ষ্ট্যালিন/পাঁচ

উইকিসংকলন থেকে

পাঁচ

 বিপ্লবের পর ষ্ট্যালিন রাশিয়ার বিভিন্ন জাতিগুলির সমস্যা সমাধানের জন্য ‘পিপলস্ কমিশার ফর ন্যাশানালিটিস্’ নিযুক্ত হইয়াছিলেন। ১৯২৩ সাল পর্যন্ত এই পদে তিনি অধিষ্ঠিত ছিলেন। পোলাণ্ড হইতে আলাস্কা পর্যন্ত তিন সহস্র মাইল ব্যাপী বিশাল রুশ সাম্রাজ্যে সকলেই রাশিয়ান নহে। রাশিয়ান ব্যতীত ইউক্রেনিয়ান, বাস‍্কীর, হোয়াইট রাশিয়ান, জর্জিয়ান, আজারবাইজান, দাগেস্তানি, তাতার, খিরগিজ, উজ‍্বেক, তাজিক, তুর্কমাণ প্রভৃতি বহুজাতি এখানে বাস করে। ইহাদের জাতীয়তাবোধ, ভাষা ও সংস্কৃতিগত স্বাতন্ত্র্য তিন শতাব্দীর জারশাসনেও বিনষ্ট হয় নাই। জারীয় সাম্রাজ্যনীতির লক্ষ্য ছিল সর্ব্ববিধ জাতীয় সংস্কৃতি বিনষ্ট করিয়া সকলকে রাশিয়ান করা। ইহার ফলে উল্লিখিত জাতিগুলির চিত্তে দীর্ঘস্থায়ী অসন্তোষ ছিল— অত্যাচারী ‘রাশিয়ান’দের প্রতি বিদ্বেষ ছিল প্রবল। এই অবস্থার মধ্যে সোভিয়েট ইহাদের জাতীয় বিশিষ্টতা রক্ষার আশ্বাস ও প্রতিশ্রুতি দিয়া সকলকে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে আনিবার জন্য চেষ্টিত হইলেন। ক্ষমতাপ্রাপ্ত সচিবরূপে ষ্ট্যালিন একটা খসড়া প্রস্তুত করিলেন এবং সোভিয়েট গভর্ণমেণ্ট তাহা বিধিবদ্ধ করিলেন। সোভিয়েট গভর্ণমেণ্ট ঘোষণা করিলেন,—

 ‘রাশিয়ার সমস্ত অধিবাসী সমান এবং সকলেরই সার্ব্বভৌম অধিকার রহিয়াছে। এই জাতিগুলি তাহাদের ইচ্ছামত ব্যবস্থা করিতে পারে, এমনকি স্বতন্ত্র হইয়া স্বাধীন রাষ্ট্র স্থাপনও করিতে পারে। কোন জাতির (রাশিয়ান) বা ধর্ম্মের (গ্রীক অর্থোডক্স চার্চ্চ) বিশেষ সুবিধামূলক বিধিনিষেধ বিলুপ্ত করা হইল। ভূতপূর্ব্ব রুশ সাম্রাজ্যের এলাকার অধিবাসী সংখ্যালঘিষ্ঠ জাতিগুলি অথবা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গোষ্ঠিগুলি স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করিয়া অবাধে আত্মোন্নতি সাধন করিতে পারিবে।’

 ইহার অর্থ হইল এই জাতিগুলি শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থার দিক দিয়া এক যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে থাকিলেও জাতীয় বৈশিষ্ট্য বিকাশের পূর্ণ সুযোগ পাইবে এবং সেই ভিত্তিতে পরস্পরের উপর নির্ভরশীল স্বাধীনতা ভোগ করিবে। জারীয় শাসনে মুসলমান শ্রমিকদের দুর্গতি চরমে উঠিয়াছিল। ইহাদিগকে যদিও ‘রাশিয়ান’ বলা হইত কিন্তু কার্য্যতঃ পরাধীন জাতির মত নির্যাতন ইহারাই সহ্য করিয়াছে বেশী এবং শিক্ষায় দীক্ষায় সর্ব্বাপেক্ষা পশ্চাৎপদ ছিল। সোভিয়েট গভর্ণমেণ্ট ঘোষণা করিলেন এই জনসমষ্টিকে শিক্ষা দীক্ষায় উন্নত করিয়া অন্যান্য সকলের সমশ্রেণীতে আনিতে হইবে।

 সংখ্যালঘিষ্ঠ সম্প্রদায় এবং জাতিগুলির সম্পর্কে এই নূতন নীতি ঘোষণার ফলে জনসাধায়ণ স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া সোভিয়েটে যোগদান করিতে লাগিল। ভাষা-শিক্ষা-সংস্কৃতি এবং বিশিষ্ট সামাজিক নিয়ম কানুন বিলুপ্তির আশঙ্কা দূরীভূত হওয়ায় সাম্যবাদের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়াশীলদের প্রচার কার্য্য ব্যর্থ হইল। ১৯২২ সালে “ইউনিয়ন অফ স্যোশালিষ্ট সোভিয়েট রিপাব‍্লিকস্” গঠত হইল। এই ঐতিহাসিক ঘটনার সহিত ষ্ট্যালিনের নাম. অচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। এই নূতন রাষ্ট্রের গঠনতন্ত্রের খসড়া সংখ্যালঘিষ্ঠ বলশেভিকদল জারের আমলেই প্রস্তুত করিয়াছিলেন। এই নূতন গঠনতন্ত্রের মূল প্রস্তাব হইল, ‘সামরিক ও অর্থ নৈতিক ঐক্য ও ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি, সঙ্গে সঙ্গে যতদূর স্বাধীনতা ও জাতীয় সংস্কৃতি বিস্তারের সম্পূর্ণ সুযোগ, জাতীয় অনৈক্যের অতীত ব্যবস্থার ক্রমধ্বংস সাধন এবং প্রগতিশীল জাতিগুলি কর্ত্তৃক অপেক্ষাকৃত দুর্ব্বল জাতিগুলিকে সর্ব্বপ্রকারে সাহায্যদান।’

 মার্কসীয় সমাজতন্ত্রবাদের আদর্শে রাষ্ট্রগঠন করিতে গিয়া লেনিন দেখিলেন, নূতন অর্থ নৈতিক ব্যবস্থা পত্তন করা ব্যতীত এই ছত্রভঙ্গ রাষ্ট্রের পুনর্গঠন অসম্ভব। রাষ্ট্রবিপ্লবে, দুর্ভিক্ষে প্রাচীন ব্যবস্থা ভাঙ্গিয়া পড়িয়াছে। কৃষি-শিল্প-বাণিজ্যকে সম্পূর্ণ নূতন ভিত্তির উপর স্থাপন করিতে হইবে। দল প্রথমতঃ যে ভাবে কার্য্য করিতে আরম্ভ করিয়াছিল লেনিন তাহা পরিবর্ত্তন করিলেন। দেশব্যাপী অসন্তোষ এবং বিশৃঙ্খলার মধ্য দিয়া কাজ করা সহজ ছিল না।

 ১৯১৪-র সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধে রাশিয়াকে ৫৬ হাজার কোটী টাকা বায় করিতে হইয়াছিল এবং কার্যক্ষম পুরুষদের মধ্যে প্রায় এক তৃতীয়াংশ যুদ্ধে হতাহত হয়। কলকারখানার উৎপাদন এবং যানবাহনের ব্যবস্থা ১৯১৩ খৃষ্টাব্দের তুলনায় পাঁচ কি ছয় ভাগের অধিক ছিল না এবং প্রতি-বিপ্লবী যুদ্ধেও প্রায় ৭০ হাজার কোটী টাকা নষ্ট হয়। উল্লেখযোগ্য বড় বড় কারখানা ধ্বংস হইয়াছিল এবং অকর্ষিত কৃষিক্ষেত্র আগাছায় ভরিয়া গিয়াছিল। শাসনব্যবস্থা, শিক্ষাব্যবস্থা এবং রাষ্ট্রের সমস্ত বিভাগই বিপর্য্যস্ত হইয়া পড়িয়াছিল। বিজয়ী লালপল্টনের হাতে রাইফেল ছিল না, পায়ে জুতা ছিল না, অর্দ্ধাহার, অনশন সম্বল ছিল। নূতন রাষ্ট্র চারিদিক হইতে আক্রান্ত এবং ইউরোপব্যাপী বয়কটের সম্মুখীন। গৃহযুদ্ধের সময় রুশ সাম্রাজ্যকে বিচ্ছিন্ন ও বিভক্ত করিতে এবং ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিগুলিকে স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত করিতে প্ররোচনা দিতে ইউরোপীয় কূটনীতিকেরা চেষ্টার ত্রুটি করেন নাই।

 গণবিপ্লবের শত্রু এবং ধনতান্ত্রিক সাম্রাজ্যবাদকে রক্ষা করিবার অগ্রদূত মিঃ লয়েড জর্জ্জ, মঃ পঁয়কারে ও মঃ ক্লেমাশোর নেতৃত্বে, প্ররোচনায় এবং সাহায্যে ‘১৪টি জাতি’ সোভিয়েট গভর্ণমেণ্ট ধ্বংস করিবার জন্য চারিদিক হইতে রাশিয়া আক্রমণ করিয়াছিল। জারতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী ভাগ্যান্বেষী কোলচাককে ফরাসী গভর্ণমেণ্ট ১৭০০ মেসিন গান, ৩০টি ট্যাঙ্ক এবং বহু বড় কামান দিয়াছিলেন। ইহা ছাড়া কোলচাকের সৈন্যদলে হাজার হাজার ইংরাজ ও আমেরিকান সৈন্য, ৭০ হাজার জাপানী ও ৬০ হাজার চেকেশ্লোভাকিয়ান সৈন্য ছিল। ডেনিকিনের ৬০ হাজার সৈন্যের উর্দ্দী হইতে রাইফেল ও গুলী পর্য্যন্ত সমস্তই ইংলণ্ড জোগান দিয়াছিল। ২ লক্ষ রাইফেল, ২ হাজার কামান এবং ৩০টি ট্যাঙ্ক ডেনিকিন পাইয়াছিলেন। তাহা ছাড়া কয়েকশত বৃটিশ সামরিক কর্ম্মচারী উপদেষ্টারূপে ডেনিকিনের সৈন্যদলে যোগ দিয়াছিল। বিজয়ী মিত্রশক্তি ভ্লাডিভষ্টক বন্দরে ২ ডিভিসন জাপ-সৈন্য, ২টি বৃটিশ ব্যাটেলিয়ন, ৬ হাজার আমেরিকান ও ৩ হাজার ফরাসী ও ইতালীয় সৈন্য রাখিয়াছিল এবং ইহারা সাইবেরিয়ায় রুশ-হত্যায় মাতিয়াছিল। রাশিয়া ‘পুনরুদ্ধারের’ জন্য ইংলণ্ড ১৪ কোটি পাউণ্ড এবং ৫০ হাজার সৈনিকের প্রাণ উৎসর্গ করিয়াছিল। ১৯১৮-২১-এ ফ্রান্স ও ইংলণ্ড মিলিতভাবে সোভিয়েটের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সমগ্র শক্তি প্রয়োগ করিয়াছিল। এই চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পরও দীর্ঘকাল ফিনল্যাণ্ড, লিথুয়ানিয়া, পোলাণ্ড হইতে সমগ্র বলকানে সাম্রাজ্যবাদীদের গুপ্তচরেরা রাশিয়ার পুনর্গঠনে বাধা দিয়াছে, শ্রমিকদের মধ্যে ধ্বংসমূলক কার্য্যের ষড়যন্ত্র পাকাইয়াছে। ঐ সময় একজন অখ্যাত তরুণ ফরাসী সাংবাদিক বলিয়াছিলেন, ‘এমন দিন আসিবে, যখন লাল রাশিয়ার মহান প্রচেষ্টাকে বুঝিবার ও সমর্থন করিবার মানদণ্ডেই আমাদের কাজের লোকদের বিচার হইবে।’ আজ সত্যই সেদিন আসিয়াছে, সমগ্র জগত লেনিন-ষ্ট্যালিনের সৃষ্টির প্রতি প্রশংসমান দৃষ্টিতে চাহিয়া আছে; কিন্তু সেদিন ষ্ট্যালিনের ভাষায়, ‘অল্পদিনের জন্য নহে, ১৯১৮ হইতে দুই বৎসর স্মরণ কর বন্ধুগণ, পেট্রোগ্রাডের শ্রমিকেরা সপ্তাহের পর সপ্তাহ এক টুকরা রুটিও পায় নাই। যেদিন তাহারা আধ সের খৈল মিশ্রিত কালো রুটি পাইত, সেদিন তাহারা নিজেদের ভাগ্যবান মনে করিত।’

 যখন সোভিয়েট রাশিয়া নূতনভাবে কলকারখানার পত্তন করিতে লাগিল তখনও সাম্রাজ্যবাদীদের গোয়েন্দারা নানা উপায়ে উহা ধ্বংস করিবার চেষ্টা করিয়াছে। মধ্যশ্রেণী ও প্রতিবিপ্লবীদের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করিবার জন্য যখন নূতন অর্থ নৈতিক ব্যবস্থা প্রবর্ত্তিত হইল তখন পৃথিবীময় রব উঠিল সোভিয়েট রাশিয়া মার্কসীয় পন্থা পরিত্যাগ করিয়াছে এবং বুর্জোয়া শ্রেণীর অর্থনৈতিক সুবিধাবাদ গ্রহণ করিতেছে। এই সময় ট্রট্‌স্কি (যিনি এমন কথা কদাচিৎ স্বীকার করিয়াছেন) বলিয়াছিলেন, ‘সংস্কারক ও বিপ্লবীদের মধ্যে পার্থক্য এই যে বিপ্লবীরা জনসাধারণ কর্তৃক ক্ষমতা হস্তগত করিবার পর নীতির দিক দিয়া সংস্কারকে স্বীকার করে। নবীন সোভিয়েট-শক্তির মূলমন্ত্র এই যে প্রয়োজন হইলে আমি কিছু কিছু সুবিধা দিব কিন্তু যখন আমি ঠিক ঠিক প্রভু হইয়াছি তাহার পূর্ব্বে নহে।’ সোভিয়েট ব্যবস্থা করিয়াছিল যে কৃষকদের ক্ষেত্রের উৎপন্ন গম, যাহা ভরণপোষণের অতিরিক্ত, গভর্ণমেণ্টকে দিতে হইত এবং যাহার জন্য কৃষকেরা অত্যন্ত অসন্তুষ্ট ছিল সেই ব্যবস্থার পরিবর্তন হইল। নিয়ম হইল কৃষকেরা ব্যবহারের অতিরিক্ত শস্য স্বাধীনভাবে বিক্রয় করিতে পারিবে। আবার মুদ্রার প্রচলন হইল। রাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত কলকারখানাগুলি বিনিময় বাণিজ্যের আদানপ্রদানের নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত হইল। কাজ ও যোগ্যতা দেখিয়া বেতন দিবার পদ্ধতি প্রবর্ত্তিত হইল। যদিও আপাতঃ দৃষ্টিতে ইহা গোঁড়া সমাজতন্ত্রবাদ নহে তথাপি এক স্তর হইতে উন্নততর স্তরে সমাজকে তুলিবার পক্ষে ইহার প্রয়োজন ছিল। ষ্ট্যালিন বলিয়াছিলেন, ‘কম্যুনিষ্টদল কি বলপূর্ব্বক জনসাধারণের উপর নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করিতে চাহে? না। তাহা সম্ভবপর নহে। উহা করিতে গেলে নেতৃত্ব কখনই টিকিবে না।’ ষ্ট্যালিন লেনিনের নৃতন ব্যবস্থা সমর্থন করিলেন। জিনোভিফ সন্দিগ্ধ হইয়া বলিলেন, ইহা পিছনে হটিয়া যাওয়া ছাড়া আর কিছুই নহে। ষ্ট্যালিন উত্তর দিলেন, ‘কার্য্যারম্ভে নূতন অর্থনৈতিক নীতি পশ্চাদপসরণের মত দেখাইতেছে বটে। এই পরিকল্পনার পশ্চাতে যাহা রহিয়াছে তাহার বলে আমরা সহজেই কেন্দ্রীভূত শক্তি প্রয়োগ করিয়া লাভের লোভকে দমন করিতে পারিব।’

 নূতন নীতি প্রবর্ত্তিত হইবার পর যদিও রাশিয়ার মধ্যশ্রেণী ও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দোকানদারেরা অন্যায় সুবিধা গ্রহণ করিয়াছিল, তাহা হইলেও কৃষকদের অবস্থা ধীরে ধীরে উন্নত হইল। শস্য উৎপাদনের হার বাড়িতে লাগিল, পতিত জমিতে আবাদ চলিতে লাগিল, ব্যক্তিগত ধন, যাহা মধ্যশ্রেণী এবং কৃষক জোতদারেরা (কুলাক্) লুকাইয়া রাখিয়াছিল, তাহা পুনরায় বাহিরে আসিয়া আভ্যন্তরীণ ব্যবসায়-বাণিজ্যে নিয়োজিত হইল। কিছুদিন পরেই দেখা গেল জাতীয় মূলধনের প্রায় অর্ধাংশ ব্যক্তিগত মূলধন। কিন্তু বৈদেশিক বাণিজ্য, আদানপ্রদান রাষ্ট্রের একচেটিয়া থাকায় এই ব্যক্তিগত মূলধন অধিকতর বিস্তৃতি লাভ করিতে পারিল না। তথাপি সমস্যা হইল এই যে শ্রেণীদের অতীত অভিজ্ঞতা ছিল এবং তাহাদের বংশ পরম্পরাগত ব্যবসায় বুদ্ধির নিপুণতাও ছিল; পক্ষান্তরে আদর্শ-নিষ্ঠ সাম্যবাদীদের কোন অতীত অভিজ্ঞতা ছিল না। তাহারা বাধ্য হইয়া ঐ শ্রেণীকে আপাততঃ কিছু কিছু সুবিধা দিয়া কলকারখানা গঠনে মনোযোগী হইল। ধনতন্ত্রী রাষ্ট্রের পুঁজিবাদীরা অবিশ্বাসের হাসি হাসিয়া বলিতে লাগিলেন সমাজতন্ত্রবাদী পাগলামির ফল দেখ। ইহারা অতি শীঘ্রই পুরাতন ধনতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ফিরিয়া আসিবে। কয়েক বৎসরের মধ্যেই দেখা গেল বলশেভিকরা তাহাদের উদ্দেশ্য সিদ্ধ করিতে লাগিয়াছে। রাষ্ট্র-পরিচালিত কলকারখানা ও ব্যবসায়ের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তিগত মূলধন হ্রাস পাইতে লাগিল। ধনতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের মধ্যে আপোয, ব্যক্তিগত এবং সমবায় পদ্ধতিতে কলকারখানা পরিচালনের মধ্যে আপোষ একটা সাময়িক কৌশল মাত্র। ধনতন্ত্রীদের মুখের ক্ষণিক ঔজ্জ্বল্য নিভিয়া গেল। বলশেভিকদের সাফল্যে তাহাদের ললাটে পুনরায় দুশ্চিন্তার রেখা দেখা দিল।

 ১৯২২ সালে বলশেভিক পার্টি কংগ্রেসের একাদশ অধিবেশনে লেনিন নূতন অর্থ নৈতিক নীতির ব্যাখ্যা করিয়া বলিলেন, ‘আমাদের পিছু হঠিবার কার্য্য এখন নূতন ব্যবস্থা প্রবর্ত্তনের জন্য কম্যুনিষ্ট পার্টিকে পুনর্গঠন করা আবশ্যক এবং যোগ্য লোকের উপর এই কাজের ভার দেওয়া হউক।’ কংগ্রেসের এই অধিবেশনের পর ষ্ট্যালিন রাশিয়ার কম্যুনিষ্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক নিযুক্ত হইলেন। ষ্টালিন ঘোষণা করিলেন, ‘আমাদের দেশকে কৃষি-প্রধান হইতে বাণিজ্য-প্রধান দেশে পরিণত করিতে হইবে। প্রয়োজনীয় সমস্ত দ্রব্যই এদেশে প্রস্তুত করিতে হইবে। এই নীতির দিক হইতে আমাদের কর্মপদ্ধতি পরিচালিত হইবে।’ ১৯২১-২২ সালে লেনিনের নেতৃত্বে চালিত গভর্ণমেণ্ট কলকারখানা স্থাপন এবং দেশব্যাপী বিদ্যুৎশক্তি সরবরাহের বিরাট পরিকল্পনা লইয়া কার্য্য করিতে লাগিল। লেনিন বলিলেন, বৈদ্যুতিক শক্তি হইল গোড়ার কথা, কারণ ইহার উপরই সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের স্থায়িত্ব নির্ভর করিতেছে। রাশিয়ার সমস্ত সংবাদপত্রে লেনিনের বৈদ্যুতিক শক্তি সরবরাহের পরিকল্পনা প্রচারিত হইতে লাগিল। সমগ্র দেশকে আলোকিত ও কর্ম্মপ্রবাহে চঞ্চল করিয়া তুলিবার জন্য লেনিন ঘোষণা করিলেন, ‘আমরা ইউরোপিয়ান রাশিয়া এবং এশিয়াটিক রাশিয়া উভয় ভূখণ্ডকে বিদ্যুৎ প্রবাহে প্লাবিত করিয়া দিব।’

 এই সময় লেনিনষ্ট্যালিন উভয়ের স্বাস্থ্যই ভাঙ্গিয়া পড়িল। অতিরিক্ত পরিশ্রম ও বিপ্লবের সাফল্য সম্পর্কে উৎকণ্ঠা তাঁহাদের দেহ ও মনকে জীর্ণ করিয়াছিল। বিশেষভাবে লেনিনই মস্তিষ্ক রোগে শয্যাশায়ী হইলেন। তাঁহার দেহ ষ্ট্যালিনের মত দৃঢ় ছিল না। তাহার উপর কয়েক বৎসর যথেষ্ট পুষ্টিকর আহারের অভাবও লেনিনকে দুর্ব্বল করিয়াছিল। গৃহযুদ্ধের সময় ষ্ট্যালিন কেবলমাত্র রুটী, লবণ, কিঞ্চিৎ পেঁয়াজ ও রসুন সহযোগে আহার করিতেন। দীর্ঘকাল এইরূপ আহারের ফলে তিনি আহারের পর উদরে বেদনা অনুভব করিতে লাগিলেন। এই বেদনা তাঁহাকে মাঝে মাঝে বিশ্রাম লইতে বাধ্য করিত। ষ্ট্যালিন চিকিৎসকদিগকে দূরে রাখিয়া চলিতেন। কিন্তু অবশেষে তাঁহাকে চিকিৎকের আশ্রয় গ্রহণ করিতে হইল। চিকিৎসকগণ ষ্ট্যালিনের অন্ত্রে অস্ত্রোপচার করিলেন। এই অস্ত্রোপচারের ফলে ষ্ট্যালিনের প্রাণ সংশয় হইয়া উঠিল। রোগশয্যাশায়ী লেনিন অত্যন্ত উৎকণ্ঠিত হইয়া উঠিলেন। বিনয়ী ও অল্পভাষী ষ্ট্যালিনের সহশক্তি দেখিয়া লেনিন বিস্মিত হইলেন। কিছু আরোগ্য লাভ করা মাত্র লেনিন ষ্ট্যালিনকে স্বাস্থ্য লাভার্থ ককেশিয়ায় প্রেরণ করিলেন। আমরা পূর্ব্বেই ইঙ্গিত করিয়াছি যে ষ্ট্যালিনের সহিত ট্রট্‌স্কি ১৯১৭ খৃষ্টাব্দ হইতেই মতভেদ ছিল। ষ্ট্যালিন ছিলেন সর্ব্বতোভাবে লেনিনের অনুগামী, পক্ষান্তরে ট্রট্‌স্কি ছিলেন সমালোচক। ষ্ট্যালিন ছিলেন কর্মবীর আর তীক্ষ্ণধী, ট্রট্‌স্কি ছিলেন বাক্যবীর। সরকারী কাগজপত্রে ট্রট্‌স্কী ও ষ্ট্যালিনের মতভেদের অনেক প্রমাণ আছে। সে যাহা হউক, লেনিনের প্রথর ব্যক্তিত্ব ক্ষমতালোভী ট্রট্‌স্কিকে বহুলাংশে সংযত রাখিত। ষ্ট্যালিনের অনুপস্থিতির সুযোগ লইয়া ট্রট‍্স্কি নিজের মর্যাদা বৃদ্ধি করিবার চেষ্টা করিতে লাগিলেন। রুগ্ন লেনিনের মৃত্যুর পর তাঁহার শূন্য স্থান গ্রহণ করিবার জন্য ট্রট্‌স্কি প্রস্তুত হইতে লাগিলেন। লেনিন তাহা বুঝিতে পারিয়া চিন্তিত হইলেন।

 স্বাস্থ্যলাভ করিয়া ষ্ট্যালিন লেনিনের শয্যাপার্শ্বে ফিরিয়া আসিলেন। আত্মাভিমানী ট্রট‍্স্কির মত তাঁহার কোন বাহ্য আড়ম্বর ছিলনা এবং তিনি কোন উচ্চাশাও পোষণ করিতেন না। লেনিন ও বলশেভিক দলের সেবার মধ্যেই ষ্ট্যালিন আপনাতে আপনি মগ্ন হইয়া থাকিতেন। ট্রট‍্স্কি-শ্রেণীর নেতাদের মত তিনি কখনও কোনদিন লেনিনের প্রতিবাদ বা সমালোচনা করেন নাই। অথচ ট্রট্‌স্কি পদে পদে নিজের বুদ্ধির শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপন্ন করিবার জন্য লেনিনের প্রতিবাদ ও সমালোচনা করিতেন। এই কারণে ষ্ট্যালিন ট্রট্‌স্কির ঔদ্ধত্যকে কখনও ক্ষমা করিতে পারেন নাই। অন্যদিকে ট্রট্‌স্কি ষ্ট্যালিনকে বড় বেশী গণনার মধ্যেই আনিতেন না। এমনকি লেনিনের প্রস্তাবে ষ্ট্যালিন যখন কম্যুনিষ্ট পার্টির সম্পাদক নির্ব্বাচিত হইলেন, ট্রট্‌স্কিও তাহা সমর্থন করিয়াছিলেন। লেনিনের রোগশয্যার পার্শ্বে দাঁড়াইয়া একদিন ষ্ট্যালিন ও ট্রট‍্স্কির বিরোধের মীমাংসা হইল। ষ্ট্যালিন বলিলেন, ‘আমরা অতীতের মতভেদ বিস্মৃত হইব এবং বন্ধুভাবে একত্রে কাজকর্ম্ম করিব।’ কিন্তু ট্রট্‌স্কি এই প্রতিশ্রুতিকে কোন মর্য্যাদা দেন নাই।

 লেনিন রোগশয্যা হইতে আর উঠিলেন না। সমগ্র রাশিয়াকে শোকাচ্ছন্ন করিয়া মাত্র ৫৪ বৎসর বয়সে ১৯২৪ সালের ২১শে জানুয়ারী তিনি চির নিদ্রায় অভিভূত হইলেন। তাঁহার মৃত্যুসংবাদে সমগ্র রাশিয়া বিস্মিত ও বিষণ্ণ হইল। ধনিক সভ্যতা ও বুর্জোয়া শ্রেণীর চিরশত্রু লেনিনের মত বিপ্লবী নেতা পৃথিবীর ইতিহাসে আর দেখা যায় নাই। জনসাধারণের এত শ্রদ্ধা, ভালবাসা, প্রীতি ও বিশ্বাস আর কোন নেতাই অর্জ্জন করিতে পারেন নাই। কৃষক ও শ্রমিকদের মনের সত্য পরিচয় লেনিন পাইয়াছিলেন এবং সেই কারণেই তিনি কখনও তাহাদের প্রতি বিশ্বাস হারান নাই। মার্কসবাদের পাষাণ-কঠিন ভিত্তির উপর দাঁড়াইয়া লেনিন শ্রমিক সম্প্রদায়ের শক্তি ও ভবিষ্যতের প্রতি সীমাহীন বিশ্বাস পোষণ করিতেন। জীবনে কোনদিন তিনি বিপ্লব এবং সর্ব্বসাধারণের জয়ের উপর ভরসা হারান নাই। কিশোর বয়স হইতে অন্তিম মূহূর্ত্ত পর্য্যন্ত তিনি পৃথিবীর শ্রমিক সম্প্রদায়ের মুক্তি-সংঘর্ষের একনিষ্ঠ পূজারী ছিলেন।

 শোকে মুহ্যমান সমগ্র রাশিয়ার জনসাধারণ অনাথ বালকের মত কাঁদিয়া উঠিল। শোকার্ত্ত রাশিয়ার সে চিত্র বহু লেখক লিপিবদ্ধ করিয়া গিয়াছেন। একজন নিরপেক্ষ আমেরিকান সাংবাদিকের গ্রন্থ হইতে আমরা তাহাব কিঞ্চিৎ পরিচয় দিতে চেষ্টা করিব।

 ২২শে জানুয়ারী বেলা ১১-৩০ টার সোভিয়েট কংগ্রেসের সভাপতি কালিনিনের নেতৃত্বে কংগ্রেসের অধিবেশন হইল। কালিনিনের নির্দ্দেশে সকলে দণ্ডায়মান হইলেন। সোভিয়েট শোকবাদ্যের করুণ সুর থামিয়া গেলে অশ্রুপূর্ণ লোচনে ভগ্নস্বরে কালিনিন কহিলেন, ‘আমি আপনাদের নিকট আমাদের প্রিয় ভ্লাডিমির ঈলিচের মৃত্যুসংবাদ জ্ঞাপন করিতেছি। গতকল্য তিনি পুনরায় পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হন এবং’ কালিনিন স্তব্ধ হইয়া নতমুখে দাঁড়াইলেন এবং যেন সমস্ত শক্তি একত্রিত করিয়া উচ্চারণ করিলেন, ‘তিনি মৃত।’ সমগ্র জনতা অশ্রুবর্ষণ করিতে লাগিল। দুই একজন বলশেভিক নেতা হস্তোত্তলন করিয়া জনতাকে শান্ত করিবার চেষ্টা করিলেন।

 লক্ষ লক্ষ নরনারী তীব্র শীত রজনীর বরফপাত উপেক্ষা করিয়া জননায়কের চির নিদ্রায় অভিভূত মৃতদেহ প্রদক্ষিণ করিতে লাগিল। বিশাল জনতা ঘনসন্নিবিষ্ট হইয়া দাঁড়াইয়া ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করিবার পর তাহাকে দর্শন করিতে লাগিল। সপ্ত দিবা-নিশি অতিবাহিত হওয়ার পর ২৭শে জানুয়ারী অপরাহ্নে ষ্ট্যালিন, কামেনফ, জিনোভিফ, বুখারিন, রাইকফ এবং কালিনিন রক্তবস্ত্রে আবৃত লেনিনের কফিন স্কন্ধে লইয়া ক্রেমলিন প্রাসাদ হইতে বহির্গত হইলেন। লাল ময়দানে লেনিনের স্মৃতিমন্দিরের জন্য চিহ্নিত স্থানে মৃতদেহ আসিল। আন্তর্জাতিক সঙ্গীত গীত হইতে লাগিল। শূন্য ডিগ্রির ৩৫° নীচের শীতে লক্ষ লক্ষ নরনারী পথের দুই ধারে রক্তপতাকা হস্তে দাঁড়াইয়াছিল। লালপল্টন শোকগম্ভীর পদক্ষেপে পাহারা দিতেছিল। লেনিনের শিষ্যগণ কোন আড়ম্বরঅঙ্গুষ্ঠান করেন নাই, কোন বক্তৃতা হয় নাই। একটা জাতির শোক যেন বেদনায় নিস্তব্ধ হইয়া শীতের তুহিনের মতই জমিয়। গিয়াছিল। মস্কো নগরীর কি রাশিয়ান, কি বিদেশী সকলেই লক্ষ্য করিল, ট্রট্‌স্কি অনুপস্থিত। ট্রট্‌স্কি তাঁহার আত্মজীবনীতে এই অনুপস্থিতির একটা কৈফিয়ৎ দিবার চেষ্টা করিয়াছেন। তাহা শত্রু-মিত্র কেহই বিশ্বাস করে নাই। ফরাসী দাংবাদিক রোলিন লিখিয়াছেন, ‘আমি যতদূর জানিতে পারিয়াছি তাহাতে ট্রট্‌স্কি গুরুতর পীড়িত ছিলেন না এবং এই হৃদয়-হীনতায় তিনি নিজের পতন নিজেই ঘটাইয়াছিলেন।’ তাঁহার অনন্যসাধারণ প্রতিভা সত্ত্বেও তিনি এই সময় হইতে জনসাধারণের অপ্রিয় হইয়া উঠিলেন। ট্রট‍্ঙ্কির অসামান্য প্রতিভা, দুঃসাহস, অপূর্ব্ব বাগ্মীতা সত্ত্বেও কেবলমাত্র অবিবেচনার জন্য তিনি অধঃপতিত হইলেন। ইতিহাসে ট্রট‍্ঙ্কির ন্যায় কর্ম্মবহুল জীবন বিরল। অজ্ঞাত স্থান হইতে তিনি খ্যাতির উচ্চ শিখরে আরোহণ করিয়াছিলেন। তাঁহার বাগ্মীতা ও লেখনী সমগ্র জগৎকে চমকিত ও বিস্মিত করিয়াছে। কিন্তু দুঃখের কথা জীবনের মধ্যাহ্নেই তাঁহার সায়াহ্ন আসিল। বিবিধ দুর্লভ গুণের সহিত তাঁহার মধ্যে যে আত্মপরায়ণ অনুদারতা এবং অহমিকা ছিল, তাহা দ্বারা বিপথে চালিত হইয়া তিনি ক্রমে কম্যুনিষ্ট পার্টি ও রাশিয়া হইতে বহিষ্কৃত হইয়াছিলেন।

 লেনিনের মৃত্যুর পর শোকাচ্ছন্ন রাশিয়ার শ্রমিকদের মধ্যে কম্যুনিষ্ট পার্টির সদস্য হইবার জন্য এক অভিনব উদ্যম লক্ষ্য করা গেল। রাডেক বলিয়াছেন, লেনিনের মৃত্যুর ক্ষতি পূরণ করিতে হইলে পার্টিকে শক্তিশালী করিতে হইবে। এই সঙ্কল্প সমগ্র সোভিয়েট ভূমিতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে জাগিয়া উঠিল।

 ২৬শে জানুয়ারী সোভিয়েট যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে ষ্ট্যালিন কম্যুনিষ্ট পার্টির নামে শপথ গ্রহণ করিয়া কংগ্রেসের পক্ষ হইতে মহান নেতার প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করিয়া ঘোষণা করিলেন,

 ‘আমরা কম্যুনিষ্টরা স্বতন্ত্র ছাঁচে ঢালা মানুষ, আমাদের গঠনের উপাদান স্বতন্ত্র। শোষিত ও পীড়িত জনসঙ্ঘের সংগ্রামের আমরা সৈনিকদল। এই সৈন্যদলে যোগদান করা অপেক্ষা সর্ব্বোচ্চ সম্মানের আর কমরেড লেনিন প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত পার্টির সদস্য হওয়া অপেক্ষা অধিকতর গৌরবের আর কিছুই নাই।...

 ‘আমাদিগকে ত্যাগ করিয়া যাইবার সময় কমরেড লেনিন অনুরোধ করিয়া গিয়াছেন, কম্যুনিষ্ট পার্টির সদস্যপদের মহান দায়িত্বের পবিত্রতা ও সম্মান অক্ষুণ্ণ রাখিবার জন্য। কমরেড লেনিন, আমরা তোমার নামে শপথ করিয়া বলিতেছি যে, তোমার ইচ্ছা পূর্ণ করিবার জন্য আমরা সমস্ত শক্তি নিয়োজিত করিব।

 ‘আমাদিগকে ত্যাগ করিয়া যাইবার সময় কমরেড লেনিন অনুরোধ করিয়া গিয়াছেন, আমাদের পার্টির ঐক্যকে যেন আমরা চক্ষুর মণির মত রক্ষা করি। কমরেড লেনিন, আমরা তোমার নামে শপথ করিয়া বলিতেছি যে, তোমার ইচ্ছা আমরা সাফল্যের সহিত পূর্ণ করিব।

 ‘আমাদিগকে ত্যাগ করিয়া যাইবার সময় কমরেড লেনিন অনুরোধ করিয়া গিয়াছেন, আমরা যেন প্রলেটারিয়েটের ডিক্টেটরশিপকে রক্ষা ও শক্তিশালী করি। কমরেড লেনিন, আমরা তোমার নামে শপথ করিয়া বলিতেছি যে, তোমার এই ইচ্ছাও আমরা সাফল্যের সহিত পূর্ণ করিব।

 ‘আমাদিগকে ত্যাগ করিয়া যাইবার সময় কমরেড লেনিন অনুরোধ করিয়া গিয়াছেন, আমরা যেন কৃষক ও শ্রমিকের মৈত্রীকে সর্ব্ব-প্রযত্নে শক্তিশালী করিয়া তুলি। কমরেড লেনিন, আমরা তোমার নামে শপথ করিতেছি যে, তোমার এই ইচ্ছা আমরা সাফল্যের সহিত পূর্ণ করিব।

 ‘আমাদের দেশের বিভিন্ন জাতিগুলির স্বেচ্ছাপ্রণোদিত মৈত্রী রক্ষার জন্য সোভিয়েট যুক্তরাষ্ট্রের গঠনতন্ত্রের মধ্যে সকল জাতির ভ্রাতৃত্বমূলক সহযোগীতার প্রয়োজনীয়তা কমরেড লেনিন সততই আমদের স্মরণ করাইয়া দিতেন।

 ‘আমাদিগকে ত্যাগ করিয়া যাইবার সময় কমরেড লেনিন সোভিয়েট যুক্তরাষ্ট্রকে সুসম্বদ্ধ ও প্রসারিত করিবার অনুরোধ করিয়া গিয়াছেন। কমরেড লেনিন, আমরা তোমার নামে শপথ করিয়া বলিতেছি যে, তোমার এই ইচ্ছা আমরা সাফল্যের সহিত পূর্ণ করিব।...

 ‘একাধিকবার লেনিন আমাদিগকে স্মরণ করাইয়া দিয়াছেন যে, লালপণ্টনকে শক্তিশালী এবং তাহাদের অবস্থা উন্নত করা আমাদের পার্টির অন্যতম মুখ্য দায়িত্ব···অতএব আইস বন্ধুগণ, আমরা সঙ্কল্প গ্রহণ করি, লালপণ্টন এবং লালনৌবহরকে শক্তিশালী করিবার জন্য আমরা সর্ব্বপ্রযত্নে চেষ্টা করিব।

 ‘আমাদের ত্যাগ করিয়া যাইবার সময় কমরেড লেনিন আমাদের নির্দ্দেশ দিয়া গিয়াছেন, আমরা যেন ‘কম্যুনিষ্ট ইনটারন্যাশনালের’ আদর্শের প্রতি নিষ্ঠাবান থাকি। কমরেড লেনিন, আমরা তোমার নামে শপথ করিতেছি, সমগ্র জগতের শ্রমিকশক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করিতে অর্থাৎ কম্যুনিষ্ট ইনটারন্যাশনালকে শক্তিশালী এবং বিস্তৃত করিতে আমরা প্রাণ পর্য্যন্ত উৎসর্গ করিতেও কাতর হইব না।’

 অনেকে আশা ও আশঙ্কা করিয়াছিলেন, লেনিনের মৃত্যুর পর কম্যুনিষ্ট পার্টি ছত্রভঙ্গ হইয়া পড়িবে এবং আত্মকলহে সমাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা ভাঙ্গিয়া পড়িবে। কিন্তু দূরদৃষ্টিসম্পন্ন লেনিন বহু পূর্ব্ব হইতেই দলের শৃঙ্খলা রক্ষা ও পরিচালন ভার ষ্ট্যালিনের উপর দিয়াছিলেন। ষ্ট্যালিন নিঃশব্দে সে কর্ত্তব্য পালন করিয়াছেন। লেনিনের অবসানের পরেই দেখা গেল ষ্ট্যালিনের নেতৃত্ব সামান্য নহে। ষ্ট্যালিনের এই অভ্যুত্থানকে অনেক সাম্যবাদ-বিরোধী লেখক “ব্যক্তিগত ক্ষমতা লোভ এবং ডিক্টেটরশিপ” বলিয়া বর্ণনা করিয়াছেন। ডিক্টেটরশিপ কথাটা আমাদের দেশেও অত্যন্ত শিথিল ভাবে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু আন্তর্জ্জাতিক কম্যুনিষ্ট পার্টিতে এবং সোভিয়েট যুক্তরাষ্ট্রে তথাকথিত ডিক্টেটরশিপ সম্ভবপর নহে; কেন না কম্যুনিজম ও সোভিয়েট-তন্ত্র একটা নির্দ্দিষ্ট মত ও পথ ধরিয়া চলিয়াছে! কাজেই অতি শক্তিশালী ব্যক্তিকেও এই ব্যবস্থার সাধারণ সেবকরূপে কাজ করিতে হয়। ব্যক্তিগত ক্ষমতা লোভ চরিতার্থ করিবার অবকাশ ইহাতে নাই। ব্যক্তিগত খেয়াল-খুশিকে কম্যুনিজম বলিয়া চালান অসম্ভব।

 মার্কসবাদের বিভিন্ন প্রকার ব্যাখ্যা অবশ্য হইতে পারে। কোন বিশেষ ব্যাপারে পথ-নির্দ্দেশ সম্বন্ধে, রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক সঙ্ঘ পরিচালনে নেতৃবৃন্দের মধ্যে মতভেদও ঘটিতে পারে এবং সোভিয়েট রাশিয়ায় তাহা যে ঘটে নাই এমন নহে। পরবর্ত্তী ঘটনা এবং অভিজ্ঞতার দৃষ্টিতে সোভিয়েট যুক্তরাষ্ট্রের পরিচালকগণ প্রকাশ্যে ভুল ত্রুটি স্বীকার করিয়াছেন এবং তাহার সংশোধন করিয়াছেন। সাম্যবাদী নেতারা কখনও কোন কৃত্রিম উপায় অবলম্বন করেন নাই। অস্ত্রবলে বিরুদ্ধবাদীদের দমন করেন নাই কিংবা মুসোলিনী ও হিটলারের ন্যায় ক্ষমতার পথ নিষ্কণ্টক করিতে ভাড়াটিয়া গুপ্তঘাতকের সাহায্য গ্রহণ করেন নাই। গুপ্ত ষড়যন্ত্র, ছল, চাতুরী, উৎকোচ এবং দলের নেতাদের বিরুদ্ধে গুপ্তচর নিয়োগ কিংবা আইন সভায় সশস্ত্র প্রহরী মোতায়েন অথবা নিশীথ শয্যায় প্রসুপ্ত শত্রুকে হত্যা দ্বারা কেহ রাজা, সম্রাট, ডুচে অথবা ফুরার্ হইতে পারে, কিন্তু এই সকল উপায়ে কম্যুনিষ্ট পার্টির সম্পাদকের পদ লাভ করা যায় না। কেননা ঐ সম্মানের পদ ভীতির উপর প্রতিষ্ঠিত নহে। পার্টির শ্রদ্ধা ও সম্মতির উপর প্রতিষ্ঠিত।

 ষ্ট্যালিনের মত শক্তিশালী ব্যক্তিকে স্বাভাবিক ভাবেই তীব্র আক্রমণ সহিতে হইয়াছে এবং তিনি অনুরূপ শক্তির সহিত আত্মরক্ষা করিয়াছেন। প্রতিপক্ষীয় দলের সহিত তাঁহার এই বিরোধ প্রকাশ্য দিবালোকেই অনুষ্ঠিত হইয়াছে এবং দুই পক্ষের প্রত্যেকটী যুক্তি জনসাধারণ বিচার করিবার সুযোগ পাইয়াছে। মৃত জারতন্ত্রের রাজপ্রাসাদের যড়যন্ত্রের জের টানিয়া ষ্ট্যালিন-বিরোধীরা অনেক আজগুবী কথা প্রচার করিয়াছেন। কিন্তু সমাজতন্ত্রী সঙ্ঘে প্রত্যেক মানুষই স্বীয় যোগ্যতা ও শক্তি অনুসারে স্থান লাভ করে। লেনিনের মৃত্যুর পরবর্ত্তী ঘটনাবলীর চাপেই ষ্ট্যালিনকে স্বাভাবিক ভাবে সম্মুখে আসিয়া নেতৃত্ব গ্রহণ করিতে হইয়াছিল। নোরিন লিখিয়াছেন, “মার্কসবাদে তিনি সুপণ্ডিত। কি তত্ত্বের দিক হইতে, কি কর্ম্মের দিক হইতে ষ্ট্যালিন আমাদের মধ্যে বহুলাংশে শ্রেষ্ঠ ছিলেন বলিয়াই তিনি আমাদের নেতা।” তিনি নেতা, কেননা তিনি সাফল্য অর্জন করিয়াছেন, কেননা তিনি মার্কস্-এঙ্গেলস্-লেনিন নির্দ্দিষ্ট পথ হইতে কখনও ভ্রষ্ট হন নাই।”

 লেনিনের মৃত্যুর পর পার্টির নেতৃত্বের প্রশ্ন মূখ্য হইয়া উঠিল। লেনিনের পর আমিই নেতা, এইরূপ একটা শ্রেষ্ঠত্বাভিমানে ট্রট্‌স্কী কেন্দ্রীয় কমিটিকে পর্য্যন্ত অবজ্ঞা করিতে লাগিলেন। পার্টির সদস্যগণ দেখিলেন যাহারা রাজনৈতিক জীবনে প্রতি পদে লেনিনকে বাধা দিয়াছেন, বল্‌শেভিক্ নীতির অপব্যাখ্যা করিয়াছেন, আজিকার সঙ্কটের দিনে তাহারা নেতৃত্ব লাভের জন্য ব্যাকুল হইয়াছেন। পার্টির সভায় ষ্ট্যালিন পুনরায় পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক নির্ব্বাচিত হইলেন। পার্টির ঐক্যবদ্ধ দৃঢ়তা দেখিয়া ট্রট্‌স্কী সাময়িক ভাবে দমিয়া গেলেন, কিন্তু প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ উপায়ে পার্টির সমালোচনার নামে ভেদ-সৃষ্টির চেষ্টা করিতে লাগিলেন। ত্রয়োদশ পার্টি কংগ্রেসে ষ্ট্যালিন ট্রট্স্কী-পন্থীদের অভিযোগের উত্তর দিলেন। তাঁহারা এই রব তুলিয়াছিলেন যে, পার্টির মধ্যে “বুরোক্রেসী” বা আমলাতান্ত্রিক কলুষ প্রবেশ করিয়াছে।

 “আসল বিপদ তাহা নহে”—ষ্ট্যালিন বলিলেন, “আসল বিপদ হইল পার্টির বাহিরে জনসাধারণের সহিত পার্টির যোগসূত্র ছিন্ন হওয়ার সম্ভাবনা। তোমরা গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে যে কোন দলের প্রতিষ্ঠান গড়িয়া তুলিতে পার, কিন্তু উহার সহিত যদি শ্রমিক শ্রেণীর যোগ না থাকে, তাহা হইলে সে গণতন্ত্র নিস্ফল ও অকিঞ্চিৎকর। পার্টির অস্তিত্ব: নির্ভর করে শ্রমিক-শ্রেণীর উপর। যদি ইহা শ্রমিক-শ্রেণীর সহিত ঐক্য ও যোগ রক্ষা করিয়া চলে, দলের বাহিরের জনসাধারণের শ্রদ্ধা ও বিশ্বাসভাজন হয়, তাহা হইলে যদি কিছু আমলাতান্ত্রিক ত্রুটীও থাকে, তাহা হইলেও ইহা টিকিবে এবং বিস্তার লাভ করিবে। ইহা যদি না থাকে তাহা হইলে তোমরা গণতান্ত্রিক বা আমলাতান্ত্রিক যে কোন পদ্ধতিতেই পার্টি গঠন কর না কেন, উহা নিশ্চয়ই ধ্বংস হইবে। পার্টি শ্রমিক-শ্রেণীর একটি অংশ, এই শ্রেণীর জন্যই ইহার অস্তিত্ব—ইহা কেবল পার্টির জন্যই পার্টি নহে।”

 ট্রট‍্স্কী-পন্থীদের আর একটি কৌশল, পুরাতন ও প্রবীণ সদস্যদের বিরুদ্ধে পার্টির নবীন সদস্যদিগকে প্রয়োগ করিবার চেষ্টা। ইহার তীব্র নিন্দা করিয়া ষ্ট্যালিন বলিলেন, “নবীন ও প্রবীণের প্রশ্নটা অতি সামান্য। আমাদের পার্টির ইতিহাসের ঘটনা ও সংখ্যা ইত্যাদি আলোচনা করিলে দেখা যাইবে, নবীন পার্টি সদস্যরা ক্রমে নির্ব্বাচিত পদগুলি লইতেছে এবং তাহার ফলে উপরের দিকের কর্মীরা শক্তিশালী হইয়াছে। পার্টি এই পথেই চলিতেছে এবং চলিবে। যাহারা মনে করে নির্ব্বাচিত পদাধিকারীরা একটা বিচ্ছিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং এই সুবিধাভোগী শ্রেণী তাহাদের মধ্যে নূতন সদস্যদিগকে লইতে চাহে না, যাহারা মনে করে প্রবীণেরা অতীতের রক্ষকশ্রেণী এক প্রকার কর্ম্মচারী এবং পার্টির অন্যান্য সদস্য ইহাদের দৃষ্টিতে নিম্নশ্রেণীর, তাহারাই প্রবীন ও পার্টির যুবকদের মধ্যে ভেদ ঘটাইতে চায়, তাহারাই গণতন্ত্রের সমস্যাকে প্রবীন ও নবীনের সমস্য করিতে চায়। গণতন্ত্রের মূলকথা নবীন ও প্রবীন নহে, পার্টির নেতৃত্বে, পরিচালনায় প্রত্যেক পার্টি-সদস্যের স্বাধীনভাবে সক্রিয় অংশ গ্রহণ করাই গণতন্ত্র। এইভাবে, কেবলমাত্র এই ভাবেই গণতন্ত্রকে বিচার করা যায়, আমরা মামুলী গণতান্ত্রিক দলের কথা বলিতেছি না, আমাদের পার্টি জনগণের পার্টি, যাহা শ্রমিকশ্রেণীর সহিত অচ্ছেদ্য বন্ধনে আবদ্ধ।”

 ট্রট্‌স্কি নিরস্ত হইলেন না, তিনি প্রকাশ্যে সংবাদপত্রে প্রবন্ধ লিখিয়া পার্টির সমালোচনা করিতে লাগিলেন। একটি দেশে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র সম্ভবপর নহে, বৈপ্লবিক নেতৃত্ব দ্বারা আন্তর্জাতিক বিপ্লব পরিচালন করিতে হইবে, এই শ্রেণীর প্রশ্ন তুলিয়া পার্টির মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টির চেষ্ট চলিল। ১৯২৫-র ডিসেম্বর মাসে বলশেভিক পার্টির চতুর্দ্দশ কংগ্রেসে একটা সুগঠিত বিরুদ্ধবাদী দলের নেতারূপে ট্রট্‌স্কি, জিনোভিফ ও কামেনষ বৈপ্লবিক নেতৃত্বের প্রশ্ন তুলিলেন। কৃষক বা জনসাধারণের দ্বারা বৈপ্লবিক সমাজতন্ত্রবাদ প্রতিষ্ঠা সম্ভব নহে, সোভিয়েটের গঠনমূলক কাজ সমাজতান্ত্রিক আদর্শ ভ্রষ্ট হইয়া যাইতেছে, এই শ্রেণীর ভেদ সৃষ্টি করিবার উদ্যমকে বাধা দিয়া ষ্ট্যালিন বলিলেন, “সম্মিলিত শ্রম, সম্মিলিত নেতৃত্ব, সঙ্ঘবদ্ধ সংগ্রাম এবং কেন্দ্রীয় কমিটির ঐক্য প্রথমে প্রয়োজন।”

 জনসাধারণের শক্তি ও সদিচ্ছায় অবিশ্বাস, তাহাদিগকে পীড়ন করিয়া ষ্ট্যালিন সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় (ট্রট্‌স্কিবাদ) আনিবার প্রস্তাবের তীব্র বিরোধীতা করিয়া ষ্ট্যালিন দৃঢ়কণ্ঠে বলিলেন, “জনসাধারণের সৃজনীশক্তির উপর অবিশ্বাস (তাহাদের বুদ্ধি যথোচিত বিকশিত হয় নাই এই অছিলায়) মারাত্মক। যদি তাহাদিগকে উপযুক্তভাবে শিক্ষা দেওয়া যায়, তাহা হইলে তাহারা নিজেদের চালিত করার সঙ্গে সঙ্গে নেতাদেরও পরিচালিত করিতে পারিবে। জনসাধারণের উপর নেতৃত্বের আভিজাত্য প্রতিষ্ঠা চলিবে না। কেননা, জনসাধারণ যেমন পুরাতন ব্যবস্থা ধ্বংস করিয়াছে, তেমনি নূতনকেও গঠন করিবে। জনসাধারণের সহিত ধাত্রী বা স্কুলমাষ্টারের মত ব্যবহার করিও না। কেননা আমাদের পুঁথি-পুস্তক হইতে তাহারা যতটা শিক্ষালাভ করে তাহাদের নিকট হইতে আমরা তাহাপেক্ষা অধিকতর শিক্ষা লাভ করি। অতএব জনসাধারণের সহিত একত্র হইয়াই আমরা প্রকৃত শাসনতন্ত্র গঠন করিতে পারিব।” বলশেভিক দলের নেতৃত্ব দ্বারা জনসাধারণকে পীড়ন করিয়া বাধ্য করার ষ্ট্যালিন বিরোধী ছিলেন; জনসাধারণকে বুঝাইয়া ঠিক পথে আনাই ছিল তাঁহার প্রস্তাব।

 লেনিনের “নূতন অর্থ নৈতিক ব্যবস্থা” প্রবর্ত্তনের পর হইতেই ট্রট্‌স্কি তাঁহার নৈষ্ঠিক মার্কসবাদের ব্যাখ্যা প্রচার করিতেছিলেন। থিয়োরীবিলাসী ট্রট্‌স্কি—বিশ্ববিপ্লব ব্যতীত রাশিয়ায় কম্যুনিজম্ প্রতিষ্ঠা অসম্ভব— তত্ত্বের দিক হইতে এই ব্যাখ্যা করিতে লাগিলেন, পক্ষান্তরে ষ্ট্যালিন বলিলেন, পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিচার করিয়াই সাম্যবাদীদের অগ্রসর হইতে হইবে। এই কারণেই লেনিন, তথাকথিত মতবাদের গোঁড়ামীর পরিবর্ত্তে বাস্তব অবস্থার দিক হইতে কর্ম্মপন্থার পরিবর্ত্তন করিয়াছিলেন। পার্টির সম্মুখে মার্কস্-লেনিনের আদর্শ সুস্পষ্ট রাখিবার ষ্ট্যালিন এই কালে বহু তথ্য ও যুক্তিপূর্ণ পুস্তিকা ও গ্রন্থ প্রণয়ন করেন। ১৯২৬-র জানুয়ারীতে ঐগুলি “Problems of Leninism” নামে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থখানি সোভিয়েট রাশিয়ায় এবং পরবর্ত্তীকালে সমগ্র জগতে লক্ষ লক্ষ নরনারী পাঠ করিয়াছে। রাজনৈতিক চিন্তা ও কর্ম্মধারার ক্রমবিকাশ এবং বৈপ্লবিক গণ-আন্দোলন পরিচালনের বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির বিশ্লেষণে ষ্ট্যালিন তাঁহার পাণ্ডিত্য ও প্রতিভার পরিচয় দিয়াছেন।

 কেবল তত্ত্ব ব্যাখ্যা করিয়া নহে, একটি দেশে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রবর্ত্তন যে সম্ভব, পার্টির সহায়তায় ষ্ট্যালিন তাহা প্রমাণ করিতে আত্মনিয়োগ করিলেন। রাশিয়ার অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি হইতেছে বটে, কিন্তু বাহিরে ধনতন্ত্রও মহাযুদ্ধের টাল সামলাইয়া লইতেছে; ট্রট্‌স্কি-পন্থীরা বলিলেন, ইহার ফলে রুশ বিপ্লব ব্যর্থ হইয়া যাইবে। ষ্ট্যালিন উত্তর দিলেন, “আমরা আত্মস্থ হইবার দুইটি চেষ্টা দেখিতেছি। এক প্রান্তে ধনতন্ত্র নিজেদের সামলাইয়া প্রতিষ্ঠা লাভ ও অধিকতর বিস্তারের পথ দেখিতেছে, অন্য প্রান্তে সোভিয়েট-ব্যবস্থা নবলব্ধ জয়কে আয়ত্তে আনিয়া অধিকতর বিজয়ের দিকে অগ্রসর—কে জয়লাভ করিবে ইহাই প্রশ্ন। এই দুইটি ব্যবস্থা পাশাপাশি কেমন করিয়া চলিবে এবং তাহার পরিণাম কি? কারণ আজ সুসংহত সর্ব্বগ্রাসী ধনতন্ত্র আর নাই। জগত আজ দুই পৃথক শিবিরে বিভক্ত। বৃটিশ ও আমেরিকান মুলধনের নেতৃত্বে চালিত ধনতন্ত্র এবং সোভিয়েট ইউনিয়নের নেতৃত্বে চালিত সমাজতন্ত্র। এই দুই শিবিরের আপেক্ষিক শক্তিদ্বারাই আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি ক্রমশঃ অধিক পরিমাণে নিয়ন্ত্রিত হইবে।

 “আমরা কোন পথে চলিব? আমরা কি আমাদের দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করিব? যদি সোভিয়েট ইউনিয়ন সমাজতান্ত্রিক গঠন-কার্য্যে কৃতকার্য্য হয়, তাহার ফল কি হইবে? অন্যান্য দেশে ধনতন্ত্রের সহিত সংগ্রামরত গণশক্তির বৈপ্লবিক শক্তি বৃদ্ধি পাইবে। গণশক্তির বিরুদ্ধে ধনতন্ত্রের সংগ্রামকে দুর্ব্বল করিবে এবং বিশ্বসাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাইবে।”

 ১৯২৫ সালে কম্যুনিষ্ট পার্টির চতুর্দ্দশ কংগ্রেসে ষ্ট্যালিন কলকারখানা প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা করেন। চারি বৎসর কাল সোভিয়েট পরিকল্পনা অনুসারে বিদ্যুৎশক্তি সরবরাহের কাজ দ্রুতগতিতে অগ্রসর হইতেছিল। এখন এই বিদ্যুৎশক্তিকে কলকারখানার কাজে লাগাইয়া যত শীঘ্র সম্ভব অগ্রগামী ধনতান্ত্রিক দেশগুলির সমকক্ষ হইতে হইবে। শিল্প-বাণিজ্যে আন্তর্জাতিক সামঞ্জস্য বিধানের টুট‍্ঙ্কি-তত্ত্ব তিনি মানিয়া লইতে অস্বীকার করিলেন। রাশিয়ার আভ্যন্তরীন গঠন-কার্য্যের ফলে বিপ্লবের সমাধি হইবে ইহা ষ্ট্যালিন বিশ্বাস করিলেন না। তিনি বলিলেন, “বর্তমান জগতে এঙ্গলো-স্যাক্সন ধনতন্ত্র ও সোভিয়েট সোসালিজম্ এই দুই পৃথক ব্যবস্থা চলিতেছে। সেভিয়েট সোসালিজম্ উহার প্রতিক্রিয়া ব্যর্থ করিবে, কেননা ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে ক্ষয়রোগ দেখা দিয়াছে।” ১৯২৮ খৃষ্টাব্দের অর্থ নৈতিক সঙ্কটের তিন বৎসর পূর্ব্বেই ষ্ট্যালিন এই ভবিষ্যৎবাণী করিয়াছিলেন।

 ১৯২৭ সালের পঞ্চদশ কংগ্রেসে কৃষিকার্য্যে সমবায় পদ্ধতি ও যন্ত্রবিজ্ঞান প্রয়োগের প্রস্তাব গৃহীত হইল। ১৯২৭ খৃষ্টাব্দে সোভিয়েট অর্থনৈতিক ব্যবস্থা জার-শাসিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা অপেক্ষাও অধিকতর উন্নতি লাভ করিল। কৃষিপণ্যের পরিমাণ শতকরা আট ভাগ এবং কলকারখানার উৎপাদন শতক ১২ ভাগ বাড়িল। জারের আমলে ১৯১৩ সালে রেলপথের দৈর্ঘ্য ছিল ৩৬,৫০০ মাইল, ১৯২৭ খৃষ্টাব্দে তাহা বাড়িয়া ৪৮,২০০ মাইল হইল। শ্রমিকদের উপার্জন প্রায় শতকরা ১৭ ভাগ বাড়িল। শিক্ষা বিভাগের বিস্তার হইল বিস্ময়কর। ১৯২৫ সালে সোভিয়েট প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ১৯১৩ সাল অপেক্ষা ২২ লক্ষ ৫০ হাজার অধিক ছাত্র দেখা গেল। বহু কারিগরি শিক্ষার বিদ্যালয় স্থাপিত হইল। কলকারখানা ও যন্ত্রশক্তিতে সোভিয়েট রাশিয়া আমেরিকা, ইংলণ্ড, জার্ম্মণী এবং ফ্রান্সের পরেই স্থান লাভ করিল। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার দিক দিয়া বিচার করিলে ১৯২৭ সালে দেখা যায় কলকারখানা ও বাণিজ্যের শতকরা ১৪ ভাগ ব্যক্তিগতভাবে পরিচালিত এবং ৭৭ ভাগ সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ও অবশিষ্ট সমবায়নীতিতে পরিচালিত। কৃষিকার্য্যের শতকরা পৌনে তিনভাগ সমাজতান্ত্রিক এবং শতকরা ৯৭ ভাগ কৃষকদের ব্যক্তিগত অধিকারে ছিল। আভ্যন্তরীন ব্যবসায়ের শতকরা প্রায় ৮২ ভাগ সমাজতান্ত্রিক এবং মাত্র ১৮ ভাগ ব্যক্তিগত।

 ১৯২৭-র পর হইতে পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা লইয়া সোভিয়েট রাশিয়া কৃষির উন্নতিতে মনোনিবেশ করিল।

 রাশিয়ায় কম্যুনিষ্টপার্টির বিরুদ্ধ দল ১৯২৬ খৃষ্টাব্দে প্রবল হইয়া উঠে। এই সময় চপলমতি জিনোভিফ ও কামেনফও ট্রট্‌স্কির সহিত যোগ দেন। এই বিরুদ্ধতা কেবল রাশিয়ার দলের বিরুদ্ধে নহে, সমগ্র সাম্যবাদী আন্তর্জ্জাতিক দলের বিরুদ্ধেই আত্মপ্রকাশ করিয়াছিল। ইহার গোপন ষড়যন্ত্র এবং আক্রমণের অধিকাংশই ষ্ট্যালিনকে সহা করিতে হয়, কেননা সাম্যবাদী দলের সংখ্যাগরিষ্ঠদের তিনিই নেতা ছিলেন। ইহাকে ষ্ট্যালিন-ট্রট‍্স্কির ব্যক্তিগত কলহরূপে কেহ কেহ বর্ণনা করিয়াছেন। কেহ বা ট্রট্‌স্কিকেই খাঁটি সাম্যবাদী বলিয়া সমর্থন করিয়াছেন। ব্যক্তির দিক হইতে না দেখিয়া সাম্যবাদের আদর্শ ও কর্ম্মপদ্ধতির দিক হইতে বিচার করিলে এই বিরোধের কারণ নির্ণয় অপেক্ষাকৃত সহজ হইবে।

 রাশিয়ার কম্যুনিষ্ট পার্টি রাষ্ট্রের একটা প্রধান শক্তি। কৃষক-শ্রমিকের অগ্রগামী প্রতিনিধি হিসাবে এই দল একটা সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র স্থাপন ও পরিচালনের কাজে নিযুক্ত। এই কার্য্য একেবারে নূতন, জগতের কোন দেশে ইহার পরীক্ষা হয় নাই; কাজেই তাহাদের সম্মুখে কোন দৃষ্টান্ত নাই, অতীতের কোন অভিজ্ঞতা নাই, চলার গতিবেগের সহিত তাহাদিগকে পথও স্বহস্তে প্রস্তুত করিতে হইয়াছে। এই অবস্থার মধ্যে পার্টির সংহতি ও ঐক্যের সর্ব্বাধিক প্রয়োজন। অনিবার্য্য ভুলত্রুটি সংশোধন করিতে হইবে, সঙ্গে সঙ্গে আত্ম-সমালোচনাও করিতে হইবে; কিন্তু যখন পার্টির সম্মুখে বিরাট পুনর্গঠন ও নবনির্ম্মান সমস্যা, তখন পদে পদে বাধা, প্রতিবাদ এবং প্রত্যেক ব্যাপারে বিরুদ্ধতা অবলম্বন সাম্যবাদীর কাজ নহে। অথচ মনুষ্য-প্রকৃতি এইরূপ যে একবার বিরুদ্ধতায় প্রবৃত্ত হইলে তাহার মনোভাব বিকৃত হইয়া উঠে। অতিরঞ্জনের দিকে অগ্রসর হয়, এমন কি অজ্ঞাতসারে আত্মঘাতী সংগ্রামলিপ্সু হইয়া উঠে। ব্যক্তিগত স্বার্থ ও ঈর্ষাই এই অবস্থার একমাত্র কারণ নহে, যদিচ উহা অন্যতম প্রধান কারণ। ট্রট্‌স্কি অত্যন্ত আত্মাভিমানী ও খেয়ালী। তিনি কোন সমালোচনা সহ্য করিতে পারিতেন না। সকলের উপরে কর্ত্তা হইতে না পারিয়া তিনি নিরাশ হইলেন। তাঁহার পাণ্ডিত্য ও প্রতিভার অপব্যবহার করিয়া সাম্যবাদের এক অবাস্তব ব্যাখ্যার দ্বারা তিনি উপস্থিত কর্ত্তব্যকে পরিহার করিতে লাগিলেন। বিরুদ্ধতা করিতে হইলে মতবাদের অস্ত্রাগার হইতে পছন্দ মত অস্ত্রশস্ত্রাদি সংগ্রহ করিতে ট্রট্‌স্কির শক্তির অভাব ছিলনা। সর্ব্বত্র দোষ দর্শন করিবার প্রবৃত্তি দমন করিতে না পারিয়া তিনি নিজেকে অধিকতর বিপ্লবী বলিয়া প্রচার করিতে লাগিলেন। তাঁহার চিন্তার এই গতি, এই মানসিক অভ্যাস এবং বুদ্ধির অস্থিরতা, তাঁহার রাজনৈতিক মতবাদ, কম্যুনিষ্ট পার্টির নিকট অশ্রদ্ধেয় হইয়া উঠিল। তিনি ক্রমে নিম্নমধ্যশ্রেণীর সুবিধাবাদীর নৈতিক ভীরুতা ও বুদ্ধির ভণ্ডামী অবলম্বন করিয়া সংস্কার-পন্থী হইয়া উঠিলেন, অথচ সঙ্গে সঙ্গে মার্কসবাদের মুখোসও তিনি ব্যবহার করিতে লাগিলেন। রাষ্ট্রে সুপ্রতিষ্ঠিত একটা পার্টির কাজ এইরূপ বিতর্কমূলক নহে। বিরুদ্ধবাদীরা আত্মসমালোচনা ছাড়িয়া আত্মবিরোধে প্রবৃত্ত হইলেন। ইহার কুফল হইল এই যে তাঁহারা সংখ্যা গরিষ্ঠ অংশ হইতে ক্রমে পৃথক হইয়া পড়িলেন। এমনকি গণতান্ত্রিক উপায়েও তাঁহারা সামঞ্জস্য বিধান করিতে অপারগ হইলেন। অবশেষে যে কোন উপায়ে ক্ষমতা হস্তগত করিবার চেষ্টা করিতে লাগিলেন।

 এইরূপ একটা সঙ্কট আসিতে পারে, লেনিন ইহা পূর্ব্বেই অনুমান করিয়াছিলেন এবং কম্যুনিষ্ট পার্টির দশম কংগ্রেসে তাঁহার চেষ্টায় নিম্নলিখিত প্রস্তাবটী গৃহীত হইয়াছিল; “পার্টির প্রত্যেক সদস্যকেই লক্ষ্য রাখিতে হইবে যে পার্টির ভুলগুলির সমালোচনা করিবার, পার্টির মূলনীতি বিশ্লেষণ করিবার, কার্যক্ষেত্রে লব্ধ অভিজ্ঞতা বিচার করিবার এবং বিচার-বিশ্লেষণ করিয়া ভুলের প্রতিকারোপায় নির্ণয় করিবার স্বাধীনতা থাকা প্রয়োজন। কিন্তু ইহা হইতে যেন কোন ব্যক্তি বিশেষের নির্দ্দেশ মুখ্য হইয়া না উঠে এবং কোন ক্ষুদ্র দল যেন স্বতন্ত্রভাবে আলোচনায় প্রবৃত্ত না হয়। প্রত্যেক আলোচনাই দলের সমস্ত সদস্যের নিকট উন্মুক্ত থাকিবে।” কিন্তু ট্রট্‌স্কি এই সিদ্ধান্ত অগ্রাহ্য করিয়া সোভিয়েট যুক্তরাষ্ট্রের শাসনপদ্ধতি এবং আন্তর্জ্জাতিক সাম্যবাদী সঙ্ঘের কার্য্যে বিঘ্ন উৎপাদন করিতে লাগিলেন। বাহির হইতে দেখিলে ইহা সমাজতান্ত্রিক শাসনপদ্ধতির পরিবর্ত্তে নিয়মতান্ত্রিক রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রবর্ত্তনের চেষ্টা বলিয়া বোধ হয়। কতকাংশে ইহা সত্য। ধনতান্ত্রিক জগতের কেন্দ্রস্থলে প্রকৃত সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের শক্তি ও স্থায়িত্ব সম্বন্ধে তাঁহারা সন্দিহান ছিলেন। তাঁহারা বিশ্বাস করিতেন না যে অপেক্ষাকৃত স্বচ্ছল অবস্থার কৃষকদিগকে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে আনা সম্ভব হইবে। তাহার উপর রাষ্ট্রচালিত কলকারখানাকে তাঁহারা মূলতঃ ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালিত কলকারখানার ব্যবস্থার অনুরূপ বলিয়া সমালোচনা করিতে লাগিলেন। দলের মধ্যে উপদল গঠন করিয়া জিনোভিফ, কামেনফ এবং ট্রট্‌স্কি দীর্ঘকাল হইতেই একটা “বিরুদ্ধদল” সৃষ্টির চেষ্টা করিতেছিলেন। লেনিনের জীবিতকালেও তাঁহারা এই বিরুদ্ধতা দেখাইয়াছেন। এখন ষ্ট্যালিনকেও উপলক্ষ করিয়া তাঁহারা “লেনিনবাদের পবিত্রতা” রক্ষার জন্য আসলে পার্টির শক্তিকে ভিতর হইতে বিশ্লিষ্ট করিবার চেষ্টা করিতে লাগিলেন।

 ষ্ট্যালিন একদিন দলের সভায় বিতর্কের উত্তরে বলিলেন, “কমরেড ট্রট্‌স্কি তাঁহার বক্তৃতায় প্রসঙ্গতঃ বলিয়াছেন যে “কার্য্যক্ষেত্রে আমরা আন্তর্জ্জাতিক অর্থনীতিদ্বারা নিয়ন্ত্রিত হইব। ইহা কি সত্য? না!, উই| পুঁজিবাদী হাঙ্গরগণের স্বপ্ন হইতে পারে, কিন্তু সত্য নহে।” ষ্ট্যালিন দেখাইলেন যে অর্থনীতিক দিক হইতে কি সোভিয়েট ব্যাঙ্ক গুলির উপর, কি কলকারখানার উপর, কি বৈদেশিক বাণিজ্যের উপর, ঐরূপ কোন প্রভাব বিস্তারের সম্ভাবনা নাই, কেনন। এইগুলি পূর্ব্ব হইতে জাতীয় সম্পদে পরিণত করা হইয়াছে। অতএব কমরেড্ ট্রট্‌স্কি কথিত “নিয়ন্ত্রণ” শব্দটীর রাজনীতির দিক দিয়াও কোন বাস্তব অস্তিত্ব নাই।

 পঞ্চদশ কংগ্রেসে কেন্দ্রীয় শক্তির বিরুদ্ধে রাজনীতিক ষড়যন্ত্রের বিশেষ বিবরণ পেশ করা হইল। দেখা গেল ট্রট্‌স্কি এবং তাঁহার অনুচরগণ কেন্দ্রীয় সমিতির মধ্যে স্বতন্ত্র দল গড়িয়াছেন, জিলা ও সহরগুলিতে শাখা সমিতি প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে, স্বতন্ত্র ধনভাণ্ডার এবং গোপন ছাপাখানা প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে। তৃতীয় আন্তর্জ্জাতিকের পরিবর্ত্তে এই নূতন দলের নিয়ন্ত্রনাধীনে আর একটা আন্তর্জ্জাতিক সঙ্ঘ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চলিতেছে। পঞ্চদশ কংগ্রেস ট্রট্‌স্কিকে এই সকল সমিতি-সঙ্ঘ ভাঙ্গিয়া দিবার জন্য অনুরোধ করিল এবং বলশেভিক দলের ক্রমাগত বিরুদ্ধতার পরিবর্ত্তে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নির্দ্দেশ মানিয়া চলিবার জন্য অনুরোধ করিল। কিন্তু মিলনের আগ্রহ না দেখাইয়া একশ একুশ জন ট্রট্‌স্কি-পন্থী পাল্টা প্রস্তাব করিয়া স্বাতন্ত্রের দাবী উপস্থিত করিলেন। ফলে ট্রট্‌স্কি ও তাঁহার সহকর্ম্মীরা দল হইতে বহিষ্কৃত হইলেন। এই বহিষ্কারের পরও তাঁহাদিগকে ব্যক্তিগত ভাবে দলে ফিরিয়া আসিবার জন্য দরজা খোলা রাখা হইল। জিনোভিফ, কামেনফ, রাডেক, রক‍্ভস্কি ভুল স্বীকার করিয়া দলে ফিরিয়া আসিলেন। কিন্তু উচ্চাভিলাষী ট্রট‍্স্কি তাঁহার জনপ্রিয়তা লইয়া ষ্ট্যালিনের বিরুদ্ধে প্রচার কার্য চালাইতে লাগিলেন। কিন্তু তাহা সাফল্যলাভ করিল না দেখিয়া ট্রট্‌স্কি ষ্ট্যালিনের সহিত সন্ধির জন্য লালায়িত হইলেন। কিন্তু উহা কৌশল মাত্র। কেন্দ্রীয় কমিটি ট্রট্‌স্কিকে মধ্য এশিয়ায় প্রেরণ করিলেন। ১৯২৮ খৃষ্টাব্দের জানুয়ারী মাসে ট্রট‍্স্কি নির্ব্বাসন হইতে মস্কো ও লেনিনগ্রাডে তাঁহার দলের লোকদের সহিত চিঠিপত্র আদান-প্রদান করিতে লাগিলেন এবং রাজনৈতিক কর্ম্মধারার নির্দ্দেশ দিতে লাগিলেন। বারংবার সাবধান করিয়া দেওয়া সত্ত্বেও ট্রট্‌স্কি নিরস্ত হইলেন না, ট্রট্‌স্কি কিছুতেই বুঝিতে চাহিলেন না যে তাঁহার সমর্থকগণের অধিকাংশই সাম্যবাদবিরোধী এবং সোভিয়েট সমাজতন্ত্রের শত্রু। অবশেষে কেন্দ্রীয় কমিটি ট্রট্‌স্কিকে রাশিয়া হইতে বাহির করিয়া দিবার সিদ্ধান্ত করিলেন। এক বৎসরের মধ্যেই দেখা গেল কোন উল্লেখযোগ্য নেতাই ট্রট্‌স্কির পক্ষসমর্থন করিলেন না। সোভিয়েট রাশিয়ার অন্যতম বিপথ-চালিত অথচ শক্তিশালী নেতা ট্রট‍্স্কি ১৯২৯-র ১২ই ফেব্রুয়ারী রাশিয়া হইতে চিরদিনের মত নির্ব্বাসিত হইলেন।