বিষয়বস্তুতে চলুন

সটীক মেঘনাদবধ কাব্য/প্রথম সর্গ

উইকিসংকলন থেকে

মেঘনাদবধ কাব্য

প্রথম সর্গ

সম্মুখ সমরে পড়ি, বীর-চূড়ামণি
বীরবাহু, চলি যবে গেলা যমপুরে
অকালে, কহ, হে দেবি অমৃতভাষিণি!
কোন্ বীরবরে বরি সেনাপতি পদে,
পাঠাইলা রণে পুনঃ রক্ষঃকুলনিধি
রাঘবারি? কি কৌশলে, রাক্ষস-ভরসা
ইন্দ্রজিৎ মেঘনাদে—অজেয় জগতে—
উর্ম্মিলাবিলাসী নাশি, ইন্দ্রে নিঃশঙ্কিলা?
বন্দি চরণারবিন্দ, অতি মন্দমতি
আমি, ডাকি আবার তোমায়, শ্বেতভুজে
ভারতি! যেমতি, মাতঃ, বসিলা আসিয়া,
বাল্মীকির রসনায় (পদ্মাসনে যেন)
যবে খরতর শরে, গহন কাননে,
ক্রৌঞ্চবধূসহ ক্রৌঞ্চে নিষাদ বিঁধিলা,

তেমতি দাসেরে, আসি, দয়া কর, সতি!
কে জানে মহিমা তব এ ভবমণ্ডলে?
নরাধম আছিল যে নর নরকুলে
চৌর্য্যে রত, হইল সে তোমার প্রসাদে,
মৃত্যুঞ্জয়, যথা মৃত্যুঞ্জয় উমাপতি!
হে বরদে, তব বরে চোর রত্নাকর
কাব্যরত্নাকর কবি! তোমার পরশে,
সুচন্দন-বৃক্ষশোভা বিষবৃক্ষ ধরে!
হায়, মা, এ হেন পুণ্য আছে কি এ দাসে?
কিন্তু যে গো গুণহীন সন্তানের মাঝে
মুঢ়মতি, জননীর স্নেহ তার প্রতি
সমধিক। ঊর তবে, ঊর দয়াময়ি
বিশ্বরমে! গাইব, মা, বীররসে ভাসি,
মহাগীত; ঊরি, দাসে দেহ পদছায়া।
—তুমিও আইস, দেবি, তুমি মধুকরী
কল্পনা! কবির চিত্ত-ফুলবন-মধু
লয়ে, রচ মধুচক্র, গৌড়জন যাহে
আনন্দে করিবে পান সুধা নিরবধি।
কনক আসনে বসে দশানন বলী—
হেমকূট-হৈমশিরে শৃঙ্গবর যথা
তেজঃপুঞ্জ। শত শত পাত্রমিত্র আদি
সভাসদ্, নতভাবে বসে চারি দিকে।

ভূতলে অতুল সভা—স্ফটিকে গঠিত;
তাহে শোভে রত্নরাজী, মানস-সরসে
সরস কমলকুল বিকসিত যথা।
শ্বেত, রক্ত, নীল, পীত স্তম্ভ সারি সারি
ধরে উচ্চ স্বর্ণছাদ, ফণীন্দ্র যেমতি
বিস্তারি অযুত ফণা, ধরেন আদরে
ধরারে। ঝুলিছে ঝলি ঝালরে মুকুতা,
পদ্মরাগ, মরকত, হীরা; যথা ঝোলে
(খচিত মুকুলে ফুলে) পল্লবের মালা
ব্রতালয়ে। ক্ষণপ্রভা সম মুহুঃ হাসে
রতনসম্ভবা বিভা—ঝলসি নয়নে।
সুচারু চামর, চারুলোচনা কিঙ্করী
ঢুলায়, মৃণালভুজ আনন্দে আন্দোলি
চন্দ্রাননা। ধরে ছত্র ছত্রধর; আহা,
হরকোপানলে কাম যেন রে না পুড়ি
দাঁড়ান সে সভাতলে ছত্রধররূপে!
ফেরে দ্বারে দৌবারিক, ভীষণ-মূরতি,
পাণ্ডব-শিবির-দ্বারে রুদ্রেশ্বর যথা
শূলপাণি! মন্দে মন্দে বহে গন্ধে বহি,
অনন্ত বসন্ত-বায়ু, রঙ্গে সঙ্গে আনি
কাকলীলহরী, মরি! মনোহর, যথা
বাঁশরীস্বরলহরী গোকুল-বিপিনে!

কি ছার ইহার কাছে, হে দানবপতি
ময়, মণিময় সভা, ইন্দ্রপ্রস্থে যাহা
স্বহস্তে গড়িলা তুমি, তুষিতে পৌরবে?
এ হেন সভায় বসে রক্ষঃকুলপতি,
বাক্যহীন পুত্ত্রশোকে! ঝর ঝর ঝরে
অবিরল অশ্রুধারা—তিতিয়া বসনে,
যথা তরু, তীক্ষ্ণ-শর সরস-শরীরে
বাজিলে, কাঁদে নীরবে। করযোড় করি,
দাঁড়ায়ে সম্মুখে ভগ্নদূত, ধুসরিত
ধূলায়, শোণিতে আর্দ্র সর্ব্ব কলেবর।
বীরবাহুসহ যত যোধ শত শত
ভাসিল রণসাগরে, তা সবার মাঝে
একমাত্র বাঁচে বীর; যে কাল-তরঙ্গ
গ্রাসিল সকলে, রক্ষা করিল রাক্ষসে—
নাম মকরাক্ষ, বলে যক্ষপতিসম।
এ দূতের মুখে শুনি সুতের নিধন,
হায়, শোকাকুল আজি রাজকুলমণি
নৈকষেয়! সভাজন দুঃখী রাজ-দুঃখে।
আঁধার জগৎ, মরি, ঘন আবরিলে
দিননাথে! কতক্ষণে চেতন পাইয়া,
বিষাদে নিশ্বাস ছাড়ি কহিলা রাবণ;—
“নিশার স্বপনসম তোর এ বারতা,

রে দূত! অমরবৃন্দ যার ভুজবলে
কাতর, সে ধনুর্দ্ধরে রাঘব ভিখারী
বধিল সম্মুখ-রণে? ফুলদল দিয়া
কাটিলা কি বিধাতা শাম্মলী-তরুবরে?—
হা পুত্ত্র, হা বীরবাহু, বীর-চূড়ামণি!
কি পাপে হারানু আমি তোমা হেন ধনে?
কি পাপ দেখিয়া মোর, রে দারুণ বিধি,
হরিলি এ ধন তুই? হায় রে, কেমনে
সহি এ যাতনা আমি? কে আর রাখিবে
এ বিপুল কুল-মান এ কাল-সমরে!
বনের মাঝারে যথা শাখাদলে আগে
একে একে কাঠুরিয়া কাটি, অবশেষে
নাশে বৃক্ষে, হে বিধাতঃ, এ দুরন্ত রিপু
তেমতি দুর্ব্বল, দেখ, করিছে আমারে
নিরন্তর! হব আমি নির্ম্মূল সমূলে
এর শরে! তা না হ’লে মরিত কি কভু
শূলীশম্ভুসম ভাই কুম্ভকর্ণ মম,
অকালে আমার দোষে? আর যোধ যত—
রাক্ষস-কুল-রক্ষণ? হায়, শূর্পণখা,
কি কুক্ষণে দেখেছিলি তুই রে অভাগী,
কাল পঞ্চবটীবনে কালকূটে ভরা

পাবক-শিখা-রূপিণী জানকীরে আমি
আনিনু এ হৈম গেহে? হায়, ইচ্ছা করে,
ছাড়িয়া কনকলঙ্কা, নিবিড় কাননে
পশি, এ মনের জ্বালা জুড়াই বিরলে!
কুসুমদাম-সজ্জিত, দীপাবলী-তেজে
উজ্জ্বলিত নাট্যশালাসম রে আছিল
এ মোর সুন্দরী পুরী! কিন্তু একে একে
শুকাইছে ফুল এবে, নিবিছে দেউটী;
নীরব ররাব, বীণা, মুরজ, মুরলী;
তবে কেন আর আমি থাকি রে এখানে?
কার রে বাসনা বাস করিতে আঁধারে?”
এইরূপে বিলাপিলা, আক্ষেপে রাক্ষস-
কুলপতি রাবণ; হায় রে মরি, যথা
হস্তিনার অন্ধরাজ, সঞ্জয়ের মুখে
শুনি, ভীমবাহু ভীমসেনের প্রহারে
হত যত প্রিয়পুত্ত্র কুরুক্ষেত্র-রণে।
তবে মন্ত্রী সারণ (সচিবশ্রেষ্ঠ বুধ)
কৃতাঞ্জলিপুটে উঠি কহিতে লাগিলা
নতভাবে;—“হে রাজন ভুবনবিখ্যাত,
রাক্ষসকুলশেখর, ক্ষম এ দাসেরে!
হেন সাধ্য কার আছে বুঝায় তোমারে

অভ্রভেদী চূড়া যদি যায় গুঁড়া হ’য়ে
বজ্রাঘাতে, কভু নহে ভূধর অধীর
সে পীড়নে। বিশেষতঃ এ ভবমণ্ডল
মায়াময়, বৃথা এর দুঃখ-সুখ যত।
মোহের ছলনে ভুলে অজ্ঞান যে জন।”
উত্তর করিলা তবে লঙ্কা-অধিপতি;—
“যা কহিলে সত্য, ওহে অমাত্য-প্রধান
সারণ! জানি হে আমি, এ ভব-মণ্ডল
মায়াময়, বৃদ্ধা এর দুঃখ-সুখ যত।
কিন্তু জেনে শুনে তবু কাঁদে এ পরাণ
অবোধ। হৃদয়-বৃন্তে ফুটে যে কুসুম,
তাহারে ছিঁড়িলে কাল, বিকল হৃদয়
ডোবে শোক-সাগরে, মৃণাল যথা জলে,
যবে কুবলয়ধন লয় কেহ হরি।”
এতেক কহিয়া রাজা, দূতপানে চাহি,
আদেশিলা;—“কহ, দূত, কেমনে পড়িল
সমরে অমর-ত্রাস বীরবাহু বলী?”
প্রণমি রাজেন্দ্রপদে, করযুগ যুড়ি,
আরম্ভিলা ভগ্নদূত;—“হায়, লঙ্কাপতি,
কেমনে কহিব আমি অপূর্ব্ব কাহিনী?
কেমনে বর্ণিব রীররাহুর বীরতা?—

পশিল বীরকুঞ্জর অরিদলমাঝে
ধনুর্দ্ধর। এখনও কাঁপে হিয়া মম
থরথরি, স্মরিলে সে ভৈরব হুঙ্কার!
শুনেছি, রাক্ষসপতি, মেঘের গর্জ্জন;
সিংহনাদ; জলধির কল্লোল; দেখেছি
দ্রুত ইরম্মদ, দেব, ছুটিতে পবন-
পথে; কিন্তু কভু নাহি শুনি ত্রিভুবনে,
এ হেন ঘোর ঘর্ঘর কোদণ্ড টঙ্কার!
কভু নাহি দেখি শর হেন ভয়ঙ্কর!—
পশিলা বীরেন্দ্রবৃন্দ বীরবাহুসহ
রণে, যূথনাথসহ গঙ্গযূথ যথা।
ঘন ঘনাকারে ধূলা উঠিল আকাশে,—
মেঘদল আসি যেন আবরিলা রুষি
গগনে; বিদ্যুৎঝলা-সম চকমকি
উড়িল কলম্বকুল অম্বর প্রদেশে
শন্‌শনে!—ধন্য শিক্ষা বীর বীরবাহু!
কত যে মরিল অরি, কে পারে গণিতে?
এইরূপে শত্রুমাঝে যুঝিলা স্বদলে
পুত্ত্র তব, হে রাজন্! কতক্ষণ পরে,
প্রবেশিলা যুদ্ধে আসি নরেন্দ্র রাঘব।
কনক-মুকুট শিরে, করে ভীম ধনুঃ,
বাসবের চাপ যথা বিবিধ রতনে

খচিত,”—এতেক কহি, নীরবে কাঁদিল
ভগ্নদূত, কাঁদে যথা বিলাপী, স্মরিয়া
পূর্ব্বদুঃখ। সভাজন কাঁদিলা নীরবে।
অশ্রুময়-আঁখি পুনঃ কহিলা রাবণ,
মন্দোদরীমনোহর;—“কহ, রে সন্দেশ-
বহ, কহ, শুনি আমি, কেমনে নাশিলা
দশাননাত্মজ শূরে দশরথাত্মজ?”
“কেমনে, হে মহীপতি”, পুনঃ আরম্ভিল
ভগ্নদূত, “কেমনে, হে রক্ষঃকুলনিধি,
কহিব সে কথা আমি, শুনিবে বা তুমি?
অগ্নিময় চক্ষুঃ যথা হর্য্যক্ষ, সরোষে
কড়মড়ি ভীম দন্ত, পড়ে লম্ফ দিয়া
বৃষস্কন্ধে, রামচন্দ্র আক্রমিলা রণে
কুমারে! চৌদিকে এবে সমর-তরঙ্গ
উথলিল, সিন্ধু যথা দ্বন্দ্বি রায়ুসহ
নির্ঘোষে! ভাতিল অসি অগ্নিশিখাসম,
ধূমপুঞ্জসম চর্ম্মাবলীর মাঝারে
অযুত! নাদিল কম্বু অম্বুরাশি-রবে!—
আর কি কহিব, দেব? পূর্ব্বজন্মদোষে
একাকী বাঁচিনু আমি! হায় রে বিধাতঃ,
কি পাপে এ তাপ আজি দিলি তুই মোরে?
কেন না শুই আমি শরশয্যোপরি,

হৈমলঙ্কা-অলঙ্কার বীরবাহুসহ
রণভূমে? কিন্তু নহি নিজদোষে দোষী।
ক্ষত বক্ষঃস্থল মম, দেখ, নৃপমণি,
রিপু-প্রহরণে; পৃষ্ঠে নাহি অস্ত্রলেখা।”
এতেক কহিয়া স্তব্ধ হইল রাক্ষস
মনস্তাপে। লঙ্কাপতি হরষে বিষাদে
কহিলা;—“সাবাসি দূত! তোর কথা শুনি
কোন্ বীর-হিয়া নাহি চাহে রে পশিতে
সংগ্রামে? ডমরু-ধ্বনি শুনি কাল-ফণী,
কভু কি অলসভাবে নিবাসে বিবরে?
ধন্য লঙ্কা, বীরপুত্ত্রধাত্রী! চল, সবে,—
চল যাই, দেখি, ওহে সভাসদ্‌জন,
কেমনে প’ড়েছে রণে বীর-চূড়ামণি
বীরবাহু; চল, দেখি জুড়াই নয়ন।”
উঠিলা রাক্ষসপতি প্রাসাদ-শিখরে,
কনক-উদয়াচলে দিনমণি যেন
অংশুমালী। চারিদিকে শোভিল কাঞ্চন-
সৌধ-কিরীটিনী লঙ্কা—মনোহরা পুরী!—
হেমহুর্ম্ম্য সারি সারি পুষ্পবন-মাঝে;
কমল-আলয় সরঃ; উৎস রজঃছটা;
তরুরাজী; ফুলকুল চক্ষুঃ-বিনোদন,
যুবতীযৌবন কথা; হীরাচুড়াশিরঃ

দেবগৃহ; নানা রাগে রঞ্জিত বিপণি,
বিবিধ রতন-পূর্ণ; এ জগৎ যেন
আনিয়া বিবিধ ধন, পূজার বিধানে,
রেখেছে, রে চারুলঙ্কে, তোর পদতলে,
জগৎ-বাসনা তুই, সুখের সদন।
দেখিলা রাক্ষসেশ্বর উন্নত প্রাচীর—
অটল অচল যথা। তাহার উপরে,
বীরমদে মত্ত, ফেরে অস্ত্রিদল, যথা
শৃঙ্গধরোপরি সিংহ। চারি সিংহদ্বার
(রুদ্ধ এবে) হেরিলা বৈদেহীহর; তথা
জাগে রথ, রথী, গজ, অশ্ব, পদাতিক
অগণ্য। দেখিল রাজা নগর-বাহিরে,
রিপুবৃন্দ, বালিবৃন্দ সিন্ধুতীরে যথা,
নক্ষত্র-মণ্ডল কিম্বা আকাশ-মণ্ডলে।
থানা দিয়া পূর্ব্বদ্বারে, দুর্ব্বার সংগ্রামে,
বসিয়াছে বীর নীল; দক্ষিণ দুয়ারে
অঙ্গদ, করভসম নব-বলে বলী;
কিম্বা বিষধর, যবে বিচিত্র কঞ্চুক-
ভূষিত, হিমান্তে অহি ভ্রমে ঊর্দ্ধ-ফণা—
ত্রিশূলসদৃশ জিহ্বা লুলি অবলেপে!
উত্তর দুয়ারে রাজা সুগ্রীব আপনি
বীরসিংহ। দাশরথি পশ্চিম দুয়ারে—

হায় রে বিষণ্ণ এবে জানকী-বিহনে,
কৌমুদী-বিহনে যথা কুমুদরঞ্জন
শশাঙ্ক! লক্ষ্মণ সঙ্গে, বায়ুপুত্ত্র হনু,
মিত্রবর বিভীষণ। শত প্রসরণে,
বেড়িয়াছে বৈরিদল স্বর্ণ-লঙ্কাপুরী,
গহন কাননে যথা ব্যাধ-দল মিলি,
বেড়ে জালে সাবধানে কেশরি-কামিনী—
নয়ন-রঞ্জিনী-রূপে, পরাক্রমে ভীমা
ভীমাসমা! অদূরে হেরিলা রক্ষঃপতি
রণক্ষেত্র। শিবাকুল, গৃধিনী, শকুনি,
কুক্কুর, পিশাচদল ফেরে কোলাহলে।
কেহ উড়ে; কেহ বসে; কেহ বা বিবাদে
পাকশাট মারি কেহ খেদাইছে দূরে
সমলোভী জীবে; কেহ, গরজি উল্লাসে,
নাশে ক্ষুধা-অগ্নি; কেহ, শোষে রক্তস্রোতে;
প’ড়েছে কুঞ্জরপুঞ্জ ভীষণ-আকৃতি;
ঝড়গতি ঘোড়া, হায়, গতিহীন এবে;
চূর্ণ রথ অগণ্য, নিষাদী, সাদী, শূলী,
রথী, পদাতিক পড়ি যায় গড়াগড়ি
একত্রে! শোভিছে বর্ম্ম, চর্ম্ম, অসি, ধনু,
ভিন্দিপাল, তূণ, শর, মুদ্গর, পরশু,
স্থানে স্থানে, মণিময় কিরীট, শীর্ষক

আর বীর-আভরণ, মহাতেজস্কর।
পড়িয়াছে যন্ত্রিদল যন্ত্রদল মাঝে।
হৈমধ্বজদণ্ড হাতে, যম-দণ্ডাঘাতে,
পড়িয়াছে ধ্বজবহ। হায় রে, যেমতি
স্বর্ণ-চূড় শষ্য ক্ষত কৃষীদলবলে,
পড়ে ক্ষেত্রে, পড়িয়াছে রাক্ষসনিকর,
রবিকুলরবি শূর রাঘবের শরে!
পড়িয়াছে বীরবাহু—বীর-চূড়ামণি,
চাপি রিপুচর বলী, পড়েছিল যথা
হিড়িম্বার স্নেহনীড়ে পালিত গরুড়
ঘটোৎকচ, যবে কর্ণ, কালপৃষ্ঠধারী,
এড়িলা একাঘ্নী বাণ রক্ষিতে কৌরবে।
মহাশোকে শোকাকুল কহিলা রাবণ;—
“যে শয্যায় আজি তুমি শুয়েছ, কুমার
প্রিয়তম, বীরকুলসাধ এ শয়নে
সদা! রিপুদলবলে দলিয়া সমরে,
জন্মভূমি-রক্ষাহেতু কে ডরে মরিতে?
যে ডরে, ভীরু সে মূঢ়; শত ধিক্‌ তারে
তবু, বৎস, যে হৃদয়, মুগ্ধ মোহমদে,
কোমল সে ফুল-সম। এ বজ্র আঘাতে,
কত যে কাতর সে, তা জানেন সে জন,
অন্তর্য্যামী যিনি, আমি কহিতে অক্ষম

হে বিধি, এ ভবভূমি তব লীলাস্থলী,—
পরের যাতনা কিন্তু দেখি কি হে তুমি
হও সুখী? পিতা সদা পুত্ত্রদুঃখে দুঃখী—
তুমি হে জগৎ-পিতা, এ কি রীতি তব?
হা পুত্ত্র, হা বীরবাহু! বীরেন্দ্র-কেশরী!
কেমনে ধরিব প্রাণ তোমার বিহনে?”
এইরূপে আক্ষেপিয়া রাক্ষস-ঈশ্বর
রাবণ, ফিরায়ে আঁখি, দেখিলেন দূরে
সাগর—মকরালয়। মেঘশ্রেণী যেন
অচল, ভাসিছে জলে শিলাকুল, বাঁধা
দৃঢ় বাঁধে। দুই পাশে তরঙ্গ-নিচয়,
ফেনাময়, ফণাময় যথা ফণিবর,
উথলিছে নিরন্তর গম্ভীর নির্ঘোষে।
অপূর্ব্ব-বন্ধন সেতু; রাজপথ-সম
প্রশস্ত; বহিছে জলস্রোতঃ কলরবে,
স্রোতঃ-পথে জল যথা বরিষার কালে।
অভিমানে মহামানী বীরকুলর্ষভ
রাবণ, কহিলা বলী সিন্ধুপানে চাহি;—
“কি সুন্দর মালা আজি পড়িয়াছ গলে,
প্রচেতঃ! হা ধিক্, ওহে জলদলপতি!
এই কি সাজে তোমারে, অলঙ্ঘ্য, অজেয়
তুমি? হায় এই কি তোমার ভূষণ,

রত্নাকর? কোন্ গুণে, কহ, দেব, শুনি,
কোন্ গুণে দাশরথি কিনেছে তোমারে?
প্রভঞ্জন বৈরী তুমি; প্রভঞ্জন-সম
ভীম-পরাক্রম! কহ, এ নিগড় তবে
পর তুমি কোন্ পাপে? অধম ভালুকে
শৃঙ্খলিয়া যাদুকর, খেলে তারে ল’য়ে;
কেশরীর রাজপদ কার সাধ্য বাঁধে
বীতংসে? এই যে লঙ্কা, হৈমবতী পুরী,
শোভে তব বক্ষঃস্থলে, হে নীলাম্বুস্বামি,
কৌস্তুভ-রতন যথা মাধবের বুকে,
কেন হে নির্দ্দয় এবে তুমি এর প্রতি?
উঠ, বলি, বীরবলে এ জাঙাল ভাঙি,
দূর কর অপবাদ; জুড়াও এ জ্বালা,
ডুবায়ে অতল-জলে এ প্রবল রিপু।
রেখো না গো তব ভালে এ কলঙ্ক-রেখা,
হে বারীন্দ্র, তব পদে এ মম মিনতি।”
এতেক কহিয়া রাজরাজেন্দ্র রাবণ,
আসিয়া বসিল পুনঃ কনক-আসনে
সভাতলে; শোকে মগ্ন বসিলা নীরবে
মহামতি; পাত্রমিত্র, সভাসদ-আদি
বসিলা চৌদিকে, আহা, নীরব বিষাদে।
হেনকালে চারিদিকে সহসা ভাসিল

রোদন-নিনাদ মৃদু; তা সহ মিশিয়া
ভাসিল নূপুরধ্বনি, কিঙ্কিণীর বোল
ঘোর রোলে। হেমাঙ্গী সঙ্গিনী দল সাথে,
প্রবেশিলা সভাতলে চিত্রাঙ্গদা দেবী।
আলু থালু, হায়, এবে কবরীবন্ধন!
আভরণহীন দেহ, হিমানীতে যথা
কুসুমরতন-হীন বন-সুশোভিনী
লতা! অশ্রুময় আঁখি, নিশার শিশির-
পূর্ণ পদ্মপর্ণ যেন! বীরবাহু-শোকে
বিবশা রাজমহিষী, বিহঙ্গিনী যথা,
যবে গ্রাসে কালফণী কূলায়ে পশিয়া
শাবকে! শোকের ঝড় বহিল সভাতে!
সুর-সুন্দরীর রূপে শোভিল চৌদিকে
বামাকুল; মুক্তকেশ মেঘমালা; ঘন
নিশ্বাস প্রলয়-বায়ু; অশ্রুবারি-ধারা
আসার; জীমূত-মন্দ্র হাহাকার রব!
চমকিলা লঙ্কাপতি কনক আসনে।
ফেলিল চামর দূরে তিতি নেত্রনীরে
কিঙ্করী; কাঁদিল ফেলি ছত্র ছত্রধর;
ক্ষোভে, রোষে, দৌবারিক নিষ্কোষিল অসি
ভীমরূপী; পাত্র, মিত্র, সভাসদ্ যত,
অধীর, কাঁদিলা সবে ঘোর কোলাহলে

কতক্ষণে মৃদুস্বরে কহিলা মহিষী
চিত্রাঙ্গদা, চাহি সতী রাবণের পানে;—
“একটী রতন মোরে দিয়াছিল বিধি
কৃপাময়; দীন আমি থুয়েছিনু তারে
রক্ষাহেতু তব কাছে, রক্ষঃকুল-মণি,
তরুর কোটরে রাখে শাবকে যেমতি
পাখী। কহ, কোথা তুমি রেখেছ তাহারে,
লঙ্কানাথ? কোথা মম অমুল্য রতন?
দরিদ্র-ধন-রক্ষণ রাজধর্ম্ম; তুমি
রাজকুলেশ্বর; কহ, কেমনে রেখেছ,
কাঙ্গালিনী আমি, রাজা, আমার সে ধনে?”
উত্তর করিলা তবে দশানন বলী;—
“এ বৃথা গঞ্জনা, প্রিয়ে, কেন দেহ মোরে?
গ্রহদোষে দোষী জনে কে নিন্দে, সুন্দরি?
হায়, বিধিবশে, দেবি, সহি এ যাতনা
আমি! বীরপুত্ত্রধাত্রী এ কনকপুরী,
দেখ, বীরশূন্য এবে; নিদাঘে যেমতি
ফুলশূন্য বনস্থলী, জলশূন্য নদী!
বরজে সজারু পশি বারুইর যথা
ছিন্ন-ভিন্ন করে তারে, দশরথাত্মজ
মজাইছে লঙ্কা মোর! আপনি জলধি
পরেন শৃঙ্খল পায়ে তার অনুরোধে!

এক পুত্ত্রশোকে তুমি আকুলা, ললনে!
শত পুত্ত্রশোকে বুক আমার ফাটিছে
দিবানিশি! হায়, দেবি, যথা বনে বায়ু
প্রবল, শিমূলশিম্বী ফুটাইলে বলে,
উড়ি যায় তূলারাশি, এ বিপুল-কুল-
শেখর রাক্ষস যত পড়িছে তেমতি
এ কাল-সমরে। বিধি প্রসারিছে বাহু
বিনাশিতে লঙ্কা মম, কহিনু তোমারে।”
নীরবিলা রক্ষোনাথ; শোকে অধোমুখে
বিধুমুখী চিত্রাঙ্গদা, গন্ধর্ব্বনন্দিনী,
কাঁদিলা,—বিহ্বলা, আহা, স্মরি পুত্ত্রবরে।
কহিতে লাগিলা পুনঃ দাশরথি অরি;—
“এ বিলাপ কভু, দেবি, সাজে কি তোমারে?
দেশবৈরী নাশি রণে পুত্ত্রবর তব
গেছে চলি স্বর্গপুরে; বীরমাতা তুমি;
বীরকর্ম্মে হতপুত্ত্র-হেতু কি উচিত
ক্রন্দন? এ বংশ মম উজ্জ্বল হে আজি
তব পুত্ত্রপরাক্রমে; তবে কেন তুমি
কাঁদ, ইন্দুনিভাননে, তিত অশ্রুনীরে?”
উত্তর করিলা তবে চারুনেত্রা দেবী
চিত্রাঙ্গদা;—“দেশবৈরী নাশে যে সমরে
শুভক্ষণে জন্ম তার; ব’লে মানি

হেন বীরপ্রসূনের প্রসূ ভাগ্যবতী।
কিন্তু ভেবে দেখ, নাথ, কোথা লঙ্কা তব;
কোথা সে অযোধ্যাপুরী? কিসের কারণে,
কোন্ লোভে, কহ, রাজা, এসেছে এ দেশে
রাঘব? এ স্বর্ণলঙ্কা দেবেন্দ্রবাঞ্ছিত,
অতুল ভবমণ্ডলে; ইহার চৌদিকে
রজত-প্রাচীর-সম শোভেন জলধি।
শুনেছি, সরযূতীরে বসতি তাহার—
ক্ষুদ্র নয়। তব হৈমসিংহাসন-আশে
যুঝিছে কি দাশরথি? বামন হইয়া
কে চাহে ধরিতে চাঁদে? তবে দেশরিপু
কেন তারে বল, বলি? কাকোদর সদা
নম্রশিরঃ; কিন্তু তারে প্রহারয়ে যদি
কেহ, ঊর্দ্ধ-ফণা ফণী দংশে প্রহারকে।
কে, কহ, এ কাল-অগ্নি জ্বালিয়াছে আজি
লঙ্কাপুরে? হায়, নাথ, নিজ কর্ম্ম-ফলে,
মজালে রাক্ষসকুল, মজিলা আপনি!”
এতেক কহিয়া বীরবাহুর জননী,
চিত্রাঙ্গদা, কাঁদি সঙ্গে সঙ্গিদলে ল’য়ে,
প্রবেশিলা অন্তঃপুরে। শোকে, অভিমানে,
ত্যজি সুকনকাসন, উঠিলা গর্জ্জিয়া
রাঘবারি। “এতদিনে” (কহিলা ভূপতি)

“বীরশূন্য লঙ্কা মম! এ কাল-সমরে,
আর পাঠাইব কারে? কে আর রাখিবে
রাক্ষসকুলের মান? যাইব আপনি।
সাজ হে বীরেন্দ্রবৃন্দ, লঙ্কার ভূষণ!
দেখিব, কি গুণ ধরে রঘুকুলমণি!
অরাবণ, অরাম বা হবে ভব আজি!”
এতেক কহিলা যদি নিকষানন্দন
শূরসিংহ, সভাতলে বাজিল দুন্দুভি
গম্ভীর জীমূতমন্দ্রে। সে ভৈরব রবে,
সাজিল কর্ব্বুরবৃন্দ বীরমদে মাতি,
দেব-দৈত্য-নর-ত্রাস। বাহিরিল বেগে
বারী হ’তে (বারিস্রোতঃ-সম পরাক্রমে
দুর্ব্বার) বারণযূথ; মন্দুরা ত্যজিয়া
বাজীরাজী, বক্রগ্রীব, চিবাইয়া রোধে
মুখস্। আইল রড়ে রথ স্বর্ণচূড়,
বিভায় পূরিয়া পুরী। পদাতিকব্রজ,
কনক-শিরস্ক শিরে ভাস্বর-পিধানে
অসিবর, পৃষ্ঠে চর্ম্ম অভেদ্য সমরে,
হস্তে শূল, শালবৃক্ষ অভ্রভেদী যথা,
আয়সী-আবৃত দেহ, আইল কাতারে।
আইল নিষাদী যথা মেঘবরাসনে
বজ্রপাণি; সাদী যথা অশ্বিনী-কুমার,

ধরি ভীমাকার ভিন্দিপাল, বিশ্বনাশী
পরশু,—উঠিল আভা আকাশ-মণ্ডলে,
যথা বনস্থলে যবে পশে দাবানল।
রক্ষঃকুলধ্বজ ধরি, ধ্বজধর বলী
মেলিলা কেতনবর, রতনে খচিত,
বিস্তারিয়া পাখা যেন উড়িলা গরুড়
অম্বরে। গম্ভীর রোলে বাজিল চৌদিকে
রণবাদ্য, হয়ব্যূহ হ্রেষিল উল্লাসে,
গরজিল গজ, শঙ্খ নাদিল ভৈরবে;
কোদণ্ড-টঙ্কার সহ অসির ঝন্‌ঝনি
রোধিল শ্রবণ-পথ মহা-কোলাহলে!
টলিল কনকলঙ্কা বীরপদভরে;—
গর্জ্জিলা বারীশ রোষে! যথা জলতলে
কনক-পঙ্কজ-বনে, প্রবাল আসনে,
বারুণী রূপসী বসি, মুক্তাফল দিয়া
কবরী বাঁধিতেছিলা, পশিল সে স্থলে
আরাব; চমকি সতী চাহিলা চৌদিকে।
কহিলেন বিধুমুখী সখীরে সম্ভাষি
মধুরস্বরে;—“কি কারণে, কহ, লো স্বজনি,
সহসা জলেশ পাশী অস্থির হইলা?
দেখ, থর থর করি কাঁপে মুক্তাময়ী
গৃহচুড়া। পুনঃ বুঝি দুষ্ট রায়ুকুল

যুঝিতে তরঙ্গচর সঙ্গে দিলা দেখা।
ধিক্ দেব প্রভঞ্জনে! কেমনে ভুলিলা
আপন প্রতিজ্ঞা, সখি, এত অল্পদিনে
বায়ুপতি? দেবেন্দ্রের সভায় তাঁহারে
সাধিনু সেদিন আমি বাঁধিতে শৃঙ্খলে
বায়ু-বৃন্দে; কারাগারে রোধিতে সবারে।
হাসিয়া কহিলা দেব; ‘অনুমতি দেহ,
জলেশ্বরি, তরঙ্গিণী বিমলসলিলা
আছে যত ভবতলে কিঙ্করী তোমারি,
তা সবার সহ আমি বিহারি সতত,—
তা হ’লে পালিবে আজ্ঞা’;—তখনি, স্বজনি,
সায় তাহে দিনু আমি। তবে কেন আজি,
আইলা পবন মোরে দিতে এ যাতনা?”
উত্তর করিলা সখী কল কল রবে;—
“বৃথা গঞ্জ প্রভঞ্জনে, বারীন্দ্রমহিষি!
তুমি। এ ত ঝড় নহে; কিন্তু ঝড়াকারে
সাজিছে রাবণ-রাজা স্বর্ণলঙ্কাধামে,
লাঘবিতে রাঘবের বীরগর্ব্বরণে।”
কহিলা বারুণী পুনঃ;—“সত্য, গো স্বজনি,
বৈদেহীর হেতু রাম-রাবণে বিগ্রহ।
রক্ষঃকুল-রাজলক্ষ্মী মম প্রিয়তমা
সখী। যাও শীঘ্র তুমি তাঁহার সদনে;

শুনিতে লালসা মোর রণের বারতা।
এই স্বর্ণ-কমলটী দিও কমলারে।
কহিও, যেখানে তাঁর রাঙা পা-দুখানি
রাখিতেন শশিমুখী বসি পদ্মাসনে,
সেখানে ফোটে এ ফুল, যে অবধি তিনি,
আঁধারি জলধি-গৃহ, গিয়াছেন গৃহে।”
উঠিলা মুরলা সখী, বারুণী আদেশে,
জলতল ত্যজি, যথা উঠয়ে চটুলা
সফরী, দেখাতে ধনী রজত কান্তি-ছটা-
বিভ্রম বিভাবসুরে। উতরিলা দূতী
যথায় কমলালয়ে, কমল-আসনে
বসেন কমলময়ী কেশব-বাসনা
লঙ্কাপুরে। ক্ষণকাল দাঁড়ায়ে দুয়ারে,
জুড়াইলা আঁখি সখী, দেখিয়া সম্মুখে,
যে রূপমাধুরী মোহে মদনমোহনে।
বহিছে বসন্তানিল——চির-অনুচর—
দেবীর কমল-পদ-পরিমল-আশে
সুস্বনে। কুসুম-রাশি শোভিছে চৌদিকে,
ধনদের হৈমাগারে রত্নরাজী যথা।
শত স্বর্ণ-ধূপদানে পুড়িছে অগুরু,
গন্ধরস, গন্ধামোদে আমোদি দেউলে।
স্বর্ণপাত্রে সারি সারি উপহার নানা,

বিবিধ উপকরণ। স্বর্ণ-দীপাবলী
দীপিছে, সুরভি তৈলে পূর্ণ—হীনতেজাঃ
খদ্যোতিকাদ্যোতি যথা পূর্ণ-শশী-তেজে!
ফিরায়ে বদন, ইন্দু-বদনা ইন্দিরা
বসেন বিষাদে দেবী, বসেন যেমতি—
বিজয়া দশমী যবে বিরহের সাথে
প্রভাতয়ে গৌড়গৃহে—উমা চন্দ্রাননা!
করতলে বিন্যাসিয়া কপোল কমলা
তেজস্বিনী, বসি দেবী কমল-আসনে;—
পশে কি গো শোক হেন কুসুম-হৃদয়ে?
প্রবেশিলা মন্দগতি মন্দিরে সুন্দরী
মুরলা; প্রবেশি দূতী, রমার চরণে
প্রণমিলা, নতভাবে। আশীষি ইন্দিরা—
রক্ষঃ-কুল-রাজলক্ষ্মী—কহিতে লাগিলা;—
“কি কারণে হেথা আজি, কহ লো মুরলে,
গতি তব? কোথা দেবী জলদলেশ্বরী,
প্রিয়তমা সখী মম? সদা আমি ভাবি
তাঁর কথা। ছিনু যবে তাঁহার আলয়ে,
কত যে করিলা কৃপা মোর প্রতি সতী
বারুণী, কভু কি আমি পারি তা ভুলিতে?
রমার আশার বাস হরির উরসে;—
হেন হরি হারা হয়ে বাঁচিল যে রমা,

সে কেবল বারুণীর স্নেহৌষধ-গুণে।
ভাল ত আছেন, কহ, প্রিয়সখী মম
বারীন্দ্রাণী?” উত্তরিলা মুরলা রূপসী;
“নিরাপদে জলতলে বসেন বারুণী।
বৈদেহীর হেতু রাম-রাবণে বিগ্রহ;
শুনিতে লালসা তাঁর রণের বারতা।
এই যে পদ্মটী, সতি, ফুটেছিল সুখে
যেখানে রাখিতে তুমি রাঙা পা-দুখানি;
তেঁই পাশি-প্রণয়িনী প্রেরিয়াছে এরে।”
বিষাদে নিশ্বাস ছাড়ি কহিলা কমলা,
বৈকুণ্ঠধামের জ্যোৎস্না;—“হায় লো স্বজনি,
দিন দিন হীন-বীর্য্য রাবণ দুর্ম্মতি,
যাদঃ-পতি-রোধঃ যথা চলোর্ম্মি-আঘাতে!
শুনি চমকিবে তুমি। কুম্ভকর্ণ বলী
ভীমাকৃতি, অকম্পন, রণে ধীর, যথা
ভূধর, পড়েছে সহ অতিকায় রথী।
আর যত রক্ষঃ আমি বর্ণিতে অক্ষম।
মরিয়াছে বীরবাহু—বীর-চূড়ামণি।
ওই যে ক্রন্দন-ধ্বনি শুনিছ, মুরলে!
অন্তঃপুরে, চিত্রাঙ্গদা কাঁদে পুত্রশোকে
বিকলা। চঞ্চলা আমি ছাড়িতে এ পুরী।
বিদরে হৃদয় মম, শুনি, দিবা-নিশি

প্রমদা-কুল-রোদন! প্রতিগৃহে কাঁদে
পুত্ত্রহীনা মাতা, দূতি, পতিহীনা সতী।”
সুধিলা মুরলা;—“কহ, শুনি, মহাদেবি,
কোন্ বীর আজি পুনঃ সাজিছে যুঝিতে
বীরদর্পে?” উত্তরিলা মাধব রমণী;—
“না জানি কে সাজে আজি। চল লো মুরলে,
বাহিরিয়া দেখি মোরা কে যায় সমরে।”
এতেক কহিয়া রমা মুরলার সহ,
রক্ষঃকুল-বালা-রূপে, বাহিরিলা দোঁহে
দুকূল-বসনা। রুণু রুণু মধুবোলে
বাজিল কিঙ্কিণী; করে শোভিল কঙ্কণ;
নয়নরঞ্জন কাঞ্চী কৃশ কটিদেশে।
দেউল দুয়ারে দোঁহে দাঁড়ায়ে দেখিলা,
কাতারে কাতারে সেনা চলে রাজপথে,
সাগর-তরঙ্গ যথা পবন-তাড়নে
দ্রুতগামী। ধায় রথ, ঘুররে ঘর্ঘরে
চক্রনেমি। দৌড়ে ঘোড়া ঘোর ঝড়াকারে।
অধীরিয়া বসুধারে পদভরে, চলে
দন্তী, আস্ফালিয়া শুণ্ড, দণ্ডধর যথা
কাল-দণ্ড। বাজে বাদ্য গভীর নিক্কণে।
রতনে খচিত কেতু উড়ে শত শত
তেজস্কর। দুই পাশে, হৈম নিকেতন

রাতায়নে দাঁড়াইয়া ভুবনমোহিনী
লঙ্কাবধূ বরিষয়ে কুসুম-আসার,
করিয়া মঙ্গলধ্বনি। কহিলা মুরলা,
চাহি ইন্দিরার ইন্দু-বদনের পানে;—
ত্রিদিব-বিভব, দেবি, দেখি ভবতলে
আজি! মনে হয় যেন, বাসব আপনি
স্বরীশ্বর, সুর-বল-দল সঙ্গে করি,
প্রবেশিলা লঙ্কাপুরে। কহ কৃপাময়ি,
কৃপা করি কহ, শুনি, কোন্ কোন্ রথী
রণ-হেতু সাজে এবে মত্ত বীরমদে?”
কহিলা কমলা সতী কমলনয়না;—
“হায়, সখি, বীরশূন্য স্বর্ণ-লঙ্কাপুরী!
মহারথিকুল-ইন্দ্র আছিল যাহারা,
দেব-দৈত্য-নর-ত্রাস, ক্ষয় এ দুর্জ্জয়
রণে! শুভক্ষণে ধনুঃ ধরে রঘুমণি!
ওই যে দেখিছ রথী স্বর্ণ-চূড়-রথে,
ভীমমূর্ত্তি, বিরূপাক্ষ রক্ষোদল-পতি,
প্রক্ষ্বেড়নধারী বীর, দুর্ব্বার সমরে।
গজপৃষ্ঠে দেখ ওই কালনেমি, বলে
রিপুকুল-কাল বলী, ভিন্দিপালপাণি!
অশ্বারোহী দেখ ওই তালবৃক্ষাকৃতি
তালজঙ্ঘা, হাতে গদা, গদাধর যথা

মুরারি সমর-মদে মত্ত, ওই দেখ
প্রমত্ত, ভীষণ রক্ষঃ, বক্ষঃ শিলাসম
কঠিন! অন্যান্য যত কত আর কব?
শত শত হেন যোধ হত এ সমরে;
যথা যবে প্রবেশয়ে গহন বিপিনে
বৈশ্বানর, তুঙ্গতর মহীরুহব্যূহ
পুড়ি ভস্মরাশি সবে ঘোর দাবানলে।”
সুধিলা মুরলা দূতী;—“কহ, দেবীশ্বরি!
কি কারণে নাহি হেরি মেঘনাদ রথী
ইন্দ্রজিতে—রক্ষঃ কুল-হর্য্যক্ষ বিগ্রহে?
হত কি সে বলী, সতি, এ কাল সমরে?”
উত্তর করিলা রমা সুচারুহাসিনী;—
“প্রমোদ-উদ্যানে বুঝি ভ্রমিছে আমোদে,
যুবরাজ, নাকি জানি হত আজি রণে
বীরবাহু; যাও তুমি বারুণীর পাশে,
মুরলে! কহিও তাঁরে এ কনক-পুরী
ত্যজিয়া, বৈকুণ্ঠ-ধামে ত্বরা যার আমি।
নিজদোষে মজে রাজা লঙ্কা-অধিপতি।
হায়, বরিষার কালে বিমল-সলিলা
সরসী সমলা যথা কর্দ্দম-উদ্গমে,
পাপে পূর্ণ স্বর্ণলঙ্কা! কেমনে এখানে
আর বাস করি আমি? যাও চলি সখি,

প্রবাল-আসনে যথা বসেন বারুণী
মুক্তাময়-নিকেতনে। যাই আমি যথা
ইন্দ্রজিৎ, আনি তারে স্বর্ণ-লঙ্কা-ধামে।
প্রাক্তনের ফল ত্বরা ফলিবে এ পুরে।”
প্রণমি দেবীর পদে, বিদায় হইয়া,
উঠিলা পবন-পথে মুরলা রূপসী
দূতী, যথা শিখণ্ডিনী, আখণ্ডল-ধনুঃ
বিবিধ-রতন-কান্তি আভায় রঞ্জিয়া
নয়ন, উভয়ে ধনী মঞ্জু কুঞ্জবনে!
উতরি জলধি-কূলে, পশিলা সুন্দরী
নীল-অম্বু-রাশি। হেথা কেশব-বাসনা
পদ্মাক্ষী, চলিলা রক্ষঃ-কুল-লক্ষ্মী, দূরে
যথায় বাসব-ত্রাস বসে বীরমণি
মেঘনাদ। শূন্যমার্গে চলিলা ইন্দিরা।
কতক্ষণে উতরিলা হৃষীকেশ-প্রিয়া
সুকেশিনী, যথা বসে চির-রণজয়ী
ইন্দ্রজিৎ। বৈজয়ন্তধাম-সম পুরী,—
অলিন্দে সুন্দর হৈমময় স্তম্ভাবলী
হীরাচূড়; চারিদিকে রম্য বনরাজী
নন্দন কানন যথা। কুহরিছে ডালে
কোকিল; ভ্রমরদল ভ্রমিছে গুঞ্জরি;
বিকশিছে ফুলকুল; মর্ম্মরিছে পাতা;

বহিছে বসন্তানিল; ঝরিছে ঝর্ঝরে
নির্ঝর। প্রবেশি দেবী সুরর্ণ-প্রাসাদে,
দেখিলা সুবর্ণ-দ্বারে ফিরিছে নির্ভয়ে
ভীমরূপী বামাবৃন্দ, শরাসন-করে।
দুলিছে নিষঙ্গ-সঙ্গে বেণী পৃষ্ঠদেশে।
বিজলীর ঝলা সম, বেণীর মাঝারে,
রত্নরাজী, তূণে শর মণিময় ফণী!
উচ্চ কুচ-যুগোপরি সুবর্ণ-কবচ,
রবি-কর-জাল যথা প্রফুল্ল কমলে।
তূণে মহাখর শর; কিন্তু খরতর
আয়ত-লোচনে শর। নবীন-যৌবন-
মদে মত্ত, ফেরে সবে মাতঙ্গিনী যথা
মধুকালে। বাজে কাঞ্চী, মধুর শিঞ্জিতে,
বিশাল নিতম্ববিম্বে, নূপুর চরণে।
বাজে বীণা, সপ্তস্বরা, মুরজ, মুরলী;
সঙ্গীত তরঙ্গ মিশি সে রবের সহ,
উথলিছে চারিদিকে, চিত্ত বিনোদিয়া।
বিহারিছে বীরবর, সঙ্গে বরাঙ্গনা
প্রমদা, রজনীনাথ বিহারেন যথা
দক্ষ-বালা-দলে ল’য়ে; কিম্বা রে যমুনে,
ভানুসুতে, বিহারেন রাখাল যেমতি
নাচিয়া কদম্বমূলে, মুরলী অধরে,

গোপ-বধূ সঙ্গে রঙ্গে তোর চারুকুলে!
মেঘনাদধাত্রী নামে প্রভাষা রাক্ষসী।
তার রূপ ধরি রমা, মাধব-রমণী,
দিলা দেখা, মুষ্টে যষ্টি, বিশদ-বসনা।
কনক আসন ত্যজি, বীরেন্দ্রকেশরী
ইন্দ্রজিৎ, প্রণমিয়া ধাত্রীর চরণে,
কহিল;—“কি হেতু, মাতঃ, গতি তব আজি
এ ভবনে? কহ দাসে লঙ্কার কুশল?”
শিরঃ চুম্বি ছদ্মবেশী অম্বুরাশি-সুতা
উত্তরিলা;—“হায়! পুত্ত্র, কি আর কহিব
কনক-লঙ্কার দশা! ঘোরতর রণে,
হত প্রিয় ভাই তব রীরবাহু বলী!
তার শোকে মহাশোকী রাক্ষসাধিপতি,
সসৈন্যে সাজেন আজি যুঝিতে আপনি।”
জিজ্ঞাসিলা মহাবাহু বিস্ময় মানিয়া;—
“কি কহিলা, ভগবতি! কে বধিল, কবে
প্রিয়ানুজে? নিশা-রণে সংহারিনু আমি
রঘুবরে; খণ্ড খণ্ড করিয়া কাটিনু
বরষি প্রচণ্ড শর বৈরী-দলে; তবে
এ বারতা,—এ অদ্ভুত-বারতা, জননি!
কোথায় পাইলে তুমি, শীঘ্র কহ দাসে?”
রত্নাকর-রত্নোত্তমা ইন্দিরা-সুন্দরী

উত্তরিলা;—“হায়! পুত্ত্র, মায়াবী মানব
সীতাপতি; তব শরে মরিয়া বাঁচিল।
যাও তুমি ত্বরা করি; রক্ষ রক্ষঃকুল-
মান, এ কাল-সমরে, রক্ষঃ-চূড়ামণি!”
ছিঁড়িলা কুসুমদাম রোষে মহাবলী
মেঘনাদ; ফেলাইলা কনক-বলয়
দূরে, পদ-তলে পড়ি শোভিল কুণ্ডল,
যথা অশোকের ফুল অশোকের তলে
আভাময়! “ধিক্ মোরে” কহিলা গম্ভীরে
কুমার;—“হা ধিক্ মোরে। বৈরিদল বেড়ে
স্বর্ণলঙ্কা, হেথা আমি বামাদল-মাঝে?
এই কি সাজে আমারে? দশাননাত্মজ
আমি ইন্দ্রজিৎ; আন রথ ত্বরা করি;
ঘুচাব এ অপবাদ, বধি রিপুকুলে।”
সাজিলা রথীন্দ্রর্ষভ বীর-আভরণে,
হৈমবতীসুত যথা নাশিতে তারকে
মহাসুর; কিম্বা যথা বৃহন্নলারূপী
কিরীটী বিরাটপুত্ত্রসহ উদ্ধারিতে
গোধন, সাজিলা শূর শমীবৃক্ষমূলে।
মেঘবর্ণ রথ; চক্র বিজলীর ছটা;
ধ্বজ ইন্দ্রচাপরূপী; তুরঙ্গম বেগে
আশুগতি। রথে চড়ে বীর-চুড়ামণি

বীরদর্পে, হেনকালে প্রমীলা সুন্দরী,
ধরি পতি-কর-যুগ (হায় রে, যেমতি
হেমলতা আলিঙ্গয়ে তরু-কুলেশ্বরে)
কহিল কাঁদিয়া ধনী;—“কোথা প্রাণসখে,
রাখি এ দাসীরে, কহ, চলিলা আপনি?
কেমনে ধরিবে প্রাণ তোমার বিরহে
এ অভাগী? হায়, নাথ, গহন কাননে,
ব্রততী বাঁধিলে সাধে করি-পদ, যদি
তার রঙ্গরসে মন না দিয়া, মাতঙ্গ
যায় চলি, তবু তারে রাখে পদাশ্রয়ে
যূথনাথ। তবে কেন তুমি, গুণনিধি,
ত্যজ কিঙ্করীরে আজি?” হাসি উত্তরিলা
মেঘনাদ;—“ইন্দ্রজিতে জিতি তুমি, সতি,
বেঁধেছে যে দৃঢ় বাঁধে, কে পারে খুলিতে
সে বাঁধে? ত্বরায় আমি আসিব ফিরিয়া
কল্যাণি! সমরে নাশি তোমার কল্যাণে
রাঘবে। বিদায় এবে দেহ, বিধুমুখি!”
উঠিল পবন-পথে, ঘোরতর রবে,
রথবর, হৈমপাখা বিস্তারিয়া যেন
উড়িলা মৈনাক-শৈল অম্বর উজলি!
শিঞ্জিনী আকর্ষি রোষে টঙ্কারিলা ধনুঃ
বীরেন্দ্র, পক্ষীন্দ্র যথা নাদে মেঘমাঝে

ভৈরবে। কাঁপিলা লঙ্কা, কাঁপিলা জলধি!
সাজিছে রাবণ রাজা, বীরমদে মাতি;—
বাজিছে রণ-বাজনা; গরজিছে গজ;
হ্রেষে অশ্ব; হুঙ্কারিছে পদাতিক, রথী;
উড়িছে কৌশিক-ধ্বজ; উঠিছে আকাশে
কাঞ্চন-কঞ্চুক-বিভা; হেনকালে তথা
দ্রুতগতি উত্তরিলা মেঘনাদ রথী।
নাদিল কর্ব্বুরদল হেরি বীরবরে
মহাগর্ব্বে। নমি পুত্ত্র পিতার চরণে,
করযোড়ে কহিলা;—“হে রক্ষঃকুল-পতি!
শুনেছি, মরিয়া না কি বাঁচিয়াছে পুনঃ
রাঘব? এ মায়া, পিতঃ, বুঝিতে না পারি!
কিন্তু অনুমতি দেহ; সমূলে নির্ম্মূল
করিব পামরে আজি! ঘোর শরানলে
করি ভস্ম, বায়ু-অস্ত্রে উড়াইব তারে;
নতুবা বাঁধিয়া আনি দিব রাজ-পদে।”
আলিঙ্গি কুমারে, চুম্বি শিরঃ, মৃদুস্বরে
উত্তর করিলা এবে স্বর্ণ-লঙ্কাপতি;
“রাক্ষস-কুল-শেখর তুমি, বৎস! তুমি
রাক্ষস-কুল-ভরসা। এ কাল-সমরে
নাহি চাহে প্রাণ মম পাঠাইতে তোমা
বারম্বার! হায়, বিধি বাম মম প্রতি।

কে কবে শুনেছে, পুত্ত্র, ভাসে শিলা জলে,
কে কবে শুনেছে, লোক মরি পুনঃ বাঁচে?”
উত্তরিলা বীরদর্পে অসুরারি-রিপু;—
"কি ছার সে নর, তারে ডরাও আপনি,
রাজেন্দ্র? থাকিতে দাস, যদি যাও রণে
তুমি, এ কলঙ্ক, পিতঃ, ঘুষিবে জগতে।
হাসিবে, মেঘবাহন; রুষিবেন দেব
অগ্নি। দুইবার আমি হারানু রাঘবে;
আর একবার পিতঃ, দেহ আজ্ঞা মোরে,
দেখিব এবার বীর বাঁচে কি ঔষধে!”
কহিলা রাক্ষসপতি;—“কুম্ভকর্ণ বলী
ভাই মম, তায় আমি জাগানু অকালে
ভয়ে; হায়, দেহ তার, দেখ, সিন্ধুতীরে
ভূপতিত, গিরিশৃঙ্গ কিম্বা তরু যথা
বজ্রাঘাতে! তবে যদি একান্ত সমরে
ইচ্ছা তব, বৎস, আগে পূজ ইষ্টদেব,—
নিকুম্ভিলা যজ্ঞ সাঙ্গ কর, বীরমণি!
সেনাপতি-পদে আমি বরিনু তোমারে।
দেখ, অস্তাচলগামী দিননাথ এবে;
প্রভাতে যুঝিও, বৎস, রাখবের সাথে।”
এতেক কহিয়া রাজা, যথাবিধি ল’য়ে
গঙ্গোদক, অভিষেক করিলা কুমারে।

অমনি বন্দিল বন্দী, করি বীণাধ্বনি
আনন্দে; “নয়নে তব, হে রাক্ষস-পুরি,
অশ্রুবিন্দু; মুক্তকেশী শোকাবেশে তুমি!
ভূতলে পড়িয়া, হায়, রতন-মুকুট,
আর রাজ-আভরণ, হে রাজসুন্দরি,
তোমার! উঠ গো, শোক পরিহরি, সতি!
রক্ষঃকুল-রবি ওই উদয় অচলে।
প্রভাত হইল তর দুঃখ বিভাবরী!
উঠ রাণি, দেখ, ওই ভীম বাম করে
কোদণ্ড, টঙ্কারে যার বৈজয়ন্ত ধামে
পাণ্ডুবর্ণ আখণ্ডল। দেখ তূণ, যাহে
পশুপতি-ত্রাস অস্ত্র পাশুপত-সম!
গুণিগণ-শ্রেষ্ঠ গুণী, বীরেন্দ্র-কেশরী,
কামিনীরঞ্জন রূপে, দেখ মেঘনাদে।
ধন্য রাণী মন্দোদরী! ধন্য রক্ষঃপতি
নৈকষেয়! ধন্য লঙ্কা, বীরধাত্রী তুমি!
আকাশ-দুহিতা ওগো শুন প্রতিধ্বনি,
কহ সবে মুক্তকণ্ঠে, সাজে অরিন্দম
ইন্দ্রজিৎ। ভয়াকুল কাঁপুক্ শিবিরে
রঘুপতি, বিভীষণ, রক্ষঃ কুল-কালি,
দণ্ডক-অরণ্যচর ক্ষুদ্র প্রাণী যত।”
বাজিল রাক্ষস-বাদ্য, নাদিল রাক্ষস,—
পূরিল কনক-লঙ্কা জয় জয় রবে।

ইতি শ্রীমেঘনাদবধকাব্যে অভিষেকো নাম

প্রথমঃ সর্গঃ।

প্রথম সর্গ

সম্মুখ সমরে—in a face-to-face battle.
অকালে—at an untimely hour.
বীরবাহু চিত্রসেন নামক গন্ধর্ব্বকন্যা চিত্রাঙ্গদাকে রাবণ হরণ করিয়া আনেন। বীরবাহু তাঁহারই গর্ভজাত পুত্র।
রক্ষঃকুলনিধি রাঘবারি—রাক্ষসবংশশ্রেষ্ঠ রাবণ; Ravana (the enemy of Raghaba i.e. Ramchandra), the greatest of the Rakshasas.
কি কৌশলে—by what strategy.
রাক্ষসভরসা ইন্দ্রজিৎ মেঘনাদে—Meghanada, the conqueror of Indra, and the hope of the Rakshasas.
অজেয়—unconquerable.
উর্ম্মিলাবিলাসী—the lover of Urmila i.e. Lakshmana. Note the epithets used of Meghanada, and the epithet used of Lakshmana. The poet describes Megha nada as a great hero, and Lakshmana as a lover. It is curious that a lover should conquer a great hero. Hence the question কি কৌশলে etc.
চরণারবিন্দ—চরণ + অরবিন্দ; চরণপদ্ম। Lotus-like feet.
মন্দমতি—of poor intellect.
শ্বেতভুজে ভারতি—Oh Bharati of white arms.

 যেমতি মাতঃ ইত্যাদি—পুরাণে লিখিত আছে যে, কবিগুরু বাল্মীকি যৌবনাবস্থায় অতি দুরাচার ও দুর্ব্বৃত্ত ছিলেন। কোনও সময়ে ভগবান্ ব্রহ্মা ঋষিরূপ ধারণ পূর্ব্বক তাঁহাকে অনেক ভর্ৎসনা করাতে, তিনি অসৎ পথ পরিত্যাগ করিয়া কঠোর তপস্যা আরম্ভ করিলেন। একদা তিনি স্নান করিয়া আপন আবাসে প্রত্যাগমন করিতেছেন, এমন সময়ে একজন ব্যাধ কামক্রীড়ামত্ত ক্রৌঞ্চমিথুনের মধ্যে ক্রৌঞ্চকে বাণাঘাতে বধ করিল। এতাদৃশ ক্রূরাচরণ দর্শনে ক্রুদ্ধ হওয়ায় নিম্নলিখিত শ্লোকটী তাঁহার মুখ হইতে নির্গত হইল:—

মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং ত্বমগমঃ শাস্বতীঃ সমাঃ
যৎ ক্রৌঞ্চমিথুনাদেকমবধীঃ কামমোহিতম্॥

 ওরে নিষাদ! তুই অকারণে ক্রৌঞ্চমিথুনের মধ্যে কামমোহিত ক্রৌঞ্চকে বধ করিলি, অতএর এই পৃথিবীতে তুই কখনই প্রতিষ্ঠা লাভ করিতে পারিবি না। সেই শুভক্ষণ অবধি ভারতে কবিতার সৃষ্টি হইল। এস্থলে গ্রন্থকার, সরস্বতীর নিকট এই প্রার্থনা করিতেছেন, যে তিনি যেমন কামাসক্ত ক্রৌঞ্চের নিধনাবসরে বাল্মীকির রসনাগ্রে অধিষ্ঠিতা হইয়াছিলেন, তেমনি যেন এ গ্রন্থকারের প্রতিও সানুকম্পা হন। এই কাব্যখানির অনেক স্থান বাল্মীকিক্বত রামায়ণ অবলম্বন করিয়া রচিত হইয়াছে, এই হেতু কবি বাল্মীকির ভারতীকে আরাধনা করিতেছেন।

ক্রৌঞ্চবধূসহ—অর্থাৎ ক্রৌঞ্চবধূসহবাসী; cohabiting with the she-heron.
নরাধম আছিল ইত্যাদি—যে নরাধম যৌবনকালে দক্ষাবৃত্তি রত ছিল, (অর্থাৎ বাল্মীকি) সে এক্ষণে তোমার প্রসাদে অমর হইয়াছে।
মৃত্যুঞ্জয়—অমর; conqueror of Death.
মৃত্যুঞ্জয় উমাপতি—মহেশ্বর, শিব; Siva, the husband of Uma and the conqueror of Death.
হে বরদে—O Thou, giver of boons.
রত্নাকর—বাল্মীকির পূর্ব্বনাম।
কাব্যরত্নাকর—কাব্যসাগর; ocean of Poetry.
সুচন্দন বৃক্ষপোতা বিষযুক্ষ ধরে—The tree of poison wears the beauty of a good sandal tree.
কিন্তু যে গো......... সমধিক—The mother looks with the greatest affection upon that one child who is the worst of the unworthy children.
উর—আবির্ভূতা হও—appear; come down.
বিশ্বরমে—হে বিশ্বসন্তোষদায়িনি; Oh pleasuregiver of the universe.
মধুকরী কল্পনা—রূপক অলঙ্কার। কবিকল্পনাও যেন একজন দেবী। Imagination, the honeymaker.
কবির চিত্তফুলবনমধু লয়ে—with the honey of the flower garden of the mind of a poet. কবির চিত্ত has been compared to a ফুলবন।
মধুচক্র—honey-comb.
যাহে—যাহাতে, so that.
গৌড়জন—বঙ্গবাসী, The people of Bengal.
হেমকূট—the name of a mountain.
হৈমশিরে—on the golden top; on the top bright with the golden rays of the sun. কনক আসন—is compared with হেমকূটহৈমশির।
শৃঙ্গবর—a great peak. দশানন is compared with the great-peak.
সভা—সভাস্থল, court house.
স্ফটিকে গঠিত—This should be connected with সভা made of crystal.
রত্নরাজী—রত্নসমূহ; groups of jewels.
মানস সরসে—in the lake of Manasar.
সরস—রসযুক্ত, juicy.
স্তম্ভ—লাম, pillars.
স্বর্ণছাদ—Roof of gold.
ফণীন্দ্র—নাগেন্দ্র রাসুকি Vasuki, the lord of serpents.
বিস্তারি অযুত ফণা—expanding ten thousand hoods; with numerous hoods expanded.
ঝলি—ঝল ঝল করিয়া; Dazzling.
ঝালরে—in the fringe.
খচিত মুকুলে ফুলেে—adorned with buds and flowers.
ব্রতালয়েে—In a festive house.
ক্ষণপ্রভা—বিদ্যুৎ; lightning.
রতনসম্ভবা— ত্নজাতা, রত্ন হইতে উৎপন্না—produced by gems and jewels. বিভা—আলোক; light.
ঝলসি নয়নে—dazziling the eyes.
চামর—a chowrie. চারুলোচনা কিঙ্করী—maidservants with charming eyes.
মৃণালভুজ—arm like the stalk of a lotus.
চন্দ্রাননা—having moon-like faces.
হরকোপানলে—in the fire of the anger of Hara or Siva.
কাম—মদন—Cupid. দৌবারিক—দ্বারী gate-keeper.
রুদ্রেশ্বর—রুদ্রপতি; Lord of the Rudras.
শূলপাণি—যাঁহার পাণিতে অর্থাৎ হস্তে শূল; অর্থাৎ শিব।
রঙ্গে—playfuly; merrilly.
কাকলী—দূরাগত মৃদুমধুর ধ্বনি; Sounds mellowed and sweetened by distance.
লহরী—তরঙ্গ; wares.
ময়—ময়নামক দানব একজন বিখ্যাত শিল্পী ছিলেন। তিনি যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞের সভাগৃহ নির্মাণ করেন।
তুষিতে পৌরবে—in order to satisfy the Pauravas.
কাল-তরঙ্গ—The waves of Time.
নৈকষেয়— Ravana, the son of Nikasa. Nikasa was the mother of Ravana.
ঘন—মেঘ; clouds. দিননাথ-সূর্য্য; the sun.
নিশার স্বপন সম—like the dream of the night.
ধনুর্দ্ধর—archer.
ফুলদল দিয়া— with the petals of flowers.
কাল-সমরে—In this deadly war.
শূলী শম্ভুসম—ত্রিশূলধারী শিবের ন্যায় প্রতাপশালী; powerful like Siva armed with His trident.
রাক্ষসকুলরক্ষণ—রাক্ষস বংশরক্ষাকারী, the preserver of the family of the Rakshasas.
কাল পঞ্চবটী বনে—in the deadly forest of Panchavati.
কালকূটে ভরা—filled with poison.
ভুজগ—সর্প; snake.
পাবকশিখারূপিণী—অগ্নিশিখা তুল্য, like the flame of Fire.
হৈম গেহ—House of gold.
দাম—(১) সমূহ, collection. (২) রজ্জু, মালা; string; wreath.
নাট্যশালা সম—like a theatre.
দেউটি—প্রদীপ; lamp.
রবাব—বেহালা বিশেষ; a kind of violin.
ভীমবাহু—ভয়ঙ্কর বাহু যাহার; fierce-armed; with dreadful arms.
বুধ—জ্ঞানী; a wise man.
শেখর—(১) চূড়া, crest. (২) মুকুট crown.
রাক্ষসকুলশেখর—the crest or crown of the Rakshasa family; the best of the Rakshasa family.
অভ্রভেদী—আকাশভেদী; penetrating into the sky.
ভূধর—পর্ব্বত; mountain.
মায়াময়—full of illusions; illusive, deceptive.
কুবলয় ধন—the wealth of lotuses.
অমরত্রাস—অমরগণ অর্থাৎ দেবগণ যাহাকে ভর করেন; the dread of the Devas.
মদকল—মদমত্ত; intoxicated with the juice which flows from the temples of an elephant.
বীরকুঞ্জর—বীরশ্রেষ্ঠ; the greatest of heroes.
কুঞ্জর—হস্তী। এখানে কুঞ্জর পদ শ্রেষ্ঠার্থবাচক।
ইরম্মদ—বজ্রাগ্নি; the fire of thunder.
পবনপথ—আকাশ; the sky.
কোদণ্ড—ধনু; bow.
টঙ্কার—twang.
ঘন ঘনাকারে—in the form of dense clouds.
বিদ্যুৎঝলা সম―like the dash of lightning.
চক্‌মকি—চক্‌মক্‌ করিয়া; shining.
কলম্বকুল—তীরসমূহ; flight of arrows.
অম্বরপ্রদেশে—আকাশ প্রদেশে; in the region of the sky.
বাসবের চাপ—ইন্দ্রের ধনু; the bow of Indra the rainbow.
মন্দোদরী-মনোহর—The charmer of the mind of Mandodari; i. e., Ravana the husband of Mandadari.
সন্দেশবহ—সংবাদবাহক; messenger.
হর্য্যক্ষ-সিংহ; lion.
দ্বন্দ্বি—দ্বন্দ্ব বা কলহ করিয়া; যুদ্ধ করিয়া; fighting; quarrelling.
নির্ঘোষে—চীৎকার করে; roars; thunders.
ভাতিল—দীপ্ত হইল; shone.
চর্ম্মাবলী—ঢাল সমূহ; numbers of shields.
কম্বু—শঙ্খ; conch.
অম্বুরাশিরবে—জলরাশির শব্দে; with the roars of the mass of waters.
অস্ত্রলেখা—অস্ত্রের দাগ; marks of weapon.
সাবাসি দূত—Bravo, messenger.
বীরপুত্ত্র ধাত্রী—the foster mother of heroic sons.
দিনমণি—(বিশেষ্য) সূর্য্য; sun.
অংশুমালী (বিশেষণ) কিরণমালাধারী; wearing the wreath of his rays.
কাঞ্চনসৌধ কিরিটীনী—কাঞ্চন অর্থাৎ স্বর্ণ দ্বারা নির্ম্মিত সৌধ অর্থাৎ অট্টালিকা যাহার কিরীট বা মুকুট স্বরূপ; wearing the crown of the palaces of gold.
উৎস—a fountain; a spring. রজঃছটা—রজতছটা; having the ছটা or splendour of রজত or silver; silvery.
হীরাচুড়াশিরঃ—হীরকনির্ম্মিত চূড়া হইতেছে শিরঃ যাহার; of which the summit is a pinnacle of diamond.
দেবগৃহ—মন্দির; temple.
জগৎবাসনা—জগতের আকাঙ্ক্ষিত বস্তু; the desire of the world.
শৃঙ্গধর—পর্ব্বত; যে শৃঙ্গ ধারণ করে; mountain.
বৈদেহীহর—সীতাহরণকারী; the abductor of Vaidehi or Sita.
বালিবৃন্দ সিন্ধুতীরে যথা—বেরূপ সমুদ্রতীরে নগণ্য রালুকারাশি; unnumerable like the sands on the sea-shore.
থানা দিয়া পূর্ব্ব দ্বারে—guarding the eastern gate.
করভ—হস্তিশিশু; the young of an elephant.
বিচিত্র—জমকাল, সুন্দর; gaudy.
কঞ্চুক—সর্পচর্ম্ম; the skin of a snake.
ঊর্দ্ধফণা—with his hood raised up.
লুলি—কাঁপাইয়া; shaking; trembling.
অবলেপে—গর্ব্বে; proudly.
কৌমুদী—moonlight.
কুমুদরঞ্জন—চন্দ্র; চন্দ্রালোকে কুমুদফুল প্রস্ফুটিত হয় বলিয়া কবিগণ চন্দ্রকে কুমুদিনীনায়ক, কুমুদিনীপতি ইত্যাদি আখ্যা প্রদান করেন। কুমুদরঞ্জন—the moon, the lover of the water-lily.
প্রসরণ—প্রাচীর; wall.
কেশরী-কামিনী—সিংহের স্ত্রী অর্থাৎ সিংহী; lioness.
ভীমাসমা—চণ্ডীর ন্যায়; like the fierce-looking goddess Chandi.
সমলোভী—একই প্রকারে লোভযুক্ত; greedy for the same thing.
নিষাদী—গজারোহী; the rider of an elephant; a soldier fightin on elephant-back.
সাদী—অশ্বারোহী; horseman.
শীর্ষক—পাগড়ি; turban.
হৈম ধ্বজদণ্ড—সুবর্ণনির্ম্মিত পতাকার দণ্ড; the stick of the banner of gold.
ধ্বজবহ—পতাকাবাহী; flag-bearer.
স্বর্ণচূড়—স্বর্ণনির্ম্মিত চূড়ার ন্যায় চূড়া বাহার; স্বর্ণনিস্মিত চূড়ার ন্যায় শীষ যাহার; which has ears like tops of gold.
স্নেহনীড়ে—স্নেহপূর্ণ নীড়ে, অর্থাৎ স্নেহময় ক্রোড়ে; in the affectionate arms.
গরুড়—গরুড়ের ন্যায় প্রতাপশালী; powerful like the Gadura.
কালপৃষ্ট—কর্ণের ধনুর নাম; the name of the bow of Karna.
একাঘ্নী—যাহা মাত্র একজনকে বিনাশ করে; the destroyer of only one.
বীরেন্দ্র-কেশরী—বীরেন্দ্রশ্রেষ্ঠ; বীরশ্রেষ্ঠগণের মধ্যেও শ্রেষ্ঠ; the greatest of the most heroic.
সিংহ, কেশরী, ঋষভ, কুঞ্জর ইত্যাদি শ্রেষ্ঠার্থবাচক।
বীরকুলর্ষভ—the greatest of the class of heroes
প্রচেতঃ—বরুণদেব; Varuna the ocean-god.
প্রভঞ্জন—পবনদেব; Pavana, the god of winds
নিগড়—শৃঙ্খল; chain; bondage.
বীতংস—মৃগপক্ষীদিগের বন্ধনোপকরণ, ফাঁসি; noose to fasten the beasts and birds.
নীলাম্বুস্বামি—হে নীল জলরাশির কর্ত্তা; Oh Lord of the blue ocean.
কৌস্তুভ রতন—the jewel called Kaustava.
বলি—‘বলী’ এই শব্দের সম্বোধন পদ; O powerful being.
জাঙাল—বাঁধ; embankment.
কিঙ্কিণীর বোল—অলঙ্কার সমূহের শব্দ; the sound of the ornaments.
কবরী রন্ধন—চুল বান্ধা; the dressing of hair into a knot.
আলু থালু—উন্মুক্ত; dishevelled; disordered.
পদ্মপর্ণ—পদ্মপত্র, the petals of lotuses.
বিবশা—বলহীনা; অস্থিরা; having no self-control.
সুরসুন্দরী—বিদ্যুৎ; lightning.
প্রলয়বায়ু—ধ্বংসকালীন ঝড়; the storm at the time of destruction
আসার—বৃষ্টি-ধারা; the lines of rain.
জীমূত—মেঘ; cloud.
মন্দ্র— ধ্বনি; sound.
শোকের ঝড়...... হাহাকার রব—A storm of grief blew in the court. The females were, as it were, the lightning; their dishevelled hair was, as it were, the cloud; their tears were, as it were, the rains; and the cries of grief were, as it were, the roars of clouds.
রাজধর্ম্ম—kingly virtue. গঞ্জনা—তিরস্কার; rebuke.
গ্রহদোষে দোষী—গ্রহবৈগুণ্যাধীন; who is under the evil influence of planets.
বরজ—a garden of betel plants.
সজারু—a porcupine. বারুই—betel planter.
শিমুলশিম্বী—শিমূল গাছের শিম্ব অর্থাৎ তুলার পাব্‌ড়া; the kidney bean of the silk cotton tree.
বলে—forcibly.
ইন্দুনিভাননে—‘ইন্দুনিভাননা’ এই শব্দের সম্বোধন পদ। ইন্দু—চন্দ্র। নিভ—ন্যায়। আনন—মুখ। ইন্দুনিভাননে—O thou moon-faced.
বীর প্রসূন—the flower of a hero.
প্রসূ—জননী; mother.
রজত প্রাচীর সম—like a wall made of silver.
কাকোদর—সর্প; snake, serpent.
অরাবণ—রাবণশূন্য; Ravanaless.
অরাম—রামশূন্য; Ramless.
কর্ব্বুর বৃন্দ—রাক্ষস সমূহ; numbers of Rakshasas.
বারী—গজগৃহ; elephant-shed.
বারণযূথ—হস্তিযূথ; crowds of elephants.
মন্দুরা—অশ্বশালা; horse-shed; stable
মুখস লাগায়; bridle.
কনকশিরস্ক—স্বর্ণভূষিত পাগড়ী যাহার—having a turban adorned with gold.
ভাস্বর পিধানে—উজ্জ্বল আবরণে; in a brilliant sheath.
বর্ম্ম ঢাল; shield.
আয়সী—লৌহ আবরণ; সাঁজোয়া; iron-mail.
আয়সী-আবৃতদেহ—with their body protected with iron-mail
হয়ব্যূহ—অশ্ব সমূহ; crowds of horses.
পরশু—কুঠার; axe. শ্রবণপথ—কর্ণ; ears.
বারীশ—জলপতি বরুণ; Varuna, the god of the sea.
প্রবাল আসনে—on the throne made of corals.
বারুণী—wife of Varuna.
জলেশ—same as বারীশ।
পাশী—পাশ অস্ত্রধারী; whose weapon is a noose.
লাঘবিতে—লঘু করিতে to lighten.
গৃহে—অর্থাৎ বৈকুণ্ঠে। চটুলা—চঞ্চলা; restless.
ধনী—যুবতী বালিকা; a young girl.
সফরী is here comparend to a young girl.
রজত—রৌপ্য, silver. কান্তি—শোভা; beauty.
ছটা—আভা; splendour.
বিভ্রম—শোভা; beauty.
রজতকান্তিছটা বিভ্রম—রৌপ্যের শোভার আভারূপ বিভ্রম; the beauty of the splendour of silver.
বিভাবসুরে—বিভাবসুকে, সূর্য্যকে; to the sun.
মদনমোহন—বিষ্ণু; Vishnu.
কমলপদ—পরিমল আশে—with the hope of smelling the fragrance of the lotus of foot. পদ্মের ন্যায় পদের সুগন্ধের আশায়।
ধনদ—কুবের, Kuvera. দেউল—মন্দির, temple.
বিন্যাসিয়া—বিন্যস্ত করিয়া; Placing.
কপোল—গণ্ডস্থল; cheek. উরস্‌—বক্ষঃস্থল; breast.
রমার আশার বাস হরির উরসে—the abode of the hope of Lakshmi is in the breast of Hari.
যাদঃ—ভীষণ সামুদ্রিক প্রাণী; a sea-monster.
যাদঃপতি—Lord of sea monsters, i.e the ocean.
রোধঃ—তট; shore.
চলোর্ম্মি—চঞ্চল তরঙ্গ; restless waves; breakers
যাদঃপতিরোধঃ যথা চলোর্ম্মি আঘাতে—as is the case with the sea-shore being beaten by restless breakers.
অতিকায়—রাবণের পুত্র।
প্রমদাকুল রোদন—the weepings of the females.
দুকূলবসনা—দুকূল অর্থাৎ পট্টবস্ত্র বসন যাহাদের; covered with pieces of cloth.
চক্রনেমি—চক্রের পরিধি; the circumference of the wheel.
দন্তী—দন্তবিশিষ্ট হস্তী; tusker.
দণ্ডধর—Yama is called, দণ্ডধর, as he is armed with a দণ্ড or club.
নিক্কণ—শব্দ; sound.
ত্রিবিদবিভব—স্বর্গসম্পদ; the wealth of the Heaven.
স্বরীশ্বর—স্বর্গপতি; Lord of the kingdom of Heaven.
মহারথিকুল ইন্দ্র—মহারথিগণ মধ্যে শ্রেষ্ঠ; the best among the great chariot-warriors.
মহারথী—অত্যন্ত যুদ্ধ বিশারদ; যে যোদ্ধা একাকী দশ সহস্র ধনুর্দ্ধারীর সহিত যুদ্ধ করিতে পারেন
প্রক্ষ্বেড়ন—লৌহধনুঃ—an iron-bow.
রিপুকুল কাল—the death of the enemies.
বলে রিপুকুলকাল বলী—In respect of strength the strong hero is, as it were, the Yama to the enemies,
বৈশ্বানর—অগ্নিদেব; fire god.
তুঙ্গতর—উচ্চতর; higher taller.
মহীরুহব্যূহ—বৃক্ষসমূহ; number of trees.
বিমলসলিলা—নির্ম্মল জল যাহার; having clear and transparent water.
সমলা—মলাযুক্ত; dirty.
প্রাক্তন—অদৃষ্ট; fate.
শিখণ্ডিনী—ময়ূরিণী; peahen.
আখণ্ডল—ইন্দ্র।
কান্তি—সৌন্দর্য্য।
আখণ্ডলধনুঃ বিবিধ রতনকান্তি আভায়—ইন্দ্রধনুর নানাপ্রকার রত্নের সৌন্দর্য্যের আভা দ্বারা। ইন্দ্রধনু নানা প্রকার রত্নের দ্বারা নির্ম্মিত বলিয়া কবিকল্পনা
রঞ্জিয়া—রঞ্জন করিয়া; প্রীত করিয়া; gratifying.
মঞ্জু—সুন্দর, মনোহর; beautiful.
কুঞ্জবন—grove.
পবনপথে—আকাশে; in the sky.
উঠিলা পবন পথে......ধনী মঞ্জু কুঞ্জবনে—Murala has clothes and ornaments of variegated colours. The peahen has a body of variegated colours. Both of them are gaudy like the rainbow and are pleasing to the eyes. The flight of Murala is compared to the flight of a peahen proceeding to a beautiful grove.
বৈজয়ন্ত ধাম সম—স্বর্গ ধামের ন্যায়; like the Heaven.
অলিন্দ—বারান্দা; veranda.
বসন্তানিল—বসন্তবায়ু; the air of the spring season.
শরাসন—শরের আসন অর্থাৎ ধনু; bow.
নিষঙ্গ—তূণীর; quiver.  বেণী—braid of hair.
মণিময় ফণী—serpents with jewels. The arrows with brilliant ends are compared to serpents with jewels on their heads.
কুচযুগ—the pair of breasts.  কবচ—সাঁজোয়া; breast-plate; armour for the breast.
মধুকালে—in the spring season.
শিঞ্জিত ধ্বনি; the tingling.
নিতম্ববিম্ব—the disk of the buttocks of a woman.
বরাঙ্গনা—the best of woman.
দক্ষবালাদল—the daughters of Daksha.
ভানুসুতে—হে সূর্য্যতনয়ে, Oh daughter of the sun. The river Jumna is so called.
বিশদবসনা—dressed with white clothes. বিশদ—white.
অম্বুরাশিসুতা—the daughter of the Ocean. Lakshmi is so called.
রত্নাকর রত্নোত্তমা—the best of the jewels of the mine of jewels; the best of the jewels of the sea viz. Lakshmi.
ইন্দিরা—i.e. Lakshmi.
কুণ্ডল—an ear ring. রথীন্দ্রর্ষভ— রথি + ইন্দ্র + ঋষভ। ঋষভ—a bull. Here it is শ্রেষ্ঠার্থবাচক।
বীর-আভরণ—Ornaments worthy of a hero.
হৈমবতীসুত—i.e. Kartikeya, son of Haimabati or Durga.
তারক—the giant named Taraka.
কিরীটী—i.e. Arjuna. মেঘবর্ণ—dark as clouds.
চক্রবিজলীর ছটা—the wheels stand for the flashes of lightning.
ধ্বজ ইন্দ্রচাপরূপী—the banner is like the bow of Indra.
তুরঙ্গম—the horse. বেগে—in respect of speed.
আশুগতি—whose speed is swift; i.e. the wind.
ব্রততী—creeper. করিপদ—the feet of the elephant.
যূথনাথ—the lord of the herd i.e. the greatest of the elephants.
উজলি—Brightening. শিঞ্জিনী—the string of the bow. পক্ষীন্দ্র—i.e. Garuda.
কৌশিক—the name of Indra.
কৌশিকধ্বজ—the banner of Indra.
কাঞ্চনকঞ্চুকবিভা—the brilliance of the armour of gold.
বাম মম প্রতি—unfavourable to me.
অসুরারিরিপু—the enemy of the enemy of the Asuras i.e. the enemy of Indra i.e. Indrajit,
মেঘবাহন—Indra who is borne by clouds.
দেব অগ্নি—The fire was the god whom Indrajit worshipped.
গঙ্গোদক—the sacred water of the Ganges.
অভিষেক করিলা কুমারে—sprinkled his son with water.
বন্দিল—বন্দনা করিল; sang in praise.
বন্দী—স্তুতিপাঠক; a panegyrist, or bard attached to the court of prince.
পাণ্ডুবর্ণ—pale with fear. আখণ্ডল—Indra.
হে রাক্ষসপুরি—Oh the city of Lanka.
ওই ভীম বাম করে—in that dreadful left hand of Meghnada. পশুপতি—Siva.
পশুপতি-ত্রাস—causing fear even to Siva.
পাশুপত-সম—পাশুপত অস্ত্রের ন্যায়; শিবপ্রদত্ত অস্ত্রের ন্যায়, like the weapon given by Pasupati or Siva.
আকাশদুহিতা—Echo is so called. She is called the daughter of the sky.
অরিন্দম—শত্রুদমন, the subduer of enemies.
রক্ষঃকুলকালি—the dirt or stain of the Rakshasa family.