ব্যবহারকারী:Subrata Roy/শ্রীশ্রীচৈতন্যচরিতামৃত/আদিলীলা/ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
- বন্দে তং শ্রীমদদ্বৈতা-
- চার্য্যমদ্ভুতচেষ্টিতম্।
- যস্য প্রসাদাদজ্ঞোহপি
- তৎস্বরূপং নিরূপয়েৎ।।১
অন্বয়ঃ।- অদ্ভুতচেষ্টিতম্ (আশ্চর্য্য-চরিত) তৎ শ্রীমদদ্বৈতাচার্য্যং বন্দে (সেই শ্রীমদদ্বৈত-আচার্য্যকে বন্দনা করি), অজ্ঞঃ অপি যস্য প্রসাদাৎ তৎস্বরূপং নিরূপয়েৎ (অতি অজ্ঞ হইয়াও যাঁহার অনুগ্রহে লোক তাঁহার স্বরূপ নিরূপণে সমর্থ হয়)।
অনুবাদ।- অপূর্ব্বকর্ম্মা সেই অদ্বৈতের বন্দনা করি। তাঁর কৃপায় অজ্ঞজনও তাঁর তত্ত্ব নির্ণয় করতে পারেন।।১।।
- জয় জয় শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য দয়াময়।
- জয় নিত্যানন্দ জয়াদ্বৈত মহাশয়।।
- পঞ্চ শ্লোকে কহিল এই নিত্যানন্দ-তত্ত্ব।
- শ্লোকদ্বয়ে কহি অদ্বৈতাচার্য্যের মহত্ত্ব।।
- শ্রীস্বরূপগোস্বামিকড়চায়াঃ শ্লোকদ্বয়ম্
- মহাবিষ্ণুর্জগৎকর্ত্তা মায়যা যঃ সৃজত্যদঃ।
- তস্যাবতার এবায়মদ্বৈতাচার্য্য ঈশ্বরঃ।।২
- অদ্বৈতং হরিণাদ্বৈতাদাচার্য্যং ভক্তিশংসনাৎ।
- ভক্তাবতারমীশং তমদ্বৈতাচার্য্যমাশ্রয়ে।।৩
এই শ্লোকদ্বয়ের অন্বয় ও বঙ্গানুবাদ ১ম পরিচ্ছেদে ১২।১৩ শ্লোকে দ্রষ্টব্য।।২।৩।।
- অদ্বৈত-আচার্য্য-গোঁসাঞি সাক্ষাৎ ঈশ্বর।
- যাঁহার মহিমা নহে জীবের গোচর।।
- মহাবিষ্ণু সৃষ্টি করেন জগদাদি-কার্য্য।
- তাঁর অবতার সাক্ষাৎ অদ্বৈত-আচার্য্য।।
- যে পুরুষ সৃষ্টি স্থিতি করেন মায়ায়।
- অনন্ত-ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি করেন লীলায় (১)।।
(১) 'লীলায়' - অনায়াসে।
- ইচ্ছায় (২) অনন্তমূর্ত্তি (৩) করেন প্রকাশে।
- এক এক মূর্ত্ত্যে করেন ব্রহ্মাণ্ডে প্রবেশে।।
- সে পুরুষের অংশ (৪) অদ্বৈত নাহি কিছু ভেদ।
- শরীর বিশেষ তাঁর নাহিক বিচ্ছেদ (৫)।।
- সহায় করেন তাঁর লইয়া প্রধানে (৬)।
- কোটি ব্রহ্মাণ্ড করেন ইচ্ছায় নির্ম্মাণে।।
- জগৎ মঙ্গলাদ্বৈত মঙ্গল-গুণধাম।
- মঙ্গল চরিত্র সদামঙ্গল (৭) যাঁর নাম।।
- কোটি-অংশ কোটি-শক্তি কোটি-অবতার।
- এত লঞা সৃজে পুরুষ সকল সংসার।।
- মায়া যৈছে দুই অংশ নিমিত্ত উপাদান।
- মায়া নিমিত্ত-হেতু উপাদান প্রধান।।
- পুরুষ ঈশ্বর ঐছে দ্বিমূর্ত্তি করিয়া।
- বিশ্ব-সৃষ্টি করে নিমিত্ত-উপাদান লঞা।।
- আপনে পুরুষ বিশ্বের নিমিত্ত-কারণ।
- অদ্বৈত-রূপে উপাদান হয় নারায়ণ।।
- নিমিত্তাংশে করে তেঁহো মায়াতে ঈক্ষণ।
- উপাদান অদ্বৈত করেন ব্রহ্মাণ্ড-সৃজন (৮)।।
(২) 'ইচ্ছায়' - স্বাধীনভাবে।
(৩) 'অনন্তমূর্ত্তি' - গর্ভোদশায়িরূপ অসংখ্য মূর্ত্তি।
(৪) 'সে পুরুষের' - মহাবিষ্ণুর। 'অংশ' - প্রকাশ।
(৫) 'বিচ্ছেদ' - পার্থক্য।
(৬) "সহায় করেন তাঁর লইয়া প্রধানে।" 'সহায়' - সৃষ্ট্যাদি কার্য্যে সাহায্য। 'তাঁর লইয়া' অর্থাৎ তাঁর শক্তি লইয়া। 'প্রধান' - প্রকৃতি।
(৭) 'সদামঙ্গল' - সদাশিব।
(৮) ' মায়া যৈছে ....... সৃজন' - ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি-নিমিত্ত মহাবিষ্ণু নিমিত্ত মায়ার রজোগুণ বৃদ্ধি করেন। আর অদ্বৈত উপাদান মায়াদ্বারা অর্থাৎ পুরুষেক্ষণপ্রযুক্ত বর্দ্ধিতরজোগুণা মায়া দ্বারা ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি করেন।
- যদ্যপি সাংখ্য মানে প্রধান কারণ।
- জড় হইতে কভু নহে জগৎ সৃজন।।
- নিজ সৃষ্টিশক্তি প্রভু সঞ্চারে প্রধানে।
- ঈশ্বরের শক্ত্যে তবে হয়েত নির্ম্মাণে।।
- অদ্বৈতরূপে করে শক্তি সঞ্চারণ।
- অতএব অদ্বৈত হয়েত মুখ্য কারণ।। (১)
- অদ্বৈত আচার্য্য কোটি ব্রহ্মাণ্ডের কর্ত্তা।
- আর এক এক মূর্ত্ত্যে (২) ব্রহ্মাণ্ডের ভর্ত্তা।।
- সেই নারায়ণের মুখ্য অঙ্গ অদ্বৈত।
- অঙ্গ শব্দে অংশ করি কহে ভাগবত।।
(১) জড় হইতে ... কারণ - প্রভু মহাবিষ্ণু অদ্বৈতরূপে জড়রূপা প্রকৃতিতে সৃষ্টিশক্তি সঞ্চার করেন বলিয়া অদ্বৈতই ব্রহ্মাণ্ডসৃষ্টির মুখ্য কারণ।
(২) 'এক এক মূর্ত্ত্যে' - গর্ভোদশায়িরূপে এক এক মূর্ত্তিতে।
- বৈষ্ণবের গুরু তেহোঁ জগতের আর্য্য।
- দুই নাম মিলনে হৈল অদ্বৈত আচার্য্য।।
- কমলনয়নের (৩) তেহোঁ যাতে অঙ্গ অংশ।
- কমলাক্ষ (৪) করি ধরে নাম অবতংস।।
- ঈশ্বর-সারূপ্য পায় পারিষদগণ।
- চতুর্ভুজ পীতবাস যৈছে নারায়ণ।।
- অদ্বৈত-আচার্য্য ঈশ্বরের অংশবর্য্য। (৫)
- তাঁর তত্ত্বনাম গুণ সকল আশ্চর্য্য।।
- যাঁহার তুলসীজলে যাঁহার হুঙ্কারে।
- স্বগণ সহিতে চৈতন্যের অবতারে।।
- যাঁর দ্বারা কৈল প্রভু কীর্ত্তন-প্রচার।
- যাঁর দ্বারা কৈল প্রভু জগৎ-নিস্তার।।
- আচার্য্য-গোঁসাঞির গুণ-মহিমা অপার।
- জীবকীট কোথায় পাইবেক তার পার।।
- আচার্য্য-গোঁসাঞি চৈতন্যের মুখ্য-অঙ্গ।
- আর এক অঙ্গ তাঁর প্রভু-নিত্যানন্দ।।
- প্রভুর উপাঙ্গ শ্রীবাসাদি ভক্তগণ।
- হস্ত-মুখ-নেত্র-অঙ্গ চক্রাদ্যস্ত্র সম।।
- এ সব লইয়া চৈতন্য প্রভুর বিহার।
- এই সব লইয়া করেন বাঞ্ছিত প্রচার।। (৬)
- মাধবেন্দ্র পুরীর ইহোঁ শিষ্য এই জ্ঞানে।
- আচার্য্য গোঁসাঞিরে প্রভু গুরু করি মানে।।
- লৌকিক লীলাতে ধর্ম্ম মর্য্যাদা রক্ষণ।
- স্তুতি ভক্ত্যে করেন তাঁর চরণ বন্দন।।
- চৈতন্য গোঁসাঞিকে আচার্য্য করে প্রভুজ্ঞান।
- আপনাকে করেন তাঁর দাস অভিমান।।
- সেই অভিমানে সুখে আপনা পাসরে।
- কৃষ্ণদাস হও জীবে উপদেশ করে।।
- কৃষ্ণদাস অভিমানে যে আনন্দ-সিন্ধু।
- কোটি ব্রহ্ম সুখ নহে তার এক বিন্দু।।
(৩) 'কমলনয়নের' - মহাবিষ্ণুর।
(৪) 'কমলাক্ষ' - অদ্বৈত প্রভুর পিতৃদত্ত নাম।
(৫) 'অংশবর্য্য' - শ্রেষ্ঠ অংশ।
(৬) 'বাঞ্ছিত প্রচার' - জীবকে নাম প্রেম প্রদান।
- মুঞি যে চৈতন্যদাস আর নিত্যানন্দ।
- দাসভাব সম নহে অন্যত্র আনন্দ।।
- পরমপ্রেয়সী লক্ষ্মী হৃদয়ে বসতি।
- তেঁহো দাস্যসুখ মাগে করিয়া মিনতি।।
- দাস্যভাবে আনন্দিত পারিষদগণ।
- বিধি ভব নারদ আর শুক সনাতন।।
- নিত্যানন্দ অবধূত সবাতে আগল। (১)
- চৈতন্যের দাস্য প্রেমে হইলা পাগল।।
- শ্রীবাস হরিদাস রামদাস গদাধর।
- মুরারি মুকুন্দ চন্দ্রশেখর বক্রেশ্বর।।
- এ সব পণ্ডিত লোক পরম-মহত্ত্ব।
- চৈতন্যের দাস্যে সবায় করয়ে উন্মত্ত।।
- এই মত নাচে গায় করে অট্টহাস।
- লোকে উপদেশে (২) হও চৈতন্যের দাস।।
- চৈতন্য-গোঁসাঞি মোরে করে গুরুজ্ঞান।
- তথাপিহ মোর হয় দাস-অভিমান।।
- কৃষ্ণপ্রেমের এই এক অপূর্ব্ব প্রভাব।
- গুরু সম লঘুকে করায় দাসভাব।। (৩)
- ইহার প্রমাণ শুন শাস্ত্রের ব্যাখ্যান।
- মহদনুভব যাতে সুদৃঢ় প্রমাণ।।
- অন্যের কা কথা ব্রজে নন্দ মহাশয়।
- তাঁর সম গুরু কৃষ্ণের আর কেহ নয়।।
- শুদ্ধ বাৎসল্য ঈশ্বর-জ্ঞান নাহি যাঁর।
- তাঁহাকেও প্রেমে করায় দাস্য অনুকার।।
- তেঁহো রতি-মতি মাগে কৃষ্ণের চরণে।
- তাঁহার শ্রীমুখ-বাণী তাহাতে প্রমাণে।।
- শুন উদ্ধব সত্য কৃষ্ণ আমার তনয়।
- তেঁহো ঈশ্বর হেন যদি তোমার মনে লয়।।
- তথাপি তাঁহাতে মোর রহু মনোবৃত্তি।
- তোমার ঈশ্বর কৃষ্ণে হউক মোর মতি।।
(১) 'সবাতে আগল' - সকল পারিষদ মধ্যে অগ্রগণ্য, সর্ব্বশ্রেষ্ঠ।
(২) 'উপদেশে' - উপদেশ দান করেন।
(৩) 'গুরু' - পিতা, মাতা প্রভৃতি। 'সম' - সখা প্রভৃতি। 'লঘু' - কনিষ্ঠ বা দাস প্রভৃতি।
- তথাহি - শ্রীমদ্ভাগবতে ১০।৪৭।৬৬-৬৭
- মনসো বৃত্তয়ো নঃ স্যুঃ কৃষ্ণপাদাম্বুজাশ্রয়াঃ।
- বাচোহভিধায়িনীর্নাম্নাং কায়স্তৎ প্রহ্বণাদিষু।।৫
- কর্ম্মভির্ভ্রাম্যমাণানাং যত্র ক্কাপীশ্বরেচ্ছয়া।
- মঙ্গলাচরিতৈর্দানৈ-রতির্নঃ কৃষ্ণ ঈশ্বরে।।৬
অন্বয়ঃ।- [শ্রীনন্দমহারাজ বলিতেছেন] নঃ মনসো বৃত্তয়ঃ কৃষ্ণপাদাম্বুজাশ্রয়াঃ স্যুঃ (আমাদের মনোবৃত্তিসমূহ কৃষ্ণপাদপদ্মের আশ্রয়ে থাকুক) বাচঃ নাম্নাম্ অভিধায়িনীঃ স্যুঃ (ঐ বাক্যসকল তাঁহার নাম উচ্চারণে নিযুক্ত হউক) তৎপ্রহ্বণাদিষু কায়ঃ অস্তু (এবং শরীর তাঁহার নমস্কারাদিতে নিরত হউক) যত্র ক্কাপি ভ্রাম্যমাণানাং নঃ মঙ্গলাচরিতৈঃ দানৈঃ ঈশ্বরে কৃষ্ণে রতিঃ অস্তু (কর্ম্মফলে ঈশ্বরেচ্ছায় যে কোন স্থানেই ভ্রমণকারী আমাদের দানাদি পুণ্যাচরণের ও দানের ফলে শ্রীকৃষ্ণে রতি হউক)।
অনুবাদ।- আমাদের মনের বৃত্তিগুলি শ্রীকৃষ্ণের চরণকমলকে আশ্রয় করুক, কথায়হোক তাঁরই নামকীর্ত্তন, দেহ করুক তাঁরই সেবা। ঈশ্বরের নির্দ্দেশে প্রাক্তনকর্ম্ম আমাদের যেখানেই নিয়ে যাক, দানাদি-পুণ্যকর্ম্মফলে যেন ঈশ্বরস্বরূপ কৃষ্ণেই মতি থাকে।।৫-৬।।
- শ্রীদামাদি ব্রজের যত সখার নিচয়।
- ঐশ্বর্য্য-জ্ঞানহীন কেবল সখ্যময়।।
- কৃষ্ণসঙ্গে যুদ্ধ করে স্কন্ধে আরোহণ।
- তারা দাস্যভাবে করে চরণ-সেবন।।
- তথাহি - তত্রৈব শ্রীমদ্ভাগবতে ১০।১৫।১৭
- পাদসংবাহনং চক্রুঃ কেচিত্তস্য মহাত্মনঃ
- অপরে হতপাপ্মানো ব্যজনৈঃ সমবীজয়ন্।।৭
অন্বয়ঃ।- কেচিৎ তস্য মহাত্মনঃ (কেহ কেহ সেই মহাত্মা শ্রীকৃষ্ণের) পাদসংবাহনং চক্রুঃ (পাদসংবাহন করিয়াছিল) হতপাপ্মানঃ অপরে ব্যজনৈঃ সমবীজয়ন্ (পাপশূন্য অপর কেহ কেহ তাঁহাকে ব্যজন দ্বারা বাতাস করিয়াছিল)।
অনুবাদ।- জনকয়েক সেই পরমপুরুষের পদসেবা করলেন, আর নিষ্পাপচিত্ত অনেকে তাঁকে ব্যজন করলেন।।৭।।
- কৃষ্ণের প্রেয়সী ব্রজে যত গোপীগণ।
- যাঁর পদধূলি করে উদ্ধব প্রার্থন।।
- যাঁ সভা উপরে কৃষ্ণের প্রিয় নাহি আন।
- তাঁরা আপনাকে করে দাসী অভিমান।।
- তথাহি - শ্রীমদ্ভাগবতে ১০।৩১।৬
- ব্রজজনার্ত্তিহন্! বীর! যোষিতাং
- নিজজনস্ময়ধ্বংসনস্মিত।
- ভজ সখে! ভবৎকিঙ্করীঃ স্ম নো
- জলরুহাননং চারু দর্শয়।।৮
অন্বয়ঃ।- ব্রজজনার্ত্তিহন্ (তুমি ব্রজবাসীর দুঃখহারী) বীর নিজজনস্ময়ধ্বংসনস্মিত (তুমি নিজজনের গর্ব্বধ্বংসকারী হাস্যযুক্ত) সখে ভবৎকিঙ্করীঃ নঃ ভজ স্ম (অতএব হে সখে! তোমার দাসী আমাদিগকে তুমি ভজন কর) চারু জলরুহাননং যোষিতাং দর্শয় (এবং এই নারীগণকে তোমার বদনকমল দর্শন করাও)।
অনুবাদ।- হে বীর! ব্রজের দুঃখ তুমি নাশ কর! হাস্যদ্বারা নিজজনের গর্ব্বকে তুমি হরণ কর। সখা! আমরা তোমার কিঙ্করী, আমাদের ভজনা কর; আর তোমার কমল-আনন তুমি দেখাও।।৮।।
- তত্রৈব ১০।৪৭।২১
- অপি বত মধুপুর্য্যামার্য্যপুত্রোহধুনাস্তে
- স্মরতি স পিতৃগেহান্ সৌম্য বন্ধূংশ্চ গোপান্।
- ক্বচিদপি স কথাং নঃ কিঙ্করীণাং গৃণীতে
- ভুজমগুরুসুগন্ধং মূর্দ্ধ্ন্যধাস্যৎ কদা নু।।৯
অন্বয়ঃ।- [গোপীগণ উদ্ধবকে বলিতেছেন] আর্য্যপুত্রঃ অধুনা অপি বত মধুপুর্য্যাম্ আস্তে (আর্য্যপুত্র কি এখন মধুপুরীতেই আছেন?) সৌম্য! সঃ পিতৃগেহান্ বন্ধূন্ শ্চ গোপান্ চ স্মরতি (হে সৌম্য! তিনি পিতৃগৃহসমূহকে, বন্ধুগণকে ও গোপগণকে কি স্মরণ করিয়া থাকেন?) স ক্বচিদপি কিঙ্করীণাং নঃ কথাং গৃণীতে (তিনি কি কখনও এই দাসীদিগের কথা বলিয়া থাকেন?) অগুরুসুগন্ধং ভুজং কদা নু মূর্দ্ধ্নি অধাস্যৎ (হায় হায়! কবে তিনি তাঁহার অগুরুর দ্বারা সুগন্ধ বাহু আমাদিগের মস্তকে অর্পণ করিবেন?)।
অনুবাদ।- এখন কি আর্য্যপুত্র মথুরায় রয়েছেন? হে সৌম্য! তাঁর কি পিতৃগৃহের কথা মনে পড়ে? মনে পড়ে স্বজন ও গোপদের কথা? আমাদের মত কিঙ্করীদের কথা কি কখনো বলেন? হায়! আর কি তাঁর অগুরু-সুরভি বাহু আমাদের মাথায় রাখবেন?।।৯।।
- তাঁ সবার কথা রহু শ্রীমতী রাধিকা।
- সভা হৈতে সকলাংশে পরম অধিকা।।
- তেহোঁ যার দাসী হৈঞা সেবেন চরণ।
- যাঁর প্রেমগুণে কৃষ্ণ বদ্ধ অনুক্ষণ।।
- তথাহি - শ্রীমদ্ভাগবতে ১০।৩০।৩৯
- হা নাথ রমণ প্রেষ্ঠ ক্কাসি ক্কাসি মহাভুজ।
- দাস্যাস্তে কৃপণায়া মে সখে দর্শয় সন্নিধিম্।।১০
অন্বয়ঃ।- [শ্রীরাধিকা বলিতেছেন] হা নাথ! রমণ! প্রেষ্ঠ! মহাভুজ! ক্ক অসি ক্ক অসি (হে নাথ! হে রমণ! হে প্রিয়তম! হে মহাভুজ! তুমি কোথায় আছ?) সখে! দাস্যাঃ কৃপণায়াঃ মে তে সন্নিধিং দর্শয় (হে সখে! তুমি এই দুঃখিতা দাসীকে তোমার দর্শন দান কর)।
অনুবাদ।- হে প্রভু, হে রমণ, হে প্রিয়তম! - মহাভুজ! তুমি কোথায়, তুমি কোথায়? আমি তোমার কিঙ্করী - সখা, তুমি কোথায় আছ, দুঃখিতা আমাকে দেখা দাও।।১০।।
- দ্বারকতাতে রুক্মিণ্যাদি যতেক মহিষী।
- তাঁহারাও আপনাকে মানে কৃষ্ণদাসী।।
- শ্রীমদ্ভাগবতে ১০।৮৩।৮
- চৈদ্যায় মার্পয়িতুমুদ্যত কার্ম্মুকেষু
- রাজস্বজেয়ভটশেখারিতাঙ্ঘ্রিরেণুঃ।
- নিন্যে মৃগেন্দ্র ইব ভাগমজাবিষূথা -
- ত্তচ্ছ্রীনিকেতচরণোহস্তু মমার্চ্চনায়।।১১
অন্বয়ঃ।- [শ্রীরুক্মিণী দেবী শ্রীদ্রৌপদীকে বলিতেছেন] মা চৈদ্যায় অর্পয়িতুং (আমাকে শিশুপালের হস্তে সমর্পণ করিবার জন্য) রাজসু উদ্যতকার্ম্মুকেষু (রাজগণ ধনুর্ব্বাণ ধারণ করিলে) মৃগেন্দ্রঃ অজাবিষূথাৎ ভাগম্ ইব (যিনি সিংহের ন্যায় অজগণের নিকট হইতে স্বীয় ভাগস্বরূপ) অজেয়ভটশিখারিতাঙ্ঘ্রিরেণুঃ (অজেয় বীরগণের মুকুটসমূহে পাদরেণু অর্পণপূর্ব্বক) [অহং] নিন্যে (আমাকে গ্রহণ করিয়াছিলেন) তচ্ছ্রীনিকেত-চরণঃ মম অর্চ্চনায় অস্তু (তাঁহার সর্ব্বশোভার আস্পদ সেই শ্রীচরণ আমার অর্চ্চনের যোগ্য হউক)।
অনুবাদ।- সিংহ যেমন ক'রে অজযুথের মধ্য থেকে নিজের ভাগ ছিনিয়ে আনে তিনিও তেমনি দুর্জয় রাজবৃন্দের মাথায় পা দিয়ে সেই সব উদ্যতধনু রাজাদের সম্মুখেই শিশুপালে হাত থেকে আমাকে উদ্ধার করেছিলেন। সকল শোভার আস্পদ তাঁর চরণ দু'টি যেন আমি পূজা করতে পাই।।১১।।
- তথাহি শ্রীমদ্ভাগবতে - ১০।৮৩।১১
- তপশ্চরন্তীং মাজ্ঞায় স পাদস্পর্শনাশয়া।
- সখ্যোপেত্যাগ্রহীৎ পাণিং সাহং তদ্গৃহমার্জ্জনী।।১২
অন্বয়ঃ।- [শ্রীকালিন্দী শ্রীদ্রৌপদীকে বলিতেছেন] পাদস্পর্শনাশয়া তপশ্চরন্তীং মা আজ্ঞায় (আমি তাঁহার পাদস্পর্শের আমায় তপস্যা করিতেছি জানিতে পারিয়া) স সখ্যা উপেত্য পাণিম্ অগ্রহীৎ (তিনি সখার সহিত গমন করিয়া আমার পাণিগ্রহণ করিয়াছিলেন) সা অহং তদ্গৃহমার্জ্জনী (সেই আমি তদবধি তাঁহার গৃহসংস্কারকারিণী দাসী)।
অনুবাদ।- আমি তাঁর চরণস্পর্শের আশায় তপস্যা করেছিলাম, কিন্তু এ কথা জেনে তিনি সখাকে সঙ্গে নিয়ে এসে যার পাণিগ্রহণ করলেন আমিই সেই তাঁর গৃহদাসী।।১২।।
- তত্রৈব ১০।৮৩।৩৯
- আত্মারামস্য তস্যেমা বয়ং বৈ গৃহদাসিকাঃ।
- সর্ব্বসঙ্গনিবৃত্ত্যাদ্ধা তপসা চ বভূবিম।।১৩
অন্বয়ঃ।- [শ্রীলক্ষণা বলিতেছেন] ইমা বয়ং সর্ব্বসঙ্গনিবৃত্ত্যা তপসা চ (এই আমরা সর্ব্বসঙ্গনিবৃত্তিমূলক তপস্যার দ্বারা) আত্মারামস্য তস্য অদ্ধা গৃহদাসিকাঃ বভূবিম (সেই আত্মারাম শ্রীকৃষ্ণের সাক্ষাৎ গৃহদাসী হইয়াছি)।
অনুবাদ।- সবার সঙ্গ ত্যাগ ক'রে আর তপস্যা ক'রে সেই আনন্দময় পুরুষোত্তমের আমরা সাক্ষাৎ কিঙ্করীই হয়েছি।।১৩।।
- আনের কি কথা বলদেব মহাশয়।
- যাঁর ভাব শুদ্ধ সখ্য-বাৎসল্যাদিময়।।
- তেঁহো আপনাকে করেন দাস-ভাবনা।
- কৃষ্ণদাস-ভাব বিনু আছে কোন্ জনা।।
- সহস্র বদন যেহো শেষ সঙ্কর্ষণ।
- দশদেহ (১) ধরি করেন কৃষ্ণের সেবন।।
- অনন্ত ব্রহ্মাণ্ডে রুদ্র সদাশিবের অংশ।
- গুণাবতার তেঁহো সর্ব্ব-অবতংস।।
- তেহোঁ যে করেন কৃষ্ণের দাস্য প্রত্যাশ।
- নিরন্তর কহে শিব মুঞি কৃষ্ণদাস।।
- কৃষ্ণপ্রেমে উন্মত্ত বিহ্বল দিগম্বর।
- কৃষ্ণগুণ-লীলা গায় নাচে নিরন্তর।।
- পিতা-মাতা-গুরু-সখা-ভাব কেনে নয়।
- প্রেমের স্বভাবে দাস্যভাব সে করয়।।
- এক কৃষ্ণ সর্ব্বসেব্য জগৎ ঈশ্বর।
- আর যত সব তাঁর সেবকানুচর।।
- সেই কৃষ্ণ অবতীর্ণ চৈতন্য-ঈশ্বর।
- অতএব আর সব তাঁহার কিঙ্কর।।
- কেহো মানে কেহো না মানে সবে তাঁর দাস।
- যে না মানে তার হয় সেই পাপে নাশ।।
- চৈতন্যের দাস মুঞি চৈতন্যের দাস।
- চৈতন্যের দাস মুঞি তাঁর দাসের দাস।।
- এত বলি নাচে গায় হুঙ্কার গম্ভীর।
- ক্ষণেকে বসিলা আচার্য্য হৈঞা সুস্থির।।
(১) 'দশদেহ' - ছত্র, পাদুকা, শয্যা, উপাধান, বসন, উপবন, বাসগৃহ, যজ্ঞসূত্র, সিংহাসন ও পৃথিবীধারণ।
- ভক্ত অভিমান (১) মূল শ্রীবলরামে।
- সেই ভাবে অনুগত তাঁর অংশগণে।।
- তাঁর অবতার এক শ্রীসঙ্কর্ষণ।
- ভক্ত করি অভিমান করে সর্ব্বক্ষণ।।
- তাঁর অবতার এক শ্রীযুত লক্ষ্মণ।
- শ্রীরামের দাস্য তেহোঁ কৈল অনুক্ষণ।।
- সঙ্কর্ষণ অবতার কারণাব্ধিশায়ী।
- তাঁহার হৃদয়ে ভক্তভাবে অনুযায়ী।।
- তাঁহার প্রকাশভেদ অদ্বৈত-আচার্য্য।
- কায়মনোবক্যে তাঁর ভক্তি সদা কার্য্য।।
- বাক্যে কহে মুঞি চৈতন্যের অনুচর।
- মুঞি তাঁর ভক্ত মনে ভাবে নিরন্তর।।
- জল তুলসী দিয়া করে কায়েতে (২) সেবন।
- ভক্তি প্রচারিয়া সব তারিলা ভুবন।।
- পৃথিবী ধরেন যেই শেষ সঙ্কর্ষণ।
- কায়ব্যূহ (৩) করি করেন কৃষ্ণের সেবন।।
- এই সব হয় শ্রীকৃষ্ণের অবতার।
- নিরন্তর দেখি সবার ভক্তির আচার।।
- এ সবাকে শাস্ত্রে কহে ভক্ত-অবতার।
- ভক্ত-অবতার পদ উপরি সবার।।
- অতএব অংশী কৃষ্ণ অংশ অবতার।
- অংশী অংশে দেখি জ্যেষ্ঠ কনিষ্ঠ আচার।।
- জ্যেষ্ঠ ভাবে অংশীতে হয় প্রভুজ্ঞান।
- কনিষ্ঠ ভাবে আপনাতে ভক্ত অভিমান।।
- কৃষ্ণের সমতা হৈতে বড় ভক্তপদ।
- আত্মা হৈতে কৃষ্ণের ভক্ত প্রেমাস্পদ।।
- আত্মা হৈতে কৃষ্ণ ভক্ত বড় করি মানে।
- তাহাতে বহুত শাস্ত্র বচন-প্রমাণে।।
(১) 'অভিমান' - ভাব, নিজের ভাব।
(২) 'কায়েতে' - মস্তকে।
(৩) 'কায়ব্যূহ' - এক শরীর হইতে বহু শরীর প্রকটীকরণের নাম কায়ব্যূহ।
- তথাহি - শ্রীমদ্ভাগবতে ১১।১৪।১৫
- ন তথা মে প্রিয়তমো আত্মযোনির্নশঙ্করঃ
- ন চ সঙ্কর্ষণো ন শ্রীর্নৈবাত্মাচ যথা ভবান্।।১৪
অন্বয়ঃ।- [শ্রীকৃষ্ণ উদ্ভবকে বলিতেছেন] - ভবান্ যথা তথা (তুমি ভক্ত বলিয়া আমার যেরূপ প্রিয়তম সেরূপ) আত্মযোনিঃ মে ন প্রিয়তমঃ ন শঙ্করঃ ন চ সঙ্কর্ষণঃ ন শ্রীঃ ন এব আত্মা চ (আমা হইতে জাত ব্রহ্মা, আমা হইতে অভিন্ন শ্রীশঙ্কর বা সঙ্কর্ষণ, আমার বক্ষঃস্থিতা লক্ষ্মী, এমন কি - আমার আত্মাও আমার সেরূপ প্রিয় নহেন)।
অনুবাদ।-আপনি যেমন আমার প্রিয়তম, তেমন প্রিয়তম ব্রহ্মাও নন, শিবও নন, সঙ্কর্ষণও নন, লক্ষ্মীও নন, আত্মপুরুষও নন।।১৪।।
- কৃষ্ণ সাম্যে নহে তাঁর মাধুর্য্য আস্বাদন।
- ভক্তভাবে করে তাঁর মাধুর্য্য চর্ব্বণ।।
- শাস্ত্রের সিদ্ধান্ত এই বিজ্ঞ অনুভব।
- মূঢ়লোক নাহি জানে ভাবের বৈভব।।
- ভক্তভাব অঙ্গীকরি বলরাম লক্ষ্মণ।
- অদ্বৈত নিত্যানন্দ শেষ সঙ্কর্ষণ।।
- কৃষ্ণের মাধুর্য্য-রসামৃত করে পান।
- সেই সুখে মত্ত কিছু নাহি জানে আন।।
- অন্যের আছুক কার্য্য আপনে শ্রীকৃষ্ণ।
- আপন-মাধুর্য্য পানে হইয়া সতৃষ্ণ।।
- স্বমাধুর্য্য আস্বাদিতে করেন যতন।
- ভক্তভাব বিনু নহে তাহা আস্বাদন।।
- ভক্তভাব অঙ্গীকরি হৈলা অবতীর্ণ।
- শ্রীকৃষ্ণ-চৈতন্য-রূপে সর্ব্বভাবে পূর্ণ।।
- নানা ভক্তভাবে করেন স্বমাধুর্য্য পান।
- পূর্ব্বে করিয়াছি এই সিদ্ধান্ত ব্যাখ্যান।।
- অবতারগণের ভক্তভাবে অধিকার।
- ভক্তভাব হইতে অধিক সুখ নাহি আর।।
- মূল ভক্ত অবতার শ্রীসঙ্কর্ষণ।
- ভক্ত অবতার তহিঁ অদ্বৈত গণন।। (৪)
(৪) মূল ভক্ত-অবতার শ্রীসঙ্কর্ষণ, তাঁহার অবতার বলিয়া অদ্বৈতাচার্য্যকে ভক্তাবতার বলা হয়।
- অদ্বৈত আচার্য্য গোঁসাঞির মহিমা অপার।
- যাঁহার হুঙ্কারে কৈল চৈতন্যাবতার।।
- সংকীর্ত্তন প্রচারিয়া জগৎ তারিল।
- অদ্বৈত প্রসাদে লোক প্রেমধন পাইল।।
- অদ্বৈত মহিমানন্ত কে পারে কহিতে।
- সেই লিখি যেই শুনি মহাজন হৈতে।।
- আচার্য্য চরণে মোর কোটি নমস্কার।
- ইথে অপরাধ কিছু না লবে আমার।।
- তোমার মহিমা কোটি সমুদ্র অগাধ।
- তাহার ইয়ত্তা কহি এ বড় অপরাধ।।
- জয় জয় জয় শ্রীঅদ্বৈত-আচার্য্য।
- জয় জয় শ্রীচৈতন্য নিত্যানন্দ আর্য্য।।
- দুই শ্লোকে কহিল অদ্বৈত-তত্ত্ব-নিরূপণ।
- পঞ্চতত্ত্বের বিচার কিছু শুন ভক্তগণ।।
- শ্রীরূপ-রঘুনাথ-পদে যার আশ।
- চৈতন্যচরিতামৃত কহে কৃষ্ণদাস।।