শোধ-বোধ/প্রথম অঙ্ক/পঞ্চম দৃশ্য

উইকিসংকলন থেকে

পঞ্চম দৃশ্য

বাগান

সুকুমারীর প্রবেশ

 সুকু। দেখো দেখি, এখন সতীশ কেমন পরিশ্রম করে’ কাজকর্ম্ম ক’রচে। দেখ অতবড় সাহেব বাবু আজকাল পুরোনো কালো আলপাকার চাপকানের উপর কোঁচানো চাদর ঝুলিয়ে কেমন নিয়মিত আফিসে যায়।

 শশধর। বড়ো সাহেব সতীশের খুব প্রশংসা করেন।

 সুকুমারী। ভালোই তো, যা মাইনে পাবে, তাতেই বেশ চলে’ যাবে। তার উপরে যদি তোমার জমিদারিটা তাকে দিয়ে বসো, তবে একদিনে সে টাই-কলার-জুতা ছড়ি কিনেই সেটা নিলামে চড়িয়ে দেবে। আমার পরামর্শ নিয়ে যদি চ’লতে, তবে সতীশ এত দিনে মানুষের মতো হ’তো।

 শশধর। বিধাতা আমাদের বুদ্ধি দেন নি, কিন্তু স্ত্রী দিয়েচেন, আর তোমাদের বুদ্ধি দিয়েচেন, তেমনি সঙ্গে সঙ্গে নির্ব্বোধ স্বামীগুলাকেও তোমাদের হাতে সমর্পণ ক’রেছেন—আমাদেরই জিত।

 সুকুমারী। আচ্ছা আচ্ছা, ঢের হয়েচে, ঠাট্টা ক’র্‌তে হবে না। কিন্তু সতীশের পিছনে এত দিন যে টাকাটা ঢেলেছো, সে যদি আজ থাকতো, তবে—

 শশধর। সতীশ তো বলেচে, কোনো-একদিন সে সমস্তই শোখ করে’ দেবে।

 সুকুমারী। রইলো। সে তো বরাবরই ঐ রকম লম্বা-চৌড়া কথা বলে’ থাকে। তুমি বুঝি সেই ভরসায় পথ চেয়ে বসে’ আছো।

 শশধর। এত দিন তো ভরসা ছিলো, তুমি যদি পরামর্শ দাও তো সেটা বিসর্জ্জন দিই।

 সুকুমারী। দিলে তোমার বেশী লোক্‌সান হবে না, এই পর্য্যন্ত বল্‌তে পারি। ঐ যে তোমার সতীশ বাবু আস্‌ছেন। আমি যাই।

সতীশের প্রবেশ

 সতীশ। মাসিমা, পালাতে হবে না, এই দেখ, আমার হাতে অস্ত্র-শস্ত্র কিছুই নেই—কেবল খান কয়েক নোট আছে!

 শশধর। ইস্, এ যে এক তাড়া নোট। যদি আপিসের টাকা হয় তো এমন করে, সঙ্গে নিয়ে বেড়ানো ভালো হচ্চে না, সতীশ।

 সতীশ। আর সঙ্গে নিয়ে বেড়াব না। মাসিমাব পায়ে বিসর্জ্জন দিলাম। প্রণাম হই মাসিমা! বিস্তর অনুগ্রহ ক’রেছিলে, তখন তার হিসাব রাখ্‌তে হবে মনেও করিনি, সুতরা পরিশোধের অঙ্কে কিছু ভুলচুক্ হতে পারে! এই পনরো হাজার টাকা গুণে নাও। তোমার হরেনের পোলাও-পরমান্নে একটি তণ্ডুলকণাও কম না পড়ুক্।

 শশধর। এ কি কাণ্ড সতীশ! এত টাকা কোথায় পেলে?

 সতীশ। আমি গুণচট আজ ছয়মাস আগাম খরিদ করে’ রেখেচি—ইতিমধ্যে দর চড়েছে, তাই মুনাফা পেয়েছি।

 শশধর। সতীশ, এ যে জুয়োখেলা!

 সতীশ। খেলা এইখানেই শেষ, আর দরকার হবে না।

 শশধর। তোমার এ টাকা তুমি নিয়ে যাও, আমি চাই না।

 সতীশ। তোমাকে তো দিই নি মেসোমশায়! এ মাসিমার ঋণ শোধ,তোমার ঋণ কোনকালে শোধ ক’র্‌তে পার্‌বো না।

 শশধর। কি সুকু, এ টাকাগুলো—

 সুকুমারী। গুণে খাতাঞ্জির হাতে দাও না, ঐখানেই কি ছড়ানো পড়ে’ থাক্‌বে? (নোটগুলি তুলিয়া গুণিয়া দেখা)

 শশধর। সতীশ, খেয়ে এসেছ তো?

 সতীশ। বাড়ি গিয়ে খাবো।

 শশধর। আাঁ, সে কি কথা! বেলা যে বিস্তর হ’য়েছে। আজ এইখানেই খেয়ে যাও।

 সতীশ। আর খাওয়া নয় মেসোমশায়। এক দফা শোধ ক’রলেম, অন্নঋণ আর নূতন করে’ ফাঁদ্‌তে পার্‌বো না।

প্রস্থান।

 সুকুমারী। বাপের হাত থেকে রক্ষা করে’ এত দিন ওকে খাইয়ে পরিয়ে মানুষ ক’র্‌লেম, আজ হাতে দু’পয়সা আস্‌তেই ভাবখানা দেখেছো। কৃতজ্ঞতা এমনই বটে! ঘোর কলি কি না!

উভয়ের প্রস্থান।

সতীশের প্রবেশ

 সতীশ। এই পিস্তলে দু’টি গুলি পূরেচি—এই যথেষ্ট! আমার অন্তিমের প্রেয়সী। ও কে ও? হরেন! কী ক’র্‌ছিস্? এই সন্ধ্যার সময় বাগানে অন্ধকার যে, চারদিকে কেউ নেই—পালা, পালা, পালা। (কপালে আঘাত করিয়া) সতীশ, কি ভাবচিস্ তুই—ওরে সর্ব্বনেশে, চুপ্ চুপ্—না, না, না, এ কী বক্‌চি? আমি কি পাগল হ’য়ে গেলুম?—

কে আছিস ওখানে? বেহারা, বেহারা। কেউ না, কেউ কোথাও নেই। মাসিমা! শুন্‌তে পাচ্চ? ইঃ, একেবারে লুটোপুটি ক’র্‌তে থাকবে। আঃ। হাতকে আর সামলাতে পাচ্চিনে। হাতটাকে নিয়ে কী করি। হাতটাকে নিয়ে কী করা যায়! (ছড়ি লইয়া সতীশ সবেগে চারা গাছগুলিকে ক্রমাগত আঘাত করিতে লাগিলো। তাহাতে তাহার উত্তেজনা ক্রমশঃ আরো বাড়িয়া উঠিতে লাগিলো। অবশেষে নিজের হাতকে সবেগে আঘাত করিলো, কিন্তু কোন বেদনা বোধ করিলো না, শেষে পকেটের ভিতর হইতে পিস্তল সগ্রহ করিয়া লইয়া সে হরেনের দিকে সবেগে অগ্রসর হইতে লাগিল।

 হরেন। (চমকিয়া উঠিয়া) এ কী! দাদা না কী। তোমার দু’টি পায়ে পড়ি দাদা, তোমার দুটি পায়ে পড়ি, কাঁচাপেয়ারা পাড়্‌ছিলুম, বাবাকে বলে’ দিয়ো না।

 সতীশ। (চীৎকার করিয়া) মেসোমশায়, এই বেলা রক্ষা করো, আর দেরি কোরো না—তোমার ছেলেকে এখনো রক্ষা করো।

 শশধর। (ছুটিয়া আসিয়া) কী হ’য়েছে সতীশ? কী হয়েচে?

 সুকুমারী। (ছুটিয়া আসিয়া) কী হ’য়েছে সতীশ। কী হ’য়েচে?

 হরেন। কিছুই হয় নি মা—কিছুই না—দাদা তোমাদের সঙ্গে ঠাট্টা ক’রচেন!

 সুকুমারী। এ কী বকম বিশ্রী ঠাট্টা। ছি, ছি, সকলি অনাসৃষ্টি! দেখো দেখি। আমার বুক এখনো ধড়াস ধড়াস ক’র্‌চে। সতীশ মদ ধ’রেচে বুঝি?

 সতীশ। পালাও—তোমার ছেলেকে নিয়ে পালাও। নইলে তোমাদের রক্ষা নেই।

(হরেনকে লইয়া ত্রস্তপদে সুকুমারীর পলায়ন)

 শশধর। সতীশ, অমন উতলা হ’য়ো না। ব্যাপারটা কী বলো! হরেনকে কার হাত থেকে রক্ষা ক’রবার জন্য ডেকেছিলে?

 সতীশ। আমার হাত থেকে (পিস্তল দেখাইয়া) এই দেখ এই দেখ—মেসোমশায়।

দ্রুতপদে বিধুমুখীর প্রবেশ

 বিধু। সতীশ, তুই কোথায় কী সর্ব্বনাশ করে’ এসেছিস্ বল দেখি! আপিসের সাহেব পুলিস সঙ্গে নিয়ে আমাদের বাড়িতে খানাতল্লাসি ক’রতে এসেচে। যদি পালাতে হয়, এই বেলা পালা! হায় ভগবান্! আমি তো কোনো পাপ করিনি, আমারি অদৃষ্টে এত দুঃখ ঘটে কেন?

 সতীশ। ভয় নেই—পালাবার উপায় আমার হাতেই আছে।

 শশধর। তবে কী তুমি—

 সতীশ। তাই বটে মেসোমশায়, যা সন্দেহ ক’রেচো, তাই। আমি চুরি করে’ মাসির ঋণ শোধ ক’রেচি। আমি চোর। মা তুমি শুনে খুসী হবে, আমি চোর, আমি খুনী! তোমার কীর্ত্তি পূরো হ’লো। এখন আর কাঁদ্‌তে হবে না—যাও তুমি, যাও তুমি, যাও যাও, আমার সম্মুখ থেকে যাও। আমার অসহ্য় বোধ হচ্ছে।

 শশধর। সতীশ, তুমি আমার কাছেও তো কিছু ঋণী আছ, তাই শোধ করে’ যাও।

 সতীশ। বলো, কেমন করে’ শোধ ক’র্‌বো। কী আমি দিতে পারি। কী চাও তুমি!

 শশধর। ঐ পিস্তলটা।

 সতীশ। এই দিলাম। আমি জেলেই যাব। না গেলে আমার পাপের ঋণ শোধ হবে না।

 শশধর। পাপের ঋণ শাস্তির দ্বারা শোধ হয় না, সতীশ, কর্ম্মের দ্বারাই শোধ হয়। তুমি নিশ্চয় জেনো, আমি অনুরোধ ক’ল্লে তোমার বড়ো সাহেব তোমাকে জেলে দেবেন না। এখন থেকে জীবনকে সার্থক করে’ বেঁচে থাকো।

 সতীশ। মেসোমহাশয়, আমার পক্ষে বাঁচা যে কত কঠিন, তা তুমি জানো না—

 শশধর। তবু বাঁচতে হবে, আমার ঋণের এই শোধ। আমাকে ফাঁকি দিয়ে পালাতে পারবে না।

 সতীশ। তবে তাই হবে।

 শশধর। আমার একটা অনুরোধ শোনো। তোমার মাকে আর মাসীকে ক্ষমা করো।

 বিধু। বাবা, আমার কপালে ক্ষমা না থাকে, নাই থাক্, ভগবান্ তোকে যেন ক্ষমা করেন। দিদির কাছে যাই। তাঁর পায়ে ধরিগে।

প্রস্থান।

 শশধর। তবে এসো, সতীশ, আমার ঘরে আজ আহার করে যেতে হবে।

দ্রুতপদে নলিনীর প্রবেশ

 নলিনী। সতীশ।

 সতীশ। কী নলিনী?

 নলিনী। এর মানে কি? এ চিঠি তুমি আমাকে কেন লিখেচো?

 সতীশ। মানে যেমন বুঝেছিলে, সেইটেই ঠিক। আমি তোমাকে প্রতারণা করে’ চিঠি লিখি নি। তবে আমার ভাগ্যক্রমে সকলি উল্টো হয়। তুমি মনে ক’রতে পার, তোমার দয়া উদ্রেক ক’রবার জন্যই আমি—কিন্তু মেসোমশায় সাক্ষী আছেন, আমি অভিনয় ক’রছিলেম না—তবু যদি বিশ্বাস না হয়, প্রতিজ্ঞা রক্ষা ক’রবার এখনো সময় আছে।

 নলিনী। কি তুমি পাগলের মতো ব’কচো? আমি তোমার কী অপরাধ করেছি যে, তুমি আমাকে এমন নিষ্ঠুরভাবে—

 সতীশ। যে জন্য আমি এই সঙ্কল্প ক’রেছি, সে তুমি জান, নলিনী—আমি তো একবর্ণও গোপন করিনি, তবে কী আমার উপর শ্রদ্ধা আছে?

 নলিনী। শ্রদ্ধা। সতীশ, তোমার উপর ঐ জন্যই আমার রাগ ধরে। শ্রদ্ধা—ছি, ছি, শ্রদ্ধা তো পৃথিবীতে অনেকেই অনেককে করে। তুমি যে কাজ ক’রেছো, আমিও তাই ক’রেছি—তোমাতে আমাতে কোন ভেদ রাখিনি। এই দেখ, আমার গহনাগুলি সব এনেচি—এগুলো এখনো আমার সম্পত্তি নয়—এগুলি আমার বাপমায়ের। আমি তাঁদের না ব’লে’ চুরি ক’রেই এনেচি, এর কত দাম হ’তে পারে, আমি কিছুই জানিনে, কিন্তু এ দিয়ে কি তোমার উদ্ধার হবে না।

 শশধর। উদ্ধার হবে, এই গহনাগুলিব সঙ্গে আরো অমূল্য যে ধনটি দিয়েচ, তা দিয়েই সতীশের উদ্ধার হবে।

 নলিনী। এই যে শশধর বাবু, মাপ্ ক’রবেন, তাড়াতাড়িতে আপনাকে আমি—

 শশধর। মা, সে জন্য লজ্জা কি। দৃষ্টির দোষ কেবল আমাদের মত বুড়োদেরই হয় না—তোমাদের বয়সে আমাদের মত প্রবীণ লোক হঠাৎ চোখে ঠেকে না। সতীশ, তোমার আফিসের সাহেব এসেছেন দেখ্‌চি। আমি তাঁর সঙ্গে কথাবার্ত্তা কয়ে আসি। ততক্ষণ তুমি আমার হয়ে’ অতিথিসৎকার করো। মা, এই পিস্তলটা এখন তোমার জিম্বাতেই থাক্‌তে পারে।

যবনিকা