সঞ্চয়িতা/লীলাসঙ্গিনী

উইকিসংকলন থেকে

লীলাসঙ্গিনী

দুয়ার বাহিরে যেমনি চাহি রে মনে হল যেন চিনি—
কবে নিরুপমা ওগো প্রিয়তমা, ছিলে লীলাসঙ্গিনী!
কাজে ফেলে মোরে চলে গেলে কোন্ দূরে,
মনে পড়ে গেল আজি বুঝি বন্ধুরে?
ডাকিলে আবার কবেকার চেনা সুরে, বাজাইলে কিঙ্কিণী।
বিশ্বরণের গোধূলিক্ষণের আলোকে তোমারে চিনি।

এলো চুলে ব’হে এনেছ কী মোহে সেদিনের পরিমল?
বকুলগন্ধে আনে বসন্ত কবেকার সম্বল?
চৈত্র-হাওয়ায় উতলা কুঞ্জ-মাঝে
চারু চরণের ছায়ামঞ্জীর বাজে—
সে দিনের তুমি এলে এ দিনের সাজে ওগো চিরচঞ্চল।
অঞ্চল হতে ঝরে বায়ুস্রোতে সে দিনের পরিমল।

মনে আছে সে কি সব কাজ সখী, ভুলায়েছ বারে বারে?
বন্ধ দুয়ার খুলেছ আমার কঙ্কণঝংকারে।
ইশারা তোমার বাতাসে বাতাসে ভেসে
ঘুরে ঘুরে যেত মোর বাতায়নে এসে
কখনো আমের নবমুকুলের বেশে, কভু নবমেঘভারে।
চকিতে চকিতে চল-চাহনিতে ভুলায়েছ বারে বারে।

নদীকূলে-কূলে কল্লোল তুলে গিয়েছিলে ডেকে ডেকে।
বনপথে আসি করিতে উদাসি কেতকীর রেণু মেখে।
বর্ষাশেষের গগনকোনায়-কোনায়,
সন্ধ্যামেঘের পুঞ্জ সোনায় সোনায়
নির্জন খনে কখন অন্যমনায় ছুঁয়ে গেছ থেকে থেকে।
কখনে। হাসিতে কখনো বাঁশিতে গিয়েছিলে ডেকে ডেকে।

কী লক্ষ্য নিয়ে এসেছ এ বেলা কাজের কক্ষকোণে?
সাথি খুঁজিতে কি ফিরিছ একেলা তব খেলা প্রাঙ্গণে?
নিয়ে যাবে মোরে নীলাম্বরের তলে
ঘরছাড়া যত দিশাহারাদের দলে—
অযাত্রাপথে যাত্রী যাহারা চলে নিষ্ফল আয়োজনে?
কাজ ভোলাবারে ফের বারে বারে কাজের কক্ষকোণে।

আবার সাজাতে হবে আভরণে মানসপ্রতিমাগুলি?
কল্পনাপটে নেশার বরনে বুলাব রসের তুলি?
বিবাগি মনের ভাবনা ফাগুনপ্রাতে
উড়ে চলে যাবে উৎসুক বেদনাতে
কলগুঞ্জিত মৌমাছিদের সাথে, পাখায় পুষ্পধূলি।
আবার নিভৃতে হবে কি রচিতে মানসপ্রতিমাগুলি?

দেখ না কি হায়, বেলা চলে যায়, সারা হয়ে এল দিন!
বাজে পূরবীর ছন্দে রবির শেষ রাগিণীর বীন।
এতদিন হেথা ছিনু আমি পরবাসী,
হারিয়ে ফেলেছি সে দিনের সেই বাঁশি—
আজ সন্ধ্যায় প্রাণ ওঠে নিশ্বাসি গানহারা উদাসীন।
কেন অবেলায় ডেকেছ খেলায়— সারা হয়ে এল দিন।

এবার কি তবে শেষ খেলা হবে নিশীথ-অন্ধকারে?
মনে মনে বুঝি হবে খোঁজাখুঁজি অমাবস্যার পারে?
মালতীলতায় যাহারে দেখেছি প্রাতে
তারায় তারায় তারি লুকাচুরি রাতে?
সুর বেজেছিল যাহার পরশপাতে, নীরবে লভিব তারে?
দিনের দুরাশা স্বপনের ভাষা রচিবে অন্ধকারে?

যদি রাত হয় না করিব ভয়, চিনি যে তোমারে চিনি।
চোখে নাই দেখি, তবু ছলিবে কি হে গোপনরঙ্গিণী?
নিমেষে আঁচল ছুঁয়ে যায় যদি চ’লে
তবু সব কথা যাবে সে আমায় ব’লে—
তিমিরে তোমার পরশলহরী দোলে হে রসতরঙ্গিণী।
হে আমার প্রিয়, আবার ভুলিয়ো, চিনি যে তোমারে চিনি।

 ফাল্গুন ১৩৩০