সঞ্চয়িতা/সুরদাসের প্রার্থনা

উইকিসংকলন থেকে

সুরদাসের প্রার্থনা

ঢাকো ঢাকো মুখ টানিয়া বসন, আমি কবি সুরদাস।
দেবী, আসিয়াছি ভিক্ষা মাগিতে, পুরাতে হইবে আশ।
অতি-অসহন বহ্নিদহন
মর্ম-মাঝারে করি যে বহন,
কলঙ্করাহু প্রতি পলে পলে জীবন করিছে গ্রাস

পবিত্র তুমি, নির্মল তুমি, তুমি দেবী, তুমি সতী—
কুৎসিত দীন অধম পামর পঙ্কিল আমি অতি।
তুমিই লক্ষ্মী, তুমিই শক্তি,
হৃদয়ে আমার পাঠাও ভক্তি—
পাপের তিমির পুড়ে যায় জ্বলে কোথা সে পুণ্যজ্যোতি।

দেবের করুণা মানবী-আকারে,
আনন্দধারা বিশ্ব-মাঝারে,
পতিতপাবনী গঙ্গা যেমন এলেন পাপীর কাজে,
তোমার চরিত রবে নির্মল,
তোমার ধর্ম রবে উজ্জ্বল
আমার এ পাপ করি দাও লীন তোমার পুণ্য-মাঝে।

তোমারে কহিব লজ্জাকাহিনী, লজ্জা নাহিকো তায়—
তোমার আভায় মলিন লজ্জা পলকে মিলায়ে যায়।
যেমন রয়েছ তেমনি দাঁড়াও,
আঁখি নত করি আমা-পানে চাও—
খুলে দাও মুখ, আনন্দময়ী, আবরণে নাহি কাজ।
নিরখি তোমারে ভীষণ-মধুর,
আছ কাছে তবু আছ অতি দূর—
উজ্জ্বল যেন দেবরোষানল, উদ্যত যেন বাজ।

জান কি আমি এ পাপ আঁখি মেলি তোমারে দেখেছি চেয়ে?
গিয়েছিল মোর বিভোর বাসনা ওই মুখ-পানে ধেয়ে।
তুমি কি তখন পেরেছ জানিতে—
বিমল হৃদয়-আরশিখানিতে
চিহ্ন কিছু কি পড়েছিল এসে নিশ্বাসরেখাছায়া,
ধরার কুয়াশা ম্লান করে যথা আকাশ-ঊষার কায়া।

লজ্জা সহসা আসি অকারণে
বসনের মতো রাঙা আবরণে
চাহিয়াছিল কি ঢাকিতে তোমায় লুব্ধ নয়ন হতে?
মোহচঞ্চল সে লালসা মম
কৃষ্ণবরন ভ্রমরের সম
ফিরিতেছিল কি গুন্‌গুন্ কেঁদে তোমার দৃষ্টিপথে?

আনিয়াছি ছুরি তীক্ষ্ণ দীপ্ত প্রভাতরশ্মিসম;
লও, বিঁধে দাও বাসনাসঘন এ কালো নয়ন মম।
এ আঁখি আমার শরীরে তো নাই, ফুটেছে মর্মতলে—
নির্বাণহীন অঙ্গারসম নিশিদিন শুধু জ্বলে।
সেথা হতে তারে উপাড়িয়া লও জ্বালাময় দুটো চোখ;
তোমার লাগিয়া তিয়াষ যাহার সে আঁখি তোমারি হোক।

অপার ভুবন, উদার গগন, শ্যামল কাননতল,
বসন্ত অতি মুগ্ধমুরতি, স্বচ্ছ নদীর জল,
বিবিধবরন সন্ধ্যানীরদ, গ্রহতারাময়ী নিশি,
বিচিত্রশোভা শস্যক্ষেত্র প্রসারিত দূর দিশি,
সুনীল গগনে ঘনতর নীল অতিদূর গিরিমালা,
তারি পরপারে রবির উদয় কনককিরণ-জ্বালা,
চকিতড়িৎ সঘন বরষা, পূর্ণ ইন্দ্রধনু,
শরৎ-আকাশে অসীমবিকাশ জ্যোৎস্না শুভ্রতনু—
লও, সব লও, তুমি কেড়ে লও, মাগিতেছি অকপটে—
তিমিরতুলিকা দাও বুলাইয়া আকাশচিত্রপটে।

ইহারা আমারে ভুলায় সতত, কোথা নিয়ে যায় টেনে;
মাধুরীমদিরা পান ক’রে শেষে প্রাণ পথ নাহি চেনে।
সবে মিলে যেন বাজাইতে চায় আমার বাঁশরি কাড়ি;
পাগলের মতো রচি নব গান, নব নব তান ছাড়ি।

আপন ললিত রাগিণী শুনিয়া আপনি অবশমন;
ডুবাইতে থাকে কুসুমগন্ধ বসন্তসমীরণ।
আকাশ আমারে আকুলিয়া ধরে, ফুল মোরে ঘিরে বসে—
কেমনে না জানি জ্যোৎস্নাপ্রবাহ সর্বশরীরে পশে।
ভুবন হইতে বাহিরিয়া আসে ভুবনমোহিনী মায়া;
যৌবনভরা বাহুপাশে তার বেষ্টন করে কায়া।
চারি দিকে ঘিরি করে আনাগোনা কল্পমুরতি কত;
কুসুমকাননে বেড়াই ফিরিয়া যেন বিভোরের মতো।

শ্লথ হয়ে আসে হৃদয়তন্ত্রী, বীণা খসে যায় পড়ি;
নাহি বাজে আর হরিনামগান বরষ বরষ ধরি।
হরিহীন সেই অনাথ বাসনা পিয়াসে জগতে ফিরে;
বাড়ে তৃষা, কোথা পিপাসার জল অকূল লবণনীরে!
গিয়েছিল দেবী, সেই ঘোর তৃষা তোমার রূপের ধারে;
আঁখির সহিতে আঁখির পিপাসা লোপ করো একেবারে।

ইন্দ্রিয় দিয়ে তোমার মূর্তি পশেছে জীবনমূলে;
এই ছুরি দিয়ে সে মুরতিখানি কেটে কেটে লও তুলে।
তারি সাথে হায় আঁধারে মিশাবে নিখিলের শোভা যত—
লক্ষ্মী যাবেন, তাঁরি সাথে যাবে জগৎ ছায়ার মতো।

যাক, তাই যাক, পারি নে ভাসিতে কেবলি মুরতিস্রোতে;
লহো মোরে তুলে আলোকমগন মুরতিভুবন হতে।
আঁখি গেলে মোর সীমা চলে যাবে; একাকী অসীম-ভরা
আমারি আঁধারে মিলাবে গগন, মিলাবে সকল ধরা।
আলোহীন সেই বিশাল হৃদয়ে আমার বিজন বাস;
প্রলয়-আসন জুড়িয়া বসিয়া রব আমি বারো মাস।

থামে। একটুকু; বুঝিতে পারি নে, ভালো করে ভেবে দেখি
বিশ্ববিলোপ বিমল আঁধার চিরকাল রবে সেকি।

ক্রমে ধীরে ধীরে নিবিড় তিমিরে ফুটিয়া উঠিবে নাকি
পবিত্র মুখ, মধুর মূর্তি, স্নিগ্ধ আনত আঁখি?
এখন যেমন রয়েছ দাঁড়ায়ে দেবীর প্রতিমা সম,
স্থির গম্ভীর করুণ নয়নে চাহিছ হৃদয়ে মম,
বাতায়ন হতে সন্ধ্যাকিরণ পড়েছে ললাটে এসে,
মেঘের আলোক লভিছে বিরাম নিবিড়তিমির কেশে—
শান্তিরূপিণী এ মুরতি তব অতি অপূর্ব সাজে
অনলরেখায় ফুটিয়া উঠিবে অনন্তনিশি-মাঝে।
চৌদিকে তব নূতন জগৎ আপনি সৃজিত হবে;
এ সন্ধ্যাশোভা তোমারে ঘিরিয়া চিরকাল জেগে রবে।
এই বাতায়ন, ওই চাঁপাগাছ, দূর সরযূর রেখা,
নিশিদিনহীন অন্ধ হৃদয়ে চিরদিন যাবে দেখা।
সে নব জগতে কালস্রোত নাই, পরিবর্তন নাহি—
আজি এই দিন অনন্ত হয়ে চিরদিন রবে চাহি।

তবে তাই হোক, হোয়ো না বিমুখ— দেবী, তাহে কিবা ক্ষতি,
হৃদয়-আকাশে থাক্‌-না জাগিয়া দেহহীন তব জ্যোতি।
বাসনামলিন আঁখিকলঙ্ক ছায়া ফেলিবে না তায়,
আঁধার হৃদয় নীল-উৎপল চিরদিন রবে পায়।
তোমাতে হেরিব আমার দেবতা, হেরিব আমার হরি—
তোমার আলোকে জাগিয়া রহিব অনন্ত বিভাবরী।

 ২২ ও ২৩ জ্যৈষ্ঠ ১২৯৫