সমাজ/অযোগ্য ভক্তি

উইকিসংকলন থেকে

অযোগ্য ভক্তি

ইষ্টি আর পুরোহিত
যাহা হ’তে সর্ব্বস্থিত
তারা যদি আসে বাড়ি পরে,
শুধু হাতে প্রণামেতে
ভার হ’য়ে যান তাতে
মুখে হাসি অন্তরে বেজার।
তিন টাকা নগদে দিলে
চরণ তুলি মাথা পরে
প্রসন্ন বদনে দেন বর।

 উল্লিখিত শ্লোক তিনটি টাকা সম্বন্ধীয় একটি ছড়া হইতে আমরা উদ্ধৃত করিয়া দিলাম। ইহার ছন্দ মিল এবং কবিত্ব সম্বন্ধে আমাদের বলিবার কিছুই নাই।

 কেবল দেখিবার বিষয় এই যে, ইহার মধ্যে যে সত্যটুকু বর্ণিত হইয়াছে তাহা আমাদের দেশে সাধারণের মধ্যে প্রচলিত, তাহা সর্ব্ববাদীসম্মত।

 টাকার যে কি আশ্চর্য্য ক্ষমতা তাহারই অনেকগুলি দৃষ্টান্তের মধ্যে আমাদের অখ্যাতনামা কবি উপরের দৃষ্টান্তটিও নিবিষ্ট করিয়াছেন। কিন্তু এ-দৃষ্টান্তে টাকার ক্ষমতা মানুষের মনের সেই অত্যাশ্চর্য্য ক্ষমতা প্রকাশ করিতেছে যাহার প্রভাবে সে একই সময়ে একই লোককে যুগপৎ ভক্তি এবং অশ্রদ্ধা করিতে পারে।

 সাধারণত গুরু পুরোহিত যে সাধুপুরুষ নহেন, সামান্য বৈষয়িকদের মত পয়সার প্রতি তাঁহার যে বিলক্ষণ লোভ আছে সে-সম্বন্ধে আমাদের কিছুমাত্র অন্ধতা নাই, তথাপি তাঁহার পায়ের ধূলা মাথায় লইয়া আমরা কৃতার্থ হইয়া থাকি কেননা গুরু ব্রহ্ম। এরূপ ভক্তি দ্বারা আমরা যে নিজেকে অপমানিত করি, এবং উপযুক্ত ব্যক্তিকে সম্মান করাই যে আত্মসম্মান এ-কথা আমরা মনেই করি না।

 কিন্তু অন্ধ ভক্তি অন্ধ মানুষের মত অভ্যাসের পথ দিয়া অনায়াসে চলিয়া যায়। সকল দেশেই ইহার নজির আছে। বিলাতে একজন লর্ডের ছেলে সর্ব্বতোভাবে অপদার্থ হইলেও অতি সহজেই যোগ্য লোকের শ্রদ্ধা আকর্ষণ করিয়া থাকে।

 যাহাকে অনেকদিন অনেকে পূজা করিয়া আসিতেছে তাহাকে ভক্তি করিবার জন্য কোনো ভক্তিজনক গুণ বা ক্ষমতা বিচারের প্রয়োজন হয় না। এমন কি সে স্থলে অভক্তির প্রত্যক্ষ কারণ থাকিলেও অর্ঘ্য্য আপনি আসিয়া আবৃষ্ট হয়।

 এইরূপ আমাদের মনের মধ্যে স্বভাবতই অনেকটা পরিমাণে জড়ধর্ম্ম আছে। সেই কারণে আমাদেব মন অভ্যাসের গড়ান পথে মোহের আকর্ষণে আপনিই পাথরের মত গড়াইয়া পড়ে, যুক্তি তাহার মাঝখানে বাধা দিতে আসিলে যুক্তি চূর্ণ হইয়া যায়।

 ভক্তির দ্বারা যে বিনতি আনয়ন করে সে বিনতি সকল ক্ষেত্রেই শোভন নহে। এই বিনতি, কেবল গ্রহণ কবিবার, শিক্ষা করিবার, মাহাত্ম্য প্রভাবের নিকট আপনার প্রকৃতিকে সাষ্টাঙ্গে অনুকূল করিবার জন্য। কিন্তু অমূলক বিনিতি অস্থানে বিনতি সেই কারণেই দুর্গতি আনয়ন করে। তাহা হীনকে ভক্তি করিয়া হীনতা লাভ করে, তাহা অযোগ্যের নিকট নত হইয়া অযোগ্যতার জন্য আপনাকে অনুকূল করিয়া রাখে।

 ভক্তি আমাদিগকে ভক্তিভাজনের আদর্শের প্রতি স্বতঃ আকর্ষণ করে বলিয়াই সজীব সভ্যসমাজে কতকগুলি কঠিন বিচার প্রচলিত আছে। সেখানে যে লোকের এমন কোনো ক্ষমতা আছে যাহা সাধারণের দৃষ্টি ও শ্রদ্ধা আকর্ষণ করে তাহাকে সমাজ সকল বিষয়েই নিষ্কলঙ্ক হইতে প্রত্যাশা করে। যে লোক রাজনীতিতে শ্রদ্ধেয় সে লোক ধর্ম্মনীতিতে হেয় হইলে সাধারণ দুর্নীতিপর লোক অপেক্ষা তাহাকে অনেক বেশি নিন্দনীয় হইতে হয়।

 এই হিসাবে ইহার মধ্যে কিঞ্চিৎ অন্যায় আছে। কারণ, ক্ষমতা সর্ব্বাতোব্যাপী হয় না, রাষ্ট্রনীতিতে যাহার বিচক্ষণতা তাহার ক্ষমতা এবং চরিত্রের অপর অংশ সাধারণ লোকের অপেক্ষা যে উন্নত হইবেই এমন কোনো প্রাকৃতিক নিয়ম নাই—অতএব সাধারণ লোককে যে আদর্শে বিচার করি বাষ্ট্রনীতিতে বিচক্ষণ ব্যক্তিকে রাষ্ট্রনীতি ব্যতীত অন্য অংশে সেই আদর্শে বিচার করাই উচিত। কিন্তু সমাজ কেবলমাত্র আত্মরক্ষার জন্য এ-সম্বন্ধে কিয়ৎ পরিমাণে অবিচার করিতে বাধ্য।

 কারণ, পূর্ব্বেই বলিয়াছি, ভক্তির দ্বারা মন গ্রহণ করিবার অনুকূল অবস্থায় উপনীত হয়। এক অংশ লইব এবং অপর অংশ লইব না এমন বিচারশক্তি তখন তাহার থাকে না।

 কিন্তু যে বিষয়ে কোনো লোক অসাধারণ ঠিক সেই বিষয়েই সাধারণ লোকেব পক্ষে তাহার অনুকরণ দুঃসাধ্য। সুতরাং যে অংশে সে সাধারণ লোকের অপেক্ষা উচ্চ নহে, এমন কি, যে অংশে তাহার দুর্ব্বলতা, সেই অংশেরই অনুকরণ দেখিতে দেখিতে ব্যাপ্ত এবং সফল হইয়া উঠে। এই জন্য যে লোক এক বিষয়ে মহৎ সে লোক অন্য বিষয়ে হীন হইলে সমাজ প্রথমত তাহার এক বিষয়ের মহত্ত্বও অস্বীকার করিতে চেষ্টা করে,—তাহাতে যদি কৃতকার্য্য না হয় তবে তাহার হীনতার প্রতি সাধারণ হীনতা অপেক্ষা গাঢ়তর কলঙ্ক আরোপ করে। আত্মরক্ষার জন্য সভ্যসমাজের এইরূপ চেষ্টা। যে লোক অসাধারণ, তাহাকে সংশোধন করিবার জন্য ততটা নহে, কিন্তু যাহারা সাধারণ লোক তাহাদিগকে ভক্তির কুফল হইতে রক্ষা করিবার জন্য।

 অহঙ্কারের কুফল সম্বন্ধে নীতিশাস্ত্রমাত্রেই আমাদিগকে সতর্ক করিয়া রাখে। অহঙ্কারে লোকের পতন হয় কেন? প্রথম কারণ, নিজের বড়ত্ব সম্বন্ধে অতিবিশ্বাস থাকাতে সে পরকে ঠিকমত জানিতে পাবে না; যে সংসারে পাঁচজনের সহিত বাস করিতে ও কাজ করিতে হয় সেখানে নিজের তুলনায় অন্যকে যথার্থরূপে জানিতে পারিলে তবেই সকল বিষযে সফলতা লাভ করা সম্ভব। চীন দেশে আত্মাভিমানের প্রবলতায় জাপানকে চিনিতে পারে নাই। তাই তাহার এমন অকস্মাৎ দুর্গতি ঘটিল। জর্ম্মানির সহিত যুদ্ধের পূর্ব্বে ফ্রান্সেরও সেই দশ। ঘটিয়াছিল। আব অতি দর্পে হতা লঙ্কা, একথা আমাদের দেশে প্রসিদ্ধ। ইংরাজিতে একটা প্রবাদ আছে, জ্ঞানই বল। কি গৃহে, কি কর্ম্মক্ষেত্রে পরের সম্বন্ধে ঠিকমত জ্ঞানই আমাদের প্রধান বল। অহঙ্কার সেই সম্বন্ধে অজ্ঞতা আনয়ন করিয়া আমাদের দুর্ব্বলতার প্রধান কারণ হইয়া থাকে।

 অহঙ্কারের আর এক বিপদ, তাহা সংসারকে আমাদের প্রতিকূলে দাঁড় করায়। যিনি যত বড় লোকই হোন্ না কেন সংসারের কাছে নানা বিষয়ে ঋণী; যে লোক সবিনয়ে সেই ঋণ স্বীকার করিতে না চাহে তাহার পক্ষে ঋণ পাওয়া কঠিন হয়।

 কিন্তু সর্ব্বাপেক্ষা বিপদ আর একটি আছে। বড়কে বড় বলিয়া জানায় একটি অধ্যাত্মিক আনন্দ আছে। আত্মার বিস্তার হয় বলিয়া সে আনন্দ। অহঙ্কার আমাদিগকে নিজের সঙ্কীর্ণতার মধ্যে বদ্ধ করিয়া বাখে, যাহার ভক্তি নাই, সে জানে না অহঙ্কারের অধিকার কত সঙ্কীর্ণ; যাহার ভক্তি আছে সেই জানে আপনার বাহিরে যে বৃহত্ত্ব যে মহত্ত্ব তাহাই অনুভব করাতেই আত্মার মুক্তি।

 এই জন্য বৈষয়িক এবং আধ্যাত্মিক উভয় হিসাবেই অহঙ্কারের এত নিন্দা।

 কিন্তু অযথা ভক্তিও যে অহঙ্কারের মত সর্ব্বতোভাবে দুষ্য নীতি শাস্ত্রে সে কথার উল্লেখ থাকা উচিত। অন্ধ ভক্তিও পরের সম্বন্ধে আমাদের অজ্ঞতার কারণ হয়। এবং অযোগ্য ভক্তিতে আমাদিগকে যদি আপনার সমকক্ষ অথবা আপনার অপেক্ষা হীনের নিকট নত করে তবে তাহাতে যে দীনতা উপস্থিত করে তাহা অহঙ্কাবের সঙ্কীর্ণতা অপেক্ষা অল্প হেয় নহে এই জন্য ইংরাজ সমাজে অভিমানকে অহঙ্কারের মত নিন্দনীয় বলে না। অভিমান না থাকিলে মনুষ্যত্বের হানি হয় একথা তাহারা স্বীকার করে।

 যাহার মনুষ্যত্বের অভিমান আছে সে কখনই অযোগ্য স্থানে আপনাকে নত করিতে পারে না। তাহার ভক্তির বৃত্তি যদি চরিতার্থতা চায় তবে সে যেখানে সেখানে লুটাইয়া পড়ে না,—সে যথোচিত সন্ধান ও প্রমাণের ধারা যথার্থ ভক্তিভাজনকে বাহির করে।

 কিন্তু আমরা ভক্তিপ্রবণ জাতি। ভক্তি করাকেই আমরা ধর্ম্মাচরণ বলিয়া থাকি;—কাহাকে ভক্তি করি তাহা বিচার করা আমাদেব পক্ষে বাহুল্য।

 আমাদের সৎপ্রবৃত্তিরও পথ যদি অত্যন্ত অবাধ হয় তাহাতে ভাল ফল হয় না। তাহার বল, তাহার সচেষ্টতা, তাহার আধ্যাত্মিক উজ্জ্বলতা রক্ষার জন্য, তাহাকে অমোঘ হইবার জন্য বাধার সহিত তাহার সংগ্রাম আবশ্যক।

 যেমন বৈজ্ঞানিক সত্য নির্ণয় করিতে হইলে তাহাকে পদে পদে সংশয়ের দ্বারা বাধা দিতে হয়, আপাতদৃষ্টিতে বিশ্ব সাধারণের কাছে যাহা অসন্দিগ্ধ সত্য বলিয়া খ্যাত তাহাকেও কঠিন প্রমাণের দ্বারা বারম্বার বিচিত্রভাবে পরীক্ষা করিয়া দেখিতে হয়। যে লোক অতিব্যগ্রতার সহিত তাড়াতাড়ি আপনার প্রশ্নের উত্তর পাইতে চায় অধিকাংশ স্থলেই সে ভুল উত্তর পায়। যে-কোনো প্রকারে হৌক্ জিজ্ঞাসাবৃত্তির নিবৃত্তিই মুখ্য লক্ষ্য হওয়া উচিত নহে, সত্য নির্ণয়ই জিজ্ঞাসার প্রকৃত পরিণাম ৷

 তেমনি, তাড়াতাড়ি কোনো প্রকারে ভক্তিবৃত্তির পরিতৃপ্তি সাধনই ভক্তির সার্থকতা নহে। বরঞ্চ কোনোমতে আপনাকে পরিতৃপ্ত করিবার অতিমাত্র আগ্রহে সে আপনাকে ভ্রান্ত পথে লইয়া যায়। এইরূপে সে মিথ্যা দেবতা, আত্মাবমান ও সহজ সাধনার সৃষ্টি করিতে থাকে। মহত্ত্বের ধারণাই ভক্তির লক্ষ্য তা সে যতই কঠিন হৌক্‌; আত্মপরিতৃপ্তি নহে, তা সে যতই সহজ ও সুখকর হৌক্‌! জিজ্ঞাসা বৃত্তির পথে বুদ্ধিবিচারই প্রধান আবশ্যক বাধা। সেই সঙ্গে একটা অভিমানও আছে। অভিমান বলে, আমাকে ফাঁকি দিতে পারিবে না। আমি এমন অপদার্থ নহি। যাহা তাহাকে আমি সত্য বলিয়া মানিতে পারি না। আগে আমার সমস্ত সংশয়কে পরাস্ত কর তবেই আমি সত্যকে সত্য বলিয়া গ্রহণ করিতে পারি।

 ভক্তিপথেও সেই বুদ্ধিবিচার ও অভিমানই অত্যাবশ্যক বাধা। সেই বাধা থাকিলে তবেই ভক্তি—যথার্থ ভক্তিভাজনকে আশ্রয় করিয়া আপনাকে চরিতার্থ করে। অভিমান সহজে মাথা নত হইতে দেয় না। যখন সে আত্মসমর্পণ করে তখন ভক্তিভাজনের পরীক্ষা হইয়া গেছে, রামচন্দ্র তখন ধনুক ভাঙিয়া তবে তাঁহার বলের প্রমাণ দিয়াছেন। সেই বাধা না থাকিলে ভক্তি অলস হইয। যায়, অন্ধ হইয়া যায়, কলের পুতুলের মত নির্ব্বিচারে ক্ষণে ক্ষণে মাথা নত করিয়া সে আপনাকে কৃতার্থ জ্ঞান করে। এইরূপে ভক্তি অধ্যাত্মশক্তি হইতে মোহে পরিণত হয় ৷

 অনেক সময় আমরা ভুল বুঝিয়া ভক্তি করি। যাহাকে মহৎ মনে করি সে হয় ত মহৎ নয়। কিন্তু যতক্ষণ পর্য্যন্ত আমার কল্পনায় সে মহৎ ততক্ষণ তাহাকে ভক্তি করিলে ক্ষতির কারণ অল্পই আছে।

 ক্ষতির কারণ কিছু নাই তাহা নয়। পূর্ব্বেই বলিয়াছি যাহাকে মহৎ বলিয়া ভক্তি করি জ্ঞাত এবং অজ্ঞাতসারে তাহার অনুকরণে প্রবৃত্ত হই। যে লোক প্রকৃত মহৎ নহে কেবল আমাদের কল্পনায় ও বিশ্বাসে মহৎ, অন্ধভাবে তাহার আচরণের অনুকরণ আমাদের পক্ষে উন্নতিকর নহে।

 কিন্তু আমাদের দেশে আশ্চর্য্যের বিষয় এই যে, আমরা ভুল বুঝিয়াও ভক্তি করি। আমরা যাহাকে হীন বলিয়া জানি তাহার পদধূলি অকৃত্রিম ভক্তিভরে মস্তকে ধারণ করিতে ব্যগ্র হই।

 আমাদের দেশে মোহান্তের মহৎ, পুরোহিতের পবিত্র এবং দেবচরিত্রের উন্নত হওয়ার প্রয়োজন হয় না, কারণ, আমরা ভক্তি লইয়া প্রস্তুত রহিয়াছি। যে মোহান্ত জেলে যাইবার যোগ্য তাহার চরণামৃত পান করিয়া আমরা আপনাকে অপমানিত জ্ঞান করি না, যে পুরোহিতের চরিত্র বিশুদ্ধ নহে এবং যে লোক পূজানুষ্ঠানের মন্ত্রগুলির অর্থ পর্য্যন্তও জানে না তাহাকে ইষ্ট গুরুদেব বলিয়া স্বীকার করিতে আমাদের মুহূর্তের জন্যও কুণ্ঠা বোধ হয় না,—এবং আমাদেরই দেশে দেখা যায়, যে-সকল দেবতার পুরাণ-বর্ণিত আচরণ লক্ষ্য করিয়া আলাপে ও প্রচলিত কাব্যে ও গানে অনেক স্থলে নিন্দা ও পরিহাস করি সেই দেবতাকেই আমরা পূর্ণ ভক্তিতে পূজা করিয়া থাকি।

 সুতরাং এস্থলে সহজেই মনে প্রশ্ন উঠে, কেন পূজা করি? তাহার এক উত্তর এই যে, অভ্যাসবশত অর্থাৎ মনের জড়ত্ব বশত, দ্বিতীয় উত্তর এই যে, ভক্তিজনক গুণের জন্য নহে পরন্তু শক্তি কল্পনা করিয়া এবং সেই শক্তি হইতে ফল কামনা করিয়া।

 আমাদের উদ্ধৃত শ্লোকের প্রথমেই আছে “ইষ্টি আর পুরোহিত যাহা হ’তে সর্ব্বস্থিত।” ইহাতেই বুঝা যাইতেছে গুরু ও পুরোহিতেব মধ্যে আমবা একটা গূঢ় শক্তি কল্পনা করিয়া থাকি, তাঁহাদের শিক্ষা, চরিত্র ও আচরণ যেমনই হৌক্‌ তাঁহারা আমাদের সাংসারিক মঙ্গলের প্রধান কারণ এবং তাঁহাদেব প্রতি ভক্তিতে লাভ ও অভক্তিতে লোকসান আছে এই বিশ্বাস আমাদের মাথাকে তাঁহাদের পায়ের কাছে নত করিয়া রাখিয়াছে। কোনো কোনো সম্প্রদায়ের মধ্যে এ বিশ্বাস এতদূর পর্য্যন্ত গিয়াছে যে তাঁহারা গৃহধর্ম্মনীতির সুস্পষ্ট ব্যভিচাব দ্বারাও গুরুভক্তিকে অন্যায় প্রশ্রয় দিয়া থাকেন।

 দেবতা সম্বন্ধেও সে কথা খাটে। দেবচবিত্র আমাদের আদর্শ চরিত্র হইবে এমন আবশ্যক নাই। দেবভক্তিতে ফল আছে, কারণ দেবতা শক্তিমান।

 ব্রাহ্মণ সম্বন্ধেও তাহাই। ব্রাহ্মণ দুশ্চরিত্র নরাধম হইলেও ব্রাহ্মণ বলিয়াই পূজ্য। ব্রাহ্মণের কতকগুলি নিগূঢ় শক্তি আছে। তাঁহাদের প্রসাদে ও বিবাগে আমাদের ভালমন্দ ঘটিয়া থাকে। এরূপ ভক্তিতে ভক্ত ও ভক্তিপাত্রের মধ্যে আধ্যাত্মিক সম্বন্ধ থাকে না, দেনা-পাওনার সম্বন্ধই দাঁড়াইয়া যায়। সেই সম্বন্ধে ভক্তিপাত্রকেও উচ্চ হইতে হয় না এবং ভক্তও নীচতা লাভ করে।

 কিন্তু আমাদের দেশের দেবভক্তি সম্বন্ধে আধুনিক শিক্ষিত অনেকে অত্যন্ত সূক্ষ্ম তর্ক করেন। তাঁহারা বলেন ঈশ্বর যখন সর্ব্বজ্ঞ সর্ব্বব্যাপী তখন ঈশ্বর বলিয়া আমরা যাঁহাকেই পূজা করি ঈশ্বরই সে-পূজা গ্রহণ করেন। অতএব এরূপ ভক্তি নিষ্ফল নহে।

 পূজা যেন খাজনা দেওয়ার মত, স্বয়ং রাজার হস্তেই দিই আর তাঁহার তহশিলদারের হস্তেই দিই একই রাজভাণ্ডারে গিয়া জমা হয়।

 দেবতার সহিত দেনা-পাওনার সম্বন্ধ আমাদের মনে এমনই বদ্ধমূল হইয়া গেছে যে, পূজার দ্বারা ঈশ্বরের যেন একটা বিশেষ উপকার করিলাম এবং তাহার পরিবর্ত্তে একটা প্রত্যুপকার আমার পাওনা রহিল ইহাই ভুলিতে না পারিয়া আমরা দেবভক্তি সম্বন্ধে এমন দোকানদারীব কথা বলিয়া থাকি। পূজাটা দেবতাব হস্তগত হওয়াই যখন বিষয়, এবং সেটা ঠিকমত তাঁহার ঠিকানায় পৌঁছিলেই যখন আমার কিঞ্চিৎ লাভ আছে, তখন যত অল্প ব্যয়ে অল্প চেষ্টায় সেটা চালান করা যায় ধর্ম্ম ব্যবসায়ে ততই আমার জিৎ। দরকার কি ঈশ্বরের স্বরূপ ধারণা চেষ্টায়, দরকার কি কঠোর সত্যানুসন্ধানে; সম্মুখে কাষ্ঠ, প্রস্তর, যাহা উপস্থিত থাকে তাহাকে ঈশ্বর বলিয়া পূজা নিবেদন করিয়া দিলে যাঁহার পূজা তিনি আপনি ব্যগ্র হইয়া আসিয়া হাত বাড়াইয়া লইবেন।

 আমাদের পুরাণে ও প্রচলিত কাব্যে যেরূপ বর্ণনা আছে তাহাতে মনে হয় দেবতারা যেন আপনাদের পূজা গ্রহণের জন্য মৃতদেহের উপর শকুনী গৃধিনীর ন্যায় কাড়াকাড়ি ছেঁড়াছিঁড়ি করিতেছেন। অতএব আমাদের নিকট হইতে ভক্তিগ্রহণের লোলুপতা যে ঈশ্বরেরই একথা আমাদের শিক্ষিত সম্প্রদায়ের মনেও অলক্ষ্যে বিবাজ করিতেছে।

 কিন্তু, কি মনুষ্যপূজায় এবং কি দেবপূজায়, ভক্তি ভক্তেরই লাভ। যাঁহাকে ভক্তি করি তিনি না জানিলেও ক্ষতি নাই। কিন্তু তাঁহাকেই আমার জানা চাই, তবেই আমার ভক্তির সার্থকতা। পূজ্য ব্যক্তির আদর্শকে আমাদের প্রকৃতির সহিত সম্পূর্ণ মিশাইয়া লইতে চাহিলে ভক্তি ছাড়া আর কোনো উপায়ই নাই। আমরা যাঁহাকে পূজা করি তাঁহাকেই যদি বস্তুত চাই তবে তাঁহার প্রকৃতির আদর্শ তাঁহার সত্যস্বরূপ একান্ত ভক্তিযোগে হৃদয়ে স্থাপনা করিতে হয়। সেরূপ অবস্থায় ফাঁকি দিতে স্বতই প্রবৃত্তি হয় না,—তাঁহার সহিত বৈসাদৃশ্য ও দূরত্ব যতই দীনত্বের সহিত অনুভব করি ততই ভক্তি বাড়িয়া উঠিয়া ক্ষুদ্র আপনাকে তাঁহার সহিত লীন করিবার চেষ্টা করে।

 ইহাই ভক্তির গৌরব। ভক্তিরস সেই আধ্যাত্মিক রসায়নশক্তি যাহা ক্ষুদ্রকে বিগলিত করিয়া মহতের সহিত মিশ্রিত করিতে পারে।

 অতএব ঈশ্বরকে যখন ভক্তি করি তখন তদ্দ্বারা তাঁহার ঐশ্বর্য্য বাড়ে না—আমরাই সেই রসস্বরূপের রাসায়নিক মিলন লাভ করি। আমাদের ঈশ্বরের আদর্শ যত মহৎ মিলনের আনন্দ ততই প্রগাঢ়, এবং তদ্দ্বারা আত্মার প্রসারতা ততই বিপুল হইবে।

 ভক্তি আমরা যাঁহাকে করি তাঁহাকে ছাড়া আর কাহাকেও পাই না। যদি গুরুকে ব্রহ্ম বলিয়া ভক্তি করি তবে সেই গুরুর আদর্শই আমাদের মনে অঙ্কিত হয়। ভক্তির প্রবলতার দ্বারা সেই গুরুর মানস আদর্শ তাঁহার স্বাভাবিক আদর্শ অপেক্ষা কতকটা পরিমাণে আপনি বাড়িয়া যায় সন্দেহ নাই কিন্তু তাহা হইতে স্বতন্ত্র হইতে পারে না।

 অস্থানে ভক্তি করিবার একটা মহৎ পাপ এই যে, যিনি যথার্থ পূজ্য, অযোগ্য পাত্রদের সহিত তাঁহাকে একাসনভুক্ত করিয়া দেওয়া হয়। দেবতায় উপদেবতায় প্রভেদ থাকে না।

 আমাদের দেশে এই অন্যায় মিশ্রণ সকল দিকেই ঘটিয়াছে। আমাদের দেশে অনাচার, আচারের ত্রুটি এবং ধর্ম্মনিয়মের লঙ্ঘনকে একত্র মিশ্রিত করিয়া আমরা ঘোরতর জড়বাদ ও নিগূঢ় নাস্তিকতায় উপনীত হইয়াছি।

 ভক্তিরাজ্যেও সেইরূপ মিশ্রণ ঘটাইয়া আমরা ভক্তির অধ্যাত্মিকতা নষ্ট করিয়াছি। সেই জন্যই আমরা বরঞ্চ সাধু শূদ্রকে ভক্তি করি না কিন্তু অসাধু ব্রাহ্মণকে ভক্তি করি। আমরা প্রভাতসূর্য্যালোকিত হিমাদ্রিশিখরের প্রতি দৃক্‌পাত না করিয়া চলিয়া যাইতে পারি কিন্তু সিন্দুরলিপ্ত উপলখণ্ডকে উপেক্ষা করিতে পারি না।

 সত্য এবং শাস্ত্রের মধ্যেও আমরা এইরূপ একটা জটা পাকাইয়াছি। সমুদ্রযাত্রা উচিত কি না তাহা নির্ণয় করিতে ইহাই দেখা কর্ত্তব্য যে, নূতন দেশ ও নূতন আচার ব্যবহার দেখিয়া আমাদের জ্ঞানের বিস্তার হয় কি না, আমাদের সঙ্কীর্ণতা দূর হয় কি না, ভূখণ্ডের একটি ক্ষুদ্র সীমার মধ্যে কোনো জ্ঞানপিপাসু উন্নতি-ইচ্ছুক ব্যক্তিকে বলপূর্ব্বক বন্ধ করিয়া রাখিবার ন্যায্য অধিকার কাহারও আছে কি না। কিন্তু তাহা না দেখিয়া আমরা দেখিব পরাশর সমুদ্র পার হইতে বলিয়াছেন কি না এবং অত্রি কি বলিয়া তাহার সমর্থন করিয়াছেন।

 এমন বিপরীত বিকৃতি কেন ঘটিল? ইহার প্রধান কারণ এই যে, স্বাধীনতাতেই যে-সমস্ত প্রবৃত্তির প্রধান গৌরব তাহাদিগকেই বন্ধনে বদ্ধ করা হইয়াছে।

 অভ্যাস বা পরের নির্দ্দেশবশত নহে পরন্তু স্বাধীন বোধশক্তিযোগে যে-ভক্তিবলে আমরা মহত্ত্বের নিকট আত্মসমর্পণ করি তাহাই সার্থক ভক্তি।

 কিন্তু আশঙ্কা এই যে, যদি বোধশক্তি তোমার না থাকে! অতএব নিয়ম বাঁধিয়া দেওয়া গেল অমুক সম্প্রদায়কে এই প্রণালীতে ভক্তি করিতেই হইবে। না করিলে সাংসারিক ক্ষতি ও পুরুষানুক্রমে নরকবাস।

 গাছ মাটিতে রোপণ করিলে তাহাকে গরুতে খাইতে পারে, তাহাকে পথিকে দলন করিতে পারে, এই ভয়ে তাহাকে লোহার সিন্ধুকে বদ্ধ রাখা হইল। সেখানে সে নিরাপদে রহিল কিন্তু তাহাতে ফল ধরিল না; সজীব গাছ মৃত কাঠ হইয়া গেল।

 মানুষের বুদ্ধিকে যতক্ষণ স্বাধীনতা না দেওয়া যায় ততক্ষণ সে ব্যর্থ। কিন্তু যদি সে ভুল করে, অতএব তাহাকে বাঁধ; আমি বুদ্ধিমান যে ঘানিগাছ রোপন করিলাম চোখে ঠুলি দিয়া সেইটেকে সে নিত্যকাল প্রদক্ষিণ করিতে থাক্।

 স্বাস্থ্যতত্ত্ব সম্বন্ধে তাহাকে কোনো দিন মাথা ঘুরাইতে হইবে না— আমি ঠিক করিয়া দিলাম কোন তিথিতে মূলা খাইলে তাহার নরক এবং চিঁড়া খাইলে তাহার অক্ষয় ফল। তোমার মূলা ছাড়িয়া চিঁডা খাইয়া তাহার কি উপকার হইল তাহার কোনো প্রমাণ নাই কিন্তু যাহা অপকার হইল ইতিহাসে তাহা উত্তরোত্তর পুঞ্জীকৃত হইয়া

 ১৩০৫।