সঞ্চয়িতা/উদাসীন (৩)

উইকিসংকলন থেকে

উদাসীন

ফাল্গুনের রঙিন আবেশ
যেমন দিনে দিনে মিলিয়ে দেয় বনভূমি
নীরস বৈশাখের রিক্ততায়
তেমনি করেই সরিয়ে ফেলেছ হে প্রমদা, তোমার মদির মায়া
অনাদরে অবহেলায়।
একদিন আপন হাতে আমার চোখে বিছিয়েছিলে বিহ্বলতা,
রক্তে দিয়েছিলে দোল,
চিত্ত ভরেছিলে নেশায়, হে আমার সাকি,
পাত্র উজাড় ক’রে
জাদুরসধারা আজ ঢেলে দিয়েছ ধুলায়।
আজ উপেক্ষা করেছ আমার স্তুতিকে,
আমার দুই চক্ষুর বিস্ময়কে ডাক দিতে ভুলে গেলে;

আজ তোমার সাজের মধ্যে কোনো আকুতি নেই,
নেই সেই নীরব সুরের ঝংকার
যা আমার নামকে দিয়েছিল রাগিণী।

শুনেছি একদিন চাঁদের দেহ ঘিরে
ছিল হাওয়ার আবর্ত।
তখন ছিল তার রঙের শিল্প,
ছিল সুরের মন্ত্র,
ছিল সে নিত্যনবীন।
দিনে দিনে উদাসী কেন ঘুচিয়ে দিল
আপন লীলার প্রবাহ!
কেন ক্লান্ত হল সে আপনার মাধুর্যকে নিয়ে!
আজ শুধু তার মধ্যে আছে
আলোছায়ার মৈত্রীবিহীন দ্বন্দ্ব—
ফোটে না ফুল,
বহে না কলমুখরা নির্ঝরিণী।

সেই বাণীহারা চাঁদ তুমি আজ আমার কাছে।
দুঃখ এই যে, এতে দুঃখ নেই তোমার মনে।
একদিন নিজেকে নূতন নূতন করে সৃষ্টি করেছিলে মায়াবিনী
আমারই ভালো লাগার রঙে রঙিয়ে।
আজ তারই উপর তুমি টেনে দিলে
যুগান্তের কালো যবনিকা—
বর্ণহীন, ভাষাবিহীন।
ভুলে গেছ, যতই দিতে এসেছিলে আপনাকে
ততই পেয়েছিলে আপনাকে বিচিত্র ক’রে।
আজ আমাকে বঞ্চিত ক’রে
বঞ্চিত হয়েছ আপন সার্থকতায়।

তোমার মাধুর্যযুগের ভগ্নশেষ
রইল আমার মনের স্তরে স্তরে—
সেদিনকার তোরণের স্তূপ,
প্রাসাদের ভিত্তি,
গুল্মে-ঢাকা বাগানের পথ।

আমি বাস করি
তোমার ভাঙা ঐশ্বর্যের ছড়ানো টুকরোর মধ্যে।
আমি খুঁজে বেড়াই মাটির তলার অন্ধকার,
কুড়িয়ে রাখি যা ঠেকে হাতে।
আর, তুমি আছ
আপন কৃপণতার পাণ্ডুর মরুদেশে—
পিপাসিতের জন্যে জল নেই সেখানে,
পিপাসাকে ছলনা করতে পারে
নেই এমন মরীচিকারও সম্বল।

শান্তিনিকেতন
৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৬