ব্যবহারকারী:Subrata Roy/শ্রীশ্রীচৈতন্যচরিতামৃত/আদিলীলা/সপ্তম পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে


অগত্যেকগতিং নত্বা হীনার্থাধিকসাধকম্‌।
শ্রীচৈতন্যং লিখ্যতেহস্য প্রেমভক্তিবদান্যতা।।১

অন্বয়ঃ।- অগত্যেকগতিম্‌ (গতিহীনদিগের একমাত্র গতি) হীনার্থাধিকসাধকং (যিনি নীচজনের পরমপুরুষার্থ সাধনকারী) শ্রীচৈতন্যং নত্বা অস্য প্রেমভক্তিবদান্যতা লিখ্যতে (সেই শ্রীচৈতন্যদেবকে নমস্কারপূর্ব্বক তাঁহার প্রেম-ভক্তি বদান্যতার বিষয়ে লিখিতেছি)।

অনুবাদ।- যিনি অগতির গতি, দুর্ভাগ্যের সৌভাগ্যদাতা - সেই শ্রীচৈতন্যকে প্রণাম ক'রে তাঁর প্রেমভক্তির বদান্যতার কথা লিখছি।।১।।

জয় জয় মহাপ্রভু শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য।
তাঁহার চরণাশ্রিত সেই বড় ধন।।
পূর্ব্বে গুর্ব্বাদি ছয় তত্ত্বের (১) কৈল নমস্কার।
গুরুতত্ত্ব কহিয়াছি শুন পাঁচের বিচার (২)।।
পঞ্চ-তত্ত্ব অবতীর্ণ শ্রীচৈতন্যের সঙ্গে।
পঞ্চ-তত্ত্ব মিলি করে সংকীর্ত্তন রঙ্গে।।
পঞ্চ-তত্ত্ব এক বস্তু নাহি কিছু ভেদ।
রস-আস্বাদিতে তবু বিবিধ বিভেদ।।

(১) গুরু, ভক্ত, ঈশ, অবতার, প্রকাশ ও শক্তি - ছয় তত্ত্বের।

(২) 'পাঁচের' - পঞ্চতত্ত্বের।

শ্রীস্বরূপগোস্বামি - কড়চায়াম্‌
পঞ্চতত্ত্বাত্মকং কৃষ্ণং ভক্তরূপস্বরূপকম্‌।।২

এই শ্লোকের অন্বয় ও অনুবাদ ৪ পৃষ্ঠায় দ্রষ্টব্য।।২

রাসাদি-বিলাসী-ব্রজ-ললনানাগর।
আর যত সব দেখ তাঁর পরিকর।।
সেই কৃষ্ণ অবতীর্ণ শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য।
সেই পরিকরগণ সঙ্গে সব ধন্য।।
একলে ঈশ্বরতত্ত্ব চৈতন্য-ঈশ্বর।
ভক্তভাবময় তাঁর শুদ্ধ কলেবর।।
কৃষ্ণমাধুর্য্যের এক অদ্ভুত স্বভাব।
আপনা আস্বাদিতে কৃষ্ণ করে ভক্তভাব।।
ইথে ভক্তভাব ধরে চৈতন্য গোঁসাঞি।
ভক্ত-স্বরূপ তাঁর নিত্যানন্দ ভাই।।
ভক্ত অবতার তাঁর আচার্য্য গোঁসাঞি।
এই তিন তত্ত্ব (৩) সবে প্রভু করি গাই।।
এক মহাপ্রভু আর প্রভু দুইজন।
দুই প্রভু সেবে মহাপ্রভুর রচরণ।।
এই তিন তত্ত্ব - সর্ব্বারাধ্য করি মানি।
চতুর্থ যে ভক্ততত্ত্ব আরাধক জানি।।
শ্রীবাসাদি যত কোটি কোটি ভক্তগণ।
শুদ্ধ-ভক্ত-তত্ত্ব মধ্যে সবার গণন।।
গদাধর আদি প্রভুর শক্তি-অবতার।
অন্তরঙ্গ ভক্ত করি গণন যাঁহার (৪)।।
যাহা সভা লৈয়া প্রভুর নিত্য বিহার।
যাহা সভা লৈঞা প্রভুর কীর্ত্তন প্রচার।।
যাঁহা সভা লৈয়া করেন প্রেম আস্বাদন।
যাঁহা সভা লৈয়া দান করেন প্রেমধন।।

(৩) 'এই তিন তত্ত্ব' - শ্রীমহাপ্রভু, শ্রীনিত্যানন্দপ্রভু ও শ্রীঅদ্বৈতপ্রভু।

(৪) হলাদিনীশক্তির অবতার কহিতেছেন - 'গদাধর আদি ........ গণন যাঁহার' ইহাদ্বারা এই প্রতিপন্ন হইল যে, যাঁহারা শ্রীমহাপ্রভুর অন্তরঙ্গ ভক্ত মধ্যে গণ্য, তাঁহারা হলাদিনীশক্তিরূপা শ্রীভগবৎপ্রেয়সীবৃন্দের অবতার।

এই পঞ্চতত্ত্ব মিলি পৃথিবী আসিয়া।
পূর্ব্ব প্রেম ভাণ্ডারের মুদ্রা উঘাড়িয়া।। (১)
পাঁচে মিলি লুটে প্রেম করে আস্বাদন।
যত যত পিয়ে তৃষ্ণা বাড়ে অনুক্ষণ।।
পুনঃ পুনঃ পিয়া পিয়া হয় মহা মত্ত।
নাচে কান্দে হাসে গায় যৈছে মদমত্ত।।
পাত্রাপাত্র বিচার নাহি নাহি স্থানাস্থান।
যেই যাঁহা পায় তাঁহা করে প্রেমদান।।
লুটিয়া খাইয়া দিয়া ভাণ্ডার উজাড়ে।
আশ্চর্য্য ভাণ্ডার প্রেম শতগুণ বাঢ়ে।।
উথলিল প্রেমবন্য চৌদিকে বেড়ায়।
স্ত্রী বালক বৃদ্ধ যুব সভারে ডুবায়।।
সজ্জন দুর্জ্জন পঙ্গু জড় অন্ধগণ।
প্রেম-বন্যায় ডুবাইল জগতের জন।।
জগৎ ডুবিল জীবের হৈল বীজ নাশ। (২)
তাহা দেখি পাঁচজনের (৩) পরম উল্লাস।।
যত যত প্রেমবৃষ্টি করে পঞ্চজনে।
তত তত বাঢ়ে জল ব্যাপে ত্রিভুবনে।।
মায়াবাদী কর্ম্মনিষ্ঠ কুতার্কিক জন।
নিন্দুক পাষণ্ডী যত পঢ়ুয়া অধম।।
এই সব মহাদক্ষ ধাঞা পলাইল।
সেই বন্য তা সভারে ছুঁইতে নারিল।। (৪)

(১) 'পূর্ব্ব ........ উঘাড়িয়া' - কৃষ্ণ অবতারকালের প্রেমভাণ্ডারের দ্বারা উদ্ঘাটন করিয়া।

(২) 'বীজ' - অবিদ্যা। হৈল বীজ নাশ - সংসারবীজমূল অজ্ঞানবাসনা ধ্বংস হৈল।

(৩) 'পাঁচজনের' - পঞ্চতত্ত্বের।

(৪) 'মায়াবাদী' - যাহার জগৎকে ভ্রম বলে; শ্রীশঙ্করাচার্য্যে মতানুবর্ত্তী গোতমাদি ব্যক্তিগণ। 'কর্ম্মনিষ্ঠ' - যাহাদের কর্ম্মে পুরুষার্থবুদ্ধি - অর্থাৎ যাজ্ঞিকাদি। 'কুতার্কিক' - ভক্তিবিরোধিতর্ককারী। 'পাষণ্ড' - নাস্তিক, উপধর্ম্মযাজী অর্থাৎ অবৈদিক পথানুসারী। 'পঢ়ুয়া' - ছাত্র। মায়াবাদী প্রভৃতি ভক্তিবহির্ম্মুখ বলিয়া অধম, যেহেতু মহাপ্রভুর প্রেম-বন্যাও তাঁহাদিগকে স্পর্শ করিতে পারিল না, তাই কহিতেছেন 'এই সব ...... ছুঁইতে নারিল'।

তাহা দেখি মহাপ্রভু করেন চিন্তন।
জগৎ ডুবাইতে আমি করিল যতন।।
কেহ কেহ এড়াইল প্রতিজ্ঞা হৈল ভঙ্গ।
তা সভা ডুবাইতে পাতিব কিছু রঙ্গ।।
এত বলি মনে কিছু করিয়া বিচার।
সন্ন্যাস আশ্রম প্রভু কৈলা অঙ্গীকার।।
চব্বিশ বৎসর ছিলা গৃহস্থ আশ্রমে।
পঞ্চবিংশতি বর্ষে কৈল যতিধর্ম্মে।।
সন্ন্যাস করিয়া প্রভু কৈল আকর্ষণ।
যতেক পলায়াছিল তার্কিকাদিগণ।।
পঢ়ুয়া-পাষণ্ডী-কর্ম্মী-নিন্দকাদি যত।
সভে আসি প্রভু পায় হৈলা অবনত।।
অপরাধ ক্ষমাইল ডুবিল প্রেমজলে।
কেবা এড়াইবে প্রভুর প্রেম মহাজালে।।
সভা নিস্তারিতে প্রভুর কৃপা অবতার।
সভা নিস্তারিতে করেন চাতুরী অপার।।
তবে নিজ ভক্ত কৈল যত ম্লেচ্ছ আদি।
সবে এক এড়াইল কাশীর মায়াবাদী।।
বৃন্দাবন যাইতে প্রভু রহিলা কাশীতে।
মায়াবাদিগণ তাঁরে লাগিলা নিন্দিতে।।
সন্ন্যাসী হইয়া করেন গায়ন নাচন।
না করে বেদান্ত পাঠ - করে সংকীর্ত্তন।।
মূর্খ সন্ন্যাসী নিজ ধর্ম্ম নাহি জানে।
ভাবক হইয়া ফেরে ভাবকের সনে।।
এসব শুনিয়া প্রভু হাসে মনে মনে।
উপেক্ষা করিয়া কৈল মথুরাগমন।
মথুরা দেখিয়া পুনঃ কৈল আগমন।।
কাশীতে লেখক শূদ্র চন্দ্রশেখর।
তার ঘরে রহিলা প্রভু স্বতন্ত্র ঈশ্বর।।
তপন মিশ্রের (৫) ঘরে ভিক্ষা নির্ব্বাহণ।
সন্ন্যাসীর সঙ্গে নাহি মানে নিমন্ত্রণ।।

(৫) 'তপন মিশ্র' - ইনি গৌড়ীয় ব্রাহ্মণ শ্রীরঘুনাথ ভট্টগোস্বামীর পিতা।

সনাতন গোঁসাঞি আসি তাঁহাই মিলিলা।
তাঁর শিক্ষা লাগি প্রভু দুই মাস রহিলা।।
তারেঁ শিখাইল যত বৈষ্ণবর ধর্ম্ম।
ভাগবত আদি শাস্ত্রে যত গূঢ় মর্ম্ম।।
ইতি-মধ্যে চন্দ্রশেখর মিশ্র তপন।
দুঃখী হৈয়া প্রভুপদে কৈল নিবেদন।।
কতেক শুনিব প্রভু তোমার নিন্দন।
না পারি সহিতে এবে ছাড়িব জীবন।।
তোমারে নিন্দয়ে যত সন্ন্যাসীর গণ।
শুনিতে না পারি ফাটে হৃদয় শ্রবণ।।
ইহা শুনি রহে প্রভু ঈষৎ হাসিয়া।
সেই কালে এক বিপ্র (১) মিলিল আসিয়া।।
আসি নিবেদন করে চরণে ধরিয়া।
এক বস্তু মাগোঁ দেহ প্রসন্ন হইয়া।।
সকল সন্ন্যাসী মুঞি কৈল নিমন্ত্রণ।
তুমি যদি আইস পূর্ণ হয় মোর মন।।
না যাহ সন্ন্যাসী-গোষ্ঠী (২) ইহা আমি জানি।
মোরে অনুগ্রহ কর নিমন্ত্রণ মানি।।
প্রভু হাসি নিমন্ত্রণ কৈল অঙ্গীকার।
সন্ন্যাসীরে কৃপা লাগি এ ভঙ্গী তাঁহার।।
সেই বিপ্র জানে প্রভু না যান কারো ঘরে।
তাঁহার প্রেরণায় তারেঁ অত্যাগ্রহ করে (৩)।।
আর দিনে গেলা প্রভু সে বিপ্রভবনে।
দেখিলেন বসি আছেন সন্ন্যাসীর গণে।।

(১) 'বিপ্র' - জনৈক মহারাষ্ট্রীয় ব্রাহ্মণ।

(২) 'গোষ্ঠী' - সমাজ।

(৩) মহাপ্রভুর ইচ্ছা যে তিনি সন্ন্যাসিগণকে কৃপা করিবেন সুতরাং সেই বিপ্র যদিও জানিতেন যে, মহাপ্রভু কাহারও গৃহে খান না, তথাপি মহাপ্রভু এই ব্রাহ্মণের মনের মধ্যে তাঁহাকে (মহাপ্রভুকে) নিমন্ত্রণ করিবার ইচ্ছা জাগাইয়া দিলেন।

সভা নমস্করি (৪) গেলা পাদ প্রক্ষালনে।
পাদ প্রক্ষালন করি বসিল সেই স্থানে (৫)।।
বসিয়া করিল কিছু ঐশ্বর্য্য প্রকাশ।
মহা তেজোময় বপু কোটি সূর্য্যভাস।।
প্রভাবে আকর্ষিল সব সন্ন্যাসীর মন।
উঠিল সন্ন্যাসীগণ ছাড়িয়া আসন।।
প্রকাশানন্দ (৬) নামে সর্ব্ব সন্ন্যাসী-প্রধান।
প্রভুকে কহিল কিছু করিয়া সম্মান।।
ইহাঁ আইস ইহাঁ আইস শুনহ শ্রীপাদ।
অপবিত্র স্থানে বৈস কিবা অবসাদ (৭)।।
প্রভু কহেন আমি হই হীন সম্প্রদায় (৮)।
তোমা সভার সভায় বসিতে (৯)।।
আপনে প্রকাশানন্দ হাথেতে ধরিয়া।
বসাইল সভামধ্যে সম্মান করিয়া।।
পুছিল তোমার নাম শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য।
কেশব ভারতীর শিষ্য তাতে তুমি ধন্য।।

(৪) 'নমস্করি' - প্রণাম করিয়া।

(৫) 'সেই স্থানে' - যেখানে পাদ প্রক্ষালন করিলেন সেই স্থানে।

(৬) অদ্বৈতবাদী সন্ন্যাসী। অনেকে গোপাল ভট্ট গোস্বামীর পিতৃব্য ও গুরু 'প্রবোধানন্দকে' প্রকাশানন্দের সহিত অভেদ কল্পনা করিয়া থাকেন - কিন্তু ঐতিহাসিক প্রমাণে এই মতের বিরোধী।

(৭) 'অবসাদ' - দুঃখ, কষ্ট।

(৮) 'হীন সম্প্রদায়' - শ্রীশঙ্করাচার্য্য সম্প্রদায়ী সন্ন্যাসিগণ - তীর্থ, আশ্রম, বন, অরণ্য, গিরি, পর্ব্বত, পুরী, ভারতী, সাগর এবং সরস্বতী - এই দশ নামে বিখ্যাত। কথিত আছে, এই সন্ন্যাসীদিগের মধ্যেগিরি ও পুরীর দণ্ড আচার্য্য কাড়িয়া লয়েন, এবং ভারতীর দণ্ড ভাঙ্গিয়া অর্দ্ধেক রাখেন, একারণ গুরুদণ্ডিত বলিয়া ভারতী সম্প্রদায় শঙ্কর সম্প্রদায়ের নিকট হীনরূপে গণ্য। শ্রীমহাপ্রভু ভারতী সম্প্রদায়ে সন্ন্যাস গ্রহণ করিয়াছেন বলিয়া কহিলেন, আমি হীন সম্প্রদায়।

(৯) 'না যুয়ায়' - উপযুক্ত হয় না।

সম্প্রদায়ী সন্ন্যাসী তুমি রহ এই গ্রামে।
কি কারণে আমা সভার না কর দর্শনে।।
সন্ন্যাসী হইয়া কর নর্ত্তন গায়ন।
ভাবক সব সঙ্গে লঞা কর সংকীর্ত্তন।।
বেদান্ত পঠন ধ্যান সন্ন্যাসীর ধর্ম্ম।
তাহা ছাড়ি কর কেনে ভাবকের কর্ম্ম।।
প্রভাবে দেখিয়ে তোমা সাক্ষাৎ নারায়ণ।
হীনাচার কর কেনে কি ইহার কারণ।।
প্রভু কহে শুন শ্রীপাদ ইহার কারণ।
গুরু মোরে মূর্খ দেখি করিয়া শাসন।।
মূর্খ তুমি তোমার নাহি বেদান্তাধিকার।
কৃষ্ণমন্ত্র জপ সদা এই মন্ত্র সার।।
কৃষ্ণমন্ত্র হৈতে হবে সংসার মোচন।
কৃষ্ণনাম হৈতে পাবে কৃষ্ণের চরণ।।
নাম বিনা কলিকালে নাহি আর ধর্ম্ম।
সর্ব্বমন্ত্রসার নাম - এই শাস্ত্র-মর্ম্ম।।
এত বলি এক শ্লোক শিক্ষাইল মোরে।
কণ্ঠে করি এই শ্লোক করিহ বিচারে।।
তথাহি - বৃহন্নারদীয়বচনম্‌ ৩৮।১২৬
হরের্নাম হরের্নাম
হরের্নামৈব কেবলম্‌।
কলৌ নাস্ত্যেব নাস্ত্যেব
নাস্ত্যেব গতিরন্যথা।।৩

অন্বয়ঃ।- কলৌ অন্যথা গতিঃ নাস্তি এব (কলিযুগে অন্য গতি নাই নাই নাই) কেবলং হরের্নাম এব (মাত্র হরিনামই)।

অনুবাদ।- হরিনাম শ্রবণ কর, হরিনাম জপ কর, হরিনাম কীর্ত্তন কর। কলিতে জ্ঞানযোগ কর, কলিতে কর্ম্মযোগ নয়, কলিতে ভক্তিযোগ ছাড়া আর কোনো পথই নাই।।৩।।

এই আজ্ঞা পাঞা নাম লই অনুক্ষণ।
নাম লৈতে লৈতে মোর ভ্রান্ত হৈল মন।।
ধৈর্য্য করিতে নারি - হৈলাম উন্মত্ত।
হাসি কান্দি নাচি গাই - যৈছে মদমত্ত।।
তব ধৈর্য্য করি মনে করিল বিচার।
কৃষ্ণনামে জ্ঞানাচ্ছন্ন হইল আমার।।
পাগল হইলাঙ আমি ধৈর্য্য নাহি মনে।
এত চিন্তি নিবেদিলুঁ গুরুর চরণে।।
কিবা মন্ত্র দিলা গোঁসাঞি কিবা তার বল।
জপিতে জপিতে মন্ত্র করিল পাগল।।
হাসায় নাচায় মোরে করায় ক্রন্দন।
এত শুনি গুরু হাসি বলিলা বচন।
কৃষ্ণনাম মহামন্ত্রের এইত স্বভাব।
যেই জপে তার কৃষ্ণে উপজয়ে ভাব।।
কৃষ্ণ-বিষয়ক প্রেমা - পরম পুরুষার্থ।
যার আগে তৃণতুল্য চারি পুরুষার্থ।।
পঞ্চম পুরুষার্থ প্রেমানন্দামৃত-সিন্ধু।
মোক্ষাদি আনন্দ যার নহে এক বিন্দু।।
কৃষ্ণনামের ফল প্রেম সর্ব্বশাস্ত্রে কয়।
ভাগ্যে সেই প্রেমা তোমার করিল উদয়।।
প্রেমার স্বভাবে করে চিত্ত-তনু-ক্ষোভ (১)।
কৃষ্ণের চরণ প্রাপ্ত্যে উপজায় লোভ।।
প্রেমার স্বভাবে ভক্ত হাসে কান্দে গায়।
উন্মত্ত হইয়া নাচে ইতি উতি (২) ধায়।।
স্বেদ কম্প রোমাঞ্চাশ্রু গদগদ বৈবর্ণ্য।
উন্মাদ বিষাদ ধৈর্য্য গর্ব্ব হর্ষ দৈন্য (৩)।
এত ভাবে প্রেমা ভক্তগণেরে নাচায়।
কৃষ্ণের আনন্দামৃতসাগরে ভাসায়।।

(১) শরীর ও মনের চাঞ্চল্য।

(২) ইতি উতি - ইতস্ততঃ।

(৩) স্বেদ - ঘর্ম্ম। রোমাঞ্চ - লোমোদ্গম, পুলক। অশ্রু - নেত্রজল। গদগদ - অস্পষ্ট বাক্য। বৈবর্ণ্য - নিজবর্ণের অন্যথাভাব। উন্মাদ - চিত্তবিভ্রম। বিষাদ - অনুৎসাহ। ধৈর্য্য - সহিষ্ণুতা। গর্ব্ব - অন্যকে অবজ্ঞা। হর্ষ - চিত্তপ্রসন্নতা। দৈন্য - নিজেকে অতি হীন বলিয়া ভাবা।

ভাল হৈল পাইলে তুমি পরম পুরুষার্থ।
তোমার প্রেমাতে আমি হৈলাম কৃতার্থ।।
নাচ গাও ভক্তসঙ্গে কর সংকীর্ত্তন।
কৃষ্ণনাম উপদেশি তার (১) সর্ব্বজন।।
এত বলি এক শ্লোক শিখাইল মোরে।
ভাগবতের সার এই বোলে বারে বারে।।
তথাহি - শ্রীমদ্ভাগবতে ১১।২।৪৯
এবংব্রতঃ স্বপ্রিয়নামকীর্ত্ত্যা
জাতানুরাগো দ্রুতচিত্ত উচ্চৈঃ।
হসত্যথো রোদিতি রৌতি গায়-
ত্যুন্মাদবন্নৃত্যতি লোকবাহ্যঃ।।৪

অন্বয়ঃ।- এবংব্রতঃ (এইপ্রকার ব্রতধারী মনুষ্য) স্বপ্রিয়নামকীর্ত্ত্যা (নিজের প্রিয়নাম কীর্ত্তনের দ্বারা) জাতানুরাগঃ (জাতপ্রেম হইয়া) দ্রুতচিত্তঃ (বিদ্রাবিত চিত্ত হইয়া) উন্মাদবৎ লোক-বাহ্যঃ (উন্মাদের মত শ্লথহৃদয়) সন্‌ (হইয়া) অথো উচ্চৈঃ হসতি, রোদিতি, রৌতি, গায়তি, নৃত্যতি (উচ্চৈঃস্বরে হাসিতে থাকে, কখনও বা ক্রন্দন করিতে থাকে, কখনও চীৎকার করে, গাহিতে থাকে এবং নৃত্য করিতে থাকে)।

অনুবাদ।- এমনি ভাবে যে নাম ভাল লাগে সেই নামে ডেকে অনুরাগভরে, বিগলিত চিত্তে, বিবশ হয়ে তিনি উচ্চৈঃস্বরে কখনো হাসেন, কখনো কাঁদেন, কখনো চেঁচান, কখনো গান করেন, আর কখনো বা উন্মাদের মতন নৃত্য করেন।।৪।।

এই তাঁর বাক্যে আমি দৃঢ় বিশ্বাস ধরি।
নিরন্তর কৃষ্ণনাম-সংকীর্ত্তন করি।।
সেই কৃষ্ণনাম কভু গাওয়ায় নাচায়।
গাই নাচি নাহি আমি আপন ইচ্ছায়।।
কৃষ্ণনামে যে আনন্দ-সিন্ধু-আস্বাদন।
ব্রহ্মানন্দ তাঁর আগে খাতোদকসম।।
তথাহি - হরিভক্তিসুধোদয়ে ১৪।৩৬
ত্বৎসাক্ষাৎকরণাহ্লাদ -
বিশুদ্ধাব্ধিস্থিতস্য মে।
সুখানি গোষ্পদায়ন্তে
ব্রাহ্ম্যাণ্যপি জগদ্‌গুরো।।৫

অন্বয়ঃ।- [শ্রীপ্রহ্লাদ শ্রীনৃসিংহকে বলিলেন] হে জগদ্‌গুরো ত্বৎসাক্ষাৎকরণাহ্লাদবিশুদ্ধাব্ধিস্থিতস্য (হে জগদ্‌গুরো! তোমার সাক্ষাৎকারজনিত যে বিশুদ্ধ আনন্দসমুদ্র তাহাতে অবস্থিত হইয়া) মে ব্রাহ্ম্যাণ্য অপি সুখানি গোষ্পদায়ন্তে (আমার ব্রহ্মানন্দজনিত সুখসমূহকেও গোষ্পদের ন্যায় মনে হইতেছে)।

অনুবাদ।- হে ভুবনপাবন! সাগরশায়ী যেমন গোষ্পদকে তুচ্ছ করে, আমিও তেমনি তোমার দর্শনে আনন্দনির্ম্মল চিত্তে ব্রহ্মসুখকেও তুচ্ছ করি।।৫।।

প্রভুর মিষ্টবাক্য শুনি সন্ন্যাসীর গণ।
চিত্ত ফিরি গেল কহে মধুর বচন।।
যে কিছু কহিলে তুমি সর্ব্ব সত্য হয়।
কৃষ্ণপ্রেমা সেই পায় যার ভাগ্যোদয়।।
কৃষ্ণে ভক্তি কর ইহায় সভার সন্তোষ।
বেদান্ত না শুন কেনে তাতে কিবা দোষ।।
এত শুনি হাসি প্রভু বলিলা বচনা।
দুঃখ না মানহ যদি করি নিবেদন।।
ইহা শুনি বলে সর্ব্ব সন্ন্যাসীর গণ।
তোমারে দেখিয়ে যৈছে সাক্ষাৎ নারায়ণ।।
তোমার বচন শুনি জুড়ায় শ্রবণ।
তোমার মাধুরী দেখি জুড়ায় নয়ন।।
তোমার প্রভাবে সভার আনন্দিত মন।
কভু অসঙ্গত নহে তোমার বচন।।
প্রভু কহে বেদান্ত-সূত্র ঈশ্বর-বচন।
ব্যাসরূপে কহিলা যাহা শ্রীনারায়ণ।।
ভ্রম-প্রমাদ-বিপ্রলিপ্সা-করণাপাটব (২)।
ঈশ্বরের বাক্যে নাহি দোষ এই সব।।

(২) দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে ২০ পৃষ্ঠায় ২নং পাদটীকা দ্রষ্টব্য।

উপনিষৎ সহিত সূত্র কহে যেই তত্ত্ব (১)।
মুখ্যবৃত্তি সেই অর্থ পরম মহত্ত্ব (২)।।
গৌণবৃত্ত্যে যেবা ভাষ্য করিল আচার্য্য (৩)।
তাহার শ্রবণে নাশ হয় সর্ব্বকার্য্য।।
তাঁহার নাহিক দোষ ঈশ্বরাজ্ঞা (৪) পাইয়া।
গৌণ অর্থ কৈল মুখ্য অর্থ আচ্ছাদিয়া।।
ব্রহ্মশব্দে মুখ্য অর্থে কহে ভগবান্‌।
ষড়ৈশ্বর্য্যপরিপূর্ণ অনূর্দ্ধসমান (৫)।।
তাঁহার বিভূতি দেহ সব চিদাকার।
চিদ্বিভূতি (৬) আচ্ছাদি তাঁরে কহে নিরাকার।।
চিদানন্দ তেঁহো তাঁর স্থান পরিবার।
তাঁরে কহে প্রাকৃত সত্ত্বের বিকার।।
তাঁর দোষ নাহি তিহোঁ আজ্ঞাকারী দাস।
আর যেই শুনে তার হয় সর্ব্বনাশ।।
বিষ্ণুনিন্দা আর নাহি ইহার উপর।
প্রাকৃত করিয়া মানে বিষ্ণুকলেবর।।

(১) 'উপনিষদ' - বেদের শিরোভাগ যাহাতে ব্রহ্ম নিরূপিত হইয়াছেন। যথা - ঈশ, কেন, কঠ প্রভৃতি। 'সূত্র' - ব্রহ্মসূত্র।

(২) 'মুখ্যবৃত্তি' - শব্দের প্রধান অর্থ অর্থাৎ শব্দোচ্চারণ মাত্র যে অর্থের বোধ হয় তাহা। গৌণবৃত্তি শব্দের অপ্রধান অর্থ। যেমন "ঐ বালকটি সিংহশিশু"। সিংহশিশু শব্দের মুখ্যবৃত্তি 'সিংহের শাবক'। কিন্তু এ স্থলে তাহার গৌণবৃত্তি অর্থাৎ 'সিংহশাবকের ন্যায় পরাক্রান্ত' এই অর্থ হইয়াছে।

(৩) 'আচার্য্য' - শ্রীমৎ শঙ্করাচার্য্য।

(৪) শঙ্করাচার্য্য সাক্ষাৎ ভগবান্‌, মহাদেবের অবতার, তিনি কেন এতাদৃশ কার্য্য করিলেন? ব্রহ্মবৈবর্ত্তে (অথবা পদ্মপুরাণে) ভগবান্‌ মহাদেবকে কহিলেন, "আগমৈঃ কল্পিতৈস্ত্বঞ্চ জনান্‌ মদ্বিমুখান্‌ কুরু" অর্থাৎ কল্পিত আগমদ্বারা জনসমূহকে আমা হইতে বিমুখ কর।

(৫) 'অনূর্দ্ধসমান' - যাহা হইতে ঊর্দ্ধ অর্থাৎ অধিক বা যাহার সমান নাই এমন।

(৬) 'চিদ্বিভূতি' - চিন্ময়বৈভব গৃহপরিচ্ছদাদি।

ঈশ্বরের তত্ত্ব যেন জ্বলিত জ্বলন।
জীবের স্বরূপ যৈছে স্ফুলিঙ্গের কণ।।
জীবতত্ত্ব শক্তি কৃষ্ণতত্ত্ব শক্তিমান্‌ (৭)।
গীতা-বিষ্ণুপুরাণাদি ইথে পরমাণ।।

(৭) ভগবানের সহিত জীবের সম্বন্ধ ভিন্ন হইয়াও অভিন্ন। যেমন অগ্নি হইতে স্ফুলিঙ্গ বাহির হইলে তাহা পূর্ব্বের অগ্নির সহিত এক নহে অথচ তাহা হইতে ভিন্নও নহে। সেইরূপ অণুজীবও বিভুচৈতন্য ঈশ্বরের স্বরূপ নহে অথচ চৈতন্যাংশে ভিন্নও নহে।

তথাহি - গীতায়াম্‌ ৭।৫
অপরেয়মিতস্ত্বন্যাং
প্রকৃতিং বিদ্ধি মে পরাম্‌।
জীবভূতাং মহাবাহো
যয়েদং ধার্য্যতে জগৎ।।৬

অন্বয়ঃ।- [শ্রীভগবান্‌ অর্জ্জুনকে কহিতেছেন] ইয়ম্‌ অপরা (ইহা অপরা প্রকৃতি) ইতঃ পরাম্‌ অন্যাং জীবভূতাং মে প্রকৃতিং বিদ্ধি (ইহা হইতে উৎকৃষ্টা আমার অন্যা জীবভূতা প্রকৃতি আছে জানিও)। হে মহাবাহো, যয়া ইদং জগৎ ধার্য্যতে (হে মহাবাহো! ইহা দ্বারাই জগৎ বিধৃত হইয়া আছে)।

অনুবাদ।- হে মহাবাহু! এটি অপরা প্রকৃতি। আমার অন্য একটি প্রকৃতি আছে - সে পরা প্রকৃতি। সেই পরা প্রকৃতিই জীব শক্তি যা লোককে ধারণ ক'রে আছে।।৬।।

তথাহি - বিষ্ণুপুরাণে ৬।৭।১১
বিষ্ণুশক্তিঃ পরা প্রোক্তা
ক্ষেত্রজ্ঞাখ্যা তথাপরা।
অবিদ্যা কর্ম্মসংজ্ঞান্যা
তৃতীয়া শক্তিরিষ্যতে।।৭

অন্বয়ঃ।- বিষ্ণুশক্তিঃ পরা প্রোক্তা (বিষ্ণুশক্তি বা বিষ্ণুর স্বীয়া অন্তরঙ্গা শক্তিকেই পরা বলা হইয়া থাকে) তথা ক্ষেত্রজ্ঞাখ্যা অপরা (আমার ক্ষেত্রজ্ঞা নামে শক্তি অপরা শক্তি) অন্যা অবিদ্যা কর্ম্মসংজ্ঞা, তৃতীয়া ইষ্যতে (অন্য অবিদ্যা কর্ম্মসংজ্ঞা শক্তিকে তৃতীয়া শক্তি বলা হয়)।

অনুবাদ।- বিষ্ণুর তিনটি শক্তি - পরা, অপরা ও অবিদ্যা। অপরাই ক্ষেত্রজ্ঞা শক্তি এবং অবিদ্যাকে কর্ম্মসংজ্ঞা এক তৃতীয়া শক্তি বলা হয়।।৭।।

হেন জীবতত্ত্ব লৈয়া লিখি পরতত্ত্ব।
আচ্ছন্ন করিল শ্রেষ্ঠ ঈশ্বর-মহত্ত্ব (১)।।
ব্যাসের সূত্রেতে কহে পরিণাম-বাদ (২)।
ব্যাস ভ্রান্ত বলি তাঁহা উঠাইল বিবাদ।।
পরিণাম-বাদে ঈশ্বর হয়েন বিকারী (৩)।
এত কহি বিবর্ত্তবাদ স্থাপন যে করি।।
বস্তুত পরিণামবাদ সেইত প্রমাণ।
দেহে আত্মবুদ্ধি এই বিবর্ত্তের স্থান (৪)।।
অবিচিন্ত্য শক্তিযুক্ত শ্রীভগবান্‌।
ইচ্ছায় জগদ্রুপে পায় পরিণাম।।
তথাপি অচিন্ত্য শক্ত্যে হয় অবিকারী।
প্রাকৃত-চিন্তামণি তাহে দৃষ্টান্ত যে ধরি।।
নানা রত্নরাশি হয় চিন্তামণি হৈতে।
তথাপিহ মণি রহে স্বরূপ অবিকৃতে।।
প্রাকৃত বস্তুতে যদি অচিন্ত্যশক্তি হয়।
ঈশ্বরের অচিন্ত্যশক্তি ইথে কি বিস্ময়।।

(১) যে জীব ব্রহ্মের অংশমাত্র তাহাকে গৌণার্থের দ্বারা ব্রহ্মের সহিত অভিন্ন বলিয়া শ্রীমৎ শঙ্করাচার্য্য ব্রহ্মের বিভুত্বাদি গুণের হানি করিয়াছেন।

(২) 'পরিণাম-বাদ' - বস্তুর অবস্থান্তরপ্রাপ্তির নাম পরিণাম। যেমন দুগ্ধের পরিণাম দধি, মৃত্তিকার পরিণাম ঘট। 'জন্মাদ্যশ্য যতঃ' প্রভৃতি সূত্রে পরিণামবাদ কথিত হইয়াছে। অর্থাৎ সদ্রূপ ঈশ্বর জগদ্রূপে পরিণত হইয়াছেন, ইহাই প্রতিপাদন করিতেছে।

(৩) মহাপ্রভু বলিতেছেন যে পরিণামবাদই ব্রহ্মসূত্রের মুখ্যার্থ, বিবর্ত্তবাদ নহে। নশ্বরদেহে যে সত্য বুদ্ধি তাহাই বিবর্ত্তবাদের স্থান (উদাহরণ)।

প্রণব সে মহাবাক্য বেদের নিদান।
ঈশ্বর-স্বরূপ প্রণব সর্ব্ব বিশ্বধাম।।
সর্ব্বাশ্রয় ঈশ্বরের প্রণব উদ্দেশ।
"তত্ত্বমসি" - বাক্য হয় বেদের একদেশ।।
প্রণব মহাবাক্য তাহা করি আচ্ছাদন।
মহাবাক্যে করি তত্ত্বমসির স্থাপন (৫)।।
সর্ব্ব বেদসূত্রে করে কৃষ্ণের অভিধান (৬)।
মুখ্য বৃত্তি ছাড়ি কৈল লক্ষণা ব্যাখ্যান।।
স্বতঃপ্রমাণ বেদ - প্রমাণ-শিরোমণি।
লক্ষণা (৭) করিলে স্বতঃপ্রমাণতা-হানি।।
এইমত প্রতি সূত্রে সহজার্থ ছাড়িয়া।
গৌণার্থ ব্যাখ্যা করে কল্পনা করিয়া।।
এই মত প্রতি সূত্রে করেন দূষণ।
শুনি চমৎকার হৈল সন্ন্যাসীর গণ।।

(৫) অর্থবোধক বর্ণ বা বর্ণসমূহের নাম পদ। যোগ্যতা আকাঙ্ক্ষা ও আসত্তিযুক্ত পদসমূহের নাম বাক্য। বর্ণনীয় বিষয়সমূহ যে বাক্যের অন্তর্গত তাহা মহাবাক্য অর্থাৎ মহাবাক্য সর্ব্বব্যাপক। শ্রীশঙ্করাচার্য্য চারি বেদের চারিটি শাখা হইতে চারিটি মহাবাক্য উদ্ধার করিয়াছেন; (১ম) ঋগ্বেদীয় ঐতরেয় আরণ্যক নামক শাখার মহাবাক্য "প্রজ্ঞানং ব্রহ্ম", (২য়) যজুর্ব্বেদ শাখায় বৃহদারণ্যক উপনিষদের মহাবাক্য "অহং ব্রহ্মাস্মি", (৩য়) সামবেদীয় ছান্দোগ্য শ্রুতিগত মহাবাক্য "তত্ত্বমসি", (৪র্থ) অথর্ব্ববেদের মহাবাক্য "অয়মাত্মা ব্রহ্ম"। এই চারিবেদীয় চারিটি মহাবাক্য মধ্যে 'তত্ত্বমসি' সর্ব্বপ্রধান। কিন্তু উপর্য্যুক্ত চারিটি বেদবাক্য বেদের একদেশ বলিয়া মহাবাক্য হইতে পারে না। বচনজাত দ্বারা সমস্ত বেদের নিদান ও ঈশ্বরস্বরূপ ও বিশ্বাশ্রয় প্রণবই যথার্থ মহাবাক্য।

(৬) 'অভিধান' - মুখ্যবৃত্তিদ্বারা কীর্ত্তন।

(৭) 'লক্ষণা' - মুখ্যার্থ দ্বারা অর্থসঙ্গতি না হইলে তদ্‌যুক্ত অন্যার্থ যাহা দ্বারা প্রতীত হয় তাহার নাম লক্ষণা, যেমন "গঙ্গায়াং ঘোষঃ" - গঙ্গায় ঘোষ বাস করে। এখানে গঙ্গা শব্দে লক্ষণা দ্বারা গঙ্গাতীর বুঝাইল।

সকল সন্ন্যাসী করে শুনহ শ্রীপাদ।
তুমি যে খণ্ডিলে অর্থ এ নহে বিবাদ।।
আচার্য্য কল্তি অর্থ ইহা সভে জানি।
সম্প্রদায় অনুরোধে তবু তাহা মানি (১)।।
মুখ্যার্থ ব্যাখ্যা কর দেখি তোমার বল।
মুখ্যার্থ লাগাইল প্রভু সূত্র সকল।।
বৃহদ্বস্তু ব্রহ্ম কহি শ্রীভগবান্‌ (২)।
ষড়্‌বিধ ঐশ্বর্য্যপূর্ণ পরতত্ত্ব ধাম।।
স্বরূপ ঐশ্বর্য্য তাঁর নাহি মায়া-গন্ধ (৩)।
সকল বেদের হয় ভগবান্‌ সম্বন্ধ।।
তারে নির্ব্বিশেষ কহি চিচ্ছক্তি না মানি।
অর্দ্ধস্বরূপ না মানিলে পূর্ণতা হয় হানি (৪)।।

(১) যেমন স্বপ্রকাশ সূর্য্যকে প্রকাশ করিতে দীপাদির আবশ্যক হয় না, সেইরূপ বেদকে আর কিছুদ্বারা প্রমাণ করিতে হয় না। কিন্তু প্রদীপ জ্বালিয়া সূর্য্য দেখিতে গেলে সূর্য্যের স্বপ্রকাশতা নাই ইহাই যেরূপ বুঝায়, সেইরূপ বেদের মুখ্যার্থ আচ্ছাদন করিলে বেদের সহজ আজ্ঞার আর এক প্রকারে ব্যাখ্যা হয় বলিয়া স্বতঃপ্রমাণত্ব থাকে না।

(২) 'জন্মাদ্যশ্য' সূত্র ব্যাখ্যা করিতেছেন, 'বৃহদ্বস্তু ..... প্রয়োজন নাম।' 'বৃহদ্বস্তু ব্রহ্ম' - অর্থাৎ যিনি স্বতঃ বৃহৎ ও অন্যকে বৃহৎ করেন, ব্রহ্ম শব্দের এই মুখ্যার্থে বৃহত্তা হেতু ষড়ৈশ্বর্য্যপূর্ণতা ও অন্যকে বৃহৎ করান নিমিত্ত পূর্ণশক্তিমত্তাবিশিষ্ট ভগবান্‌কে প্রতিপাদন করিতেছে, কিন্তু নির্ব্বিশেষ বস্তুকে প্রতিপাদন করিতেছে না।

(৩) যদি কেহ বলে "ঐশ্বর্য্য মাত্র মায়িক ও শক্তিজড়, এবং বৃহত্তা নিমিত্ত যদি আকার থাকে, তবে তাহার উৎপত্তি ও নাশ আছে" তাহাদিগকে নিরস্ত করিতেছেন, 'ঐশ্বর্য্য স্বরূপ ..... পূর্ণতা হয় হানি।' 'স্বরূপ ঐশ্বর্য্য' - স্বরূপভূত ঐশ্বর্য্য অর্থাৎ ভগবানের ঐশ্বর্য্য তত্তুল্য চিদানন্দময়, তাহাতে মায়া সম্বন্ধ নাই, তাঁহার শক্তিও চিদ্রূপা।

(৪) ভগবান্‌ শঙ্করাচার্য্য ব্রহ্মের আকার, ঐশ্বর্য্য ও শক্তি স্বীকার করেন না। কেবল ব্রহ্মের সত্তা মাত্র স্বীকার করেন; এই মতে দোষারোপণ করিতেছেন - 'অর্দ্ধস্বরূপ না মানিলে ইত্যাদি' - অর্থাৎ চিদৈশ্বর্য্য, চিৎশক্তি ও চিদাকার না মানিয়া কেবল সত্তা মাত্র মানিলে, অর্দ্ধস্বরূপ না মানায় তাঁহার পূর্ণতার হানি হয়।

ভগবান্‌ প্রাপ্তি হেতু যে করি উপায়।
শ্রবণাদি-ভক্তি কৃপাপ্রাপ্তির সহায়।।
সেই সর্ব্ববেদের হয় অভিধেয় নাম।
সাধন-ভক্তি হৈতে হয় প্রেমের উদ্গম।।
কৃষ্ণের চরণে যদি হয় অনুরাগ।
কৃষ্ণ বিনু অন্যত্র তার নাহি রহে রাগ।।
পঞ্চম পুরুষার্থ সেই প্রেম-মহাধন।
কৃষ্ণের মাধুর্য্য-রস করায় আস্বাদন।।
প্রেমা হৈতে কৃষ্ণ হয় নিজভক্ত বশ।
প্রেমা হৈতে পাই কৃষ্ণের সেবা সুখরস।।
সম্বন্ধ অভিধেয় প্রয়োজন নাম।
এই তিন অর্থ সর্ব্বসূত্রে পর্য্যবসান (৫)
এই মত সর্ব্বসূত্রের ব্যাখ্যান শুনিয়া।
সকল সন্ন্যাসী কহে বিনয় করিয়া।।
বেদময় মূর্ত্তি তুমি সাক্ষাৎ নারায়ণ।
ক্ষম অপরাধ পূর্ব্বে যে কৈলু নিন্দন।।
সেই হৈতে সন্ন্যাসীর ফিরি গেল মন।
'কৃষ্ণ' 'কৃষ্ণ' নাম সদা করয়ে গ্রহণ।।
এই মত তা সভার ক্ষমি অপরাধ।
সভাকারে কৃষ্ণনাম করিল প্রসাদ।।
তবে সব সন্ন্যাসী মহাপ্রভুকে লৈয়া।
ভিক্ষা করিলেন (৬) সভে মধ্যে বসাইয়া।
ভিক্ষা করি মহাপ্রভু আইলা বাসাঘর।
হেন চিত্রলীলা করে গৌরাঙ্গসুন্দর।।
চন্দ্রশেখর তপন-মিশ্র সনাতন।
শুনি দেখি আনন্দিত সভাকার মন।।

(৫) অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণ সম্বন্ধ, শ্রীকৃষ্ণভক্তি অভিধেয় ও প্রেময় প্রয়োজন, এই তিনটি বিষয় সমস্ত বেদান্তসূত্রে প্রতিপাদন করিয়াছেন।

(৬) ভিক্ষা - ভোজন।

প্রভুকে দেখিতে আইসে সকল সন্ন্যাসী।
প্রভুর প্রশংসা করে সর্ব্ব বারাণসী।।
বারাণসীপুরী আইলা শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য।
পুরীসহ সর্ব্বলোক হৈল মহাধন্য।।
লক্ষ লক্ষ লোক আইসে প্রভুকে দেখিতে।
মহা ভিড় হৈল দ্বারে নারে প্রবেশিতে।।
প্রভু যবে যান বিশ্বেশ্বর দরশনে।
লক্ষ লক্ষ লোক আসি মিলে সেই স্থানে।।
স্নান করিতে যবে যান গঙ্গাতীরে।
তাহাঞি সকল লোক হয় মহা ভিড়ে।।
বাহু তুলি প্রভু বোলে বল হরি হরি।
হরিধ্বনি করে লোক স্বর্গমর্ত্ত ভরি।।
লোক নিস্তারিয়া প্রভুর চলিতে হৈল মন।
বৃন্দাবনে পাঠাইলেন শ্রীসনাতন।।
রাত্রি দিবসে লোকের শুনি কোলাহল।
বারাণসী ছাড়ি প্রভু আইলা নীলাচল।।
এ লীলা কহিব আগে বিস্তার করিয়া।
সংক্ষেপে কহিল ইহা প্রসঙ্গ পাইয়া।।
এই পঞ্চতত্ত্বরূপে শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য।
কৃষ্ণনাম-প্রেম দিয়া বিশ্ব কৈল ধন্য।।
মথুরাতে পাঠাইল রূপ সনাতন।
দুই সেনাপতি কৈল ভক্তি প্রচারণ।।
নিত্যানন্দ গোসাঞে পাঠাইল গৌড়দেশে।
তেহোঁ ভক্তি প্রচারিল অশেষ বিশেষে।।
আপনে দক্ষিণ দেশে করিলা গমন।
গ্রামে গ্রামে কৈল কৃষ্ণ নাম প্রচারণ।।
সেতুবন্ধ পর্য্যন্ত কৈল ভক্তির প্রচার।
কৃষ্ণপ্রেম দিয়া কৈল সভায় নিস্তার।।
এইত কহিল পঞ্চতত্ত্বের ব্যাখ্যান।
ইহার শ্রবণে হয় চৈতন্যতত্ত্ব জ্ঞান।।
শ্রীচৈতন্য নিত্যানন্দ অদ্বৈত তিন জন।
শ্রীবাস গদাধর আদি যত ভক্তগণ।।
সভাকার পাদপদ্মে কোটী নমস্কার।
যৈছে তৈছে (১) কহি কিছু চৈতন্য-বিহার।।
শ্রীরূপ রঘুনাথ-পদে যার আশ।
চৈতন্য-চরিতামৃত কহে কৃষ্ণদাস।।

ইতি শ্রীচৈতন্যচরিতামৃতে আদিলীলায়াং পঞ্চতত্ত্বাখ্যাননিরূপণং নাম সপ্তমৎ পরিচ্ছেদঃ।

(১) যৈছে তৈছে - যথারূপে।