সময় অসময় নিঃসময়/নাস্তিকতার সমাজতত্ত্ব

উইকিসংকলন থেকে

নাস্তিকতার সমাজতত্ত্ব

 আস্তিক ও নাস্তিকের দ্বন্দ্র নানা পর্যায়ে নানা অনুষঙ্গে, আজও আমাদের সমাজে প্রাসঙ্গিক। ইতিহাস যদি সরলরেখায় এগোত, তাহলে হয়তো এই দ্বন্দুের ছায়া এতটা গাঢ় হত না। কিন্তু তা তো হয়ই না, বরং তৃতীয় সহস্রাব্দে পৌছেও আমাদের যে অমীমাংসিত দ্বন্দ্ব নিয়ে সন্দর্ভ তৈরি করতে হচ্ছে—এর চেয়ে বিস্ময়ের, বলা ভালো, আক্ষেপের খুব কম কথাই আছে। আমরা আধুনিক থেকে আধুনিকোত্তর যুগে পৌছেছি। কি পৌছাইনি—এই নিয়ে কত না চুলচেরা তর্ক। অথচ প্রদীপের নিচেই বড়ো অন্ধকার। ঈশ্বর-ধর্ম-সংস্কার ইত্যাদি মানুষ নিজের প্রয়োজনে তৈরি করেছিল যখন সে-সময় সভ্যতার হাটি হাঁটি পা পা চলছে। তারপর নীল-গঙ্গা-আমাজান-মিসিসিপি দিয়ে কত জল বয়ে গেল, কত ভিসুভিয়াস আণ্ডন উগরে দিল, কত হিমালয় উঠে এল সমুদ্র থেকে—কিন্তু নিজের বোনা জালে বন্দী মানুষ বন্দিত্বের অভ্যাস ভেঙে দাঁড়াতে পারল না। শুরুতে লিখেছি, তৰ্ক নানা পর্যায়ে হয়, হয়ে থাকে। দেশ-বিদেশের সূক্ষ্মদর্শী দার্শনিকেরা যুগে-যুগে আস্তিক আর নাস্তিকের সংজ্ঞা নিয়ে প্রচুর বিতণ্ডা করেছেন। তাদের সূক্ষ্মতা ও গভীরতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। কিন্তু পাশাপাশি সাধারণ মানুষের মধ্যে অন্য আরেক ধরনের বিতর্ক হয়েছে এবং আমজনতা নিজের মতো করে মীমাংসাও করে নিয়েছে। এই দুটি স্তরের মধ্যে সঙ্গতি অনেকক্ষেত্রেই হয় না এবং সঙ্গতি খুজে লাভও নেই। বরং দুই স্তরের ভাবনার মধ্যে শুধু কি সমান্তরাল অস্তিত্বের প্রকাশ ঘটছে নাকি এই দুইয়ের মধ্যে সামাজিক মনের দ্বিবাচনিকতাও ধরা পড়ছে—তলিয়ে ভেবে দেখা দরকার।

 সাধারণভাবে আমরা আস্তিক বলি সেই মানুষকে যে ঈশ্বরে বিশ্বাস করে, ধর্মে যার মতি আছে, পরলোক-পরজন্ম-কৰ্মফল মানে। এককথায় চিরাগত সংস্কারকে বিনা প্রতিবাদে যে মেনে নেয়, প্রশ্ন করে না কখনো। ছেলেবেলা থেকে আমাদের পারিবারিক ও সামাজিক আবহে শিষ্ট-দুষ্টের মধ্যে যে ভেদরেখা তৈরি হয়ে যায়, তার একদিকে রয়েছে আস্তিকেরা অন্যদিকে নাস্তিকেরা। তুলনামূলক ভাবে মহানাগরিক ও বৌদ্ধিক পরিবেশে এসব নিয়ে মাথা ঘামানো হয় কম; মাঝারি শহরে আর পিছিয়ে-থাকা। গ্রামগঞ্জে তোতাপাখির মতো এখনো এর আবৃত্তি চলে। এমন কী মহানাগরিক পরিশীলনে। বিদগ্ধ জনদের সামাজিক চিত্তেও রয়ে গেছে এই বিভাজনের ছায়া। যন্ত্রপ্রযুক্তির চরম উৎকর্ষের পর্বে এতে বরং বিচিত্র জটিলতা তৈরি হয়েছে। যতটুকু অবশেষ রয়ে গেছে, তার প্রতি অভূত প্রশ্রয়ে পুষ্ট হচ্ছে প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতির বিষচক্র। উল্টোদিকে যারা নাস্তিক অর্থাৎ ঈশ্বরে যাদের বিশ্বাস নেই, ধর্মে যাদের মতি থাকার কথা নয়, পরলোক-পরজন্ম-কৰ্মফল নিয়ে (যাদের কিছুমাত্র মাথা-ব্যথা নেই—তাদের আত্মপ্রত্যয় এত পলকা যে সংকটের মুহূর্তে এদের মেরুদণ্ডের হদিশ পর্যন্ত পাওয়া যায় না। অথচ এদেরই হওয়ার কথা ছিল আত্ম-প্রত্যয়ে দীপ্যমান, বলিষ্ঠ ও অগ্রণী। তাহলে, সংকট বড়ো গভীরে। আস্তিক্যবাদের আস্ফালন ভারতীয় সমাজে প্রগতির সবচেয়ে বড়ো বাধা। কেননা ‘আস্তিক’ শব্দটার মধ্যে ইতিবাচকতার যত প্রতিশ্রুতি থাক না কেন, আসলে তা ফাঁপা এবং নিরর্থক। লোককথার সেই বিখ্যাত বৃত্তান্তের মতো এই মতাবলম্বীরা যে-ডালে বসেন, সে-ডালই কাটেন। কারণ, এঁরা মাটির খবর জানতে চান না কখনো; আকাশপানে তাকাতে গিয়ে কুয়োয় গিয়ে পড়েন। তাই এমনও বলা যেতে পারে, জীবনের বদলে জীবনাতিরিক্ত বিষয়ে যাদের আগ্রহ—তাদের অস্তিবোধ কোথায়? রূপরসগন্ধস্পর্শময় সুন্দর এই জগতের বদলে কল্পলোকে যারা সুখের আলয় খোঁজেন, তারাই তো নাস্তির উপাসক। সত্যের অহঙ্কার এঁরা করেন যদিও, আসলে সত্যভ্রম আর মিথ্যার মোহিনী মায়া তাদের সম্বল। অন্যদিকে যারা বলেন, জীবনাতিরিক্ত কোনো সত্তা নেই কোথাও এবং জীবনই জীবনের লক্ষ্য ও আশ্রয়—তারাই অস্তিত্বকে। প্রতিষ্ঠিত করেন। অথচ এঁদেরকে নাস্তিক বলে নিন্দা করা হয়েছে; ঝুড়ি ঝুড়ি শাস্ত্রবাক্য তৈরি করা হয়েছে নাস্তিক্যবাদের ‘শশাচনীয়’ পরিণাম দেখানোর জন্যে। জীবনকে যারা প্রাধান্য দেন, তারা হলেন নাস্তিক, আর, জীবনকে যাঁরা প্রত্যাখ্যান করেন, তারা আস্তিক; এটা ব্যাসকূট ছাড়া আর কী!

 অথচ জনসাধারণের মনে আস্তিক-নাস্তিকের প্রচলিত সংজ্ঞা দৃঢ়মূল। ধর্মীয় দর্শনের সঙ্গে সামাজিক ও রাজনৈতিক তাৎপর্য যে কতটা অবিচ্ছেদ্য, তা এক্ষেত্রেও দিবালোকের মতো স্পষ্ট। ভারতীয় সমাজের আধিপত্যবাদী বর্গ নিজেদের স্বার্থে এই খুড়োর কলটি তৈরি করেছে। ভাবাদর্শের মধ্যেও স্বভাবত প্রতাপের যুক্তিশৃঙ্খলা সক্রিয়। পৌর সমাজে রাজনৈতিক আধিপত্যের বিন্যাস যাতে কখনো শিথিল না হয়, জাতিভেদ প্রথার সঙ্গে মানানসই এবং সমর্থনকারী ভাবাদর্শ মাকড়সার জালের মতো বিছিয়ে দেওয়া হচ্ছে! জন্মান্তর-কর্মফল-নিয়তি; সবই সামাজিক অবস্থানের নিয়ন্তা। কে কীভাবে ব্রাহ্মণ বা শূদ্র, পুরুষ বা নারী হয়ে জন্মাবে, তা অনেকটা—কিংবা সবটাই—নির্ধারিত হয়ে যাচ্ছে আধিপত্যবাদী ব্যক্তির ধ্যানধারণা-রীতিনীতি-ভালোমন্দ স্বীকার করে নেওয়ার ওপর। প্রচলিত সংজ্ঞায় আস্তিক হল সেই সুশীল ব্যক্তিটি, যে ভুলেও বিধিনিয়মকে প্রশ্ন করে না এবং মেনে নেওয়া আর মানিয়ে নেওয়া ছাড়া যার জীবনে অন্য কোনো অন্বিষ্ট নেই। তার মানে, স্রোতহীন জলাশয়ে শৈবালদাম কিংবা বদ্ধ অচলায়তনের স্তম্ভ হিসেবে বহতা কালকে এটা উপেক্ষা করে।

 নাস্তিক মানে আত্মপ্রত্যয়ে বলীয়ান সেই মানুষ যে বিনা দ্বিধায় ওই অচলায়তনের প্রাচীর ভাঙার জন্যে এগিয়ে যায়। মানুষের সার্বভৌম অস্তিত্বে তার বিশ্বাস এত বেশি যে মানুষেরই তৈরি ঈশ্বর ও ধর্ম-ভাবনার খাঁচায় বন্দী থাকাটাকে সে মনুষ্যত্বের পক্ষে হানিকর বলে মনে করে। আস্তিকের মনস্তত্ত্বে যেখানে আত্ম-সর্বস্বতা খুব প্রকট, নাস্তিক সেখানে স্বচ্ছন্দে আত্মসুখের গণ্ডি পেরিয়ে যায়। প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলার প্রেরণা তাকে স্থবির ও রক্ষণশীল হতে দেয় না কখনো, এগিয়ে দেয় নিরন্তর। আস্তিকের পথ বেঁকে যায় অভ্যাসের দিকে, অতীত থেকে সর্বদা সমর্থন খোজে সে। আর, নাস্তিক যায় অভ্যাস থেকে আশ্চর্যের দিকে, সম্ভাবনার ভবিষ্যৎ তাকে সঞ্জীবিত রাখে, এগিয়ে দেয় সামনে। আস্তিক স্বপ্ন দেখতে জানে না, নাস্তিক স্বপ্ন দেখে এবং দেখায়। এই স্বপ্ন সার্বভৌম জীবনের স্বতশ্চল লাবণ্যের যা কিনা নিজেতে নিজে পূর্ণ; অন্য কোনো নির্ভরতা খুঁজতে হয় না তাকে। কখনো শাস্ত্রবিধির দোহাই দিতে হয়; তার পাথেয় আস্তিকের মতো ভক্তি নয়, নির্মোহ যুক্তি। যা আছে তাকে আঁকড়ে না ধরে আস্তিক নিজের অস্তিত্বই খুঁজে পায় না; প্রচলিত প্রকরণকে বিনির্মাণ করার সাহস তার নেই। কিন্তু নাস্তিক জানে, সত্য অর্জিত হয় শুধু সাহসী বির্নিমাণে; কারণ, সত্য তো অচল অনড় নয়। প্রতিমুহূর্তে জীবনযাপন আর মননের কষ্টিপাথরে সত্যকে যাচাই করে নিতে হয়। রুদ্ধ সমাজ মানুষের ইতিহাসে এঁদো ডোবা হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে বারবার। তাই নাস্তিকের প্রাণশক্তি কেবল সমাজকে সচল রাখে না, দীপ্যমানও করে তোলে। কিন্তু এতেই দেখা দেয় বিচিত্র কূটাভাস। কারণ, চিরাগত যুক্তিহীন চিন্তাপরম্পরার অনুগত সামাজিক মন আস্তিক্যবাদের বাহ্যিক আড়ম্বরকে সমর্থন করে। আর, শৃঙ্খল-মোচনের জন্যে নিবেদিতপ্রাণ নাস্তিকদের জন্যে বরাদ্দ থাকে শুধু কুটি ও ঘৃণার প্রত্যাঘাত।

 আগেই লিখেছি, আস্তিক ও নাস্তিকের সংজ্ঞা ও তাৎপর্যগত দ্বন্দ্ব উঁচুতলার দার্শনিক চিন্তাবিদদের মধ্যে যেভাবে আলোচিত হয়, সমাজের নিচুতলায় সেই কূট বিতর্ক দেখা যায় না। কিন্তু সাম্প্রতিক সমাজের দিকে তাকালে বুঝতে পারি, জীবন-যাপনের তৃণমূল স্তরে এই দ্বন্দ্বের অন্য-এক ধরনের জটিল অভিব্যক্তি রয়েছে। সামাজিক মনে দার্শনিকতা খানিকটা ঝাপসাভাবে উপস্থিত হলেও দৈনন্দিন জীবনে মূলত যুক্তিহীন অভ্যাসের প্রতি বশ্যতা অনেক বেশি জোরালো ও প্রত্যক্ষ। নানা ধরনের সত্যভ্রম ও অভ্যাসের নিপুণ হাতে ছড়ানো মিথ্যা বিশ্বাসের ফাদ জনগণের চিন্তা-প্রকরণকে কার্যত অন্ধকূপে বন্দী করে রেখেছে। যুক্তি’ কথাটা আছে কেবল অভিধানে এবং বইপত্রে, জীবনে নয়। তাই যন্ত্রপ্রযুক্তির এই অভূতপূর্ব রমরমার দিনে সর্বাধুনিক পণ্যসামগ্রী হিসেবে উপস্থিত আস্তিক্যবাদ। ভোতা, নিরেট, বোকা-বোকা বক্তব্যের ঠাসবুট দিয়ে দূরদর্শন-ভিডিয়ো গুণগান করছে আস্তিকদের; বাঘে-গরুতে জল খাচ্ছে একঘাটে। সর্বশেষ পুঁজিবাদী প্রকরণ দিয়ে তৈরি করা হচ্ছে মিথ্যার স্থাপত্য; গড়ে তোলা হচ্ছে নতুন-নতুন প্রত্নকথা ও কিংবদন্তি। মেনে নেওয়া আর মানিয়ে নেওয়ার অপদর্শন অসাড় করে দিচ্ছে জনমনকে। আধা-সমৃদ্ধ শহরে-জনপদে রাতারাতি গজিয়ে উঠছে শনিমন্দির, পাড়ায়-পাড়ায় হঠাৎ বাড়বাড়ন্ত দেখা যাচ্ছে নানা দেবতার মন্দিরের। লোকপ্রিয় হিন্দি ছবির গানের সুরে-বসানো ভক্তিগীতি রাত-নেই দিন-নেই তীব্র মাইক্রোফোন দিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে দিগবিদিক। মসজিদে-মসজিদে তার সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে আজান। আশে-পাশে যারা আছে, তাদের কাছে আপন অস্তিত্ব পৌছে দেওয়ার জন্যে চলেছে যেন শব্দথেরাপির কঠিন প্রতিযোগিতা। আস্তিক্যতার এই আড়ম্বরে খান-খান হয়ে ভেঙে পড়ছে সমস্ত নৈঃশব্দ্য, সব ব্যক্তিগত নির্জনতা। যে-সময়ে এখন রয়েছি আমরা, তাতে স্থূলতার উৎকট অভিব্যক্তি দেখছি ছোট-বড়ো সমস্ত কিছুতে। সংবেদনশীলতা জীবনের কোনো ক্ষেত্রেই প্রাসঙ্গিক নয় যেন। তাই আস্তিক্যের বাড়াবাড়ি আমাদের পীড়িত করে না, আচরণের অন্তঃসারশূন্যতা নিয়ে একটুও মাথা ঘামাই না; দর্শনশূন্য অভ্যাসের নৈরাজ্য অজগর সাপের মতো গিলে খাচ্ছে আমাদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ—এই দেখেও সাড়া জাগে না কোথাও। আস্তিক্যবাদ যেহেতু মানবাতিরিক্ত নির্যাস খোঁজার নামে মানুষকেই ঝাপসা করে দেয়, স্বভাবত মানুষের পৃথিবী আক্রান্ত হলেও গূঢ় মনস্তাত্ত্বিক কারণে কোথাও কোনো প্রতিবাদের ইচ্ছা জাগে না। কারণ, এই জগৎকে যদি মূল্যহীন করে দেওয়া যায়, তাহলে তার ভালো-মন্দ-উত্থান-পতন-সম্ভাবনা-আশঙ্কা কোনো কিছুতেই কোনো প্রতিক্রিয়া তৈরি হবে না।

 সমাজ-মনস্তত্ত্বের গহনে যদি ঐহিককে মিথ্যা, অশুচি ও মনোযোগের অযোগ্য বলে জানি, সেক্ষেত্রে অনির্দেশ পারত্রিক ভাবনার কাছে সমর্পিত হবে বুদ্ধি। সব কিছুই যদি পূর্ব-নির্দিষ্ট হয়ে থাকে, তাহলে প্রতিবাদ কিংবা প্রতিরোধ তো অর্থহীন। তার চেয়ে বরং মানিয়ে নেওয়াই ভালো। এই যে মানসিকতা, তা বহু শতাব্দী ধরে সূক্ষ্ম ও ব্যাপকভাবে গড়ে তুলেছে সামাজিক প্রতাপের কর্ণধারেরা। অবাধ পীড়ন যাতে নিরঙ্কুশভাবে বজায় থাকতে পারে, আধিপত্যবাদী বর্গ সেভাবেই প্রতিভাবাদর্শের বিপুল জালের বিস্তার ঘটিয়েছে এবং সামাজিক মনকে ধারাবাহিকভাবে সেই নাগপাশে বন্দী করে রেখেছে। আজকের এই আপাত-যান্ত্রিক দুনিয়াতেও কম্পিউটার সেণ্টার ও শনিমন্দির-মসজিদ-গুরুদ্বার, সন্ত্রাসবাদীর গ্রেনেড-স্টেনগান, আর.ডি.এক্স ও পুজোমিলাদ-গুরুপ্রসঙ্গ স্বচ্ছন্দে সহাবস্থান করছে। কোনো প্রশ্ন নেই কোথাও। কেননা আস্তিক্যবাদের মূল কথা ও প্রধান শর্তই হল পারমার্থিক অভিভাবকের কাছে প্রশ্নহীন আত্মসমর্পণ। সমস্ত গান যেভাবে সমে ফিরে আসে, তেমনি আস্তিকদের সব কাজ সব চিন্তা জুড়ে থাকে একটিমাত্র ধ্রুবপদ:‘তোমার কর্ম তুমি করো মা, লোকে বলে করি আমি।’ কর্তৃত্ব যখন নেই, কোনো কাজের উদ্যম নেবই বা কেন? সমাজে যারা নিগৃহীত ও লাঞ্ছিত হচ্ছে, তাদের কর্মফল কে খণ্ডাবে! অতএব অত্যাচারীদের দিকে তাকিয়ে লাভ নেই, প্রতিবাদের চেষ্টা করার প্রশ্নই ওঠে না। সমাজ-মনস্তত্ত্ব এমন নিপুণভাবে ছাঁচে ঢালাই করে নেওয়া হয়েছে যে কয়েক সহস্রাব্দ জুড়ে নিপীড়কেরা নিশ্চিন্ত। তাদের বাড়া ভাতে কেউ কোনোদিন ছাই দিতে পারবে না। ভেজা বারুদে আর যাই হোক, আগুন জ্বলে না কখননা। মন্দির-মসজিদ-গুরুদ্বারের চাকচিক্য বাড়ছে, সাহেব বোস্টম আর বালকবাবা আর মাচান-বাবাদের দলবল নানা ধরনের ঢাকে কাঠি দিচ্ছে, রঙিন মাদকের নেশা আর নীলস্বপ্নের কুয়াশা ডিশ অ্যাণ্টেনা দিয়ে পৌছে যাচ্ছে ঘরে ঘরে, নালা-বিল-পুকুর-নদী একাকার হয়ে গিয়ে পণ্য-সাম্রাজ্যবাদের ছত্রছায়ায় গড়ে তুলছে কুণ্ঠাহীন ভোগের সাম্যতন্ত্র: এই নিচ্ছিদ্র পরিসরে কে আর কিসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে? আস্তিক্যবাদী মনোভঙ্গির উদার প্রশ্রয়ে নিজের ভবিষ্যৎকেও যখন পণ্যায়ন প্রক্রিয়ায় মিশিয়ে দিতে পারছি-বাইশ শতকেও যাব সবাই ডঙ্কা বাজিয়ে। যে-মনোভঙ্গি থেকে প্রতিবাদ দূরে থাক, জিজ্ঞাসাই দেখা দেয় না—তাতে শোষকবর্গের পোয়াবারো। তাদেরই রঙে রঞ্জিত ভাবাদর্শ দিয়ে জগৎ শাসিত ও প্রান্তিকায়িত হচ্ছে। অথচ এমনই নিদালির ঘোর আস্তিক্যবাদের নামে ছড়িয়ে পড়েছে যে নিজেদের তীব্রতম লাঞ্ছনাতেও নিম্নবর্গীয়দের ‘পিপুফিশু’ নীতি অবিচল থাকছে।

 এই অবস্থায় একটি প্রশ্ন এখন অনিবার্য: সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে-চলতে আস্তিক্যবাদ যেহেতু সমস্ত ধরনের সুবিধাবাদের আশ্রয়ভূমি হিসেবে খুবই নির্ভরযোগ্য এবং এর স্থিতিস্থাপকতাকে অদ্ভুত দক্ষতায় কাজে লাগিয়ে চলেছে। প্রতিটি সময়-পর্বের শোষকবর্গ—কীভাবে এর মোকাবিলা করা সম্ভব? আদৌ সম্ভব কি একাজ? যখন শিক্ষিত-অশিক্ষিত বুদ্ধিজীবী-পণ্যজীবী ধনী-দ্ররিদ্র ঐতিহ্যপন্থীবর্তমানপন্থী-নির্বিশেষে আস্তিক্যবাদের মোড়ক মেনে নিয়েছে, এদের সত্যভ্রমের আস্ফালন ঘোচাবে কে? প্রবাদের সেই বালকটি কোথাও কি আছে যে উলঙ্গ রাজার দিকে আঙুল তুলে বলতে পারে, ‘রাজা, তোর কাপড় কোথায়? এই পুঞ্জীভূত মিথ্যার জঞ্জাল সরিয়ে বিমানবায়নের চক্রব্যুহ থেকে মানুষকে যে উদ্ধার করবে, সেই হেরাক্লিস কোথায়? কোথায় সেই প্রমিথিউস যে আগুন নিয়ে এসে নিচ্ছিদ্র সেই অন্ধকারের বলয় ভেদ করবে? একাজ করতে পারে কেবল তারাই যারা রাষ্ট্রশক্তির অনুগ্রহপুষ্ট নয়, পৌর সমাজের মধ্যে যাদের অবস্থান পরিত্যক্ত বহিরাগতের মতো, অপপ্রচারের আঁধিতে আচ্ছন্ন হয়েও যারা সত্যের অন্তর্দীপ্তিতে উজ্জ্বল। সবচেয়ে বড়ো কথা, অপরিসীম আত্মশক্তিতে বলীয়ান বলে এধরনের মানুষ নিজেকে ছাড়া আর কাউকে কুর্নিশ করে না। কখনো কোনো শাস্ত্রবাক্যের দোহাই দেয় না, মোহমুক্ত যুক্তিবিদ্যা ছাড়া অন্য কিছুতে নির্ভরতা দেখায় না। প্রত্যক্ষ জগৎকে বেশি গুরুত্ব দেয় বলে যারা দৃশ্যমান জীবনেই বেঁচে থাকার সমস্ত স্বাদ পেতে চায়, তাদের আস্তিক্যবোধের তুলনা নেই কোননা। অথচ যুগ যুগ ধরে তারা বহন করে চলেছে নাস্তিকের নেতিবাচক অভিধা। সন্দেহ নেই যে, আমাদের সমাজে এই অভিধা আসলে অপবাদ ও তাচ্ছিল্যের অন্য নাম। কিন্তু সবচেয়ে বেশি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে জগৎ ও জীবনকে দেখে তথাকথিত নাস্তিকেরা। এদেশে যখন চিলে কান নিয়ে গেছে শুনে কানে হাত-না দিয়ে চিলের পেছনে ছুটে যাওয়াটা নিয়ম, নাস্তিকেরা সেখানে বলে যুক্তির প্রামাণিকতার কথা, বলে শাস্ত্রবাক্যের অকার্যকারিতার কথা।‘বিশ্বাসে মিলয়ে কৃষ্ণ, তর্কে বহুদূর’ বলে তার্কিকদের মাথা মুড়িয়ে ঘোল ঢালার ব্যবস্থা তথাকথিত আস্তিকেরাই করে এসেছে চিরকাল। যুক্তি যাদের পক্ষে নেই, ওরা তো যুক্তিবাদকে প্রত্যাখ্যান করবেই। প্রচারমাধ্যম তাদের হাতে, অতএব অলৌকিক গল্পকথা দিয়ে শাস্ত্রবাক্যের অচলায়তনকে দুর্ভেদ্য করতে ওদের অসুবিধে হয়নি। বিশ্বাসের কত লাভ আর অবিশ্বাসের কত লোমহর্ষক ভয়ঙ্কর পরিণতি, সেজন্যে পরলোকে স্বর্গনরকের বৃত্তান্ত আর ইহলোকে ভোগসুখ ও দুঃখদুর্দশার কাহিনি তৈরি করা হয়েছে। স্থিতাবস্থা যাতে অটুট থাকে বর্ণলিঙ্গবিভাজিত সমাজে, সেজন্যে নাস্তিকের মূল আয়ুধ অর্থাৎ যুক্তিবিদ্যাকে নস্যাৎ করার জন্যে এত উৎকট আগ্রহ আস্তিক্যবাদীদের।

 আধিপত্যবাদীরা জানে, স্থিতাবস্থা বজায় রাখার ওপর তাদের সব জারিজুরি নির্ভর করে। অতএব শশাষকশ্রেণীর চাহিদা মেটানোর জন্যে আস্তিক্যবাদী দর্শনের মধ্য দিয়ে ওরা প্রতাপের জাল বুনে গেছে। তার মানে, দর্শনের রাজনীতি সম্পর্কে প্রাচীন যুগ থেকেই ওরা খুব ওয়াকিবহাল। কোনো সন্দেহ নেই, প্রবল হিংস্রতা নিয়ে নাস্তিকদের উপর বারবার ঝাপিয়ে পড়েছে আধিপত্যবাদী শক্তি। লোকায়ত সমাজে নাস্তিক্যবাদের যদি কোনো প্রতিপত্তি না থাকত, তাহলে ওই মতবাদ নিয়ে মাথা ঘামানোর দরকার হত। নানা অজুহাতে পুরনো দিনের সাহিত্যিক ও দার্শনিক প্রতিবেদনগুলি যেহেতু নাস্তিকদের গালমন্দ করেছে, বিদ্বেষের বহর থেকে মনে হয়, নাস্তিক্যবাদ একেবারে উপেক্ষণীয় ছিল না। ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র ভয় করত ওই মতবাদের শক্তিকে এবং অবশ্যই তার অনুসরণকারীদের। কেননা সমাজবিপ্লব ঘটানোর সম্ভাবনা, দধীচির হাড়ের মধ্যে প্রচ্ছন্ন বজ্রের মতে, প্রতাপমত্তেরা দেখতে পেয়েছিল নাস্তিক্যবাদে। তাদের ভয় যে কতটা বেশি ছিল, তার প্রমাণ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়ে গেছে নানা জায়গায়। ন্যূনতম শিষ্টাচারও ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র প্রতিপক্ষকে দেখাতে রাজি ছিল না; আস্তিক্যবাদী ভাবাদর্শের উপযোগিতা সম্পর্কে তারা নিজেরাই যে সন্দিহান ছিল—এই হিংস্র বিদ্বেষ আসলে তারই অভিব্যক্তি।

 ‘ষড়দর্শনসমুচ্চয়’ গ্রন্থে হরিভদ্র নাস্তিকদের ‘শঠ’ বলেছেন। আর, গুণরত্ন ‘তর্করহস্যদীপিকা’ বইতে যা বলেছেন, তার নিবিড় পাঠ থেকে বুঝতে পারি, পৌরসমাজের মূল ভিত্তি অর্থাৎ বর্ণাশ্রম প্রথার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী ভূমিকা নিচ্ছিলেন। নাস্তিকেরা। সাধারণভাবে নিম্নবর্গীয়দের মধ্যে এই প্রতিভাবাদর্শের ফ্রন ও বিকাশ ঘটেছিল; তবে ক্রমশ কিছু কিছু উচ্চবর্গীয় ব্যক্তিও এতে শামিল হয়েছিলেন। তার মানে, এই প্রতিভাবাদর্শের রাজনৈতিক মাত্রা অস্পষ্ট নয়; তাছাড়া প্রমাণিত হল, পৌর সমাজ সর্বকালে সর্বদেশে রাজনৈতিক সমাজের ভিত্তি। গৌন ধর্মচর্যা আসলে নামেমাত্র ধর্মসংশ্লিষ্ট; মূলত তা প্রতিবাদী জীবনধারার সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তি। এইজন্যে গুণরত্ন তার শ্রেণীর সামাজিক ও রাজনৈতিক স্বার্থরক্ষার তাগিদে লিখলেন:‘কেচন নাস্তিকা ভবন্তি। তে চ মদ্যমাংসে ভুঞ্জতে মাত্রাদ্যগম্যাগমনমপি কুর্যতে।সমস্ত ধরনের শিষ্টাচারকে লঙ্ঘন করেছে এই অপভাষা। আজকের দিনে এমন অপভাষা-প্রয়োগকে আমরা সাধারণত খিস্তি-খেউড় বলি। অথচ খ্যাতকীর্তি পণ্ডিতেরা বিনা দ্বিধায় সেসব নাস্তিকদের সম্পর্কে প্রয়োগ করেছেন, যেমন মনুসংহিতায় মনু বলেছেন (২: ১১) বেদ ও স্মৃতি-শাস্ত্রে ব্যক্ত ধর্ম অনুসরণ করাই ইহলোক ও পরলোকে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার উপায়। যুক্তিশাস্ত্রের দোহাই দিয়ে যারা একে অপমান করে, সেইসব বেদ-নিন্দাকারী নাস্তিকদের ব্রাহ্মণ-অব্রাহ্মণ নির্বিশেষে, সমাজ থেকে তাড়িয়ে দিতে হবে। এই সূত্রে পরবর্তীকালে সংজ্ঞা নির্ধারিত হয়েছে ‘নাস্তিকো বেদনিন্দকঃ’।

 ইহকাল-পরকাল, স্বর্গ-নরক, ঈশ্বর-জগৎ ইত্যাদি যাবতীয় বৈপরীত্যের নিঃসংশয় স্বীকৃতি আস্তিক্যবাদের মূলাধার। এতে সমাজেও স্থিরতা অটুট থাকে অর্থাৎ অক্ষুন্ন থাকে আধিপত্যবাদী বর্গের প্রতাপ। নাস্তিকদের সবচেয়ে বড়ো অপরাধ এই নয় যে ওরা ঈশ্বর-পরকাল মানে না, ওরা বেদের প্রামাণিকতা স্বীকার করে না। তলিয়ে ভাবলেই বুঝতে পারি, ওদের সবচেয়ে বড়ো অপরাধ, ওরা যুক্তিবাদী। সব কিছুতেই ওরা তর্ক করে যায় এবং প্রশ্ন না করে, পরখ না করে কিছুই মেনে নেয় না। যুক্তির সূর্যোদয়ে যেহেতু মিথ্যা বিশ্বাস ও আপ্তবাক্যের কুয়াশা মিলিয়ে যায় শূন্যে, শোষকবর্গ নাস্তিকদের সম্পর্কে আতঙ্কিত বোধ করেছে। মানুষের পক্ষে যা কিছু জ্ঞাতব্য, সমস্তই বেদে আছে: একথা যেহেতু যুক্তিনিষ্ঠ নাস্তিকেরা শিরোধার্য করে না কখনো আধিপত্যবাদীদের পক্ষে সুবিধাজনক ভাবাদর্শের কাঠামোই নড়বড়ে হয়ে পড়ে। শাস্ত্রপরম্পরায় নিঃসপত্ন অধিকার নিঃসন্দেহে নিম্নবর্গীয় ও প্রতিভাবাদর্শপন্থী জনেরা মেনে নেয়নি। কিন্তু আমাদের সাংস্কৃতিক ইতিহাসে সেই পুঞ্জীভূত অপরের স্বীকৃতি নেই কোননা। বরং একরৈখিক ভাবে রচিত প্রতিবেদনে এদের অস্তিত্বও মুছে ফেলা হয়েছে; যেন ব্রাহ্মণতন্ত্র নির্দেশিত আস্তিক্যবাদই একমাত্র বিকল্পহীন সত্য। তবু, হাজার চেষ্টা সত্ত্বেও নাস্তিকদের উপস্থিতিকে যেহেতু একেবারে খর্ব করা যায়নি, খানিকটা সরলীকৃত ভাবে তাদের খারিজ করা হয়েছে। ভাবখানা এই, কেবলমাত্র মূখ। পাষণ্ড ও আচার-বিচারহীন ব্রাত্যজনেরা দর্শনের সূক্ষ্মতা ও মহত্ত্ব বুঝতে না পেরে নাস্তিকদের আশ্রয় নেয়। এরা করুণাযোগ্য। অত্যন্ত ক্ষতিকর অশিষ্ট দর্শনের বদ অভ্যাস থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না বলে এরা কেবল অবিদ্যা বা ভ্রান্ত জ্ঞানের পেছনে ছোটে। বৈশেষিক দর্শনের প্রবক্তা প্রশস্তপাদ তার ‘পদার্থধর্ম সংগ্রহ’ বইতে বলেছিলেন, বেদ-বহির্ভূত সমস্ত মতবাদ মিথ্যা ও বিপর্যয়ের কারণ: ‘মিথ্যাপ্রত্যয়ো বিপর্যয়ঃ। ভারতবর্ষের সামাজিক ও রাষ্ট্রনৈতিক ইতিহাসে বহু ওলটপালট হয়ে গেছে; কিন্তু আধিপত্যবাদীদের এই ভাবনা-পরম্পরায় কোনো ছেদ ঘটেনি। তাই পঞ্চম শতাব্দীতে প্রশস্তপাদ যেভাবে কথা বলেছেন, তাতে মনুর বিশ্ববীক্ষা অনুসৃত; আবার যোড়শ শতকে অদ্বৈত বেদান্তে পারঙ্গম মধুসূদন সরস্বতী প্রস্থানভেদ’ বইতে শোষকবর্গের ভাবাদর্শের প্রতিকূল সমস্ত মতবাদকে উপেক্ষা করতে বলেছেন: ‘বেদবাহ্যত্বাৎ তেযাং ম্লেচ্ছাদি প্রস্থানবৎ পরস্পরয়াপি পুরুষার্থানুপযোগিত্বাৎ উপেক্ষণীয়ত্বমেব।’ এই উপেক্ষা আসলে খানিকটা নিজেকে চোখ-ঠারা ছাড়া আর কিছুই নয়। দেড় হাজার বছর ধরে লাগাতার চেষ্টার পরেও নাস্তিকদের যুক্তিবাদী আয়ুধকে যে পরাভূত করা যায়নি, এখানে তো তারই স্বীকৃতি পাওয়া যাচ্ছে। কারণ, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও বৌদ্ধিক ভাবে কোনঠাসা করার পরেও যে ঘটা করে বলতে হচ্ছে, এরা উপেক্ষণীয়—তাতেই প্রত্যাখ্যাত অপরদের বৈপ্লবিক শক্তির আভাস পাওয়া যাচ্ছে।

 একদিকে শাস্ত্রবিধির চোখ-রাঙানি আর অন্যদিকে যুক্তিবিদ্যার মধ্য দিয়ে জীবনে ও মননে নিত্যনূতন পরিসর আবিষ্কারের হাতছানি। লোকায়ত সমাজ যুগ যুগ ধরে কোনদিকে ঝুঁকে ছিল—তা বলার অপেক্ষা রাখে না নিশ্চয়। কিন্তু তাই বলে আধিপত্যবাদী বর্গ কি হাল ছেড়ে দিতে পারে? ভয় দেখিয়ে, শাস্তি দিয়ে, ঠাট্টা করে নাস্তিকদের ওরা জব্দ করতে চেয়েছে। দর্শনের এই রাজনীতি তো কেবল তাত্ত্বিক বিতর্কে সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না; সাহিত্যেও স্বভাবত তার ছায়া পড়েছে। লোকায়ত সমাজের প্রতিবাদী মননকে বিদ্রুপে বিদ্ধ করে বাল্মীকিও যুক্তিবিদ্যাকে নিন্দা করেছেন কুতর্ক বলে, দুবুদ্ধির প্রমাণ বলে। রামায়ণের অযোধ্যাকাণ্ডে রাম ভরতকে যেসব লোকায়ত দার্শনিকদের সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়েছেন, ওরা মূলত তার্কিক। এই তার্কিকতার মৌল প্রেরণা যে নাস্তিক্যবাদ থেকে উদ্ভূত হয়েছে, তাতে সংশয়ের কোনো কারণ নেই। কারণ, তার্কিকেরা কখনো প্রতাপের ভাবাদর্শকে যাচাই করতে ভোলে না; ঈশ্বর-পারত্রিকতা ঐহিক ধর্মসংস্কার-জাতিভেদ-উচুনিচুর বিভাজন (কী জীবনে কী মননে): কোনো কিছুই তাদের সন্ত্রস্ত করে না। অতএব, ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের কৃষ্টিনায়ক হিসেবে রামকে বলতেই হল:

‘অনর্থকুশলা হ্যেতে বালাঃ পণ্ডিতমানিনঃ
ধর্মশাস্ত্রে মুখ্যে বিদ্যমাননযু দুর্বধাঃ।
বুদ্ধি আত্মীক্ষিকীং প্রাপ্য নিরর্থকং প্রবদন্তি তে!!’

(২: ১০০: ৩৮-৩৯)

এই উচ্চারণ তো প্রজ্ঞাভিমানী উচ্চবর্গীয়দের, যারা তখনও মনে করত এবং এখনো মনে করে, সত্য হল তাই যাকে তারা সত্য মনে করে। তাদের মেধায় এবং তাদের প্রয়োজনে তৈরি শাস্ত্র সব শেষ কথা বলে দিয়েছে। এর বাইরে সমাজের নিচুতলার অপাঙক্তেয় জনদের জন্যে আর কোন সত্য থাকা সম্ভব! সাম্প্রতিক কবি জয় গোস্বামী যেমন তির্যক উচ্চারণে জানিয়েছেন: ‘আমরা যা করি ব্রহ্ম তা-ই আজ ব্রহ্ম তা-ই’—তেমনি ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের পুরোধা ব্যক্তিত্ব বলতে চেয়েছেন, আধিপত্যবাদের দর্শনকে যা পোষকতা করে তা-ই সৎ বুদ্ধি এবং যেসব মূঢ়জন ওই দর্শনকে প্রত্যাহ্বান জানানোর দুঃসাহস দেখায়, তাদের কাজ দুবুদ্ধি প্রণোদিত ও নিরর্থক।

 রাষ্ট্রশাসকের এই ঔদ্ধত্য অস্বাভাবিক নয় কিছু; আসলে, এধরনের মনোভঙ্গি পোষণ করা তাদের পক্ষে বাধ্যতামূলক। কারণ, তাদের শাসনব্যবস্থাই তো টিকে থাকে আস্তিক্যবাদের প্রচারক শাস্ত্রবিধির উপর। শাস্ত্রবিশ্বাসের সঙ্গে যুক্তিবিদ্যার সম্পর্ক সাপে-নেউলে; অতএব নাস্তিকদের সমূলে উচ্ছেদ করার জন্যে শোষকেরা লাগাতার চেষ্টা করে যাবেই। যেমন মনুসংহিতার মনু (৪/৩০) দুঃসাহসী প্রতিবাদীদের কষে গালাগাল করেছেন; তাদের বুঝতে দেরি হয়নি, যুক্তিবিদ্যা ও নাস্তিকতা গঙ্গাযমুনার মতো অনন্যান্য-সম্পৃক্ত। অতএব যারা তার্কিক বা হেতুশাস্ত্র অনুসরণকারী, তাদের মনু বলেছেন পাষণ্ড, নিষিদ্ধবৃত্তি অবলম্বনকারী, ভণ্ড, শঠ, দাম্ভিক। কিছুতেই তাদের সঙ্গে যেহেতু এঁটে ওঠা যায় না, সমাজ-দেহে ‘বিদূষণ’ রোধ করার জন্য ফতোয়া জারি করেছেন, এদের সঙ্গে কথা বলবে না কেউ। কারণ, কথা বললেই বিপদ; যুক্তিপরায়ণ নাস্তিকদের জনচিত্ত আকর্ষণ করার ক্ষমতা যে অনেক বেশি! নরকেও এদের ঠাই হবে; অভিশাপ দিয়েও নিশ্চয় কাজ হচ্ছিল না, কেননা নরক তো প্রত্যক্ষ নয়। পরজন্মও চাক্ষুষ প্রমাণের বাইরে। অতএব শায়েস্তা করার একমাত্র উপায় তার্কিক নাস্তিকদের একঘরে করে দেওয়া। তর্কবিদ্যা অনিবার্যভাবে নিয়ে যায় ধর্মবিশ্বাসের উল্টোদিকে, অতএব প্রচার করা হল, তর্ক নয়—বিশ্বাসই কাম্য। সর্বকর্ম ঈশ্বরে সমর্পণই শ্রেয় কেননা তিনিই সব করাচ্ছেন: ‘অহঙ্কার-বিমূঢ়াত্মা কর্তাহমিতি মন্যতে'। একথা যে কতবার কত ভাষায় বলা হয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই। আস্তিক্যবাদের শেষ পর্যায়ে ব্যক্তিত্বের বিলুপ্তি চূড়ান্ত; আর, নাস্তিক্যবাদে ঘটে ব্যক্তিত্বের সার্বিক প্রতিষ্ঠা। এই প্রতিষ্ঠা কিন্তু শাসকবর্গের পক্ষে আশঙ্কার কারণ। তাই ব্যক্তিকে লুপ্ত করে দেওয়ার জন্যে একদিকে পশুশক্তির আস্ফালন আর অন্যদিকে আস্তিক্যবাদের প্রকরণ অর্থাৎ ধর্মমোহ ছড়িয়ে দেয় ওরা। সাহিত্যের ভাষায় এই তত্ত্ব চমৎকার প্রকাশিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের ‘রক্তকরবী’ নাটকে। ওখানে কেনারাম গোঁসাই খুব তাৎপর্যপূর্ণ কথা বলেছে: ‘বাবা, দন্ত্য-ন পাড়া যদিও এখনো নড়নড় করছে, মুর্ধন্য-ণরা ইদানীং অনেকটা মধুর রসে মজেছে। মন্ত্র নেবার মতো কান তৈরি হল বলে। তবু আরও কটা মাস পাড়ায় ফৌজ রাখা ভালো। কেননা নাহংকারাৎ পরো রিপুঃ। ফৌজের চাপে অহংকারটার দমন হয়, তারপরে আমাদের পালা।’ (জন্মশতবার্ষিকী সংস্করণ, ষষ্ঠ খণ্ড পৃ ৬৬৪) একথাটাই একটু অন্যদিক দিয়ে স্পষ্ট করে বলেছে চাবুকের ঘায়ে ক্ষতবিক্ষত বিশু: ‘চাবুক মেরেছে, যে চাবুক দিয়ে ওরা কুকুর মারে। যে রশিতে এই চাবুক তৈরি সেই রশির সুতো দিয়েই ওদের গোঁসাইয়ের জপমালা তৈরি।” (তদেব: ৬৮২)

 সমাজপতিরা কখনো তাদের তৈরি শৃঙ্খলা ও কাঠামোর পক্ষে কোনো ধরনের ব্যতিক্রম সইতে পারে না। পরশ্রমজীবীবর্গ টিকে থাকে সুশৃঙ্খল কর্মীবাহিনীর অবিচল অবস্থানের ওপর। সব কিছু যন্ত্রের মতো নিখুঁত পারিপাট্য নিয়ে যদি না চলে, তাহলে তাদের অস্বস্তির আর শেষ থাকে না। স্বভাবত অস্বস্তির কাটা উপড়ে ফেলার চেষ্টা তাদের করতেই হয়। নিয়মমাফিক সবকিছু ঠিকঠাক চলছে এবং চলবে, এই বিশ্বাসে ফাটল ধরলে মুশকিল। অতএব তর্ক নয়, সমর্পণ। নাস্তিকতা তাদের কাছে নৈরাজ্যের বিভীষিকা। একদল বিনা প্রশ্নে পরিশ্রম করে যাবে, আরেক দল সেই পরিশ্রমের ফল ভোগ করবে। এই সরল পন্থা সম্পর্কে যারা আপত্তি করে, তারা নৈরাজ্যবাদী-পাষণ্ড এবং নাস্তিক। এইজন্যে মনুসংহিতার ভাষ্যকার মেধাতিথি ধর্ম-বিশ্বাসহীন তার্কিকদের সম্পর্কে ভৎর্সনার সুরে বলেছেন: ‘হেতুকাঃ নাস্তিকাঃ নাস্তি পরলোকঃ নাস্তি দত্তং, নাস্তি হুতম ইত্যেবং স্থিতপ্রজ্ঞাঃ’ আর, টীকাকার কুল্লুক ভট্ট লিখেছেন—‘হৈতুকাঃ বেদবিরোধিতর্ক-ব্যবহারিণঃ’ অর্থাৎ যারা হেতু-শাস্ত্রবিদ, তারা কেবলই বেদবিরোধী তর্ক করে যায়। একথার দ্যোতনা হচ্ছে, তর্ক হোক, তা যেন বেদের বিরুদ্ধতা না করে। সোজা ভাষায়, আধিপত্যবাদীদের মূল ভাবাদর্শে কোথাও আঁচ লাগা চলবে না। মুশকিল হচ্ছে, নাস্তিক তার্কিকেরা এই সহজ কথাটি মানে না। তাদের জন্যে মহাকাব্যে-পুরাণে-স্মৃতিশাস্ত্রে নানা ধরনের গল্প তৈরি করে জনমনে আতঙ্ক ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। মহাভারতে যেমন শান্তিপর্বের একটি আখ্যানে স্বয়ং দেবরাজ ইন্দ্র শেয়ালের ছদ্মবেশ ধরে আত্মহত্যায় প্রস্তুত কোনো-এক ব্রাহ্মণকে সাবধান করে দিয়েছেন। সেখানে দেখতে পাচ্ছি, যুক্তিবাদী ব্রাহ্মণ যদি নাস্তিকদের মতো বেদকে নিন্দা করে, তাহলে সে শেয়াল হয়ে জন্ম নেয়। (শান্তি:১৮০:৪৭-৪৯) দৃষ্টান্ত আর বাড়িয়ে লাভ নেই। দু-হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে আধিপত্যবাদী বর্গ সাধারণ মানুষকে প্রতারিত করে এসেছে নিতান্ত শ্রেণী-স্বার্থে। উল্টোদিকে, অজস্ব প্রতিকূলতা সত্ত্বেও আস্তিক্যবাদের অন্তঃসারশূন্যতা প্রমাণ করার জন্যে সচেষ্ট থেকেছেন যুক্তিবাদী চিন্তাবিদেরা। একই সঙ্গে সামাজিক অচলায়তন ও রাজনৈতিক শোষণের যুগলবন্দির বিরুদ্ধেও তাদের প্রতিবোধ। চার্বাক সম্প্রদায় এই প্রতিভাবাদর্শের সর্বোত্তম প্রকাশ। তাদের অভিমত হিসেবে মাধবাচার্য সর্বদর্শন সংগ্রহে যেসব বক্তব্য তুলে ধরেছেন, তা বিশ্লেষণ করলেই নাস্তিক্যবাদের জীবনমুখিনতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সুতরাং নামের মধ্যে যদিও নেতির দ্যোতনা অত্যন্ত প্রবল, তবু কার্যত এরাই জীবন ও জগৎ-সংলগ্নতার জোরে সবচেয়ে ইতিবাচক মনোভঙ্গির অধিকারী। তথাকথিত আস্তিক্যবাদীরা যখন প্রত্যক্ষগোচর জীবনকে না-এর ধোঁয়াশার আড়ালে সরিয়ে দেয়, নাস্তিক্যবাদীরা সেসময় জীবন ও জগতের প্রতি গভীর মমতায় খুঁজে পান ‘আছে আছে আছে এই বার্তা।

 এমন নয় যে অস্তি নাস্তির এই মিথ্যা দ্বন্দ্ব বিজ্ঞানের যুগে ঘুচে গেছে। অত্যন্ত পরিতাপের কথা, আপাতদৃষ্টিতে প্রাগ্রসর ব্যক্তিও আস্তিক্যবাদী ভাবাদর্শের আকর্ষণে দর্শনশূন্য ধর্মসংস্কারে আপাদমস্তক নিমজ্জিত হয়ে পড়ছেন। বিজ্ঞানের সঙ্গে বিচিত্র সহাবস্থান চলেছে ধর্মীয় অভ্যাসের। এমনকি, গত কয়েক বছরে মনে হচ্ছে, গোটা বিশ্ব জুড়ে প্রতিক্রিয়াশীল ভাবনার পুনরুত্থান হচ্ছে। ধর্মীয় উন্মাদনা যে-পরিমাণে যুক্তিবাদকে গ্রাস করতে উদ্যত হয়েছে, ঠিক সেই অনুপাতে বেড়েছে রাজনৈতিক অস্থিরতা। প্রত্যেকের জন্যে স্বাস্থ্য প্রত্যেকের জন্যে শিক্ষা প্রত্যেকের জন্যে খাদ্য: এই ন্যূনতম দাবি মেটাতে যখন অপারগ হয় রাষ্ট্র, নানা ধরনের সূক্ষ্ম ও স্থূল উপায়ে সুড়সুড়ি দেয় আস্তিক্যবাদী চিন্তাপ্রকরণে। সাম্প্রতিক কালের ধারাবাহিক অভিজ্ঞতা থেকে বুঝতে পারছি, দর্শনের সমর্থন নিয়ে কেউ আর মাথা ঘামাচ্ছে না। পরম্পরাগত ব্যবহারিক অভ্যাসকে আঁকড়ে ধরছে যারা, তাদের কাছেও বাস্তব চাওয়া পাওয়া মুখ্য। স্থিতাবস্থা অক্ষুন্ন থাকুক, এই তো চায় রাষ্ট্রশক্তি এবং পৌর সমাজেও অনুকূল বাতাবরণ অটুট রাখতে চায়। যতভাবে সম্ভব, লোভের আগ্রাসন বজায় রাখে; তাতে মনুষ্যত্ব-মূল্যবোধযুক্তি জাতীয় শব্দ নিতান্ত অবান্তর। ভোতা-নিপ্রাণ-স্থূলতাক্লিষ্ট জগৎ স্থবির থেকে স্থবিরতর হয়ে যাচ্ছে যত, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে আস্তিক্যবাদের সাড়ম্বর বিজ্ঞাপন। এখানেই নাস্তিকের স্পর্ধিত উপস্থিতি অত্যন্ত জরুরি হয়ে উঠেছে। এককেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থায় উচ্চপ্রযুক্তির ডানা মেলে দিয়ে যখন শিকারী বাজপাখির মতো নেমে আসছে শূন্যগর্ভ আস্তিক্যবাদ, অতীতমুগ্ধ মিথ্যা বিশ্বাসেরা—সে-সময় আলো ও আলেয়ার মধ্যে তফাতটুকু বুঝিয়ে দেওয়ার জন্যে নাস্তিকতার সামাজিক প্রেরণায় নির্ভর করতে হবে। হয়তো বা কেউ বলতে পারেন, সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েট রাশিয়ায় তো আস্তিক্যবাদকে প্রশ্রয় দেওয়া হয়নি। কিন্তু শেষপর্যন্ত, মানুষের সহজাত আস্তিকতার জয়ই তো হল! তাহলে?

 বরং উল্টো দিক থেকে কথাটা বলা যাক। বিশ্বপুঁজিবাদের গোপন ও দীর্ঘমেয়াদি চক্রান্তে প্রতিক্রিয়াবাদের সবচেয়ে বড়ো সহায়ক এবং প্রগতির সবচেয়ে কঠিন শত্রু বলেই তো প্রমাণিত হল আস্তিক্যের সংস্কার। সোভিয়েট রাশিয়ায় নতুন সমাজতান্ত্রিক মানুষ গড়ে তোলার জন্যে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল নিরবচ্ছিন্ন পুনর্নির্মাণের। ওই প্রক্রিয়ার মূল ভিত্তি নাস্তিকতার দার্শনিক ও সামাজিক প্রেরণা। কিন্তু রাষ্ট্রের কর্ণধারেরা এই অত্যন্ত জরুরি কাজটি করেননি, তার ওপর বিশ্বপুঁজিবাদের চতুর অন্তর্ঘাত। তাহলে আস্তিক্যবাদকে ব্যবহার করেই সমাজতন্ত্রে মানবমুক্তির সম্ভাবনাকে পর্যন্ত নাকচ করে দিতে পারল গণশত্রুর আন্তর্জাতিক সংঘ। এতে বরং নাস্তিকতা ও মানবচেতনার সার্বিক শৃঙ্খল মোচনের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কই প্রমাণিত হচ্ছে। প্রমাণিত হচ্ছে, যুক্তিবাদের কষ্টিপাথরে যাচাই করে নিতে হবে নিয়ত মানবমুখী নাস্তিকতাকেও। বহু ঘটনার আবর্তে বিভ্রান্ত বিশ শতকে এক পা এগিয়ে মানুষ বুঝি বা দুপা পিছিয়ে গেছে বারবার। এমনকী, মৌল মানবতা থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়ে বীভৎস জান্তব অবয়বও দেখিয়েছে কখনো কখনো। তবু এ তো কবির বাচন নয় কেবল: মেঘ ক্ষণিকের, চিরদিবসের সূর্য। সংঘবদ্ধ মূঢ়তার কাছে নিশ্চয় আত্মসমর্পণ করবে না মানুষ। আমার পিতৃপুরুষের তৈরি কুয়ো—এই পরিত্যক্ত কুয়োর দূষিত জল পান করে কেউ?’—বিখ্যাত এই প্রশ্ন উচ্চারিত হয়েছিল বহুপঠিত সংস্কৃত শ্লোকে। উত্তরও দিয়েছিলেন ওই শ্লোককার, যে করে, সে কাপুরুষ!’ অর্থাৎ অবিবেচক ও অন্ধ। আস্তিক্যবাদের আড়ম্বর দিয়ে নিজেদের অন্ধতা যারা ঢেকে রেখেছে বহু শতাব্দি ধরে, তাদের দেখানো পথ ধরে চলতে গিয়ে নিজেদের অন্ধতর বলে প্রমাণিত করব কি? বাস্তব জীবনের কাল্পনিক বিশ্লেষণ কাম্য নাকি বাস্তবের বাস্তব বিশ্লেষণ চাই? যুক্তিবাদের কঠিন মাটিতে দাঁড়িয়ে যদি প্রত্যাখ্যান না করি মানবাতিরিক্ত সব কল্প-উপাদানকে, তাহলে তো নিজেদের যুক্তিকে নিজেরাই রোধ করে রাখব চিরকাল!

 তাই এ কেবল আস্তিক-নাস্তিকের প্রশ্ন নয়, এ আসলে জীবন আর মৃত্যু, আত্ম-প্রতিষ্ঠা আর আত্মবিলোপের মধ্যে যে-কোনো একটিকে বেছে নেওয়ারই প্রশ্ন। এখনো তো গেল না আঁধার! এখনো তো আস্তিক্যবাদের সূত্রে মানুষে-মানুষে বর্গ-বর্ণ-লিঙ্গগত বিভাজন সামাজিক প্রতাপের আস্ফালনকে পুষ্ট করছে। এখনো তো স্ববিরোধিতার সমাবেশ দেখেও যুক্তিহীন বিশ্বাসের দোহাই দিয়ে সব মেনে নিচ্ছি। এখনো তো অবতার-পিরদের ব্যবসায় আমাদের মূখ সমর্থন অব্যাহত থাকছে। এখনো রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার ঘাড়ে, সিন্দবাদের সেই বুড়ো দৈত্যের মতো, চেপে বসেছে আস্তিক্যবাদ। তাই কেবল ওই আস্তিকতার অবচেতন প্রভাবে উলঙ্গ রাজাদের আমরা শনাক্ত করতে পারছি না; যথেষ্ট ক্রোধে-ঘৃণায় উদ্বেল হতে পারছি না। ফলে ক্ষয়রোগের বীজাণু অবাধে বাড়ছে। একমাত্র যুক্তিনিষ্ঠ নাস্তিকতাই আমাদের প্রতিবাদী সত্তাকে লালন করতে পারে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সাহসটুকু যোগাতে পারে। কেননা আস্তিক্যবাদ আমাদের ভীরুতা ও মানিয়ে চলা শেখায় শুধু; নিয়তিবাদের কাছে সমর্পিত হতে প্ররোচনা দেয়। অতএব নাস্তিকতার অন্তর্বর্তী উদ্দীপক ইতিবাচকতাই আমাদের আশ্রয়ভূমি হোক। বিমানবায়ন ও ফাপা আস্তিকতার অশুভ আঁতাত ধ্বংস করে কদম-কদম এগিয়ে যাক নতুন জীবনস্বপ্নের উদগাতা, নতুন মানবচৈতন্যের উদ্ভাসক নাস্তিকতার প্রত্যয়। একে কি বলব ‘শত শতাব্দীর মনীষার কাজ? হয়তো। তবু, এই কবি, জীবনানন্দ, লিখেছিলেন অমোঘ উচ্চারণে:

‘কোথাও দর্শন নেই, বেশি নেই, তবুও নিবিড় অন্তর্ভেদী
দৃষ্টিশক্তি রয়ে গেছে মানুষকে মানুষের কাছে
ভালো স্নিগ্ধ আন্তরিক হিত
মানুষের মতো এনে দাঁড় করাবার’

সন্দেহ নেই যে, রিক্ত ‘হ্যাঁ’ থেকে ‘না’-এর সৃজনী উত্তাপে উত্তরণ দুরূহ এবং তা নিরবচ্ছিন্ন প্রক্রিয়া। তবে মানবিক পূর্ণতার জন্যে গণমনে তারই উদ্যোগ চলেছে, চলতে থাকবে।