শেষের কবিতা/মিলনতত্ত্ব
১১
মিলনতত্ত্ব
ঠিক হয়ে গেল আগামী অঘ্রান মাসে এদের বিয়ে। যোগমায়া কোলকাতায় গিয়ে সমস্ত আয়োজন করবেন।
লাবণ্য অমিতকে বললে, ‘তোমার কোলকাতায় ফেরবার দিন অনেক কাল হল পেরিয়ে গেছে। অনিশ্চিতের মধ্যে বাঁধা পড়ে তোমার দিন কেটে যাচ্ছিল। এখন ছুটি। নিঃসংশয়ে চলে যাও। বিয়ের আগে আমাদের আর দেখা হবে না।’
‘এমন কড়া শাসন কেন?’
‘সেদিন যে সহজ আনন্দের কথা বলেছিলে তাকে সহজ রাখবার জন্যে।’
‘এটা একেবারে গভীর জ্ঞানের কথা। সেদিন তোমাকে কবি বলে সন্দেহ করেছিলুম, আজ সন্দেহ করছি ফিলজফার বলে। চমৎকার বলেছ। সহজকে সহজ রাখতে হলে শক্ত হতে হয়। ছন্দকে সহজ করতে চাও তো যতিকে ঠিক জায়গায় কষে আঁটতে হবে। লোভ বেশি, তাই জীবনের কাব্যে কোথাও যতি দিতে মন সরে না, ছন্দ ভেঙে গিয়ে জীবনটা হয় গীতহীন বন্ধন। আচ্ছা, কালই চলে যাব, একেবারে হঠাৎ এই ভরা দিনগুলোর মাঝখানে। মনে হবে, যেন মেঘনাদবধ-কাব্যের সেই চমকে-থেমে যাওয়া লাইনটা——
চলি যবে গেলা যমপুরে
- অকালে!
‘কী করবে।’
‘মাসিমা যতক্ষণ করবেন বিয়ের দিনের ব্যবস্থা ততক্ষণ আমাকে করতে হবে তার পরের দিনগুলোর আয়োজন। লোকে ভুলে যায় দাম্পত্যটা একটা আর্ট, প্রতিদিন ওকে নূতন করে সৃষ্টি করা চাই। মনে আছে বন্যা, রঘুবংশে অজ-মহারাজা ইন্দুমতীর কী বর্ণনা করেছিলেন?’
লাবণ্য বললে, ‘প্রিয়শিষ্যা ললিতে কলাবিধৌ।’
অমিত বললে, ‘সেই ললিতকলাবিধিটা দাম্পত্যেরই। অধিকাংশ বর্বর বিয়েটাকেই মনে করে মিলন, সেইজন্যে তার পর থেকে মিলনটাকে এত অবহেলা।’
‘মিলনের আর্ট্ তোমার মনে কিরকম আছে বুঝিয়ে দাও। যদি আমাকে শিষ্যা করতে চাও আজই তার প্রথম পাঠ শুরু হোক।’
‘আচ্ছা, তবে শোনো। ইচ্ছাকৃত বাধা দিয়েই কবি ছন্দের সৃষ্টি করে। মিলনকেও সুন্দর করতে হয় ইচ্ছাকৃত বাধায়। চাইলেই পাওয়া যায়, দামি জিনিসকে এত সস্তা করা নিজেকেই ঠকানো। কেননা, শক্ত করে দাম দেওয়ার আনন্দটা বড় কম নয়।’
‘দামের হিসাবটা শুনি।’
‘রোসো, তার আগে আমার মনে যে ছবিটা আছে বলি। গঙ্গার ধার, বাগানটা ডায়মণ্ড্ হার্বারের ওইদিকটাতে। ছোটো একটি স্টীম লঞ্চ্ ক’রে ঘণ্টা-দুয়েকের মধ্যে কোলকাতায় যাতায়াত করা যায়।’
‘আবার কোলকাতায় কী দরকার পড়ল?’
‘এখন কোনো দরকার নেই সে কথা জান। যাই বটে বার-লাইব্রেরিতে—ব্যাবসা করি নে, দাবা খেলি। অ্যাটর্নিরা বুঝে নিয়েছে, কাজে গরজ নেই, তাই মন নেই। কোনো আপসের মকদ্দমা হলে তার ব্রীফ আমাকে দেয়, তার বেশি আর কিছুই দেয় না। কিন্তু বিয়ের পরেই দেখিয়ে দেব কাজ কাকে বলে—জীবিকার দরকারে নয়, জীবনের দরকারে। আমের মাঝখানটাতে থাকে আঁঠি, সেটা মিষ্টিও নয়, নরমও নয়, খাদ্যও নয়; কিন্তু ওই শক্তটাই সমস্ত আমের আশ্রয়, ওইটেতেই সে আকার পায়। কোলকাতার পাথুরে আঁঠিটাকে কিসের জন্য দরকার বুঝেছ তো? মধুরের মাঝখানে একটা কঠিনকে রাখবার জন্যে।’
‘বুঝেছি। তা হলে দরকার তো আমারও আছে। আমাকেও কোলকাতায় যেতে হবে—দশটা-পাঁচটা।’
‘দোষ কী? কিন্তু পাড়া-বেড়াতে নয়, কাজ করতে।’
‘কিসের কাজ বলো। বিনা মাইনের?’
‘না না, বিনা মাইনের কাজ কাজও নয় ছুটিও নয়, বারোআনা ফাঁকি। ইচ্ছে করলেই তুমি মেয়ে-কলেজে প্রোফেসারি নিতে পারবে।’
‘আচ্ছা, ইচ্ছে করব। তার পর?’
‘স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, গঙ্গার ধার; পাড়ির নীচে তলা থেকে উঠেছে ঝুরি-নামা অতি পুরোনো বটগাছ। ধনপতি যখন গঙ্গা বেয়ে সিংহলে যাচ্ছিল তখন হয়তো এই বটগাছে নৌকো বেঁধে গাছতলায় রান্না চড়িয়েছিল। ওরই দক্ষিণ ধারে ছ্যাৎলা-পড়া বাঁধানো ঘাট, অনেকখানি ফাটল-ধরা, কিছু কিছু ধসে-যাওয়া। সেই ঘাটে সবুজে-সাদায়-রঙ-করা আমাদের ছিপ্ছিপে নৌকোখানি। তারই নীল নিশানে সাদা অক্ষরে নাম লেখা। কী নাম বলে দাও তুমি।’
‘বলব? মিতালি!’
‘ঠিক নামটি হয়েছে, মিতালি। আমি ভেবেছিলুম সাগরী, মনে একটু গর্বও হয়েছিল; কিন্তু তোমার কাছে হার মানতে হল।… বাগানের মাঝখান দিয়ে সরু একটি খাড়ি চলে গেছে, গঙ্গার হৃৎস্পন্দন বয়ে। তার ও পারে তোমার বাড়ি, এ পারে আমার।’
‘রোজই কি সাঁতার দিয়ে পার হবে, আর জানলায় আমার আলো জ্বালিয়ে রাখব?’
‘দেব সাঁতার মনে মনে, একটা কাঠের সাঁকোর উপর দিয়ে। তোমার বাড়িটির নাম মানসী, আমার বাড়ির একটা নাম তোমাকে দিতে হবে।’
‘দীপক।’
‘ঠিক নামটি হয়েছে। নামের উপযুক্ত একটি দীপ আমার বাড়ির চুড়োয় বসিয়ে দেব, মিলনের সন্ধেবেলায় তাতে জ্বলবে লাল আলো, আর বিচ্ছেদের রাতে নীল। কোলকাতা থেকে ফিরে এসে রোজ তোমার কাছ থেকে একটি চিঠি আশা করব। এমন হওয়া চাই, সে চিঠি পেতেও পারি, না পেতেও পারি। সন্ধে আটটার মধ্যে যদি না পাই তবে হতবিধিকে অভিসম্পাত দিয়ে বারট্রাণ্ড, রাসেলের লজিক পড়বার চেষ্টা করব। আমাদের নিয়ম হচ্ছে, অনাহুত তোমার বাড়িতে কোনোমতেই যেতে পারব না।'
'আর তোমার বাড়িতে আমি?'
'ঠিক এক নিয়ম হলেই ভালো হয়, কিন্তু মাঝে মাঝে নিয়মের ব্যতিক্রম হলে সেটা অসহ্য হবে না।'
‘নিয়মের ব্যতিক্রমটাই যদি নিয়ম না হয়ে ওঠে তা হলে তোমার বাড়িটার দশা কী হবে ভেবে দেখে বরঞ্চ আমি বুরকা পরে যাব।'
‘তা হোক, কিন্তু আমার নিমন্ত্রণ-চিঠি চাই। সে চিঠিতে আর-কিছু থাকবার দরকার নেই, কেবল কোনো-একটা কবিতা থেকে দুটি-চারটি লাইন মাত্র।'
‘আর আমার নিমন্ত্রণ বুঝি বন্ধ? আমি একঘরে?'
'তোমার নিমন্ত্রণ মাসে একদিন, পূর্ণিমার রাতে; চোদ্দটা তিথির খণ্ডতা যেদিন চরম পূর্ণ হয়ে উঠবে।'
‘এইবার তোমার প্রিয়শিষ্যাকে একটি চিঠির নমুনা দাও।'
'আচ্ছা বেশ। পকেট থেকে একটা নোটবই বের করে তার পাতা ছিঁড়ে লিখলে—
Blow gently over my garden
Wind of the southern sea,
In the hour my love cometh
And calleth me.
চুমিয়া যেয়ো তুমি
আমার বনভূমি,
দখিন-সাগরের সমীরণ,
যে শুভখনে মম
আসিবে প্রিয়তম—
ডাকিবে নাম ধ’রে অকারণ।
লাবণ্য কাগজখানা ফিরিয়ে দিলে না।
অমিত বললে, ‘এবারে তোমার চিঠির নমুনা দাও, দেখি তোমার শিক্ষা কত দূর এগোল।’
লাবণ্য একটা টুকরো কাগজে লিখতে যাচ্ছিল। অমিত বললে, ‘না, আমার এই নোটবইয়ে লেখো।’
লাবণ্য লিখে দিলে—
মিতা, ত্বমসি মম জীবনং, ত্বমসি মম ভূষণং,
ত্বমসি মম ভবজলধিরত্নম্।
অমিত বইটাকে পকেটে পুরে বললে, ‘আশ্চর্য এই, আমি লিখেছি মেয়ের মুখের কথা, তুমি লিখেছ পুরুষের। কিছুই অসংগত হয় নি। শিমুলকাঠই হোক আর বকুলকাঠই হোক, যখন জ্বলে তখন আগুনের চেহারাটা একই।’
লাবণ্য বললে, ‘নিমন্ত্রণ তো করা গেল, তার পরে?’
অমিত বললে, সন্ধ্যাতারা উঠেছে, জোয়ার এসেছে গঙ্গায়, হাওয়া উঠল ঝির্ ঝির্ করে ঝাউগাছগুলোর সার বেয়ে, বুড়ো বটগাছটার শিকড়ে শিকড়ে উঠল স্রোতের ছল্ছলানি। তোমার বাড়ির পিছনে পদ্মদিঘি, সেইখানে খিড়কির নির্জন ঘাটে গা ধুয়ে চুল বেঁধেছ। তোমার এক-একদিন এক-এক রঙের কাপড়, ভাবতে ভাবতে যাব আজকে সন্ধেবেলার রঙটা কী। মিলনের জায়গারও ঠিক নেই, কোনোদিন শানবাঁধানো চাঁপাতলায়, কোনোদিন বাড়ির ছাতে, কোনোদিন গঙ্গার ধারের চাতালে। আমি গঙ্গায় স্নান সেরে সাদা মলমলের ধুতি আর চাদর পরব, পায়ে থাকবে হাতির দাঁতে কাজ করা খড়ম। গিয়ে দেখব, গালচে বিছিয়ে বসেছ, সামনে রুপোর রেকাবিতে মোটা গোড়ে মালা, চন্দনের বাটিতে চন্দন, এক কোণে জ্বলছে ধূপ। ••• পুজোর সময় অন্তত দু মাসের জন্যে দুজনে বেড়াতে বেরোব। কিন্তু দুজনে দু জায়গায়। তুমি যদি যাও পর্বতে আমি যাব সমুদ্রে।— এই তো আমার দাম্পত্য-দ্বৈরাজ্যের নিয়মাবলী তোমার কাছে দাখিল করা গেল। এখন তোমার কী মত?'
‘মেনে নিতে রাজি আছি।'
‘মেনে নেওয়া, আর মনে নেওয়া, এই দুইয়ের যে তফাত আছে বন্যা।'
‘তোমার যাতে প্রয়োজন আমার তাতে প্রয়োজন নাও যদি থাকে, তবু আপত্তি করব না।'
‘প্রয়োজন নেই তোমার?'
‘না, নেই। তুমি আমার যতই কাছে থাক তবু আমার থেকে তুমি অনেক দূরে। কোনো নিয়ম দিয়ে সেই দূরত্বটুকু বজায় রাখা আমার পক্ষে বাহুল্য। কিন্তু আমি জানি, আমার মধ্যে এমন কিছুই নেই যা তোমার কাছের দৃষ্টিকে বিনা লজ্জায় সইতে পারবে, সেইজন্যে দাম্পত্যে দুই পারে দুই মহল করে দেওয়া আমার পক্ষে নিরাপদ।'
অমিত চৌকি থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললে, 'তোমার কাছে আমি হার মানতে পারব না বন্যা, যাক গে আমার বাগানটা। কোলকাতার বাইরে এক পা নড়ব না। নিরঞ্জনদের আপিসের উপরের তলায় পঁচাত্তর টাকা দিয়ে একটা ঘর ভাড়া নেব। সেইখানে থাকবে তুমি, আর থাকব আমি। চিদাকাশে কাছে-দূরে ভেদ নেই। সাড়ে তিন হাত চওড়া বিছানায় বাঁ পাশে তোমার মহল মানসী, ডান পাশে আমার মহল দীপক। ঘরের পুব দেওয়ালে একখানা আয়নাওয়ালা দেরাজ, তাতেই তোমারও মুখ দেখা আর আমারও। পশ্চিম দিকে থাকবে বইয়ের আলমারি, পিঠ দিয়ে সেটা রোদ্দুর ঠেকাবে আর সামনের দিকে সেটাতে থাকবে দুটি পাঠকের একটিমাত্র সার্ক্যুলেটিং লাইব্রেরি। ঘরের উত্তর দিকটাতে একখানি সোফা, তারই বাঁ পাশে একটু জায়গা খালি রেখে আমি বসব এক প্রান্তে, তোমার কাপড়ের আলনার আড়ালে তুমি দাঁড়াবে— দু হাত তফাতে। নিমন্ত্রণের চিঠিখানা উপরের দিকে তুলে ধরব কম্পিত হস্তে, তাতে লেখা থাকবে—
ছাদের উপরে বহিয়ো নীরবে
ওগো দক্ষিণ হাওয়া,
প্রেয়সীর সাথে যে নিমেষে হবে
চারি চক্ষুতে চাওয়া।
‘কিছু না মিতা। কিন্তু, এটা সংগ্রহ হল কোথা থেকে?'
‘আমার বন্ধু নীলমাধবের খাতা থেকে। তার ভাবী বধূ তখন অনিশ্চিত ছিল। তাকে উদ্দেশ করে ওই ইংরেজি কবিতাটাকে কোলকাতাই ছাঁচে ঢালাই করেছিল, আমিও সঙ্গে যোগ। দিয়েছিলুম। ইকনমিক্সে এম. এ. পাস করে পনেরো হাজার টাকা নগদ পণ আর আশি ভরি গয়না-সমেত নববধূকে লোকটা ঘরে আনলে, চার চক্ষে চাওয়াও হল, দক্ষিণে বাতাসও বয়, কিন্তু ওই কবিতাটাকে আর ব্যবহার করতে পারলে না। এখন তার অপর শরিককে কাব্যটির সর্বস্বত্ব সমর্পণ করতে বাধবে না।'
‘তোমারও ছাদে দক্ষিনে বাতাস বইবে, কিন্তু তোমার নববধূ কি চিরদিনই নববধূ থাকবে?'
টেবিলে প্রবল চাপড় দিতে দিতে উচ্চৈঃস্বরে অমিত বললে, ‘থাকবে, থাকবে, থাকবে।'
যোগমায়া পাশের ঘর থেকে তাড়াতাড়ি এসে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী থাকবে অমিত? আমার টেবিলটা বোধ হচ্ছে থাকবে না।'
‘জগতে যা-কিছু টেকসই সবই থাকবে। সংসারে নববধূ দুর্লভ, কিন্তু লাখের মধ্যে একটি যদি দৈবাৎ পাওয়া যায় সে চিরদিনই থাকবে নববধূ।'
‘একটা দৃষ্টান্ত দেখাও দেখি।'
‘একদিন সময় আসবে, দেখাব।'
‘বোধ হচ্ছে তার কিছু দেরি আছে, ততক্ষণ খেতে চলো।'