ব্যবহারকারী:Subrata Roy/শ্রীশ্রীচৈতন্যচরিতামৃত/আদিলীলা/দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে


শ্রীচৈতন্যপ্রভুং বন্দে
বালোহপি যদনুগ্রহাৎ।
তরেন্নানামতগ্রাহ-
ব্যাপ্তং সিদ্ধান্তসাগরম্‌।। ১

অন্বয়ঃ।- বালোহপি (বালকেও) যদনুগ্রহাৎ (যাঁহার অনুগ্রহে) নানামতগ্রাহব্যাপ্তং (নানামতরূপ কুম্ভীরাদি জনজন্তুসঙ্কুল) সিদ্ধান্তসাগরং তরেৎ (সিদ্ধান্ত সাগর উত্তীর্ণ হয়) তং শ্রীচৈতন্যপ্রভুং বন্দে (সেই শ্রীচৈতন্যপ্রভুকে বন্দনা করি)।

অনুবাদ।- শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুকে বন্দনা করি, যাঁর অনুগ্রহে বালকও জলজন্তুসঙ্কুল সমুদ্রের মতন কুতর্কসঙ্কুল শাস্ত্রসিদ্ধান্ত পার হ'তে পারে।। ১ ।।

কৃষ্ণোৎকীর্ত্তনগাননর্ত্তনকলা-
পাধোজনিভ্রাজিতা,
সদ্ভক্তাবলিহংসচক্রমধুপ-
শ্রেণীবিলাসাস্পদম্‌।
কর্ণানন্দিকলধ্বনির্ব্বহতু মে
জিহ্বামরু-প্রাঙ্গণে,
শ্রীচৈতন্য দয়ানিধে তব লস-
ল্লীলাসুধাস্বর্ধু নী।। ২

অন্বয়ঃ।- শ্রীচৈতন্য দয়ানিধে! কৃষ্ণোৎকীর্ত্তন-গান-নর্ত্তন-কলা-পাধোজনিভ্রাজিতা (শ্রীকৃষ্ণবিষয়ক উচ্চসংকীর্ত্তন গান এবং নৃত্যের বৈদগ্ধারূপ কমলের দ্বারা সুশোভিত) সদ্ভক্তাবলিহংসচক্রমধুপশ্রেণীবিলাসাস্পদং (এবং যাহা সাধু ভক্তাবলীরূপ হংসচক্রবাক ও মধুকরশ্রেণীর বিহারের উপযুক্ত স্থান স্বরূপ) কর্ণানন্দিকলধ্বনিঃ (যাহা কর্ণের আনন্দজনক কলধ্বনিবিশিষ্ট) তব লসল্লীলা-সুধাস্বর্ধু নী (তোমার সেই সমু্জ্জল লীলারূপ অমৃতমন্দাকিনী) মে জিহ্বামরুপ্রাঙ্গণে বহতু (আমার জিহ্বারূপ মরুপ্রাঙ্গণে প্রবাহিত হউক)।

অনুবাদ।- হে চৈতন্য, দয়ানিধি! তোমার উজ্জললীলামৃত স্বর্গের মন্দাকিনীর সঙ্গে তুলনীয়। স্বর্গের মন্দাকিনী কমলশোভিত, তোমার লীলা কৃষ্ণের কীর্ত্তন গানে ও নর্ত্তনে শোভিত। স্বর্গের মন্দাকিনী হংস, চক্রবাক ও মধুকর-শ্রেণীর বিলাসস্থল, তোমার লীলাও সজ্জন ও ভক্তদের বিলাসস্থল। স্বর্গের মন্দাকিনীর কলধ্বনি শ্রুতিসুখকর, তোমার লীলার সংকীর্ত্তনধ্বনিও শ্রুতিসুখকর। কৃষ্ণনামগুণকীর্ত্তনহীন আমার রসনা মরুর সঙ্গে তুলনীয়, মন্দাকিনীর মত তোমার লীলারসস্রোতস্বিনী আমার জিহ্বামরুতে প্রবাহিত হোক।। ২ ।।

জয় জয় শ্রীচৈতন্য জয় নিত্যানন্দ।
জয়াদ্বৈতচন্দ্র জয় গৌর ভক্তবৃন্দ।।
তৃতীয় শ্লোকের অর্থ করি বিবরণ।
বস্তু-নির্দ্দেশরূপ মঙ্গলাচরণ।।
তথাহি গ্রন্থকারস্য
যদদ্বৈতং ব্রহ্মোপনিষদি তদপ্যস্য তনুভা
য আত্মান্তর্য্যামী পুরুষ ইতি সোহস্যাংশবিভবঃ।
ষড়ৈশ্বর্য্যৈঃ পূর্ণো য হই ভগবান্‌ স স্বয়ময়ং
ন চৈতন্যাৎ কৃষ্ণাজ্জগতি পরতত্ত্বং পরমিহ।। ৩

অনুবাদ।- এর অনুবাদ প্রথম পরিচ্ছেদের ৩নং শ্লোকে আছে।

ব্রহ্ম আত্মা ভগবান্‌ অনুবাদ তিন।
অঙ্গপ্রভা অংশ স্বরূপ তিন বিধেয় চিহ্ন (১)।।
অনুবাদ আগে, পাছে বিধেয় স্থাপন।
সেই অর্থ কহি শুন শাস্ত্র বিবরণ।।

(১) ব্রহ্ম, আত্মা, ভগবান্‌ এই তিনটি অনুবাদ এবং অঙ্গপ্রভা, অংশ ও স্বরূপ এই তিনটি বিধেয়। - "বিধেয় কহিয়ে তারে যে বস্তু অজ্ঞাত। অনুবাদ কহি তারে যেই হয় জ্ঞাত।" অর্থাৎ যথাক্রমে ব্রহ্ম শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যের অঙ্গকান্তি, পরমাত্মা অংশ ও ভগবান স্বরূপ। চিহ্ন - চেন অর্থাৎ জান।

স্বয়ং ভগবান্‌ কৃষ্ণ, কৃষ্ণ পরতত্ত্ব।
পূর্ণজ্ঞান পূর্ণানন্দ পরম মহত্ত্ব।।
নন্দসুত বলি যাঁরে ভাগবতে গাই।
সেই কৃষ্ণ অবতীর্ণ চৈতন্য গোসাঞি।।
প্রকাশবিশেষে তেঁহো (১) ধরে তিন নাম।
ব্রহ্ম পরমাত্মা আর পূর্ণ ভগবান্‌।।
তাহার অঙ্গের শুদ্ধ কিরণ (২) মণ্ডল।
উপনিষদ্‌ (৩) কহে তারে ব্রহ্ম সুনির্ম্মল (৪)।।
চর্ম্মচক্ষে দেখে যৈছে সূর্য্য নির্ব্বিশেষ।
জ্ঞানমার্গে লৈতে নারে কৃষ্ণের বিশেষ (৫)।।

(১) তেঁহো - তিনি অর্থাৎ শ্রীনন্দ-নন্দন।

(২) শুদ্ধকিরণ - অপ্রাকৃত জ্যোতিঃ বা জ্যোতির্মাত্র।

(৩) উপনিষদ্‌ - বেদের জ্ঞানকাণ্ড।

(৪) সুনির্ম্মল - মায়াস্পর্শশূন্য।

(৫) মানব দিব্য দৃষ্টি লাভ না করিলে সাধারণ দৃষ্টিতে সূর্য্যদেবের চতুর্ভুজ মূর্ত্তি দেখিতে পায় না, তাঁহাকে আলোকপিণ্ড বলিয়াই জানে। সেইরূপ ভক্তি না থাকিলে শুধু জ্ঞান দ্বারা মানব শ্রীভগবানের শ্যামসুন্দর মূর্ত্তি দেখিতে পায় না, তাঁহাকে নিরাকার কিরণ-মাত্র ভাবিয়া নিরাকার ব্রহ্ম বলিয়া আখ্যাত করে।

তথাহি - শ্রীমদ্ভাগবতে (১।২।১১)
বদন্তি তত্তত্ত্ববিদ-
স্তত্ত্বং যজ্‌জ্ঞানমদ্বয়ম্‌।
ব্রহ্মেতি পরমাত্মেতি
ভগবানিতি শব্দ্যতে।। ৪

অন্বয়ঃ।- [শ্রীশুকদেব শৌনকাদিকে বলিতেছেন] - তত্ত্ববিদ তৎ তত্ত্বং বদন্তি (তত্ত্ববিদ্‌ পণ্ডিতগণ তাহাকে তত্ত্ব বলিয়া থাকেন) যৎ অদ্বয়ম্‌ জ্ঞানং (যে অখণ্ড দ্বিতীয়রহিত জ্ঞানকে) ব্রহ্ম ইতি, পরমাত্মা ইতি ভগবান্‌ ইতি শব্দ্যতে (তাঁহারা ব্রহ্ম, পরমাত্মা এবং ভগবান্‌ এই নামে অভিহিত করিয়া থাকেন)।

অনুবাদ।- তত্ত্বজ্ঞেরা যে অদ্বয়জ্ঞানকে তত্ত্ব বলে থাকেন, সেই অখণ্ড তত্ত্বই কখনো ব্রহ্ম রূপে, কখনো পরমাত্মা রূপে, কখনো বা ভগবান্‌ রূপে কথিত হ'য়ে থাকেন।। ৪ ।।

ব্রহ্মসংহিতায়াং ৫ অধ্যায়ে ৪০ শ্লোকে-
যস্য প্রভা প্রভবতো জগদণ্ডকোটি-
কোটিষ্বশেষবসুধাদিবিভূতিভিন্নম্‌।
তদ্ব্রহ্ম নিষ্কলমনন্তমশেষভূতং
গোবিন্দমাদিপুরুষং তমহং ভজামি।। ৫

অন্বয়ঃ।- জগদণ্ড-কোটিকোটিষু (কোটি কোটি ব্রহ্মাণ্ডে) অশেষ বসুধাদিবিভূতিভিন্নং (অশেষ পৃথিব্যাদি বিভূতির দ্বারা ভেদপ্রাপ্ত) নিষ্কলম (পরিপূর্ণ) অনন্তম্‌ অশেষভূম্‌ (অন্তহীন এবং অশেষভূত) তৎ ব্রহ্ম (সেই ব্রহ্ম) প্রভবতঃ যস্য প্রভা (প্রভাবশালী যাঁহার কান্তি) তম্‌ আদিপুরুষং গোবিন্দম্‌ অহং ভজামি (সেই আদিপুরুষ গোবিন্দকে আমি ভজনা করি)।

অনুবাদ।- আদিম আদিপুরুষ গোবিন্দকে ভজনা করি। প্রভাবশালী এঁরই প্রভা ব্রহ্ম-কোটি কোটি ব্রহ্মাণ্ডে যাঁর ক্ষিতি অপ্‌ প্রভৃতি বিভূতি পরিব্যাপ্ত এবং যিনি নিষ্কল অর্থাৎ অখণ্ড, অনন্ত ও অশেষভূত।। ৫ ।।

কোটি কোটি ব্রহ্মাণ্ডে যে ব্রহ্মের বিভূতি।
সেই ব্রহ্ম গোবিন্দের হয় অঙ্গ-কান্তি।।
সে গোবিন্দ ভজি আমি তেঁহো মোর পতি।
তাঁহার প্রসাদে মোর হয় সৃষ্টিশক্তি।।
তথাদি-শ্রীমদ্ভাগবতে (১১।৬।৪৭)
মুনয়ো বাতবসনাঃ
শ্রমণা ঊর্দ্ধমন্থিনঃ।
ব্রহ্মাখ্যং ধাম তে যান্তি
শান্তাঃ সন্ন্যাসিনোহমলাঃ।। ৬

অন্বয়ঃ।- [উদ্ধব শ্রীভগবানকে বলিতেছেন-] বাতবসনাঃ (দিগম্বর) মুনয়ঃ (মুনিগণ) ঊর্দ্ধমন্থিনঃ (ঊর্দ্ধরেতা) শান্তাঃ শ্রমণাঃ (জিতেন্দ্রিয় সাধুগণ) অমলাঃ সন্ন্যাসিনঃ (বিমলচিত্ত সন্ন্যাসিগণ) তে ব্রহ্মাখ্যং ধাম যান্তি (তোমার ব্রহ্মনামক ধামে গমন করেন)।

অনুবাদ।- দিগম্বর মুনিগণ, জিতেন্দ্রিয় সাধুগণ এবং নির্ম্মলচরিত্র শান্ত সন্ন্যাসিগণ তোমার ব্রহ্মরূপ ধামে গমন করেন।। ৬ ।।

আত্মা-অন্তর্য্যামী যারে যোগশাস্ত্রে কয়।
সেহ গোবিন্দের অংশবিভূতি যে হয়।।
অনন্ত স্ফটিকে যৈছে এক সূর্য্য ভাসে (১)।
তৈছে জীবে গোবিন্দের অংশ পরকাশে।।
তথাহি-শ্রীমদ্ভগবদগীতায়াং (১০।৪২)
অথবা বহুনৈতেন কিং জ্ঞাতেন তবার্জ্জুন।
বিষ্টভ্যাহমিদং কৃৎস্নমেকাংশেন স্থিতো জগৎ।। ৭

অন্বয়ঃ।- [শ্রীকৃষ্ণ অর্জ্জুনকে কহিলেন-] অথবা (হে) অর্জ্জুন! বহুনা (পৃথক্‌ পৃথ্ক্‌) এতেন জ্ঞাতেন তব কিম্‌ (ইহা জানিয়া তোমার কি প্রয়োজন?) অহম একাংশেন (আমি এক অংশের দ্বারাই) ইদং কৃৎস্নং জগৎ (এই সকল জগৎ) বিষ্টভ্য স্থিতঃ(ব্যাপিয়া অবস্থিত)।

অনুবাদ।- হে অর্জ্জুন! একটি একটি করে জানার কি প্রয়োজন? আমার একাংশ দিয়ে আমি সারা জগৎ ব্যাপ্ত করে রেখেছি।। ৭ ।।

তমিমমহমজং শরীরভাজাং
হৃদি হৃদি ধিষ্ঠিতমাত্মকল্পিতানাম্‌।
প্রতিদৃশমিব নৈকধার্কমেকং
সমধিগতোহস্মি বিধূতভেদমোহঃ।। ৮

অন্বয়ঃ।- [শ্রীভীষ্মদেব শ্রীকৃষ্ণের স্তব করিতেছেন-) বিধূতভেদমোহঃ অহম্‌ (যাহার ভেদরূপ মোহ দূরীভূত হইয়াছে সেই আমি) আত্ম-কল্পিতানাং (স্বয়ংনির্ম্মিত) শরীরভাজাং হৃদি হৃদি ধিষ্ঠিতম (শরীরধারিগণের হৃদয় হৃদয়ে অধিষ্ঠিত) তম্‌ ইমম্‌ অজং (সেই এই জন্মরহিত শ্রীকৃষ্ণকে) একম্‌ অর্কং প্রতিদৃশং নৈকথা ইব (প্রত্যেকের দৃষ্টিতে বহুপ্রকারে প্রতিভাত সূর্য্যবৎ) সমধিগতোহস্মি (প্রাপ্ত হইয়াছি)।

অনুবাদ।- আমার ভেদমোহ আর নেই, কারণ আমি জেনেছি, বিভিন্ন লোকের দৃষ্টিতে নানাভাবে প্রকাশিত হ'লেও সূর্য্য যেমন এক, তেমনি নিজসৃষ্ট প্রাণীদের হৃদয়ে হৃদয়ে বিভিন্ন ভাবে প্রকাশিত সেই শ্রীকৃষ্ণও প্রকৃতপক্ষে জন্মরহিত অর্থাৎ এক।। ৮ ।।

(১) যেমন গগনস্থ এক সূর্য্য অনন্ত স্ফটিকে প্রতিবিম্বিত হইয়া অনন্তরূপ প্রকাশ পান, সেইরূপে নিত্যধামস্থ শ্রীকৃষ্ণ অনন্তজীবে পরমাত্মরূপে অনন্ত প্রতীয়মান হয়েন।

সেইত গোবিন্দ সাক্ষাৎ চৈতন্য গোসাঞি।
জীব নিস্তারিতে ঐছে দয়ালু আর নাঞি।।
পরব্যোমেতে বৈসে নারায়ণ নাম।
ষড়ৈশ্বর্য্যপূর্ণ লক্ষ্মীকান্ত ভগবান্।।
বেদ ভাগবত উপনিষদ্‌ আগম।
'পূর্ণতত্ত্ব' যাঁরে কহে-নাহি যাঁর সম।।
ভক্তিযোগে ভক্ত পায় যাঁর দরশন।
সূর্য্য যেন সবিগ্রহ দেখে দেবগণ।।
জ্ঞানযোগ মার্গে তাঁরে ভজে যেই সব।
ব্রহ্ম আত্মারূপে তাঁরে করে অনুভব।।
উপাসনা ভেদে জানি ঈশ্বর মহিমা।
অতএব সূর্য্য তাঁর দিয়েত উপমা।।
সেই নারায়ণ-কৃষ্ণের স্বরূপ অভেদ।
একই বিগ্রহ কিন্তু আকারে বিভেদ।।
ইহোঁত দ্বিভুজ তিহোঁ ধরে চারি হাত।
ইহোঁ বেণু ধরে, তিঁহো চক্রাদিক সাথ।।
তথাহি শ্রীমদ্ভাগবতে (১০।১৪।১৪)
নারায়ণস্ত্বং ন হি সর্ব্বদেহিনা-
মাত্মাস্যধীশাখিললোকসাক্ষী।
নারায়ণোহঙ্গং নর-ভূ-জলায়নাৎ
তচ্চাপি সত্যং ন তবৈব মায়া।। ৯

অন্বয়ঃ।- [ব্রহ্মা শ্রীকৃষ্ণকে কহিতেছেন-] ত্বং নারায়ণঃ ন হি (তুমি কি নারয়ণ নহ?) যত স্ত্বং সর্ব্বদেহিনাম্‌ আত্মা অসি (যেহেতু তুমি সকল দেহীর আত্মা), (তথা) হে অধীশ (হে সর্ব্বেশ্বর) অখিললোক-সাক্ষী অসি (সমস্তলোকের অন্তরে থাকিয়া সাক্ষী বা অন্তর্য্যামী) নরভূজলায়নাৎ নারায়ণঃ (জীভহৃদয়ে ও কারণসলিলে আশ্রয় হেতু যিনি নারায়ণ) তব অঙ্গং (তিনি তোমারই দেহ বা মূর্ত্তি) তৎ চ অপি সত্যং ন তু মায়া (তাহাও সত্য-তোমার মায়া নহে)।

অনুবাদ।- [ব্রহ্মা শ্রীকৃষ্ণকে বলিলেন] তুমি যখন সর্ব্বজীবের আত্মা, তখন তুমি কি নারায়ণ নহ? নার শব্দের অর্থ জীবকুল, অয়ন শব্দের অর্থ আশ্রয়। জীবসমূহের যিনি আশ্রয়, সেই পরমাত্মাই নারায়ণ; অতএব তুমি পরমাত্মা বলিয়াই তুমি নারায়ণ। যিনি সকল লোককে জানেন বা সাক্ষাৎ দর্শন করেন, তাঁহাকেও নারায়ণ বলা যায়। আবার জীবের হৃদয় এবং জল এই দুইটি যাঁহার আশ্রয়, সেই প্রসিদ্ধ নারায়ণ তোমারই অংশ অর্থাৎ মূর্ত্তিবিশেষ। তিনি তোমা হইতে ভিন্ন নহেন। তবে সেই নারায়ণের যে তাদৃশ পরিচ্ছিন্নত্ব (পার্থক্য) তাহা সত্য নহে, পরন্তু তোমার লীলাই অথবা নারায়ণরূপ তোমার সেই মূর্ত্তিও সত্য, অর্থাৎ-উহা মায়িক নহে।। ৯ ।।

শিশু-বৎস (১) হরি ব্রহ্মা করি অপরাধ।
অপরাধ ক্ষমাইতে মাগেন প্রসাদ।।
তোমার নাভিপদ্ম হৈতে মোর জন্মোদয়।
তুমি পিতা মাতা-আমি তোমার তনয়।।
মাতা বালকের না লয় অপরাধ।
অপরাধ ক্ষম-মোরে করহ প্রসাদ।।
কৃষ্ণ কহেন ব্রহ্মা তোমার পিতা নারায়ণ।
আমি গোপ তুমি কৈছে আমার নন্দন?।।
ব্রহ্মা বলে তুমি কিনা হও নারায়ণ?।
তুমি নারায়ণ শুন তাহার কারণ।।
প্রাকৃতাপ্রাকৃত সৃষ্ট্যে যত জীব-রূপ।
তাহার যে আত্মা তুমি মূল-স্বরূপ।।
পৃথ্বী যৈছে ঘটকুলের কারণ-আশ্রয় (২)।
জীবের নিদান তুমি, তুমি সর্ব্বাশ্রয়।।
নার শব্দে কহে সর্ব্ব-জীবের নিচয়।
অয়ন শব্দেতে কহে তাহার আশ্রয়।।
অতএব তুমি হও মূল নারায়ণ।
এই এক হেতু শুন দ্বিতীয় কারণ।।
জীবের ঈশ্বর পুরুষাদি অবতার। (৩)
তাহা-সভা হৈতে তোমার ঐশ্বর্য্য অপার।।
অতএব অধীশ্বর তুমি সর্ব্বপিতা।
তোমার শক্তিতে তারা জগৎ-রক্ষিতা।।
নারের অয়ন যাতে করহ পালন।
অতএব হও তুমি মূল নারায়ণ।।
তৃতীয় কারণ শুন শ্রীভগবান্‌।
অনন্ত ব্রহ্মাণ্ড বহু বৈকুণ্ঠাদি ধাম।।
ইথে যত জীব তার ত্রৈকালিক কর্ম্ম।
তাহা দেখ, সাক্ষী তুমি, জান সব মর্ম্ম।।
তোমার দর্শনে সর্ব্ব জগতের স্থিতি।
না দেখিলে কারো নাহি স্থিতিগতি।।
নারের অয়ন যাতে কর দরশন।
তাহাতেও হও তুমি মূল নারায়ণ।।
কৃষ্ণ কহেন ব্রহ্মা তোমার না বুঝি বচন।
জীব-হৃদি-জলে (৪) বৈসে সেই নারায়ণ।।
ব্রহ্মা কহে জলে জীবে যেই নারায়ণ।
সে সব তোমার অংশ এ সত্য বচন।।
কারণাব্ধি গর্ভোদক ক্ষীরোদকশায়ী।
মায়াদ্বারে (৫) সৃষ্টি করে, তাতে সব মায়ী।।
সেই তিন জলশায়ী সর্ব্ব অন্তর্য্যামী।
ব্রহ্মাণ্ড-বৃন্দের আত্মা যে পুরুষ নামী (৬)।।
হিরণ্যগর্ভের আত্মা গর্ভোদকশায়ী (৭)।
ব্যষ্টিজীব (৮) অন্তর্য্যামী ক্ষীরোদকশায়ী।।
এ সভার দর্শনেতে আছে মায়াগন্ধ।
তুরীয় কৃষ্ণের নাঞি মায়ার সম্বন্ধ।।

(১) শিশুবৎস - শিশু রাখালগণ ও গোবৎসগণ।

(২) পৃথিবীর অংশ মৃত্তিকা দ্বারা ঘট নির্ম্মিত হয় বলিয়াই পৃথিবীই ঘটের উপাদান, কারণ ও আশ্রয় (কিন্তু তা বলিয়া পৃথিবী ঘটের স্বরূপ নহে); সেইরূপ শ্রীকৃষ্ণ জীবের উপাদান কারণ (কিন্তু জীব শ্রীকৃষ্ণের স্বরূপ নহে)।

(৩) মহাবিষ্ণু, সহস্রশীর্যপুরুষ ও বিষ্ণু এই তিন পুরুষাবতার জীবের ঈশ্বর অর্থাৎ অধীশ্বর।

(৪) জীব-হৃদিজলে - অন্তর্য্যামিরূপে জীবের অন্তঃকরণে এবং কারণাব্ধিশায়িরূপে।

(৫) দ্বারে - দ্বারা।

(৬) পুরুষ নামী অর্থাৎ কারণার্ণবশায়ী পুরুষ ব্রহ্মাণ্ডবৃন্দের আত্মা অর্থাৎ অন্তর্য্যামী।

(৭) গর্ভোদকশায়ী পুরুষ ব্রহ্মার অন্তর্য্যামী।

(৮) ব্যষ্টিজীব - প্রত্যেক পৃথক্‌ পৃথক্‌ জীব।

যদ্যপি তিনের মায়া লঞা ব্যবহার।
তথাপি তৎস্পর্শ নাহি সভে মায়া পার (১)।।
তথাহি - শ্রীমদ্ভাগবতে (১।১১।৩৪)
এতদীশনমীশস্য প্রকৃতিস্থোহপি তদ্গুণৈঃ।
ন যুজ্যতে সদাত্মস্থৈর্যথাবুদ্ধিস্তদাশ্রয়া।। ১১

অন্বয়ঃ।- ঈশস্য এতৎ ঈশনম্‌ (ঈশ্বরের ইহাই ঈশ্বরত্ব) প্রকৃতিস্থোহপি (মায়াতে অবস্থিত হইয়াও) তদ্‌গুণৈঃ সদা ন যুজ্যতে (তাহার গুণের সহিত কোনও কালেই যুক্ত হন না) যথা তদাশ্রয়া বুদ্ধিঃ (যদ্রুপ ইঁহার আশ্রয় গ্রহণকারী বুদ্ধি) আত্মস্থৈঃ ন যুজ্যতে (দেহের সুখদুঃখে লিপ্ত হয় না)।

অনুবাদ।- ঈশ্বর প্রকৃতিতে আছেন, তবু প্রকৃতির গুণ তাকে স্পর্শ করতে পারে না - এই খানেই ঈশ্বরের ঈশ্বরত্ব। ঠিক এইভাবেই ভগবদ্‌বিষয়িণী বুদ্ধিকেও দৈহিক সুখ-দুঃখ কখনো স্পর্শ করতে পারে না।। ১১ ।।

সেই তিন জনের তুমি পরম আশ্রয়।
তুমি মূল নারায়ণ-ইথে কি সংশয়?
সেই তিনের অংশী (২) পরব্যোম-নারায়ণ।
তেঁহ তোমার বিলাস তুমি মূল নারায়ণ।।

(১) অর্থাৎ ইহারা মায়ার অধীশ্বর, অধীন নহেন।

(২) অংশী - অন্য সব যাহার অংশ তিনিই অংশী অর্থাৎ মূলস্বরূপ।

অতএব ব্রহ্মবাক্যে-পরব্যোম-নারায়ণ।
তেঁহ কৃষ্ণের বিলাস এই তত্ত্ব-বিবরণ (৩)।।
এই শ্লোক তত্ত্ব-লক্ষণ (৪) ভাগবত সার।
পরিভাষা (৫) রূপে ইহার সর্ব্বত্রাধিকার।।
ব্রহ্ম আত্মা ভগবান্‌ কৃষ্ণের বিহার।
এ অর্থ না জানি মূর্খ অর্থ করে আর।।
অবতারী নারায়ণ কৃষ্ণ অবতার (৬)।
তেঁহ চতুর্ভুজ ইঁহ মনুষ্য আকার।।
এই মতে নানারূপ করে পূর্ব্বপক্ষ।
তাঁহারে নির্জ্জিতে ভাগবত পদ্য দক্ষ।। (৭)
তথাহি - শ্রীমদ্ভাগবতে ১।২।১১
বদন্তি তত্তত্ত্ববিদস্তত্ত্বং যজ্‌জ্ঞানমদ্বয়ম্।
ব্রহ্মেতি পরমাত্মেতি ভগবানিতি শব্দ্যতে।। ১২

এই শ্লোকের অন্বয় ও অনুবাদ ২য় পরিচ্ছেদে ৪র্থ শ্লোকে দ্রষ্টব্য।। ১২ ।।

শুন ভাই এই শ্লোক করহ বিচার।
এক মুখ্যতত্ত্ব, তিন তাহার প্রচার (৮)।।

(৩) পরব্যোমস্থ নারায়ণ শ্রীকৃষ্ণের দ্বিতীয় দেহ হইলেও আকৃতিতে ভিন্ন বলিয়া তাঁহার বিলাস-মূর্ত্তি।

(৪) তত্ত্বলক্ষণ - শ্রীকৃষ্ণতত্ত্বনিরূপণের মূল সূত্র।

(৫) পরিভাষা - "অনিয়মে নিয়মকারিণী পরিভাষা" যে স্থানে নিয়ম ছিল না সে স্থানে নিয়ম করিয়া সিদ্ধান্ত স্থাপনকে পরিভাষা কহে। আচার্য্যের যুক্তিযুক্ত সিদ্ধান্ত বাক্য।

(৬) "অবতারী নারায়ণ ......." এই পয়ার হইতে "ঈশ্বরঃ পরমঃ কৃষ্ণঃ - " শ্লোক পর্য্যন্ত গ্রন্থকার তাঁহার মতের একজন পূর্ব্বপক্ষ অর্থাৎ বিরুদ্ধবাদী কল্পনা করিয়া তাহার আপত্তি এবং কুব্যাখ্যাগুলির উত্থাপনপূর্ব্বক পরে নানা যুক্তি দ্বারা সেইগুলির খণ্ডন করিতেছেন। পূর্ব্বপক্ষ বলিতেছে - যেহেতু নারায়ণ চতুর্ভূজ এবং শ্রীকৃষ্ণ দ্বিভূজ কাজেই নারায়ণই মূলতত্ত্ব এবং শ্রীকৃষ্ণ তাঁহার অবতার।

(৭) নির্জ্জিতে - নিরস্ত করিতে। দক্ষ - সমর্থ।

(৮) মূখ্যতত্ত্ব - শ্রীকৃষ্ণ। তিনি তাহার প্রচার অর্থাৎ জ্ঞানীর নিকটে তিনি ব্রহ্ম, যোগীর নিকটে পরমাত্মা এবং ভক্তের নিকট ভগবান্‌।

অদ্বয় জ্ঞান তত্ত্ববস্তু কৃষ্ণের স্বরূপ।
ব্রহ্ম আত্মা ভগবান্‌ তিন তাঁর রূপ।।
এই শ্লোকের অর্থে তুমি হৈলা নির্ব্বচন (১)।
আর এক শুন ভাগবতের বচন।।
তথাহি - শ্রীমদ্ভাগবতে ১।৩।২৮
এতে চাংশকলাঃ পুংসঃ
কৃষ্ণস্তু ভগবান্‌ স্বয়ম্‌।
ইন্দ্রারিব্যাকুলং লোকং
মৃড়য়ন্তি যুগে যুগে।। ১৩

অন্বয়ঃ।- [সূত শৌনকাদিকে কহিতেছেন] - এতে চ (পূর্ব্বে উক্ত ও অনুক্ত যত অবতার) পুংসঃ (পুরুষের) অংশকলাঃ (অংশ এবং বিভূতি) কৃষ্ণঃ তু স্বয়ং ভগবান্‌ (কিন্তু কৃষ্ণ স্বয়ং ভগবান্‌) ইন্দ্রারিব্যাকুলং লোকং (সেই সকল অবতার অসুরোপদ্রুত জগৎকে) যুগে যুগে মৃড়য়ন্তি (যুগে যুগে সুখী করিয়া থাকেন)।

অনুবাদ।- এঁরা সকলেই সেই পুরুষোত্তমের অংশ বা কলা। কৃষ্ণই স্বয়ং ভগবান্‌। দৈত্যপীড়িত ভুবনকে ইনি পরিত্রাণের দ্বারা সুখ দিয়ে থাকেন।। ১৩।।

সব অবতারের করি সামান্য লক্ষণ।
তার মধ্যে কৃষ্ণচন্দ্রের করিল গণন।।
তবে সূত গোসাঞি মনে পাঞা বড় ভয়।
যার যে লক্ষণ তাহা করিল নিশ্চয়।।
অবতার সব পুরুষের কলা অংশ।
কৃষ্ণ স্বয়ং ভগবান্‌ সর্ব্ব অবতংস।।
পূর্ব্বপক্ষ কহে তোমার ভালত ব্যাখ্যান।
পরব্যোম-নারায়ণ স্বয়ং ভগবান্।।
তেঁহ আসি কৃষ্ণরূপে করেন অবতার (২)।
এই অর্থ শ্লোকে দেখি, কি আর বিচার।।

(১) নির্ব্বচন - নির্ব্বাক্‌ অর্থাৎ ইহার উপর তুমি কথা কহিতে পার না।

(২) কুতর্ককারী পূর্ব্বপক্ষ 'কৃষ্ণস্তু ভগবান্‌ স্বয়ম্‌' এই বাক্যের বিপরীত অর্থ করিয়া বলিতেছে যে "স্বয়ং ভগবান্‌ অর্থাৎ পরব্যোমস্থিত নারায়ণ স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণরূপে অবতীর্ণ হইয়াছেন, সুতরাং পরব্যোম-নারায়ণই মূলতত্ত্ব এবং শ্রীকৃষ্ণ তাঁহার অবতার।"

তারে কহে কেন কর কুতর্কানুমান।
শাস্ত্র বিরুদ্ধার্থ কভু না হয় প্রমাণ।।
তথাহি - একাদশীতত্ত্বে ধৃতো ন্যায়ঃ
অনুবাদ্যমনুক্ত্বৈব
ন বিধেয়মুদীরয়েৎ
ন হ্যলব্ধাস্পদং কিঞ্চিৎ
কুত্রচিৎ প্রতিতিষ্ঠতি।। ১৪
অনুবাদ না কহিয়া না কহি বিধেয়।
আগে অনুবাদ কহি পশ্চাৎ বিধেয়।।
বিধেয় কহিয়ে তারে - যে বস্তু অজ্ঞাত।
অনুবাদ কহি তারে -যেই হয় জ্ঞাত।।
যৈছে কহি - এই বিপ্র পরম পণ্ডিত।
বিপ্র অনুবাদ, ঞিহার বিধেয় পাণ্ডিত্য।।
বিপ্রত্ব বিখ্যাত তার পাণ্ডিত্য অজ্ঞাত।
অতএব বিপ্র আগে, পাণ্ডিত্য পশ্চাত।।
তৈছে ঞিহা অবতার সব হইলা জ্ঞাত।
কার অবতার এই বস্তু অবিজ্ঞাত।।
এতে শব্দে অবতারের আগে অনুবাদ।
পুরুষের অংশ পাছে বিধেয় সংবাদ।।
তৈছে কৃষ্ণ অবতার ভিতরে হৈল জ্ঞাত।
তাহার বিশেষ জ্ঞান সেই অবিজ্ঞাত।।
অতএব 'কৃষ্ণ' শব্দ আগে অনুবাদ।
"স্বয়ং ভগবত্ত্ব" পাছে বিধেয় সংবাদ।।
"কৃষ্ণের স্বয়ং ভগবত্ত্ব" ইহা হৈল সাধ্য।
"স্বয়ং ভগবানের কৃষ্ণত্ব" হৈল বাধ্য।।
কৃষ্ণ যদি অংশ হৈত, অংশী নারায়ণ।
তবে বিপরীত হৈত সূতের বচন।। (১)
নারায়ণ অংশী যেই স্বয়ং ভগবান্‌।
তিঁহোই শ্রীকৃষ্ণ ঐছে করিত ব্যাখ্যান।।
ভ্রম প্রমাদ বিপ্রলিপ্সা করণাপাটব।
আর্য বিজ্ঞবাক্যে নাহি দোষ এই সব (২)।।
বিরুদ্ধার্থ কহ তুমি কহিতে কর রোষ।
তোমার অর্থে অবিমৃষ্ট-বিধেয়াংশ দোষ (৩)।।
যার ভগবত্তা হৈতে অন্যের ভগবত্তা।
স্বয়ং ভগবান্‌ শব্দের তাহাতেই সত্তা (৪)।।

(১) গ্রন্থকার পূর্ব্বপক্ষকারীর আপত্তি খণ্ডন করিয়া বলিতেছে যে "এতে চাংশকলাঃ পুংসঃ কৃষ্ণস্তু ভগবান্‌ স্বয়ম্‌" এই বাক্যে প্রথমে জ্ঞাত হইল অবতার, সুতরাং তাহা অনুবাদ বা উদ্দেশ্য। পরে কাহার অবতার বা অংশকলা এই অজ্ঞাত বিষেয়ের উত্তর হইল 'পুরুষের' অর্থাৎ 'শ্রীকৃষ্ণের' সুতরাং শ্রীকৃষ্ণ বিধেয়। রবর্ত্তী বাক্যে (জ্ঞাত অর্থাৎ উদ্দেশ্য) শ্রীকৃষ্ণ কে? - এই অজ্ঞাত বিষয়ের জ্ঞান জন্মিল 'ভগবান্‌ স্বয়ম্‌' এই কথা দ্বারা; সুতরাং তাহা বিধেয়। অলঙ্কার-শাস্ত্রানুসারে উদ্দেশ্য থাকিবে পূর্ব্বে এবং বিধেয় প্রধানরূপে পরে থাকিবে। সুতরাং কৃষ্ণই উদ্দেশ্য কাজেই অংশী এবং ভগবান্‌ বা নারায়ণ অংশ ইহা প্রতিপন্ন হইল, আর নারায়ণ অংশী এবং শ্রীকৃষ্ণ অংশ এই অর্থ বাধিত হইল। কুতর্কীর মতে অর্থ হইলে শ্লোকে থাকিত 'ভগবাংস্তু কৃষ্ণঃ স্বয়ম্‌'।

(২) ভ্রম - অবস্তুতে বস্তুজ্ঞান; যেমন - রজ্জুতে সর্পজ্ঞান। প্রমাদ - অসাবধনতা বা অমনোযোগিতার নিমিত্ত এককে অন্য করিয়া বলা বা শুনা। বিপ্রলিপ্সা - বঞ্চনেচ্ছা, সেইজন্য যথার্থ না বলা বা শুনা। করণাপাটব - করণের অর্থাৎ ইন্দ্রিয়ের অপাটব অর্থাৎ অপটুতা, তজ্জন্য এক বস্তুকে অন্যরূপে দর্শনাদি। বিজ্ঞ ঋষিদের বাক্যে এই সব দোষ নাই বলিয়া তাঁহাদের বাক্য অভ্রান্ত।

(৩) অবিমৃষ্ট-বিধেয়াংশ - স্থানে প্রধানরূপে বিধেয়াংশ বর্ণিত হয় নাই। পদার্থের মধ্যে বিধেয়েরই উপাদেত্বরূপে প্রাধান্য বিদ্যমান আছে, সুতরাং প্রধানরূপে বিধেয়ের নির্দ্দেশ করা উচিত, তাহা না করিলে উক্ত দোষ হয়।

(৪) সত্তা - স্থিতি।

দীপ হৈতে যৈছে বহু দীপের জ্বলন।
মূল এক দীপ তাঁহা করিয়ে গণন।।
তৈছে সব অবতারের (৫) কৃষ্ণ সে কারণ।
আর এক শ্লোক শুন কুব্যাখ্যা খণ্ডন।।
তথাহি - শ্রীমদ্ভাগবতে (২।১০।১-২)
অত্র সর্গো বিসর্গশ্চ স্থানং পোষণমূতয়ঃ।
মন্বন্তরেশানুকথা নিরোধা মুক্তিরাশ্রয়ঃ।।১৫
দশমস্য বিশুদ্ধ্যর্থং নবানামিহ লক্ষণম্‌।
বর্ণয়ন্তি মহাত্মানঃ শ্রুতোনার্থেন চাঞ্জসা।।১৬

অন্বয়ঃ।- [শ্রীশুকদেব পরীক্ষিৎকে কহিতেছেন] অত্র (শ্রীমদ্ভাগবতে) সর্গঃ বিসর্গঃ স্থানং পোষণম্‌ (সর্গ, বিসর্গ, স্থান, পোষণ‌) ঊতয়ঃ (কর্ম্মবাসনা) মন্বন্তরেশানুকথাঃ নিরোধঃ মুক্তিঃ আশ্রয়ঃ (মন্বন্তর, ঈশানুকথা, নিরোধ, মুক্তি এবং আশ্রয় এই দশের কথা বলা হইয়াছে)। মহাত্মানঃ দশমস্য আশ্রয়স্য (মহাত্মারা ইহার মধ্যে দশমের অর্থাৎ আশ্রয়ের) বিশুদ্ধ্যর্থং (তত্ত্বজ্ঞান লাভের জন্য) নবানাং (সর্গাদি নয়টির) লক্ষণং (স্বরূপ) শ্রুতেন অঞ্জসা বর্ণয়ন্তি (শ্রুতি প্রমাণের দ্বারা এবং তাৎপর্য্যবৃত্তির দ্বারা সাক্ষাদ্রুপে বর্ণনা করিয়া থাকেন)।

অনুবাদ।- এই শ্রীমদ্ভাগবতে সর্গ, বিসর্গ, স্থান, পোষণ, কর্ম্মবাসনা, মন্বন্তর, ঈশানুকথা, নিরোধ, মুক্তি এবং আশ্রয় বর্ণিত হয়েছে (৬)। এই আশ্রয়তত্ত্বজ্ঞানের জন্য সর্গাদি নয়টির লক্ষণ মহাত্মাগণ কোনো স্থানে শ্রুতির সাহায্যে কোনো স্থানে সাক্ষাৎ ও কোনো স্থানে তাৎপর্য্য বৃত্তি দিয়ে বর্ণনা করে থাকেন।।১৫।১৬।।

আশ্রয় জানিতে কহি এ নব পদার্থ।
এ নবের উৎপত্তি হেতু সেই আশ্রয়ার্থ।।
কৃষ্ণ এক সর্ব্বাশ্রয় কৃষ্ণ এক ধাম।
কৃষ্ণের শরীরে সর্ব্ব বিশ্বের বিশ্রাম।।
তথা ভাবার্থদীপিকায়াং শ্রীধরস্বামিনোক্তম্‌ (১০।১।১)
দশমে দশমং লক্ষ্য-
মাশ্রিতাশ্রয়বিগ্রহম্‌।
শ্রীকৃষ্ণাখ্যং পরং ধাম
জগদ্ধাম নমামি তৎ।। ১৭

অন্বয়ঃ।- আশ্রিতাশ্রয়বিগ্রহং (যাঁহার বিগ্রহ আশ্রিতগণের আশ্রয়) পরং ধাম জগদ্ধাম (সেই পরমধামই জগতের আশ্রয়) দশমে (দশমস্কন্ধে) লক্ষ্যম্‌ (লক্ষ্যস্থানীয়) শ্রীকৃষ্ণাখ্যং তৎ দশমম্‌ নমামি (শ্রীকৃষ্ণ নামে সেই আশ্রয় পদার্থকে প্রণাম করি)।

অনুবাদ।- যাঁর শ্রীবিগ্রহ সঙ্কর্ষণ প্রভৃতির আশ্রয়, যিনি স্বয়ং পরম ধাম ও জগতের আশ্রয়, দশম স্কন্ধের লক্ষ্যস্থানীয়সেই আশ্রয় পদার্থরূপ শ্রীকৃষ্ণকে প্রণাম করি।।১৭।।

কৃষ্ণের স্বরূপ আর শক্তিত্রয় জ্ঞান (১)।
যার হয় তার নাহি কৃষ্ণেতে অজ্ঞান।।
কৃষ্ণের স্বরূপ হয় ষড়্‌বিধ বিলাস।
প্রাভব বৈভব রূপে দ্বিবিধ প্রকাশ (২)।।
অংশ শক্ত্যাবেশ রূপে দ্বিবিধাবতার।
বাল্য পৌগণ্ড ধর্ম্ম দুই ত প্রকার।।
কিশোর স্বরূপ কৃষ্ণ স্বয়ং অবতারী (৩)।
ক্রীড়া করে এই ছয় রূপে বিশ্ব ভরি।।
এই ছয়-রূপে হয় অনন্ত বিভেদ।
অনন্তরূপে একরূপ নাহি কিছু ভেদ।।
চিচ্ছক্তি, স্বরূপ শক্তি, অন্তরঙ্গা নাম।
তাহার বৈভবানন্ত বৈকুণ্ঠাদি ধাম।।
মায়াশক্তি বহিরঙ্গা জগৎ-কারণ।
তাহার বৈভবানন্ত ব্রহ্মাণ্ডের গণ।।
জীবশক্তি তটস্থাখ্য (৪) নাহি যার অন্ত।
মুখ্য তিন শক্তি তার বিভেদ অনন্ত।।
এইত স্বরূপগণ আর তিন শক্তি।
সবার আশ্রয় কৃষ্ণ কৃষ্ণে সব স্থিতি।।
যদ্যপি ব্রহ্মাণ্ডগণের পুরুষ আশ্রয়।
সেই পুরুষাদি সভার কৃষ্ণ মূলাশ্রয়।।
স্বয়ং ভগবান্‌ কৃষ্ণ, কৃষ্ণ সর্ব্বাশ্রয়।
পরম ঈশ্বর কৃষ্ণ সর্ব্বশাস্ত্রে কয়।।

(১) শক্তিত্রয় - অন্তরাত্মা অর্থাৎ চিচ্ছক্তি, বহিরঙ্গা শক্তি অর্থাৎ মায়া এবং তটস্থা শক্তি অর্থাৎ জীবশক্তি।

(২) প্রাভব - অল্প শক্তির প্রকাশ। বৈভব - প্রাভব অপেক্ষা অধিক শক্তির প্রকাশ।

(৩) ৫ম বর্ষ বয়ঃক্রম পর্য্যন্ত বাল্য, ১০ম বর্ষ বয়ঃক্রম পর্যন্ত পৌগণ্ড। ১১'শ হইতে ১৫'শ বর্ষ বয়ঃক্রম পর্য্যন্ত কৈশোর। কিশোর-স্বরূপ শ্রীকৃষ্ণ অবতারী এবং স্বয়ং ভগবান্।

(৪) জীবশক্তিকে তটস্থা বলা হয় এইজন্য যে তাহা চৈতন্যযুক্তা বলিয়া শ্রীকৃষ্ণে প্রবিষ্ট আবার বহির্মুখী বলিয়া অপ্রবিষ্ট।

তথাহি - ব্রহ্মসংহিতায়াং (৫।১)
ঈশ্বরঃ পরমঃ কৃষ্ণঃ সচ্চিদানন্দবিগ্রহঃ।
অনাদিরাদির্গোবিন্দঃ সর্ব্বকারণকারণম্‌।।১৮

অন্বয়ঃ।- কৃষ্ণঃ ঈশ্বরঃ (সকলের বশকর্ত্তা) পরমঃ (পরমেশ্বর) সচ্চিদানন্দবিগ্রহঃ অনাদিঃ (সচ্চিদানন্দ-মূর্ত্তি আদিহীন) আদিঃ গোবিন্দঃ সর্ব্বকারণকারণম্‌ (অথচ সকলের আদি গোবিন্দ সমস্ত কারণের কারণ)।

অনুবাদ।- কৃষ্ণ পরম ঈশ্বর। তিনি সচ্চিদানন্দবিগ্রহ। তিনি অনাদি ও আদি কেননা সর্ব্ব কারণের কারণ তিনিই গোবিন্দ।।১৮।।

এ সব সিদ্ধান্ত তুমি জান ভালমতে।
তবু পূর্ব্বপক্ষ কর আমা চালাইতে (১)।।
সেই কৃষ্ণ অবতারী ব্রজেন্দ্র-কুমার।
আপনে চৈতন্যরূপে কৈল অবতার।।
অতএব চৈতন্য গোঁসাঞি পরতত্ত্ব সীমা।
তাঁরে ক্ষীরোদশায়ী কহি কি তার মহিমা (২)।।
সেহো ত ভক্তের বাক্য নহে ব্যভিচারী।
সকল সম্ভবে কৃষ্ণে যাতে অবতারী (৩)।।
অবতারীর দেহে সব অবতারের স্থিতি।
কেহ কোনরূপে কহে যেমন যার মতি।।
কৃষ্ণকে কহয়ে কেন - নরনারায়ণ।
কেহো কহে - কৃষ্ণ হয়ে সাক্ষাৎ বামন।।

(১) সব জানিয়াও তুমি আমাকে বিচলিত করিবার জন্য তর্ক করিতেছ।

(২) চৈতন্য ভাগবতে আছে "শুইয়া আছিনু ক্ষীরসাগর ভিতরে"। গ্রন্থকার সেই কথারই উল্লেখ করিয়াছেন।

(৩) কৃষ্ণে সমস্ত অবতারগণ বিদ্যমান আছেন, এই জন্য কৃষ্ণকে যিনি যাহা বলেন, তাহাই সম্ভব হয়।

কেহো কহে কৃষ্ণ ক্ষীরোদশায়ী অবতার।
অসম্ভব নহে - সত্য বচন সভার।।
কেহো কহে পরব্যোম নারায়ণ করি।
সকল সম্ভবে কৃষ্ণে যাতে অবতারী।।
সব শ্রোতাগণের করি চরণ বন্দন।
এ সব সিদ্ধান্ত শুন করি এক মন।।
সিদ্ধান্ত বলিয়া চিত্তে না কর অলস।
ইহা হৈতে কৃষ্ণে লাগে সুদৃঢ় মানস।।
চৈতন্য মহিমা জানি এ সব সিদ্ধান্তে।
চিত্ত দৃঢ় হঞা লাগে মহিমা জ্ঞান হৈতে।।
চৈতন্য প্রভুর মহিমা কহিবার তরে।
কৃষ্ণের মহিমা কহি করিয়া বিস্তারে।।
চৈতন্য গোঁসাঞির এই তত্ত্ব নিরূপণ।
স্বয়ং ভগবান্‌ কৃষ্ণ ব্রজেন্দ্রনন্দন।।
শ্রীরূপ রঘুনাথ পদে যার আশ।
চৈতন্যচরিতামৃত কহ কৃষ্ণদাস।।

ইতি শ্রীচৈতন্যচরিতামৃতে আদিলীলায়াং
শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যচরিত-তত্ত্ব-নিরূপণং নাম
দ্বিতীয়ঃ পরিচ্ছেদঃ।