সঞ্চয়িতা/মুক্তি (২)

উইকিসংকলন থেকে

মুক্তি

ডাক্তারে যা বলে বলুক-নাকো,
রাখো রাখে। খুলে রাখো
শিওরের ওই জানলাদুটো, গায়ে লাগুক হাওয়া।
ওষুধ? আমার ফুরিয়ে গেছে ওষুধ খাওয়া।
তিতো কড়া কত ওষুধ খেলেম এ জীবনে,
দিনে দিনে ক্ষণে ক্ষণে।
বেঁচে থাকা সেই যেন এক রোগ;
কতরকম কবিরাজি, কতই মুষ্টিযোগ,
একটুমাত্র অসাবধানেই বিষম কর্মভোগ।
এইটে ভালো, ওইটে মন্দ, যে যা বলে সবার কথা মেনে
নামিয়ে চক্ষু মাথায় ঘোমটা টেনে
বাইশ বছর কাটিয়ে দিলেম এই তোমাদের ঘরে।
তাই তো ঘরে পরে
সবাই আমায় বললে, লক্ষ্মী সতী,
ভালো মানুষ অতি।

এ সংসারে এসেছিলেম ন বছরের মেয়ে,
তার পরে এই পরিবারের দীর্ঘ গলি বেয়ে
দশের-ইচ্ছা-বোঝাই-করা এই জীবনটা টেনে টেনে শেষে
পৌঁছিনু আজ পথের প্রান্তে এসে।
সুখের দুখের কথা
একটুখানি ভাবব এমন সময় ছিল কোথা?
এই জীবনটা ভালো কিম্বা মন্দ কিম্বা যা-হোক-একটা কিছু
সে কথাটা বুঝব কখন, দেখব কখন ভেবে আগুপিছু?
একটানা এক ক্লান্ত সুরে
কাজের চাকা চলছে ঘুরে ঘুরে।
বাইশ বছর রয়েছি সেই এক চাকাতেই বাঁধা

পাকের ঘোরে আঁধা।
জানি নাই তো আমি যে কী, জানি নাই এ বৃহৎ বসুন্ধরা
কী অর্থে যে ভরা।
শুনি নাই তো মানুষের কী বাণী
মহাকালের বীণায় বাজে। আমি কেবল জানি,
রাঁধার পরে খাওয়া আবার খাওয়ার পরে রাঁধা—
বাইশ বছর এক চাকাতেই বাঁধা—
মনে হচ্ছে, সেই চাকাটা ওই-যে থামল যেন
থামুক তবে। আবার ওষুধ কেন?

বসন্তকাল বাইশ বছর এসেছিল বনের আঙিনায়।
গন্ধে-বিভোল দক্ষিণবায়
দিয়েছিল জলস্থলের মর্মদোলায় দোল;
হেঁকেছিল, ‘খোল্ রে, দুয়ার খোল।’
সে যে কখন আসত যেত জানতে পেতেম না যে।
হয়তো মনের মাঝে
সংগোপনে দিত নাড়া; হয়তো ঘরের কাজে
আচম্বিতে ভুল ঘটাত; হয়তো বাজত বুকে
জন্মান্তরের ব্যথা; কারণ-ভোলা দুঃখে সুখে
হয়তো পরান রইত চেয়ে যেন রে কার পায়ের শব্দ শুনে
বিহ্বল ফাল্গুনে।
তুমি আসতে আপিস থেকে, যেতে সন্ধ্যাবেলায়
পাড়ায় কোথা সতরঞ্চ-খেলায়।
থাক্‌ সে কথা।
আজকে কেন মনে আসে প্রাণের যত ক্ষণিক ব্যাকুলতা।

প্রথম আমার জীবনে এই বাইশ বছর পরে
বসন্তকাল এসেছে মোর ঘরে।

জানলা দিয়ে চেয়ে আকাশ-পানে
আনন্দে আজ ক্ষণে ক্ষণে জেগে উঠছে প্রাণে—
আমি নারী, আমি মহীয়সী,
আমার সুরে সুর বেঁধেছে জ্যোৎস্নাবীণায় নিদ্রাবিহীন শশী।
আমি নইলে মিথ্যা হ’ত সন্ধ্যাতারা-ওঠা,
মিথ্যা হ’ত কাননে ফুল-ফোটা।

বাইশ বছর ধ’রে
মনে ছিল, বন্দী আমি অনন্তকাল তোমাদের এই ঘরে।
দুঃখ তবু ছিল না তার তরে—
অসাড় মনে দিন কেটেছে, আরো কাটত আরো বাঁচলে পরে।
যেথায় যত জ্ঞাতি
লক্ষ্মী ব’লে করে আমার খ্যাতি;
এই জীবনে সেই যেন মোর পরম সার্থকতা—
ঘরের কোণে পাঁচের মুখের কথা।
আজকে কখন মোর
কাটল বাঁধন-ডোর।
জনম মরণ এক হয়েছে ওই-যে অকূল বিরাট মোহানায়,
ওই অতলে কোথায় মিলে যায়
ভাঁড়ার ঘরের দেওয়াল যত
একটু ফেনার মতো।

এতদিনে প্রথম যেন বাজে
বিয়ের বাঁশি বিশ্ব-আকাশ-মাঝে।
তুচ্ছ বাইশ বছর আমার ঘরের কোণের ধুলায় পড়ে থাক্।
মরণ-বাসর-ঘরে আমায় যে দিয়েছে ডাক
দ্বারে আমার প্রার্থী সে যে, নয় সে কেবল প্রভু—
হেলা আমায় করবে না সে কভু।

চায় সে আমার কাছে
আমার মাঝে গভীর গোপন যে সুধারস আছে।
গ্রহতারার সভার মাঝারে সে
ওই-যে আমার মুখে চেয়ে দাঁড়িয়ে হোথায় রইল নির্নিমেষে
মধুর ভুবন, মধুর আমি নারী,
মধুর মরণ, ওগো আমার অনন্ত ভিখারি।
দাও খুলে দাও দ্বার—
ব্যর্থ বাইশ বছর হতে পার করে দাও কালের পারাবার।