেহ যেতে পারে তার কাছে?
সেথায় মানুষ কি কেউ আছে?
সেথা নাহি তরু, নাহি ঘাস,
নাহি পশুপাখিদের বাস।
সেথা শবদ কিছু না শুনি—
পাহাড় বসে আছে মহামুনি,
তাহার মাথার উপরে শুধু
সাদা বরফ করিছে ধূধূ।
সেথা রাশি রাশি মেঘ যত
থাকে ঘরের ছেলের মতো।
শুধু হিমের মতন হাওয়া
সেথায় করে সদা আসা-যাওয়া।
শুধু সারা রাত তারাগুলি
তারে চেয়ে দেখে আঁখি খুলি।
শুধু ভোরের কিরণ এসে
তারে মুকুট পরায় হেসে॥
সেই নীল আকাশের পায়ে
সেথা কোমল মেঘের গায়ে
সেথা সাদা বরফের বুকে
নদী ঘুমায় স্বপনসুখে।
কবে মুখে তার রোদ লেগে
নদী আপনি উঠিল জেগে-
কবে একদা রোদের বেলা
তাহার নে পড়ে গেল খেলা।
সেথায় একা ছিল দিন-রাতি,
কেহই ছিল না খেলার সাথি।
সেথায় কথা নাহি কারো ঘরে,
সেথায় গান কেহ নাহি করে
তাই ঝুরুঝুরু ঝিরিঝিরি
নদী বাহিরিল ধীরি ধীরি।
মনে ভাবিল, যা আছে ভবে
সবই দেখিয়া লইতে হবে॥
নীচে পাহাড়ের বুক জুড়ে
গাছ উঠেছে আকাশ ফুঁড়ে।
তারা বুড়াে বুড়াে তরু যত,
তাদের বয়স কে জানে কত!
তাদের খােপে খােপে গাঁঠে গাঁঠে
পাখি বাসা বাঁধে কুটো কাঠে।
তারা ডাল তুলে কালাে কালাে
আড়াল করেছে রবির আলাে।
তাদের শাখায় জটার মতাে
ঝুলে পড়েছে শ্যাওলা যত।
তারা মিলায়ে মিলায়ে কাঁধ
যেন পেতেছে আঁধার-ফাঁদ।
তাদের তলে তলে নিরিবিলি
নদী হেসে চলে খিলিখিলি।
তারে কে পারে রাখিতে ধরে,
সে যে ছুটোছুটি যায় সরে।
সে যে সদা খেলে লুকোচুরি,
তাহার পায়ে পায়ে বাজে নুড়ি।
পথে শিলা আছে রাশি রাশি,
তাহা ঠেলে চলে হাসি হাসি।
পাহাড় যদি থাকে পথ জুড়ে
নদী হেসে যায় বেঁকেচুরে।
সেথায় বাস করে শিঙ-তােলা
যত বুনাে ছাগ দাড়ি-ঝােলা।
সেথায় হরিণ রোঁয়ায় ভরা
তারা কারেও দেয় না ধরা।
সেথায় মানুষ নূতনতরাে,
তাদের শরীর কঠিন বড়াে।
তাদের চোখদুটো নয় সােজা,
তাদের কথা নাহি যায় বােঝা।
তারা পাহাড়ের ছেলে মেয়ে
সদাই কাজ করে গান গেয়ে।
তারা সারা দিনমান খেটে
আনে বােঝা-ভরা কাঠ কেটে।
তারা চড়িয়া শিখর-'পরে
বনের হরিণ শিকার করে॥
নদী যত আগে আগে চলে
ততই সাথি জোটে দলে দলে।
তারা তারি মতাে, ঘর হতে
সবাই বাহির হয়েছে পথে।
পায়ে ইনুঠুনু বাজে নুড়ি,
যেন বাজিতেছে মল চুড়ি।
গায়ে আলাে করে ঝিকিঝিক,
যেন পরেছে হীরার চিক।
মুখে কলকল কত ভাষে
এত কথা কোথা হতে আসে।
শেষে সখীতে সখীতে মেলি
হেসে গায়ে গায়ে হেলাহেলি।
শেষে কোলাকুলি কলরবে
তারা এক হয়ে যায় সবে।
তখন কলকল ছুটে জল,
কাঁপে টলমল ধরাতল—
কোথাও নীচে পড়ে ঝরঝর,
পাথর কেঁপে ওঠে থরথর-
শিলা খান খান যায় টুটে,
নদী চলে পথ কেটে-কুটে।
ধারে গাছগুলাে বড়াে বড়াে
তারা হয়ে পড়ে পড়াে-পড়াে,
কত বড়াে পাথরের চাপ
জলে খ'সে পড়ে ঝুপ ঝাপ।
তখন মাটি-গােলা ঘােলা জলে
ফেনা ভেসে যায় দলে দলে।
জলে পাক ঘুরে ঘুরে ওঠে,
যেন পাগলের মতাে ছােটে॥
শেষে পাহাড় ছাড়িয়া এসে
নদী পড়ে বাহিরের দেশে।
হেথা যেখানে চাহিয়া দেখে
চোখে সকলই নূতন ঠেকে।
হেথা চারি দিকে খােলা মাঠ,
হেথা সমতল পথ ঘাট।
কোথাও চাষীরা করিছে চাষ,
কোথাও গােরুতে খেতেছে ঘাস।
কোথাও বৃহৎ অশথ গাছে
পাখি শিস দিয়ে দিয়ে নাচে।
কোথাও রাখাল-ছেলের দলে
খেলা করিছে গাছের তলে।
কোথাও নিকটে গ্রামের মাঝে
লােকে ফিরিছে নানান কাজে।
কোথাও বাধা কিছু নাহি পথে,
নদী চলেছে আপন মতে।
পথে বরষার জলধারা
আসে চারি দিক হতে তারা।
নদী দেখিতে দেখিতে বাড়ে,
এখন কে রাখে ধরিয়া তারে॥
তাহার দুই কূলে উঠে ঘাস,
সেথায় যতেক বকের বাস।
সেথা মহিষের দল থাকে,
তারা লুটায় নদীর পাঁকে।
যত বুনাে বরা সেথা ফেরে,
তারা দাঁত দিয়ে মাটি চেরে।
সেথা শেয়াল লুকায়ে থাকে,
রাতে ‘হুয়া হুয়া’ করে ডাকে।
দেখে এইমততা কত দেশ
কেবা গণিয়া করিবে শেষ।
কোথাও কেবল বালির ডাঙা,
কোথাও মাটিগুলাে রাঙা রাঙা।
কোথাও ধারে ধারে উঠে বেত,
কোথাও দু ধারে গমের খেত।
কোথাও ছােটোখাটো গ্রামখানি,
কোথাও মাথা তােলে রাজধানী-
সেথায় নবাবের বড়াে কোঠা,
তারি পাথরের থাম মােটা,
তারি ঘাটের সােপান যত
জলে নামিয়াছে শত শত।
কোথাও সাদা পাথরের পুলে
নদী বাঁধিয়াছে দুই কূলে।
কোথাও লােহার সাঁকোয় গাড়ি
চলে ধকো ধকো ডাক ছাড়ি॥
নদী এইমতাে অবশেষে
এল নরম মাটির দেশে।
হেথা যেথায় মােদের বাড়ি
নদী আসিল দুয়ারে তারি।
হেথায় নদী নালা বিল খালে
দেশ ঘিরেছে জলের জালে।
কত মেয়েরা নাহিছে ঘাটে,
কত ছেলেরা সাঁতার কাটে,
কত জেলেরা ফেলিছে জাল,
কত মাঝিরা ধরেছে হাল,
সুখে সারিগান গায় দাঁড়ি—
কত খেয়াতরী দেয় পাড়ি॥
কোথাও পুরাতন শিবালয়
তীরে সারি সারি জেগে রয়।
সেথায় দু বেলা সকাল-সাঁঝে
পূজার কাঁসর ঘণ্টা বাজে।
কত জটাধারী ছাইমাখা
ঘাটে বসে আছে যেন আঁকা।
তীরে কোথাও বসেছে হাট,
নৌকো ভরিয়া রয়েছে ঘাট।
মাঠে কলাই সরিষা ধান,
তাহার কে করিবে পরিমাণ!
কোথাও নিবিড় আখের বনে
শালিক চরিছে আপন-মনে॥
কোথাও ধূধূ করে বালুচর,
সেথায় গাঙশালিকের ঘর।
সেথায় কাছিম বালির তলে
আপন ডিম পেড়ে আসে চলে।
সেথায় শীতকালে বুনাে হাঁস
কত ঝাঁকে ঝাঁকে করে বাস।
সেথায় দলে দলে চখাচখী
করে সারা দিন বকাবকি।
সেথায় কাদাখোঁচা তীরে তীরে
কাদায় খোঁচা দিয়ে দিয়ে ফিরে॥
কোথাও ধানের খেতের ধারে
ঘন কলাবন বাঁশঝাড়ে
ঘন আম-কাঁঠালের বনে
গ্রাম দেখা যায় এক কোণে।
সেথা আছে ধান গােলা-ভরা,
সেথা খড়গুলা রাশ-করা,
সেথা গােয়ালেতে গােরু বাঁধা
কত কালাে পাটকিলে সাদা।
কোথাও কলুদের কুঁড়েখানি,
সেথায় ক্যাঁকোঁ ক'রে ঘােরে ঘানি।
কোথাও কুমারের ঘরে চাক
দেয় সারাদিন ধ'রে পাক।
মুদি দোকানেতে সারা খন
ব'সে পড়িতেছে রামায়ণ।
কোথাও বসি পাঠশালা-ঘরে
যত ছেলেরা চেঁচিয়ে পড়ে,
বড়াে বেতখানি লয়ে কোলে
ঘুমে গুরুমহাশয় ঢােলে।
হোথায় এঁকেবেঁকে ভেঙেচুরে
গ্রামের পথ গেছে বহু দূরে।
সেথায় বােঝাই গােরুর গাড়ি
ধীরে চলিয়াছে ডাক ছাড়ি।
রােগা গ্রামের কুকুরগুলাে
ক্ষুধায় শুকিয়া বেড়ায় ধুলাে॥
যেদিন পুরনিমা রাতি আসে
চাঁদ আকাশ জুড়িয়া হাসে-
বনে ও পারে আঁধার কালাে,
জলে ঝিকিমিকি করে আলাে,
বালি চিকিচিকি করে চরে,
ছায়া ঝােপে বসি থাকে ডরে।
সবাই ঘুমায় কুটিরতলে,
তরী একটিও নাহি চলে।
গাছে পাতাটিও নাহি নড়ে,
জলে ঢেউ নাহি ওঠে পড়ে।
কভু ঘুম যদি যায় ছুটে
কোকিল কুহু কুহু গেয়ে উঠে,
কভু ও পারে চরের পাখি
রাতে স্বপনে উঠিছে ডাকি॥
নদী চলেছে ডাহিনে বামে,
কভু কোথাও সে নাহি থামে।
হেথায় গহন গভীর বন—
তীরে নাহি লােক, নাহি জন।
শুধু কুমির নদীর ধারে
সুখে রােদ পােহইছে পাড়ে।
বাঘ ফিরিতেছে ঝােপেঝাপে,
ঘাড়ে পড়ে আসি এক লাফে।
কোথাও দেখা যায় চিতাবাঘ
তাহার গায়ে চাকা চাকা দাগ,
রাতে চুপিচুপি আসি ঘাটে
জল চকো চকো করি চাটে॥
হেথায় যখন জোয়ার ছােটে
নদী ফুলিয়ে ফুলিয়ে ওঠে।
তখন কানায় কানায় জল-
কত ভেসে আসে ফুল ফল,
ঢেউ হেসে উঠে খলখল,
তরী করি উঠে টলমল।
নদী অজগরসম ফুলে
গিলে খেতে চায় দুই কূলে।
আবার ক্রমে আসে ভাঁটা প'ড়ে-
তখন জল যায় সরে সরে,
তখন নদী রােগা হয়ে আসে,
কাদা দেখা দেয় দুই পাশে,
বেরােয় ঘাটের সােপান যত
যেন বুকের হাড়ের মতাে॥
নদী চলে যায় কত দূরে
ততই জল উঠে পূরে পূরে।
শেষে দেখা নাহি যায় কূল,
চোখে দিক হয়ে যায় ভুল।
নীল হয়ে আসে জলধারা,
মুখে লাগে যেন নুন-পারা।
ক্রমে নীচে নাহি পাই তল,
ক্রমে আকাশে মিশায় জল,
ডাঙা কোন্খানে পড়ে রয়-
শুধু জলে জলে জলময়॥
ওরে একি শুনি কোলাহল,
হেরি একি ঘননীল জল।
ওই বুঝি রে সাগর হােথা—
উহার কিনারা কে জানে কোথা।
ওই লাখাে লাখাে ঢেউ উঠে
সদাই মরিতেছে মাথা কুটে।
ওঠে সাদা সাদা ফেনা যত
যেন বিষম রাগের মতাে।
জল গরজি গরজি ধায়,
যেন আকাশ কাড়িতে চায়।
বায়ু কোথা হতে আসে ছুটে,
ঢেউয়ে হাহা ক'রে পড়ে লুটে।
যেন পাঠশালা-ছাড়া ছেলে
ছুটে লাফায় বেড়ায় খেলে।
হেথা যত দূর-পানে চাই
কোথাও কিছু নাই কিছু নাই—
শুধু আকাশ বাতাস জল,
শুধুই কলকল কোলাহল,
শুধু ফেনা আর শুধু ঢেউ—
আর নাহি কিছু, নাহি কেউ॥
হেথায় ফুরাইল সব দেশ,
নদীর ভ্রমণ হইল শেষ।
হেথা সারা দিন সারা বেলা
তাহার ফুরাবে না আর খেলা।
তাহার সারা দিন নাচ গান
কভু হবে নাকো অবসান।
এখন কোথাও হবে না যেতে,
সাগর নিল তারে বুক পেতে।
তারে নীল বিছানায় থুয়ে
তাহার কাদামাটি দিবে ধুয়ে।
তারে ফেনার কাপড়ে ঢেকে,
তারে ঢেউয়ের দোলায় রেখে,
তার কানে কানে গেয়ে সুর
তার শ্রম করি দিবে দূর।
নদী চিরদিন চিরনিশি
রবে অতল আদরে মিশি॥