সমালোচনা/চণ্ডিদাস ও বিদ্যাপতি

উইকিসংকলন থেকে

চণ্ডিদাস ও বিদ্যাপতি।

 নিজের প্রাণের মধ্যে, পরের প্রাণের মধ্যে ও প্রকৃতির প্রাণের মধ্যে প্রবেশ করিবার ক্ষমতাকেই বলে কবিত্ব। যাহারা প্রকৃতির বহির্‌দ্বারে বসিয়া কবি হইতে যায় তাহারা কতকগুলা বড়ো বড়ো কথা, টানাবোনা তুলনা ও কাল্পনিক ভাব লইয়া ছন্দ নির্মাণ করে। মর্মের মধ্যে প্রবেশ করিবার জন্য যে কল্পনা আবশ্যক করে তাহাই কবির কল্পনা; আর গোঁজামিলন দিবার কল্পনা – না পড়িয়া পণ্ডিত হইবার– না অনুভব করিয়া কবি হইবার এক প্রকার গিল্‌‍টি-করা কল্পনা আছে, তাহা জালিয়াতের কল্পনা। যিনি প্রাণের মধ্যে প্রবেশ করিয়া কবি হইয়াছেন তিনি সহজ কথার কবি, সহজ ভাবের কবি। কারণ, যে ব্যক্তি মিথ্যা বলে তাহাকে দশ কথা বলিতে হয়, আর যিনি সত্য বলেন তাঁহাকে এক কথার বেশি বলিতে হয় না। তেমনি যিনি অনুভব করিয়া বলেন তিনি দুটি কথা বলেন, আর যে অনুভব না করিয়া বলে সে পাঁচ কথা বলে অথচ ভাব প্রকাশ করিতে পারে না। অতএব সহজ ভাষার, সহজ ভাবের, সহজ কবিতা লেখাই শক্ত, কারণ তাহাতে প্রাণের মধ্যে প্রবেশ করিয়া দেখিতে হয়। সকলের প্রাণের মধ্যেই যে ব্যক্তি আতিথ্য পায়– ফুল বলো, মেঘ বলো, দুঃখী বলো, সুখী বলো, সকলের প্রাণের মধ্যেই যাহার আসন আছে, সেই তাহা পারে। আর বড়ো বড়ো কথার মোটা মোটা ভাবের কবিতা লেখা সহজ, কারণ প্রাণের মধ্যে প্রবেশ না করিয়াও তাহা পারা যায়। বড়ো বড়ো কবির কবিতা অনেকের পক্ষে কুহেলিকাময়ী কেন? কারণ, তাঁহারা যাহা অনুভব করিয়াছেন অধিক বকিয়া যে তাহা সহজ করিতে হইবে ইহা তাঁহাদের মনেও হয় না। এবং তাঁহারা যাহা অনুভব করিয়াছেন তাহা সকলে অনুভব করে নাই; কাজেই সকলের কাছে তাঁহাদের সে সহজ কথা নিতান্ত শক্ত হইয়া পড়ে। সহজ কথা লিখিয়াছেন বলিয়াই শক্ত। সহজ কথার গুণ এই যে, তাহা যতটুকু বলে তাহা অপেক্ষা অনেক অধিক বলে। সে সমস্তটা বলে না। পাঠকদিগকে কবি হইবার পথ দেখাইয়া দেয়– যে দিকে কল্পনা ছুটাইতে হইবে সেই দিকে অঙ্গুলী নির্দেশ করিয়া দেয় মাত্র, আর অধিক কিছু করে না। নিজে যাহা আবিষ্কার করিয়াছে, পাঠকদিগকেও তাহাই আবিষ্কার করাইয়া দেয়। যাহাদের কল্পনা কম, যাহাদের চোখে আঙুল দিয়া দেখাইতে হয়, তাহারা এরূপ কবিতার পাঠক নহে।

 আমাদের চণ্ডিদাস সহজ ভাষার সহজ ভাবের কবি, এই গুণে তিনি বঙ্গীয় প্রাচীন কবিদের মধ্যে প্রধান কবি। তিনি যে-সকল কবিতা লেখেন নাই তাহারই জন্য কবি। তিনি এক ছত্র লেখেন ও দশ ছত্র পাঠকদের দিয়া লিখাইয়া লন। দুই-একটি সামান্য দৃষ্টান্ত দিলেই আমাদের কথা পরিস্ফুট হইবে।

এ ঘোর রজনী, মেঘের ঘটা,
কেমনে আইল বাটে?
আঙ্গিনার কোণে তিতিছে বঁধুয়া,
দেখিয়া পরাণ ফাটে।

সই, কি আর বলিব তোরে,
বহু পুণ্যফলে সে-হেন বঁধুয়া
আসিয়া মিলল মোরে।
ঘরে গুরুজন, ননদী দারুণ,
বিলম্বে বাহির হৈনু–
আহা মরি মরি, সংকেত করিয়া
কত-না যাতনা দিনু।
বঁধুর পিরীতি আরতি দেখিয়া
মোর মনে হেন করে
কলঙ্কের ডালি মাথায় করিয়া
আনল ভেজাই ঘরে!
রাধা শ্যামকে প্রথম দেখিয়াই বলিয়া উঠিলেন –
এ ঘোর রজনী, মেঘের ঘটা,
কেমনে আইল বাটে?
আঙ্গিনার কোণে তিতিছে বঁধুয়া
দেখিয়া পরাণ ফাটে!

কিন্তু তাহার পরেই যে তৎক্ষণাৎ মুখ ফিরাইয়া সখীদের ডাকিয়া কহিলেন,

সই, কি আর বলিব তোরে,
বহু পুণ্যফলে সে-হেন বঁধুয়া
আসিয়া মিলল মোরে!

ইহার মধ্যে কতটা কথা রাধার মনের উপর দিয়া চলিয়া গিয়াছে! কতটা কথা একেবারে বলাই হয় নাই! প্রথমেই শ্যামকে ভিজিতে দেখিয়া দুঃখ, তাহার পরেই সখীদের ডাকিয়া তাহাদের কাছে সুখের উচ্ছ্বাস, ইহার মধ্যে শৃঙ্খলটি কোথায়? সে শৃঙ্খল পাঠকদিগকে গড়িয়া লইতে হয়। রাধা যা কহিল তাহা তা সামান্য, কিন্তু রাধা যা কহিল না তাহা কতখানি! যাহা বলা হইল না পাঠকদিগকে তাহাই শুনিতে হইবে! শ্যামকে ভিজিতে দেখিয়া রাধার দুঃখ ও শ্যামকে ভিজিতে দেখিয়াই রাধার সুখ, উভয়ের মধ্যে দ্বন্দ্ব হইতেছে। রাধার হৃদয়ের এই তরঙ্গভঙ্গ, এই উত্থানপতন, কত অল্প কথায় কত সুন্দররূপে ব্যক্ত হইয়াছে! প্রথম দুই ছত্রে শ্যামকে দেখিয়া দুঃখ, দ্বিতীয় দুই ছত্রে সুখ, তৃতীয় দুই ছত্রে আবার দুঃখ, চতুর্থ দুই ছত্রে আবার সুখ। রাধা হাসিবে কি কাঁদিবে ভাবিয়া পাইতেছে না। রাধা সুখে দুঃখে আকুল হইয়া পড়িয়াছে। শেষে রাধা এই মীমাংসা করিল, শ্যাম আমার জন্য কত কষ্ট পাইয়াছে, আমি শ্যামের জন্য ততোধিক কষ্ট স্বীকার করিয়া শ্যামের সে ঋণ পরিশোধ করিব।

 দ্বিতীয় দৃষ্টান্ত–

“সই, কেমনে ধরিব হিয়া?
আমার বঁধুয়া আন বাড়ি যায়
আমার আঙ্গিনা দিয়া!
সে বঁধু কালিয়া না চায় ফিরিয়া,
এমতি করিল কে?
আমার অন্তর যেমন করিছে
তেমনি হউক সে!

যাহার লাগিয়া সব তেয়াগিনু,
লোকে অপযশ কয়,
সেই গুণনিধি ছাড়িয়া পিরীতি
আর জানি কার হয়!
যুবতী হইয়া শ্যাম ভাঙ্গাইয়া
এমতি করিল কে?
আমার পরাণ যেমতি করিছে
সেমতি হউক সে!

 “আমার পরাণ যেমতি করিছে তেমতি হউক সে!” এই কথাটার মধ্যে কতটা কথা আছে! রাধা সমস্ত বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডে আর অভিশাপ খুঁজিয়া পাইল না। শত সহস্র অভিশাপের পরিবর্ত্তে সে কেবল একটি কথা কহিল। সে কহিল, “আমার পরাণ যেমন করিছে, তেমনি হউক সে! “ইহাতেই বুঝিতে পারিয়াছি রাধার পরাণ কেমন করিতেছে! ঐ এক “যেমন করিছে” শব্দের মধ্যে নিদারুণ কষ্ট প্রচ্ছন্ন আছে, সে কষ্ট বর্ণনা না করিলে যতটা বর্ণিত হয় এমন আর কিছুতে না। উপরি-উক্ত পদটির মধ্যে রাধা দুই বার অভিশাপ দিতে গিয়াছে, কিন্তু উহার অপেক্ষা গুরুতর অভিশাপ সে আর কোনমতে খুঁজিয়া পাইল না। ইহাতেই রাধার সমস্ত হৃদয় দেখিতে পাইলাম।

 বিদ্যাপতি সুখের কবি,চণ্ডিদাস দুঃখের কবি। বিদ্যাপতি বিরহে কাতর হইয়া পড়েন, চণ্ডিদাসের মিলনেও সুখ নাই। বিদ্যাপতি জগতের মধ্যে প্রেমকে সার বলিয়া জানিয়াছেন, চণ্ডিদাস প্রেমকেই জগৎ বলিয়া জানিয়াছেন। বিদ্যাপতি ভোগ করিবার কবি, চণ্ডিদাস সহ্য করিবার কবি। চণ্ডিদাস সুখের মধ্যে দুঃখ ও দুঃখের মধ্যে সুখ দেখিতে পাইয়াছেন। তাঁহার সুখের মধ্যেও ভয় এবং দুঃখের প্রতিও অনুরাগ। বিদ্যাপতি কেবল জানেন যে মিলনে সুখ ও বিরহে দুঃখ, কিন্তু চণ্ডিদাসের হৃদয় আরো গভীর, তিনি উহা অপেক্ষা আরো অধিক জানেন! তাঁহার প্রেম “কিছু কিছু সুধা, বিষগুণা আধা,” তাঁহার কাছে শ্যাম যে মুরলী বাজান, তাহাও “বিষামৃতে একত্র করিয়া।”

কহে চণ্ডিদাস, ‘শুন বিনোদিনী,
সুখ দুখ দুটি ভাই?
সুখের লাগিয়া যে করে পিরীতি,
দুখ যায় তার ঠাঁই।'

চণ্ডিদাস শতবার করিয়া বলিয়াছেন,

“যার যত জ্বালা তার ততই পিরীতি।”

 “সদা জ্বালা যার, তবে সে তাহার মিলয়ে পিরীতিধন।” “অধিক জ্বালা যায় তার অধিক পিরীতি।” ইত্যাদি। কিন্তু সেই চণ্ডিদাস আবার কহিয়াছেন,

“সই, পিরীতি না জানে যারা,
এ তিন ভুবনে জনমে জনমে
কি সুখ জানয়ে তারা?”

পিরীতি-নামক যে জ্বালা, পিরীতি-নামক যে দুঃখ, এ দুঃখ যাহারা না জানিয়াছে, তাহারা পৃথিবীতে কি সুখ পাইয়াছে? যখন রাধা কহিলেন,

“বিধি যদি শুনিত, মরণ হইত,
      ঘুচিত সকল দুখ।”

 তখন

“চণ্ডিদাস কয়, এমতি হইলে
পিরীতির কিবা সুখ!”

 দুখই যদি ঘুচিল তবে আর সুখ কিসের? এত গম্ভীর কথা বিদ্যাপতি কোথাও প্রকাশ করেন নাই। যখন মিলন হইল তখন বিদ্যাপতির রাধা কহিলেন–

“দারুণ ঋতুপতি যত দুখ দেল,
হরিমুখ হেরইতে সব দূর গেল।
যতহুঁ আছিল মঝু হৃদয়ক সাধ
সো সব পূরল পিয়া-পরসাদ।
রভস-আলিঙ্গনে পুলকিত ভেল,
অধরহি পান বিরহ দূর গেল।
চিরদিনে বিহি আজু পূরল আশ,
হেরইতে নয়ানে নাহি অবকাশ।
ভনহ বিদ্যাপতি আর নহ আধি,
সমুচিত ঔখদে না রহে বেয়াধি।”

 চিকিৎসক চণ্ডিদাসের মতে বোধ করি ঔষধেও এ ব্যাধির উপশম হয় না, অথবা এ ব্যাধির সমুচিত ঔষধ নাই। কারণ চণ্ডিদাসের রাধা শ্যামে যখন মিলন হয় তখন “দুহুঁ কোরে দুহুঁ কাঁদে বিচ্ছেদ ভাবিয়া।” কিছুতেই তৃপ্তি নাই,

“নিমিখে মানয়ে যুগ কোরে দূর মানি!”
যখন কোন ভাবনা নাই, যখন শ্যামকে পাইয়াছেন, তখনো রাধার ভয় যায় না;–

“এই ভয় উঠে মনে, এই ভয় উঠে,
না জানি কানুর প্রেম তিলে জনি ছুটে।
গড়ন ভাঙ্গিতে, সই, আছে কত খল–
ভাঙ্গিয়া গড়িতে পারে সে বড় বিরল।
যথা তথা যাই আমি যত দূর পাই,
চাঁদ মুখের মধুর হাসে তিলেকে জুড়াই।
সে-হেন বঁধুরে মোর যে জন ভাঙ্গায়
হাম নারী অবলার বধ লাগে তায়!
চণ্ডিদাস কহে, রাই, ভাবিছ অনেক–
তোমার পিরীতি বিনে সে জীয়ে তিলেক।”

 রাধা আগেভাগে অভিশাপ দিয়া রাখে, রাধা শূন্যের সহিত ঝগড়া করিতে থাকে! এমনি তাহার ভয় যে, তাহার মনে হয় যেন সত্যই তাহার শ্যামকে কে লইল। একটা অলীক আশঙ্কা মাত্রও প্রাণ পাইয়া তাহার সম্মুখে জীবন্ত হইয়া দাঁড়ায়, কাজেই রাধা তাহার সহিত বিবাদ করে। সে বলে,

“সে-হেন বঁধুরে মোর যে জন ভাঙ্গায়
হাম নারী অবলার বধ লাগে তায়।”

 যদিও তাহার বঁধুকে এখনো কেহ ভাঙ্গায় নি, কিন্তু তা বলিয়া সে সুস্থির হইতে পারিতেছে কৈ? যখন শ্যাম তাহার সম্মুখে রহিয়াছে, তখনো সে শ্যামকে কহিতেছে,–

{{block center/s}|

“কি মোহিনী জান বঁধু, কি মোহিনী জান;
অবলার প্রাণ নিতে নাহি তোমা হেন!

}}

রাতি কৈনু দিবস, দিবস কৈনু রাতি–
বুঝিতে নারিনু বঁধু তোমার পিরীতি!
ঘর কৈনু বাহির, বাহির কৈনু ঘর–
পর কৈনু আপন, আপন কৈনু পর।
কোন্‌ বিধি সিরজিল সোতের সেঁওলি,
এমন ব্যথিত নাই ডাকি বন্ধু বলি।
বঁধু যদি তুমি মোরে নিদারুণ হও
মরিব তোমার আগে, দাঁড়াইয়া রও।

 রাধার আর সোয়াস্তি নাই। শ্যাম সম্মুখে রহিয়াছেন, শ্যাম রাধার প্রতি কোন উপেক্ষা প্রকাশ করেন নাই, তবুও রাধা একটা “যদি”কে গড়িয়া তুলিয়া, একটা “যদি”কে জীবন দিয়া কাঁদিয়া সারা হইল। কহিল–

“বঁধু যদি তুমি মোরে নিদারুণ হও
মরিব তোমার আগে, দাঁড়াইয়া রও।”

 বঁধু নিদারুণ না হইতে হইতেই সে ভয়ে সশঙ্কিত। রাধার কি আর সুখ আছে?

 একদিন রাধা গৃহে গঞ্জনা খাইয়া শ্যামের কাছে আসিয়া কাঁদিয়া কহিতেছে,

“তোমারে বুঝাই বঁধু, তোমারে বুঝাই,
ডাকিয়া শুধায় মোরে হেন কেহ নাই।”

 এত করিয়া বুঝাইবার আবশ্যক কি? শ্যাম কি বুঝেন না? কিন্তু তবু রাধার সর্ব্বদাই মনে হয়, “কি জানি!” মনে হয়, শ্যামও পাছে আমাকে ডাকিয়া না শুধায়। যদিও শ্যামের সেরূপ ভাব দেখে নাই, তবুও ভয় হয়। তাই অত করিয়া আজ বুঝাইতে আসিয়াছে,–

“তোমারে বুঝাই বঁধু, তোমারে বুঝাই,
ডাকিয়া শুধায় মোরে হেন কেহ নাই।
অনুক্ষণ গৃহে মোরে গঞ্জয়ে সকলে,
নিচয় জানিও মুঞি ভখিমু গরলে।
এ ছার পরাণে আর কিবা আছে সুখ?
মোর আগে দাঁড়াও, তোমার দেখিব চাঁদ মুখ।
খাইতে সোয়াস্তি নাই, নাহি টুটে ভুক–
কে মোর ব্যথিত আছে, কারে কব দুখ!”

 রাধার এই উক্তির মধ্যে কত কথাই অব্যক্ত আছে। যেখানে রাধা বলিতেছেন,–

“অনুক্ষণ গৃহে মোরে গঞ্জয়ে সকলে,
নিচয় জানিও মুঞি ভখিমু গরলে।”

 এই দুই ছত্রের অর্থ এই, “আমাকে গৃহে সকলে গঞ্জনা করে, অতএব”– সে ‘অতএব’ কি, তাহা কি কাহাকেও বলিতে হইবে? সেই ‘অতএব’ যদি পূর্ণ না হয় তবে রাধা বিষ খাইবে। “কে মোর ব্যথিত আছে, কারে কব দুখ? “রাধা শ্যামের মুখ হইতে শুনিতে চায়- আমি তোমার ব্যথিত, আমি তোমার দুঃখ শুনিব! রাধা শ্যামকে কহিল না যে, তুমি আমার দুঃখে দুঃখ পাও, তুমি আমার ব্যথার ব্যথী হও, সে শুধু শ্যামের মুখ চাহিয়া কহিল– “কে মোর ব্যথিত আছে, কারে কব দুখ?”

 চণ্ডিদাসের কথা এই যে, প্রেমে দুঃখ আছে বলিয়া প্রেম ত্যাগ করিবার নহে। প্রেমের যা কিছু সুখ সমস্ত দুঃখের যন্ত্রে নিংড়াইয়া বাহির করিতে হয়।–

“যেন মলয়জ ঘষিতে শীতল,
অধিক সৌরভময়,
শ্যাম বঁধুয়ার পিরীতি ঐছন,
দ্বিজ চণ্ডিদাস কয়!”

 দুঃখের পাষাণে ঘর্ষণ করিয়া প্রেমের সৌরভ বাহির করিতে হয়। যতই ঘর্ষিত হইবে, ততই সৌরভ বাহির হইবে। চণ্ডিদাস কহেন প্রেম কঠোর সাধনা। কঠোর দুঃখের তপস্যায় প্রেমের স্বর্গীয় ভাব প্রস্ফুটিত হইয়া উঠে।

“পিরীতি পিরীতি সব জন কহে,
পিরীতি সহজ কথা?
বিরিখের ফল নহে ত পিরীতি,
নাহি মিলে যথা তথা।
পিরীতি অন্তরে, পিরীতি মন্তরে,
পিরীতি সাধিল যে
পিরীতি রতন লভিল সে জন–
বড় ভাগ্যবান সে।
পিরীতি লাগিয়া আপনা ভুলিয়া
পরেতে মিশিতে পারে,
পরকে আপন করিতে পারিলে,

পিরীতি মিলয়ে তারে।
পিরীতি-সাধন বড়ই কঠিন
কহে দ্বিজ চণ্ডিদাস,
দুই ঘুচাইয়া এক অঙ্গ হও
থাকিলে পিরীতি-আশ।”

 পরকে আপন করিতে হইলে যে সাধনা করিতে হয়, যে তপস্যা করিতে হয়, সে কি সাধারণ তপস্যা? যে তোমার অধীন নহে, তোমার নিজেকে তাহার অধীন করা– যে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র, তোমার নিজেকে তাহার কাছে পরতন্ত্র করা– যাহার সকল বিষয়ে স্বাধীন ইচ্ছা আছে, তোমার নিজের ইচ্ছাকে তাহার আজ্ঞাকারী করা– সে কি কঠোর সাধন!

 যখন রাধিকা কহিলেন,

“পিরীতি পিরীতি কি রীতি মূরতি
হৃদয়ে লাগল সে–
পরাণ ছাড়িলে পিরীতি না ছাড়ে,
পিরীতি গড়ল কে?
পিরীতি বলিয়া এ তিন আখর
না জানি আছিল কোথা!
পিরীতি কণ্টক হিয়ায় ফুটল,
পরাণপুতলী যথা।
পিরীতি পিরীতি পিরীতি অনল
দ্বিগুণ জ্বলিয়া গেল,

বিষম অনল নিবাইলে নহে,
হিয়ার রহল শেল!”

 তখন চণ্ডিদাস কহিলেন,

“চণ্ডিদাস-বাণী শুন বিনোদিনি,
পিরীতি না কহে কথা–
পিরীতি লাগিয়ে পরাণ ছাড়িলে
পিরীতি মিলয়ে তথা!”

 বিদ্যাপতির ন্যায় কবিগণ যাঁহারা সুখের জন্য প্রেম চান, তাঁহারা প্রেমের জন্য এতটা কষ্ট সহ্য করিতে অক্ষম। কিন্তু চণ্ডিদাস জগতের চেয়ে প্রেমকে অধিক দেখেন,

“পিরীতি বলিয়া এ তিন আখর,
এ তিন ভুবন- সার।”

 কিন্তু ইহা বলিয়াও তাঁহার তৃপ্তি হইল না, দ্বিতীয় ছত্রে কহিলেন,

“এই মোর মনে হয় রাতি দিনে
ইহা বই নাহি আর!”

 প্রেমের আড়ালে জগৎ ঢাকা পড়ে, শুধু তাহাই নহে,–

পরাণ-সমান পিরীতি রতন
জুকিনু হৃদয়-তুলে–
পিরীতি রতন অধিক হইল,
পরাণ উঠিল চূলে।

 চণ্ডিদাস হৃদয়ের তুলাদণ্ডে মাপিয়া দেখিলেন, প্রাণের অপেক্ষা প্রেম অধিক হইল। এই তো জগৎগ্রাসী, প্রাণ হইতে গুরুতর প্রেম। ইহা আবার নিত্যই বাড়িতেছে, বাড়িবার স্থান নাই, তথাপি বাড়িতেছে,

“নিতই নূতন পিরীতি দুজন,
তিলে তিলে বাঢ়ি যায়।
ঠাঞি নাহি পায় তথাপি বাড়ায়,
পরিণামে নাহি খায়।”

 ইহার আর পরিণাম নাই।

 এত বড় প্রেমের ভাব চণ্ডিদাস ব্যতীত আর কোন্‌ প্রাচীন কবির কবিতায় পাওয়া যায়? বিদ্যাপতির সমস্ত পদাবলীতে একটি মাত্র কবিতা আছে, চণ্ডিদাসের কবিতার সহিত যাহার তুলনা হইতে পারে। তাহা শতবার উদ্ধৃত হইয়াছে, আবার উদ্ধৃত করি।

সখিরে, কি পুছসি অনুভব মোয়!
সোই পিরীতি অনুরাগ বাখানিতে
তিলে তিলে নূতন হোয়।
জনম অবধি হম রূপ নেহারনু
নয়ন না তিরপিত ভেল,
সোই মধুর বোল শ্রবণ হি শুননু
শ্রুতিপথে পরশ না গেল।
কত মধু-যামিনী রভসে গোয়ায়নু
না বুঝনু কৈছন কেল,
লাখ লাখ যুগ হিয়ে হিয়ে রাখনু

তবু হিয়ে জুড়ন না গেল।
যত যত রসিকজন রস-অনুগমন–
অনুভব কহে, না পেখে!
বিদ্যাপতি কহে প্রাণ জুড়াইতে
লাখে না মিলল একে।”

বিদ্যাপতির অনেক স্থলে ভাষার মাধুর্য, বর্ণনার সৌন্দর্য আছে, কিন্তু চণ্ডিদাসের নূতনত্ব আছে, ভাবের মহত্ত্ব আছে, আবেগের গভীরতা আছে। যে বিষয়ে তিনি লিখিয়াছেন, তাহাতে তিনি একেবারে মগ্ন হইয়া লিখিয়াছেন। তিনি নিজের রজকিনী প্রণয়িনী সম্বন্ধে যাহা লিখিয়াছেন তাহা উদ্ধৃত করি,–

শুন রজকিনী রামি,
ও দুটি চরণ শীতল জানিয়া
শরণ লইনু আমি।
তুমি বেদ-বাগিনী,হরের ঘরণী,
তুমি সে নয়নের তারা,
তোমার ভজনে ত্রিসন্ধ্যা-যাজনে,
তুমি সে গলার হারা।
রজকিনীরূপ কিশোরীস্বরূপ
কামগন্ধ নাহি তায়,
রজকিনী-প্রেম নিকষিত হেম
বড়ু চণ্ডিদাসে গায়।

 চণ্ডিদাসের প্রেম কি বিশুদ্ধ প্রেম ছিল। তিনি প্রেম ও উপভোগ উভয়কে স্বতন্ত্র করিয়া দেখিতে পারিয়াছেন। তাই তিনি প্রণয়িনীর রূপ সম্বন্ধে কহিয়াছেন, “কামগন্ধ নাহি তায়!”

 আর এক স্থলে চণ্ডিদাস কহিয়াছেন,

“রজনী দিবসে হব পরবশে,
স্বপনে রাখিব লেহা–
একত্র থাকিব নাহি পরশিব
ভাবিনী ভাবের দেহা।”

 দিবস রজনী পরবশে থাকিব, অথচ প্রেমকে স্বপ্নের মধ্যে রাখিয়া দিব। একত্রে থাকিব অথচ তাহার দেহ স্পর্শ করিব না। অর্থাৎ, এ প্রেম বাহ্য জগতের দর্শন-স্পর্শনের প্রেম নহে, ইহা স্বপ্নের ধন, স্বপ্নের মধ্যে আবৃত থাকে, জাগ্রত জগতের সহিত ইহার সম্পর্ক নাই। ইহা শুদ্ধমাত্র প্রেম, আর কিছুই নহে। যেকালে চণ্ডিদাস ইহা লিখিয়াছিলেন, ইহা সেকালের কথা নয়।

 কঠোর ব্রতসাধনা স্বরূপে প্রেমসাধনা করা চণ্ডীদাসের ভাব, সে ভাব তাঁহার সময়কার লোকের মনোভাব নহে, সে ভাব এখনকার সময়ের ভাবও নহে, সে ভাবের কাল ভবিষ্যতে আসিবে। যখন প্রেমের জগৎ হইবে, যখন প্রেম বিতরণ করাই জীবনের একমাত্র ব্রত হইবে; পূর্বে যেমন যে যত বলিষ্ঠ ছিল সে ততই গণ্য হইত, তেমনি এমন সময় যখন আসিবে, যখন যে যত প্রেমিক হইবে সে ততই আদর্শস্থল হইবে, যাহার হৃদয়ে অধিক স্থান থাকিবে, যে যত অধিক লোককে হৃদয়ে প্রেমের প্রজা করিয়া রাখিতে পারিবে সে ততই ধনী বলিয়া খ্যাত হইবে, যখন হৃদয়ের দ্বার দিবারাত্রি উদঘাটিত থাকিবে ও কোনো অতিথি রুদ্ধ দ্বারে আঘাত করিয়া বিফলমনোরথ হইয়া ফিরিয়া না যাইবে, তখন কবিরা গাইবেন,

পিরীতিনগরে বসতি করিব,
পিরীতে বাঁধিব ঘর।
পিরীতি দেখিয়া পড়শি করিব,
তা বিনু সকলি পর।