বিষয়বস্তুতে চলুন

সটীক মেঘনাদবধ কাব্য/তৃতীয় সর্গ

উইকিসংকলন থেকে

তৃতীয় সর্গ

প্রমোদ-উদ্যানে কাঁদে দানব-নন্দিনী
প্রমীলা, পতি-বিরহে কাতরা যুবতী।
অশ্রু-আঁখি বিধুমুখী ভ্রমে ফুলবনে
কভু, ব্রজ-কুঞ্জ-বনে, হায় রে, যেমতি
ব্রজবালা, নাহি হেরি কদম্বের মূলে
পীতধড়া পীতাম্বরে, অধরে মুরলী।
কভু বা মন্দিরে পশি, বাহিরায় পুনঃ
বিরহিণী, শূন্য-নীড়ে কপোতী যেমতি
বিবশা! কভু বা উঠি উচ্চ-গৃহ-চূড়ে,
একদৃষ্টে চাহে বামা দূর লঙ্কাপানে,
অবিরল চক্ষুঃজল মুছিয়া আঁচলে!—
নীরব বাঁশরী, বীণা, মুরজ, মন্দিরা,
গীত-ধ্বনি। চারিদিকে সখী-দল যত
বিরস-বদন, মরি, সুন্দরীর শোকে!
কে না জানে ফুলকুল বিরস-বদনা,
মধুর বিরহে যবে তাপে বনস্থলী?
উতরিলা নিশা-দেবী প্রমোদ-উদ্যানে
শিহরি প্রমীলা-সতী, মৃদু কল-স্বরে,

তার গলা ধরি কাঁদি, কহিতে লাগিলা;—
“ওই দেখ, আইল লো তিমির-যামিনী,
কাল-ভুজঙ্গিনী-রূপে দংশিতে আমারে,
বাসন্তি! কোথায়, সখি, রক্ষঃ-কুল-পতি,
অরিন্দম ইন্দ্রজিৎ, এ বিপত্তি-কালে?
এখনি আসিব বলি, গেলা চলি বলী;
কি কাজে এ ব্যাজ আমি বুঝিতে না পারি
তুমি যদি পার সই, কহ লো আমারে।”
কহিলা বাসন্তী সখী, বসন্তে যেমতি
কুহরে বসন্তসখা;—“কেমনে কহিব,
কেন প্রাণনাথ তব বিলম্বেন আজি?
কিন্তু চিন্তা দূর তুমি কর, সীমন্তিনি!
ত্বরায় আসিবে শূর নাশিয়া রাঘবে।
কি ভয় তোমার সখি? সুরাসুর শরে
অভেদ্য শরীর যাঁর, কে তাঁরে আঁটিবে
বিগ্রহে? আইস, মোরা যাই কুঞ্জবনে।
সরস-কুসুম তুলি, চিকণিয়া গাঁথি
ফুলমালা। দোলাইও হাসি প্রিয়-গলে
সে দামে, বিজয়ী রথ-চুড়ায় যেমতি
বিজয়-পতাকা লোক উড়ায় কৌতুকে।”
এতেক কহিয়া দোঁহে পশিলা কাননে,
যথায় সরসীসহ খেলিছে কৌমুদী

হাসাইয়া কুমুদেরে; গাইছে ভ্রমরী;
কুহরিছে পিকবর; কুসুম ফুটিছে;
শোভিছে আনন্দময়ী বনরাজী-ভালে
(মণিময় সিঁথিরূপে) জোনাকের পাঁতি;
বহিছে মলয়ানিল, মর্ম্মরিছে পাতা।
আঁচল ভরিয়া ফুল তুলিলা দুজনে।
কত যে ফুলের দলে প্রমীলার আঁখি
মুক্তিল শিশির-নীরে, কে পারে কহিতে?
কতদূরে হেরি বামা, সূর্য্যমুখী দুঃখী,
মলিন বদনা, মরি, মিহির-বিরহে,
দাঁড়াইয়া তার কাছে কহিলা সুশ্বরে;—
“তোর লো যে দশা এই ঘোর নিশাকালে,
ভানুপ্রিয়ে! আমিও লো সহি সে যাতনা!
আঁধার সংসার এবে এ পোড়া নয়নে!
এ পরাণ দহিছে লো বিচ্ছেদ-অনলে!
যে রবির ছবি-পানে চাহি বাঁচি আমি
অহরহঃ, অস্তাচলে আচ্ছন্ন লো তিনি।
আর কি পাইব আমি (ঊষার প্রসাদে
পাইবি যেমতি, সতি, তুই) প্রাণেশ্বরে?”
অবচয়ি ফুলচয়ে সে নিকুঞ্জ-বনে,
বিষাদে নিশ্বাস ছাড়ি, সখীরে সম্ভাষি
কহিলা প্রমীলা সতী;—“এই ত তুলিনু

ফুলরাশি, চিকণিয়া গাঁথিনু স্বজনি,
ফুলমালা; কিন্তু কোথা পাব সে চরণে,
পুষ্পাঞ্জলি দিয়া যাহে চাহি পূজিবারে?
কে বাঁধিল মৃগরাজে বুঝিতে না পারি।
চল, সখি, লঙ্কাপুরে যাই মোরা সবে।”
কহিলা বাসন্তী সখী;—“কেমনে পশিবে,
লঙ্কাপুরে আজি তুমি? অলঙ্ঘ্য-সাগর-
সম রাঘবীয় চমু বেড়িছে তাহারে!
লক্ষ লক্ষ রক্ষঃ-অরি ফিরিছে চৌদিকে
অস্ত্রপাণি, দণ্ডপাণি দণ্ডধর যথা।”
রুষিলা দানববালা, প্রমীলা-রূপসী।—
“কি কহিলি বাসন্তি! পর্ব্বত-গৃহ ছাড়ি
বাহিরায় যবে নদী সিন্ধুর উদ্দেশে,
কার হেন সাধ্য যে সে রোধে তার গতি?
দানবনন্দিনী আমি; রক্ষঃ-কুলবধূ;
রাবণ শ্বশুর মম; মেঘনাদ স্বামী;—
আমি কি ডরাই সখি, ভিখারী রাঘবে?
পশিব লঙ্কায় আজি নিজ ভুজবলে;
দেখিব কেমনে মোরে নিবারে নৃমণি?”
এতেক কহিয়া সতী, গজ-পতি-গতি,
রোষাবেশে প্রবেশিলা সুবর্ণ-মন্দিরে।
যথা যবে পরন্তপ পার্থ মহারথী,

যজ্ঞের তুরঙ্গ সঙ্গে আসি, উতরিলা
নারী-দেশে; দেবদত্ত শঙ্খনাদে রুষি,
রণরঙ্গে বীরাঙ্গনা সাজিল কৌতুকে;—
উথলিল চারিদিকে দুন্দুভির ধ্বনি;
বাহিরিলা বামাদল বীরমদে মাতি,
উলঙ্গিয়া অসিরাশি, কার্ম্মুক টঙ্কারি,
আস্ফালি ফলকপুঞ্জে! ঝক্ ঝক্‌ ঝকি
কাঞ্চন-কঞ্চুক-বিভা উজলিল পুরী।
মন্দুরায় হ্রেষে অশ্ব, ঊর্দ্ধ-কর্ণে শুনি
নূপুরের ঝন্ ঝনি, কিঙ্কিণীর বোলী,
ডমরুর রবে যথা নাচে কাল ফণী।
বারিমাঝে নাদে গজ শ্রবণ বিদরি,
গম্ভীর নির্ঘোষে যথা ঘোষে ঘনপতি
দূরে! রঙ্গে গিরিশৃঙ্গে, কাননে, কন্দরে,
নিদ্রা ত্যজি প্রতিধ্বনি জাগিলা অমনি;—
সহসা পূরিল দেশ ঘোর-কোলাহলে।
নৃ-মুণ্ড-মালিনীনামে উগ্রচণ্ডা ধনী,
সাজাইয়া শত বাজী বিবিধ সাজনে,
মন্দুরা হইতে আনে অলিন্দের কাছে
আনন্দে। চড়িলা ঘোড়া এক শত চেড়ী।
অশ্ব-পার্শ্বে কোষে অসি বাজিল ঝন্‌ঝনি।
নাচিল শীর্ষক চূড়া; দুলিল কৌতকে

পৃষ্ঠে মণিময় বেণী তৃণীরের সাথে।
হাতে শূল, কমলে কণ্টকময় যথা
মৃণাল। হ্রেষিল অশ্ব মগন হরষে,
দানব দলনী-পদ্ম-পদ-যুগ ধরি
বক্ষে, বিরূপাক্ষ সুখে নাদেন যেমতি!
বাজিল সমর-বাদ্য; চমকিলা দিবে
অমর, পাতালে নাগ, নর নরলোকে।
রোষে লাজ ভয় ত্যজি, সাজে তেজস্বিনী
প্রমীলা। কিরীটছটা কবরী-উপরি,
হায় রে, শোভিল যথা কাদম্বিনী-শিরে
ইন্দ্রচাপ! লেখা ভালে অঞ্জনের রেখা,
ভৈরবীর ভালে যথা নয়নরঞ্জিকা
শশিকলা! উচ্চ-কুচ আবরি কবচে
সুলোচনা, কটিদেশ যতনে আঁটিলা
বিবিধ রতনময় স্বর্ণ-সারসনে।
নিষঙ্গের সঙ্গে পৃষ্ঠে ফলক দুলিল,
রবির পরিধি হেন ধাঁধিয়া নয়নে!
ঝক্‌ঝকি ঊরুদেশে (হায় রে, বর্ত্তুল
যথা রম্ভা-বন-আভা!) হৈমময় কোষে
শোভে খরশাণ অসি; দীর্ঘ শূল করে;
ঝলমলি ঝলে অঙ্গে নানা আভরণ!
সাজিলা দানববালা, হৈমবতী যথা

নাশিতে মহিষাসুরে ঘোরতর রণে,
কিম্বা শুম্ভ-নিশুম্ভ, উন্মাদ বীর-মদে।
ডাকিনী-যোগিনী-সম বেড়িলা সতীরে
অশ্বারূঢ়া চেড়ীবৃন্দ! চড়িলা সুন্দরী
বড়বানামেতে বামী—বাড়বাগ্নি-শিখা!
গম্ভীরে অম্বরে যথা নাদে কাদম্বিনী,
উচ্চৈঃস্বরে নিতম্বিনী কহিলা সম্ভাষি
সখীবৃন্দে;—“লঙ্কাপুরে, শুন লো দানবি!
অরিন্দম ইন্দ্রজিৎ বন্দী-সম এবে!
কেন যে দাসীরে ভুলি বিলম্বেন তথা
প্রাণনাথ, কিছু আমি না পারি বুঝিতে!
যাইব তাঁহার পাশে; পশিব নগরে
বিকট কটক কাটি, জিনি ভুজবলে
রঘুশ্রেষ্ঠে;—এ প্রতিজ্ঞা, বীরাঙ্গনা মম;
নতুবা মরিব রণে—যা থাকে কপালে!
দানব-কুল-সম্ভবা আমরা, দানবি!—
দানবকুলের বিধি বধিতে সমরে,
দ্বিষৎ-শোণিত-নদে, নতুবা ডুবিতে!
অধরে ধরি লো মধু, গরল লোচনে
আমরা; নাহি কি বল এ ভুজ-মৃণালে?
চল সবে, রাখবের হেরি বীরপণা।
দেখিব, যে রূপ দেখি শূর্পণখা পিসী

মাতিল মদন-মদে পঞ্চবটী বনে;
দেখিব লক্ষ্মণ-শূরে; নাগপাশ দিয়া
বাঁধি লব বিভীষণে—রক্ষঃকুলাঙ্গারে!
দলিব বিপক্ষ-দলে, মাতঙ্গিনী যথা
নলবন। তোমরা লো বিদ্যুৎ-আকৃতি,
বিদ্যুতের গতি চল, পড়ি অরি মাঝে!”
নাদিল দানব-বালা হুহুঙ্কার-রবে,
মাতঙ্গিনীযূথ যথা মত্ত মধু-কালে!
যথা রায়ু সখা সহ দাবানলগতি
দুর্ব্বার, চলিলা সতী পতির উদ্দেশে।
টলিল কনক-লঙ্কা, গর্জ্জিল জলধি;
ঘনঘনাকারে রেণু উড়িল চৌদিকে;—
কিন্তু নিশাকালে কবে ধূমপুঞ্জ পারে
আবরিতে অগ্নিশিখা? অগ্নিশিখা তেজে
চলিলা প্রমীলা দেবী বামা-বল-দলে!
কতক্ষণে উতরিলা পশ্চিম দুয়ারে
বিধুমুখী। একেবারে শত শঙ্খ ধরি
ধ্বনিলা, টঙ্কারি রোষে শত ভীম-ধনু,
স্ত্রীবৃন্দ! কাঁপিল লঙ্কা আতঙ্কে; কাঁপিল
মাতঙ্গে নিষাদী; রথে রথী; তুরঙ্গমে
সাদীবর; সিংহাসনে রাজা; অবরোধে
কুলবধূ; বিহঙ্গম কাঁপিল কুলায়ে;

পর্ব্বত-গহ্বরে সিংহ; বনহস্তী বনে;
ডুবিল অতল-জলে জলচর যত।
পবননন্দন হনু ভীষণ-দর্শন,
রোষে অগ্রসরি শূর গরজি কহিলা;—
“কে তোরা এ নিশাকালে আইলি মরিতে?
জাগে এ দুয়ারে হনু, যার নাম শুনি
থরথরি রক্ষোনাথ কাঁপে সিংহাসনে!
আপনি জাগেন প্রভু রঘুকুলমণি,
সহ মিত্র বিভীষণ, সৌমিত্রি কেশরী,
শত শত বীর আর—দুর্দ্ধর্ষ সমরে।
কি রঙ্গে অঙ্গনাবেশ ধরিলি দুর্ম্মতি?
জানি আমি নিশাচর পরম মায়াবী।
কিন্তু মায়াবল আমি টুটি বাহুবলে,—
যথা পাই মারি অরি ভীম-প্রহরণে।”
নৃ-মুণ্ডমালিনী-সখী (উগ্রচণ্ডা ধনী)
কোদণ্ড টঙ্কারি রোষে কহিলা হুঙ্কারে;—
“শীঘ্র ডাকি আন্ হেথা, তোর সীতানাথে,
বর্ব্বর! কে চাহে তোরে, তুই ক্ষুদ্রজীবী!
নাহি মারি অস্ত্র মোরা তোর সম জনে
ইচ্ছায়। শৃগালসহ সিংহী কি বিবাদে?
দিনু ছাড়ি; প্রাণ ল’য়ে পালা বনবাসি
কি ফল বধিলে তোরে অবোধ! যা চলি,

ডাক্ সীতানাথে হেথা, লক্ষ্মণ-ঠাকুরে,
রাক্ষস-কুল-কলঙ্ক ডাক্‌ বিভীষণে!
অরিন্দম ইন্দ্রজিৎ—প্রমীলা-সুন্দরী
পত্নী তাঁর, বাহুবলে প্রবেশিবে এবে
লঙ্কাপুরে, পতিপদ পূজিতে যুবতী।
কোন্ যোধ সাধ্য, মূঢ়, রোধিতে তাঁহারে?”
প্রবল পবন-বলে বলীন্দ্র পাবনি
হনু, অগ্রসরি শূর, দেখিলা সভয়ে
বীরাঙ্গনা-মাঝে রঙ্গে প্রমীলা দানবী।
ক্ষণপ্রভা-সম বিভা খেলিছে কিরীটে;
শোভিছে বরাঙ্গে বর্ম্ম, সৌর-অংশু-রাশি,
মণি-আভা-সহ মিশি, শোভয়ে যেমতি!
বিস্ময় মানিয়া হনু ভাবে মনে মনে;—
“অলঙ্ঘ্য সাগর লঙ্ঘি, উতরিনু যবে
লঙ্কাপুরে, ভয়ঙ্করী হেরিনু ভীমারে,
প্রচণ্ডা, খর্পর খণ্ডা হাতে মুণ্ডমালী।
দানব-নন্দিনী যত মন্দোদরী আদি
রাবণের প্রণয়িনী, দেখি তা সবে।
রক্ষঃকুল-বালাদলে, রক্ষঃ-কুল-বধূ,
(শশিকলা-সম-রূপে) ঘোর নিশাকালে,
দেখিনু সকলে একা ফিরি ঘরে ঘরে।
দেখিনু অশোকবনে (হায় শোকাকুলা)

রঘুকুল-কমলেরে;—কিন্তু নাহি হেরি
এ হেন রূপ-মাধুরী কভু এ ভুবনে!
ধন্য বীর মেঘনাদ, যে মেঘের পাশে
প্রেম-পাশে বাঁধা সদা, হেন সৌদামিনী!”
এতেক ভাবিয়া মনে অঞ্জনা-নন্দন
(প্রভঞ্জন স্বনে যথা) কহিলা গম্ভীরে;—
“বন্দীসম শিলাবন্ধে বাঁধিয়া সিন্ধুরে,
হে সুন্দরি! প্রভু মম, রবি-কুল-রবি,
লক্ষ লক্ষ বীর সহ আইলা এ পুরে।
রক্ষোরাজ বৈরী তাঁর; তোমরা অবলা,
কহ, কি লাগিয়া হেথা আইলা অকালে?
নির্ভয়-হৃদয়ে কহ; হনুমান আমি
রঘুদাস; দয়া-সিন্ধু রঘু-কুল-নিধি।
তব সাথে কি বিবাদ তাঁর, সুলোচনে!
কি প্রসাদ মাগ তুমি, কহ ত্বরা করি,
কি হেতু আইলা হেথা? কহ, জানাইব
তব আবেদন, দেবি, রাঘবের পদে।”
উত্তর করিলা সতী,—হায় রে, সে বাণী
ধ্বনিল হনুর কাণে বীণাবাণী যথা
মধুমাখা!—“রঘুবর, পতি-বৈরী মম;
কিন্তু তা বলিয়া আমি কভু না বিবাদি
তাঁর সঙ্গে! পতি মম বীরেন্দ্র-কেশরী,

নিজ-ভুজবলে তিনি ভুবন-বিজয়ী;
কি কাজ আমার যুঝি তাঁর রিপুসহ?
অবলা, কুলের বালা, আমরা সকলে।
কিন্তু ভেবে দেখ, বীর, যে বিদ্যুৎ-ছটা
রমে আঁখি, মরে নর, তাহার পরশে।
লও সঙ্গে, শূর, তুমি, ওই মোর দূতী।
কি যাচ্ঞা করি আমি রামের সমীপে,
বিবরিয়া কবে রামা, যাও ত্বরা করি।”
নৃ-মুণ্ড-মালিনী দূতী, নৃ-মুণ্ডমালিনী
আকৃতি, পশিলা ধনী অরি-দলমাঝে
নির্ভয়ে, চলিলা যথা গরুত্মতী তরী,
তরঙ্গ-নিকরে রঙ্গে করি অবহেলা,
অকূল-সাগর জলে ভাসে একাকিনী।
আগে আগে চলে হনূ পথ দেখাইয়া।
চমকিলা বীরবৃন্দ, হেরিয়া বামারে;
চমকে গৃহস্থ যথা ঘোর নিশাকালে
হেরি অগ্নিশিখা ঘরে! হাসিলা ভামিনী
মনে মনে। একদৃষ্টে চাহে বীর যত
দড়ে রড়ে, জড় সবে হ’য়ে স্থানে স্থানে।
বাজিল নূপুর পায়ে, কাঞ্চী কটিদেশে।
ভীমাকার শূল করে, চলে নিতম্বিনী
জরজরি সর্ব্বজনে কটাক্ষের শরে

তীক্ষ্ণতর। শিরোপরি শীর্ষকের চূড়া,
চন্দ্রক-কলাপময়, নাচে কুতূহলে;
ধক্‌ধকে রত্নাবলী কুচযুগমাঝে
পীবর! দুলিছে পৃষ্ঠে মণিময় বেণী,
কামের পতাকা যথা উড়ে মধুকালে।
নব মাতঙ্গিনী-গতি চলিলা রঙ্গিণী,
আলো করি দশদিশ, কৌমুদী যেমতি,
কুমুদিনী-সখী, ঝলে বিমল-সলিলে
কিম্বা ঊষা, অংশুময়ী গিরিশৃঙ্গ-মাঝে!
শিবিরে বসেন প্রভু রঘুচূড়ামণি;
করপুটে শূরসিংহ লক্ষ্মণ সম্মুখে,
পাশে বিভীষণ সখা, আর বীর যত,
রুদ্রকুল-সম তেজঃ, ভৈরব-মূরতি।
দেব-দত্ত অস্ত্রপুঞ্জ শোভে পিঠোপরি,
রঞ্জিত রঞ্জন রাগে, কুসুম-অঞ্জলি
আবৃত; পুড়িছে ধূপ ধূমি ধূপদানে;
সারি সারি চারিদিকে জ্বলিছে দেউটী।
বিস্ময়ে চাহেন সবে দেব-অস্ত্রপানে।
কেহ বাখানেন খড়্গ; চর্ম্ম-বর কেহ,
সুবর্ণ-মণ্ডিত যথা দিবা-অবসানে
রবির প্রসাদে মেঘ; তূণীর কেহ বা,
কেহ বর্ম্ম তেজোরাশি। আপনি সুমতি

ধরি ধনু-বরে করে, কহিলা রাঘব;—
“বৈদেহীর স্বপ্নস্বরে ভাঙিনু পিণাকে
বাহুবলে; এ ধনুকে নারি গুণ দিতে!
কেমনে লক্ষ্মণ ভাই, নোয়াইবে এরে?”
সহসা নাদিল ঠাট; জয়রাম ধ্বনি
উঠিল আকাশ-দেশে ঘোর-কোলাহলে,
সাগর-কল্লোল যথা; ত্রস্তে রক্ষোরথী,
দাশরথি পানে চাহি, কহিলা কেশরী;—
“চেয়ে দেখ, রাঘবেন্দ্র, শিবির-বাহিরে।
নিশীথে কি ঊষা আসি উত্তরিলা হেথা?”
বিস্ময়ে চাহিলা সবে শিবির-বাহিরে।
“ভৈরবীরূপিণী বামা” কহিলা নৃমণি;—
“দেবী কি দানবী, সখে, দেখ নিরখিয়া।
মায়াময় লঙ্কাধাম; পূর্ণ ইন্দ্রজালে;
কামরূপী তবাগ্রজ। দেখ ভাল করি;
এ কুহক তব কাছে অবিদিত নহে।
শুভক্ষণে রক্ষোবর, পাইনু তোমারে
আমি! তোমা বিনা, মিত্র, কে আর রাখিবে
এ দুর্ব্বল বলে, কহ, এ বিপত্তিকালে?
রামের চির-রক্ষণ তুমি রক্ষঃপুরে!”
হেনকালে হনূ সহ উত্তরিলা দূতী
শিবিরে। প্রণমি বামা কৃতাঞ্জলিপুটে,

(ছত্রিশ রাগিণী যেন মিলি একতানে)
কহিলা;—“প্রণমি আমি রাঘবের পদে,
আর যত গুরুজনে;—নৃ-মুণ্ডমালিনী
নাম মম; দৈত্যবালা প্রমীলা-সুন্দরী,
বীরেন্দ্রকেশরী ইন্দ্রজিতের কামিনী,
তাঁর দাসী।” আশীষিয়া, বীর দাশরথি
সুধিলা,—“কি হেতু দূতি! গতি, হেথা তব?
বিশেষিয়া কহ মোরে, কি কাজে তুষিব
তোমার ভর্ত্রিনী শুভে! কহ শীঘ্র করি।”
উত্তরিলা ভীমারূপী;—“বীরশ্রেষ্ঠ তুমি
রঘুনাথ; আসি যুদ্ধ কর তাঁর সাথে;
নতুবা ছাড়হ পথ; পশিবে রূপসী
স্বর্ণ-লঙ্কাপুরে আজি পূজিতে পতিরে।
বধেছ অনেক রক্ষঃ নিজ ভুজবলে;
রক্ষোবধূ মাগে রণ, দেহ রণ তারে,
বীরেন্দ্র! রমণী শত মোরা যাহে চাহ,
যুঝিবে সে একাকিনী। ধনুর্ব্বান ধর,
ইচ্ছা যদি নরবর; নহে চর্ম্ম অসি,
কিম্বা গদা; মল্লযুদ্ধে সদা মোরা রত।
যথারুচি কর দেব; বিলম্ব না সহে।
তব অনুরোধে সতী রোধে সখীদলে,
চিত্রবাঘিনীরে যেথা রোধে কিরাতিনী,

মাতে যবে ভয়ঙ্করী—হেরি মৃগপালে।”
এতেক কহিয়া রামা শিরঃ নোয়াইলা,
প্রফুল্ল কুসুম যথা (শিশির-মণ্ডিত)
বন্দে নোয়াইয়া শিরঃ মন্দ সমীরণে।
উত্তবিলা রঘুপতি;—শুন সুকেশিনি,
বিবাদ না করি আমি কভু অকারণে।
অরি মম রক্ষঃপতি; তোমরা সকলে
কুলবালা কুলবধূ, কোন্ অপরাধে
বৈরিভাব আচরিব তোমাদের সাথে?
আনন্দে প্রবেশ লঙ্কা নিঃশঙ্ক হৃদয়ে।
জনম রামের রামা, রঘুরাজকুলে
বীরেশ্বর; বীরপত্নী, হে সুনেত্রা দূতি!
তব ভর্ত্রী, বীরাঙ্গনা সখী তাঁর যত।
কহ তাঁরে, শতমুখে বাখানি ললনে,
তাঁর পতিভক্তি আমি, শক্তি, বীরপণা—
বিনা রণে পরিহার মাগি তাঁর কাছে।
ধন্য ইন্দ্রজিৎ! ধন্য প্রমীলা-সুন্দরি!
ভিখারী রাঘব, দূতি, বিদিত জগতে;
বনবাসী, ধনহীন বিধি-বিড়ম্বনে;
কি প্রসাদ, সুবদনে, (সাজে যা তোমারে)
দিব আজি? সুখে থাক আশীর্ব্বাদ করি!”
এতেক কহিয়া প্রভু কহিলা হনূরে;—

“দেহ ছাড়ি পথ, বলি! অতি সাবধানে,
শিষ্ট-আচরণে তুষ্ট কর বামাদলে।”
প্রণমিয়া সীতানাথে বাহিরিলা দূতী।
হাসিয়া কহিলা মিত্র বিভীষণ;—“দেখ,
প্রমীলার পরাক্রম, দেখ বাহিরিয়া
রঘুপতি! দেখ, দেব, অপূর্ব্ব কৌতুক!
না জানি এ বামাদলে কে আঁটে সমরে,
ভীমারূপী বীর্য্যবতী চামুণ্ডা যেমতি—
রক্তবীজ-কুল অরি?” কহিলা রাঘব;—
“দূতীর আকৃতি দেখি ডরিনু হৃদয়ে,
রক্ষোবর! যুদ্ধ-সাধ ত্যজিনু তখনি।
মূঢ় যে ঘাঁটায়, সখে, হেন বাঘিনীরে
চল, মিত্র, দেখি তব ভ্রাতৃ-পুত্ত্রবধূ।”
যথা দূর দাবানল পশিলে কাননে,
অগ্নিময় দশদিশ; দেখিলা সম্মুখে
রাঘবেন্দ্র, বিভারাশি নির্ধূম আকাশে,
সুবর্ণি বারিদ-পুঞ্জে! শুনিলা চমকি
কোদণ্ড, ঘর্ঘর ঘোর, ঘোড়া দড়বড়ি,
হুহুঙ্কার, কোষে বদ্ধ অসির ঝন্‌ঝনি।
সে রোলের সহ মিশি বাজিছে বাজনা,
ঝড় সঙ্গে বহে যেন কাকলি-লহরী!
উড়িছে পতাকা—রত্ন-সঙ্কলিত আভা;

মন্দগতি আস্কন্দিতে নাচে বাজি-রাজী;
বোলিছে যুঙ্ঘুরাবলী ঘুনু ঘুনু বোলে।
গিরি-চূড়াকৃতি ঠাট দাঁড়ায় দুপাশে
অটল, চলিছে মধ্যে বামাকুলদল।
উপত্যকাপথে যথা মাতঙ্গিনী-যূথ,
গরজে পূরিয়া দেশ, ক্ষিতি টলমলি।
সর্ব্ব-অগ্রে উগ্রচণ্ডা নৃমুণ্ড-মালিনী,
কৃষ্ণ-হয়ারূঢ়া ধনী, ধ্বজদণ্ড করে
হৈমময়; তার পাছে চলে বাদ্যকরী,
বিদ্যাধরী দল যথা, হায় রে ভূতলে
অতুলিত! বীণা, বাঁশী, মৃদঙ্গ, মন্দিরা-
আদি যন্ত্র বাজে মিলি মধুর নিক্কণে!
তার পাছে শূলপাণি বীরাঙ্গনা-মাঝে
প্রমীলা, তারার দলে শশিকলা যথা!
পরাক্রমে ভীমা বামা। খেলিছে চৌদিকে
রতন-সম্ভবা বিভা ক্ষণপ্রভা-সম।
অন্তরীক্ষে সঙ্গে রঙ্গে চলে রতিপতি
ধরিয়া কুসুম-ধনু, মুহুর্ম্মুহুঃ হানি
অব্যর্থ কুসুম-শরে! সিংহপৃষ্ঠে যথা
মহিষমর্দ্দিনী দুর্গা; ঐরারতে শচী
ইন্দ্রাণী; খগেন্দ্র রমা, উপেন্দ্র-রমণী,
শোভে বীর্য্যবর্তী সতী বড়বার পিঠে—

বড়বা, বামী-ঈশ্বরী, মণ্ডিত রতনে।
ধীরে ধীরে, বৈরিদলে যেন অবহেলি,
চলি গেলা বামাকুল। কেহ টঙ্কারিলা
শিঞ্জিনী; হুঙ্কারি কেহ উলঙ্গিলা অসি;
আস্ফালিলা শূলে কেহ; হাসিলা কেহ বা
অট্টহাসে টিট্‌কারি; কেহ বা নাদিলা,
গহন বিপিনে যথা নাদে কেশরিণী,
বীরমদে, কামমদে উন্মাদ ভৈরবী।
লক্ষ্য করি রক্ষোবরে, কহিলা রাঘব;—
“কি আশ্চর্য্য, নৈকষেয়! কভু নাহি দেখি,
কভু নাহি শুনি হেন, এ তিন ভুবনে!
নিশার স্বপন আজি দেখিনু কি জাগি?
সত্য করি কহ মোরে, মিত্র-রত্নোত্তম!
না পারি বুঝিতে কিছু; চঞ্চল হইনু
এ প্রপঞ্চ দেখি, সখে! বঞ্চোনা আমারে।
চিত্ররথ-রথিমুখে শুনিনু বারতা,
উরিবেন মায়াদেবী দাসের সহায়ে,
পাতিয়া এ ছল সতী পশিলা কি আসি
লঙ্কাপুরে? কহ বুধ, কার এ ছলনা?”
উত্তরিলা বিভীষণ;—"নিশার স্বপন
নহে এ, বৈদেহীনাথ, কহিনু তোমারে।
কালনেমী নামে দৈত্য বিখ্যাত জগতে

সুরারি, তনয়া তাঁর প্রমীলা সুন্দরী।
মহাশক্তি-অংশে দেব, জনম বামার,
মহাশক্তি-সম তেজে! কার সাধ্য আঁটে
বিক্রমে এ দানবীরে? দম্ভোলি নিক্ষেপী
সহস্রাক্ষে যে হর্য্যক্ষ বিমুখে সংগ্রামে,
সে রক্ষেন্দ্রে, রাঘবেন্দ্র, রাখে পদতলে
বিমোহিনী, দিগম্বরী যথা দিগম্বরে!
জগতের রক্ষা হেতু গড়িলা বিধাতা
এ নিগড়ে, যাহে বাঁধা মেঘনাদ বলী
মদকল কাল-হস্তী! যথা বারিধারা
নিবারে কানন-বৈরী ঘোর দাবানলে,
নিবারে সতত সতী প্রেম আলাপনে
এ কালাগ্নি! যমুনার সুবাসিত জলে,
ডুবি থাকে কাল-ফণী দুরম্ভ দংশক।
সুখে বসে বিশ্ববাসী, ত্রিদিবে দেবতা,
অতল পাতালে নাগ, নর নরলোকে।”
কহিলেন রঘুপতি;—“সত্য যা কহিলে,
মিত্রবর, রথিশ্রেষ্ঠ মেঘনাদ রথী।
না দেখি এ হেন শিক্ষা এ তিন ভুবনে!
দেখিয়াছি ভৃগুরামে, ভৃগুমান্ গিরি-
সদৃশ অটল যুদ্ধে। কিন্তু শুভক্ষণে
তব ভ্রাতৃপুত্ত্র, মিত্র, ধনুর্ব্বাণ ধরে!

এবে কি করিব, কহ, রক্ষঃকুলমণি!
সিংহ সহ সিংহী আসি মিলিল বিপিনে;
কে রাখে এ মৃগপালে? দেখ হে চাহিয়া,
উথলিছে চারিদিকে ঘোর কোলাহলে
হলাহল-সহ সিন্ধু! নীলকণ্ঠ যথা
(নিস্তারিণী-মনোহর) নিস্তারিলা ভবে,
নিস্তার এ বলে, সখে, তোমারি রক্ষিত।
ভেবে দেখ মনে, শূর, কালসর্প তেজে
তবাগ্রজ, বিষদন্ত তার মহাবলী
ইন্দ্রজিৎ। যদি পারি ভাঙ্গিতে প্রকারে
এ দন্তে, সফল তবে মনোরথ হবে।
নতুবা এসেছি মিছে সাগরে বাঁধিয়া,
এ কনক লঙ্কাপুরে, কহিনু তোমারে।”
কহিলা সৌমিত্রি-শূর শিরঃ নোয়াইয়া
ভ্রাতৃপদে;—“কেন আর ডরিব রাক্ষসে
রঘুপতি! সুরনাথ সহায় যাহার,
কি ভয় তাহার, প্রভু, এ ভবমণ্ডলে?
অবশ্য হইবে ধ্বংস কালি মোর হাতে
রাবণি। অধর্ম্ম কোথা কবে জয়লাভে?
অধর্ম্ম-আচারী এই রক্ষঃকুলপতি;
তার পাপে হতবল হবে রণভূমে
মেঘনাদ; মরে পুত্র জনকের পাপে।

লঙ্কার পঙ্কজ-রবি যাবে অস্তাচলে
কালি, কহিলেন চিত্ররথ সুররথী।
তবে এ ভাবনা, দেব, কর কি কারণে?”
উত্তরিলা বিভীষণ,— “সত্য যা কহিলে,
হে বীরকুঞ্জর! যথা ধর্ম্ম জয় তথা।
নিজ পাপে মজে, হায়, রক্ষঃকুলপতি!
মরিবে তোমার শরে স্বরীশ্বর-অরি
মেঘনাদ, কিন্তু তবু থাক সাবধানে।
মহাবীর্য্যবতী এই প্রমীলা-দানবী;
নৃমুণ্ড-মালিনী, যথা নৃ-মুণ্ড-মালিনী
রণপ্রিয়া! কালসিংহী পশে যে বিপিনে,
তার পাশে বাস যার, সতর্ক সতত
উচিত থাকিতে তার। কখন, কে জানে,
আসি আক্রমিবে ভীমা, কোথায় কাহারে!
নিশায় পাইলে রক্ষা, মারিব প্রভাতে।”
কহিলেন রঘুমণি মিত্র বিভীষণে;—
“কৃপা করি, রক্ষোবর, লক্ষ্মণেরে ল’য়ে,
দুয়ারে দুয়ারে সখে, দেখ সেনাগণে;
কোথায় কে জাগে আজি? মহাক্লান্ত সবে
বীরবাহু সহ রণে! দেখ চারিদিকে—
কি করে অঙ্গদ, কোথা নীল মহাবলী;
কোথা বা সুগ্রীব মিতা? এ পশ্চিম-দ্বারে

আপনি জাগিব আমি ধনুর্ব্বাণ হাতে!”
“যে আজ্ঞা” বলিয়া শূর বাহিরিলা লয়ে
ঊর্ম্মিলা-বিলাসী শূরে, সুরপতি-সহ
তারক সূদন যেন শোভিলা দুজনে,
কিম্বা ত্বিষাম্পতি সহ ইন্দু সুধানিধি!
লঙ্কার কনকদ্বারে উতরিলা সতী
প্রমীলা। বাজিল শিঙ্গা, বাজিল দুন্দুভি
ঘোর রবে। গরজিল ভীষণ রাক্ষস,
প্রলয়ের মেঘ কিম্বা করিযূথ যথা।
রোষে বিরূপাক্ষ রক্ষঃ প্রক্ষ্বেড়ন করে,
তালজঙ্ঘা—তাল-সম-দীর্ঘ গদাধারী,
ভীমমূর্ত্তি প্রমত্ত! হ্রেষিল অশ্বাবলী।
নাদে গজ, রথচক্র ঘুরিল ঘর্ঘরে,
দুরন্ত কৌন্তিককুল কুম্ভে আস্ফালিল;
উড়িল নারাচ, আচ্ছাদিয়া নিশানাথে।
অগ্নিময় আকাশ পূরিল কোলাহলে;
যথা যবে ভূকম্পনে, ঘোর বজ্রনাদে,
উগরে আগ্নেয়-গিরি, অগ্নি-স্রোতোরাশি
নিশীথে! আতঙ্কে লঙ্কা উঠিলা কাঁপিয়া।
উচ্চৈঃস্বরে কহে চণ্ডা নৃ-মুণ্ডমালিনী,
“কাহারে হানিস্ অস্ত্র, ভীরু! এ আঁধারে?
নহি রক্ষোরিপু মোরা, রক্ষঃকুলবধূ,

খুলি চক্ষু দেখ চেয়ে।” অমনি দুয়ারী
টানিল হুড়কা ধরি হড়হড়হড়ে!
বজ্রশব্দে খুলে দ্বার। পশিলা সুন্দরী
আনন্দে কনকলঙ্কা জয় জয় রবে।
যথা অগ্নিশিখা দেখি পতঙ্গ-আবলী
ধায় রঙ্গে, চারিদিকে আইল ধাইয়া
পৌরজন, কুলবধূ দিলা হুলাহুলি,
বরষি কুসুমাসারে; যন্ত্রধ্বনি করি
আনন্দে বন্দিলা বন্দী। চলিলা অঙ্গন
আগ্নেয় তরঙ্গ যথা নিবিড় কাননে।
বাজাইল বীণা, বাঁশী, মুরজ, মন্দিরা
বাদ্যকরী বিদ্যাধরী, হ্রেষি আস্কন্দিল
হয়বৃন্দ; ঝন্‌ঝনিল কৃপাণ পিধানে।
জননীর কোলে শিশু জাগিল চমকি।
খুলিয়া গবাক্ষ কত রাক্ষস-যুবতী,
নিরখিয়া দেখি সবে মুখে বাখানিলা
প্রমীলার বীরপণা। কত ক্ষণে বামা,
উতরিলা প্রেমানন্দে পতির মন্দিরে—
মণিহারা ফণী যেন পাইল সে ধনে!
অরিন্দম ইন্দ্রজিৎ কহিলা কৌতুকে;—
“রক্তবীজে বধি বুঝি, এবে, বিধুমুখি!
আইলা কৈলাসধামে? যদি আজ্ঞা কর,

পড়ি পদতলে তবে; চিরদাস আমি,
তোমার, চামুণ্ডে!” হাসি, কহিলা ললনা;—
“ও পদ-প্রসাদে নাথ, ভব-বিজয়িনী
দাসী, কিন্তু মনমথে না পারি জিনিতে।
অবহেলি শরানলে; বিরহ অনলে
(দুরূহ) ডরাই সদা, তেঁই সে আইনু,
নিত্য নিত্য মন যারে চাহে, তাঁর কাছে।
পশিল সাগরে আসি রঙ্গে তরঙ্গিণী।”
এতেক কহিয়া সতী, প্রবেশি মন্দিরে,
ত্যজিলা বীর-ভূষণে; পরিলা দুকূলে
রতনময় আঁচল, আঁটিয়া কাঁচলি
পীন-স্তনী; শ্রোণিদেশে ভাতিল মেখলা।
দুলিল হীরার হার, মুকুতা-আবলী
উরসে; জ্বলিল ভালে তারা গাঁথা সিঁথি,
অলকে মণির আভা, কুণ্ডল শ্রবণে।
পরি নানা আভরণ সাজিলা রূপসী।
ভাসিলা আনন্দনীরে রক্ষঃ-চূড়ামণি
মেঘনাদ; স্বর্ণাসনে বসিলা দম্পতী।
গাইল গায়ক-দল; নাচিল নর্তকী;
বিদ্যাধর বিদ্যাধরী ত্রিদশ-আলয়ে
যথা; ভুলি নিজ দুঃখ, পিঞ্জর মাঝারে,
গায় পাখী; উথলিল উৎস কলকলে,

সুধাংশুর অংশু-স্পর্শে যথা অম্বুরাশি।
বহিল বসন্তানিল মধুর সুস্বনে,
যথা যবে ঋতুরাজ, বনস্থলী সহ,
বিরলে করেন কেলি, মধু মধুকালে।
হেথা বিভীষণসহ সৌমিত্রি কেশরী,
চলিল উত্তরদ্বারে; সুগ্রীব সুমতি
জাগেন আপনি তথা, বীরদলসাথে,
বিন্ধ্য-শৃঙ্গ-বৃন্দ যথা—অটল সংগ্রামে!
পূরব দুয়ারে নীল, ভৈরব-মূরতি;
বৃথা নিদ্রাদেবী তথা সাধিছেন তারে।
দক্ষিণ দুয়ারে ফিরে কুমার অঙ্গদ,
ক্ষুধাতুর হরি যথা আহার সন্ধানে,
কিম্বা নন্দী শূলপাণি কৈলাস-শিখরে।
শত শত অগ্নিরাশি জ্বলিছে চৌদিকে
ধূমশূন্য; মধ্যে লঙ্কা, শশাঙ্ক যেমনি
নক্ষত্রমণ্ডল-মাঝে স্বচ্ছ নভঃস্থলে।
চারি দ্বারে বীরব্যূহ জাগে; যথা যবে
বারিদ প্রসাদে পুষ্ট শস্যকুল বাড়ে
দিন দিন, উচ্চ মঞ্চ গড়ি ক্ষেত্রপাশে,
তাহার উপরে কৃষী জাগে সাবধানে,
খেদাইয়া মৃগযূথে, ভীষণ মহিষে,
আর তৃণজীবি জীবে। জাগে বীরব্যূহ,

রাক্ষসকুলের ত্রাস, লঙ্কার চৌদিকে।
হৃষ্টমতি দুইজন চলিলা ফিরিয়া,
যথায় শিবিরে বীর ধীর দাশরথি।
হাসিয়া কৈলাসে উমা কহিলা সম্ভাষি
বিজয়ারে;—“লঙ্কাপানে দেখ লো চাহিয়া
বিধুমুখি! বীরবেশে পশিছে নগরে
প্রমীলা, সঙ্গিনীদল সঙ্গে বরাঙ্গনা।
সুবর্ণ-কুঞ্চুক-বিভা উঠিছে আকাশে!
সবিস্ময়ে, দেখ, ওই দাঁড়ায়ে নৃমণি
রাঘব, সৌমিত্রি, মিত্র বিভীষণ আদি
বীর যত! হেন রূপ কার নর-লোকে?
সাজিনু এ বেশে আমি নাশিতে দানবে
সত্যযুগে। ওই শোন ভয়ঙ্কর ধ্বনি!
শিঞ্জিনী আকর্ষি রোষে টঙ্কারিছে বামা
হুঙ্কারে। বিকট ঠাট কাঁপিছে চৌদিকে!
দেখ লো নাচিছে চূড়া কবরী-বন্ধনে।
তুরঙ্গম আস্কন্দিতে উঠিছে পড়িছে
গৌরাঙ্গী, হায় রে, মরি, তরঙ্গ হিল্লোলে
কনক-কমল যেন মানস-সরসে!”
উত্তরে বিজয়া সখী;—“সত্য যা কহিলে
হৈমবতি! হেন রূপ কার নরলোকে?
জানি আমি বীর্য্যবতী দানবনন্দিনী

প্রমীলা, তোমার দাসী; কিন্তু ভাব মনে,
কিরূপে আপন কথা রাখিবে ভবানি?
একাকী জগৎ-জয়ী ইন্দ্রজিৎ তেজে;
তা সহ মিলিল আসি প্রমীলা; মিলিল
বায়ুসখী অগ্নিশিক্ষা সে বায়ুর সহ!
কেমনে রক্ষিবে রামে কহ, কাত্যায়নি!
কেমনে লক্ষ্মণ-শূর নাশিবে রাক্ষসে?”
ক্ষণকাল চিত্তি তবে কহিলা শঙ্করী;—
“মম অংশে জন্ম ধরে প্রমীলা রূপসী,
বিজয়ে! হরিব তেজঃ কালি তার আমি।
রবিচ্ছবি-করস্পর্শে উজ্জ্বল যে মণি,
আভাহীন হয় সে লো, দিবা-অবসানে;
তেমনি নিস্তেজা কালি করিব বামারে।
অবশ্য লক্ষ্মণ-শূর নাশিবে সংগ্রামে
মেঘনাদে! পতিসহ আসিবে প্রমীলা
এ পুরে; শিবের সেবা করিবে রাবণি;
সখী করি প্রমীলারে তুষিব আমরা।”
এতেক কহিয়া সতী পশিলা মন্দিরে।
মৃদুপদে নিদ্রাদেবী আইলা কৈলাসে;
লভিলা কৈলাসবাসী কুসুম-শয়নে
বিরাম; ভবের ভালে দীপি শশিকলা,
উজলিল সুখধাম রজোময় তেজে।

ইতি শ্রীমেঘনাদবধ কাব্যে সমাগমো নাম

তৃতীয়ঃ সর্গঃ।


তৃতীয় সর্গ।

পতিবিরহে ইত্যাদি—প্রথম সর্গে মেঘনাদ প্রমীলার নিকট হইতে বিদায় লইয়া লঙ্কায় গমন করেন এবং রাবণ কর্ত্তৃক সেনাপতিত্বে অভিষিক্ত হইয়া ফিরিয়া আসিতে পারিলেন না। প্রমীলা পতির বিরহে উতলা হইয়া উঠিলেন।
প্রমোদ উদ্যান—Pleasure garden.
অশ্রু-আঁখি—with eyes full of tears.
অধরে মুরলী—with a flute in the mouth.
কে না জানে......... তাপে বনস্থলী—The attendants pale with sorrow for their mistress Pramila afflicted with separation from her husband Maghanada are compared to the pale, flowers in a garden scorched with sun at the end of the spring season. The spring season stands for Meghanada, the garden for Pramila, and the flowers for the companions of Pramila.
বসন্তসৌরভা—having the fragrance of the spring season.
তিমির যামিনী—dark night. ব্যাজ—delay.
বসন্তসখা—friend or companion of spring.
সীমন্তিনী—one who has the partition of the hair of the head; i.e. a woman who has her hair always parted.
সীমন্তিনি—case of address.
অভেদ্য—Impenetrable.
তাঁরে আঁটিবে—will cope with him.
সরস কুসুম—Juicy flowers: Flowers of vigorous growth. চিকণিয়া—making fine.
প্রিয়গলে—round the neck of the husband.
দাম—wreath; garland.
বিজয়ী রথচূড়ায়—on the top of the chariot of a conqueror.
পাঁতি—row line; series.
মর্ম্মরিছে—are making a murmuring sound.
মুক্তিল—মুক্তাফল দিয়া অলঙ্কৃত করিল; adorned, as it were, with pearl beads.
শিশির নীরে—with dew water. The drops of tears are compared to drops of dews.
মিহিরবিরহে—owing to separation from the sun.
পোড়ানয়নে—to these miserable eyes.
অবচয়ি—plucking
স্বজনী—Feminine form of স্বজন।
স্বজন—friend; relative.
অলঙ্ঘ্য সাগরসম—like a sea which cannot be crossed.
চমূ—Army.
গজপতিগতি—having the gait of the lord of elephants. রোষাবেশে—out of anger.
দেবদত্ত—is the name of Arjuna’s conch.
উলঙ্গিয়া—making naked; unsheathing; drawring out of the sheath.
কার্ম্মুক টঙ্কারি—sounding the bow string with a twang.
আস্ফালি—parading. কঞ্চুক—armour.
ঊর্ধ্বকর্ণে—with ears erect.
ঘনপতি—The lord of clouds. অলিন্দ—Verandah.
কমলে কণ্টকময় যথা মৃণাল—A lotus is very soft, beautiful and charming, but its stalk is full of thorns. So Pramila and her followers are tender, beautiful and charming, but their hands are armed with dreadful weapons.
দানবদলনীপদ্মপদযুগ—the pair of the lotus-like feet of the destroyer of the Danavas: the pair of the lotus-like feet of Kali.
দিবে—in the Heaven.
কাদম্বিনী—a long line of clouds.
অঞ্জন—eye-paint; collyrium.
নয়নরঞ্জিকা—charming to the eyes; gratifying to the eyes.
নিষঙ্গ—quiver of arrows.
হায় রে, বর্ত্তুল যথা রম্ভাবন আভা—The thighs of the female soldiers were charmingly round; and they looked like the trunks of plantain trees. The place where the female soldiers were, looked like a beautiful garden of plantain trees.
হৈমময় কোষ—Sheath made of gold.
উন্মাদ—haughty; insolent.
বড়বা—means a mare. But here it is a proper name.
বামী—a mare.
বাড়বাগ্নি-শিখা—the flame of a submarine fire.
বিকট—Dreadful. কটক—army.
দানবকুলসম্ভবা—born of the Danava family.
দ্বিষৎশোণিতনদ—the stream of the blood of enemies.
ভুজ-মৃণাল—hands looking like lotus stalks.
বীরপণা—heroism; bravery.
যথা বায়ুসখাসহ দাবানলগতি দুর্ব্বার, চলিলা সতী পতির উদ্দেশে—The devoted wife with the force of the irresistible forest-fire went in search of her husband accompanied, as it were, by the comrade, wind.
ধূমপুঞ্জ—masses of smoke. The masses of dust surrounding Pramila are compared to masses of smoke surrounding the flame of fire. Pramila is compared to the flame of fire.
দুর্দ্ধর্ষ—Irresistible. ময়াবী—Juggler, magician.
কোন যোধ সাধা—কোন্ যোধের সাধ্য; what fighter is able.
বলীন্দ্র—বলিশ্রেষ্ঠ; the best among the strong.
পাবনি—the son of Pavana Deva.
খর্পর—a pot to receive the blood of the victim at a sacrifice.  খণ্ডা―a sword.
মুণ্ডমালী—The goddess Kali, wearing the মালা or garland of cut-off heads.
শশিকলাসমরূপে—like the phase of the moon in beauty.
প্রেমপাশে—with the tie of love.
সৌদামিনী—lightning.
অঞ্জনানন্দন—Hanuman, the son of Anjana.
শিলাবন্ধে—with the embankment made of stones.
যে বিদ্যুৎ ছটা... তাহার পরশে—Man dies of the contact with that lightning, the flash of which charms the eye. Pramila reminds Hanuman that they were indeed charming to the eyes, and yet destructive, like the flash of lightning.
নৃমুণ্ডমালিনী দূতী—The name of the female was Nrimundamalini.
নৃমুণ্ডমালিনী আকৃতি—whose appearance is like that of the goddess Kali wearing the garland of human heads.
গরুত্মতী—winged when applied to তরী (boat) it means “with sails spread.”
তরঙ্গনিকর—the series of waves.
ভামিনী—a passionate woman.
কাঞ্চী—a woman’s girdle or zone with tinkling bells. কটাক্ষের শর—the arrows of sideglances.
চন্দ্রক—the eye in a pea-cock’s tail.
কলাপ—assemblage; multitude. The use of the word is appropriate here as it also means a pea-cock’s tail.
চন্দ্রকলাপময়—adorned with an assemblage of the eyes in a pea-cock’s tail.
কুচযুগ মাঝে পীবর—পীবর কুচযুগ মাঝে—in the midst of the plump and prominent breasts.
কুমুদিনীসখী—moon light which is spoken of as the companion of the water-lily.
অংশুময়ী—full of rays; brilliant.
রুদ্রকুলসমতেজঃ—having the vigour of the race of the Rudras.
ভৈরবমূরতি—having a dreadful appearance.
দেবদত্ত—granted by gods.
রঞ্জনরাগে—with the dye of red sandal.
দেউটী—lamps. পিষ্ঠ—altar.
Ramchandra is worshipping the arms granted by gods.
সুবর্ণমণ্ডিত...মেঘ—adorned with gold like clouds adorned with the light of the sun towards the close of day. প্রসাদ—light.
পিনাক—the bow of Siva. ঠাট—army.
ত্রস্তে—in a hurry. রক্ষোরথী—is here Bibhisana.
কামরূপী—able to assume any shape at will.
চিররক্ষণ—protector for ever.
বিশেষিয়া—giving details; in detail.
ভর্ত্রিণী—mistress. শুভে—সম্বোধন পদ; from the base শুভা; Oh blessed. চিত্রবাঘিনী—striped tigress; dappled tigress.
কিরাতিনী—huntress.
বামা—woman. সুকেশিনি—beautilul-haired; the base is সুকেশিনী।
রঘুরাজকুলে বীরেশ্বর—বীরেশ্বর রঘুরাজকুলে; in the family of King Raghu, the greatest of the heroes.  সুনেত্রা—charming-eyed.
বাখানি—praise. পরিহার—averting (a danger).
বিধি-বিড়ম্বনে—through the disfavour of the God.
প্রসাদ—food offered to a god; food offered to any superior. Hence any offering.
ঘাঁটায়—excites; pokes. নির্ধূম—smokeless.
সুবর্ণি বারিদপুঞ্জে—dyeing the masses of clouds with the colour of gold.
কোদণ্ড—bow-stick.
কাকলি-লহরী—the waves of the music of birds.
রত্নসঙ্কলিত আভা—splendour acquired from gem.
মন্দগতি—adj. qualifying “বাজিরাজী”; moving slowly. আস্কন্দিতে—to fight.
আস্কন্দন—means “fighting”.
কৃষ্ণহয়ারুঢ়া—mounted on a black horse.
হৈমময়—হেমময়; made of gold. It qualifies the noun “ধ্বজদণ্ড”।
রতনসম্ভবা বিভা ক্ষণ প্রভাসম—the splendour issuing out of jewels, like lightning.
মহিষমর্দ্দিনী—the killer of Mahisasura.
খগেন্দ্র—the king of birds, i.e. Garuda.
বামী-ঈশ্বরী—the mistress among the mares.
শিঞ্জিনী—a bow-string.
ভৈরবী—dreadful. It qualifies “কেশরিণী”.
প্রপঞ্চ—(1) phenomenon, দৃশ্য; (2) illusions, মায়া; (3) opposition, বৈপরীত্য; (4) বঞ্চনা, deception.
উরিবেন মায়াদেবী দাসের সহায়ে—the goddess Maya will come down in aid of her servant. বুধ—wise man.
হর্য্যক্ষ—lion.
রক্ষেন্দ্রে—the greatest Rakshasa, i.e. Meghanada. বিমোহিনী—charming.
রাখে পদতলে—(In the case of Digambari) keeps under her feet. (In the case of Pramila) keeps under control.
Digambari—Kali whose অম্বর or cloth is দিক্‌ or quarters; i.e. who is naked.
Digambara—is Siva.
নিগড়—chain. Pramila is so called.
মদকল—speaking inarticulately like a drunken person. কাল-হস্তী—deadly elephant.
কাননবৈরী—enemy of forests. Forest fire (দাবানল) is so called.
ভৃগুমান্—having a precipice; precipitous.
নীলকণ্ঠ—Siva.
রক্ষিত—one protected or sheltered by you
কালসর্প তেজে তবাগ্রজ—your elder brother like a deadly snake in vigour.
বিষদন্ত—fang; poisonous tooth.
প্রকারে—some how.
জয়লাভে—জয় লাভ করে, gains victory.
হতবল—(destitute of strength.
স্বরীশ্বর অরি—the অরি or enemy of the ঈশ্বর or lord of স্বর or Heaven—Indrajit who is the enemy of Indra.
দুয়ারে দুয়ারে—from door to door.
তারক-সূদন—Karttikeya, the killer of Tarakasura.
ত্বিষাম্পতি—the sun.
সুধানিধি—the sea or the Reservoir of nectar.
রোষে—is angry. বিরূপাক্ষ রক্ষঃ—the Rakshasa named Birupaksha.
প্রক্ষ্বেড়ন—a kind of iron arrow called নারাচ।
তালজঙ্ঘা—adj. qualifying রক্ষঃ। Having a জঙ্ঘা (shank, the leg below the knee) like a palm. তালসমদীর্ঘ গদাধারী—armed with a weapon as tall as the palm tree.
ভীমমূর্ত্তি—Whose appearance is fierce.
প্রমত্ত—excited; maddened.
কৌন্তিক—a soldier armed with a কুন্ত or শূল (spear). চণ্ডী—dreadful.
হুলাহুলি—is perhaps the inarticulate sound উলু।
বন্দী—court musician, আগ্নেয় তরঙ্গ—fiery Waves; waves of fire.
হ্রেষি—neighing
আস্কন্দিল—danced. পিধান—sheath.
অরিন্দম—the subduer of enemies.
মনমথ—Manatha, or Madan
শরানল—the fire of arrows.
বিরহ-অনল—the fire of separation.
রতনময় আঁচল—adj. qualifying দুকুল, having the skirts adorned with jewels.
কাঁচলি—Bodice or short jacket for women.
পীনস্তনী—having plump and prominent breasts.
শ্রোণি—নিতম্ব, buttocks. মেখলা—girdle.
অলক—a curl of hair; a ringlet.
কুণ্ডল—ear-ring. শ্রবণ—ear.
উৎস—fountain; spring.
কলকলে—with a babbling sound.
মধু মধুকাল—sweet spring.
বিন্ধ্যশৃঙ্গ-বৃন্দ—the group of the summits of the Vindhyas.
হরি—lion.
শূলপাণি—who has শূল in his hands.
তৃণজীবিজীব—animals living on grass.
বীরব্যূহ—the circle of heroes.
সঙ্গিনীদল সঙ্গে বরাঙ্গনা—বরাঙ্গনা সঙ্গিনীদল সঙ্গে—with very beautiful women as her companions.
হেন রূপ কার নর-লোকে—who has got such a beauty in the world of men as Pramila has?
কবরী-বন্ধনে—on the chignon.
গৌরাঙ্গী—having a body of fair complexion.
কনক-কমল—golden lotus.
মানস সরসে—in the Manasarwar.
রবিচ্ছবিকরস্পর্শ—the touch of the ray of sun light. ছবি—means ‘brightness’ Here it means ‘light’
দীপি—shining. উজলিল—brightened.
সুখধাম—in Kailas
রজোময়—is it রজতময়, silvery?