সমালোচনা/তার্কিক

উইকিসংকলন থেকে

তার্কিক

 কেহ কেহ বলেন, যাঁহাদের সঙ্গে মতের মিল নাই, প্রতি কথায় যুক্তির লাঠালাঠি চলে, তর্কবিতর্ক না করিয়া যাঁহারা এক পা অগ্রসর হইতে দেন না, তাঁঁহাদেব সহবাসে উপকার আছে। তাহাদের উৎপাতে কাঁঁচা কথা বলিবার যো থাকে না, দুর্ব্বল মত ত্রাহি ত্রাহি করিতে থাকে, খুব খাঁটি মত না হইলে টিকিতে পারে না। বুদ্ধিরাজ্যে Survival of the Fittest নিয়ম খুব ভালরূপে বজায় থাকে। এ কথাটা আমার ত ঠিক মনে হয় না।

 আমাদের কোন ভাব অহিবাবণের মত একেবারে জন্মিয়াই কিছু যুদ্ধ আরম্ভ করিতে পারে না। কিছু দিন ধরিয়া প্রশংসা, বন্ধুদিগের মমতা, ও অনুকূল যুক্তির লঘুপাক ও পুষ্টিকর খাদ্য তাহাকে বাতিমত সেবন করান' আবশ্যক। যখন সে পায়ের উপর দাঁঁড়াইতে পাড়িবে, তখন বরঞ্চ, মাঝে মাঝে হুঁচট খাওয়া, মাথা ঠোকা, পড়িয়া যাওয়া মন্দ নহে। কিন্তু যেমনি আমার ভাবটি জন্মগ্রহণ করিল, অমনি যদি আমার নৈয়ায়িক কুস্তিওয়ালা খ্যাক করিয়া তাহার গলা চাপিয়া ধরেন তবে ত তাহার আর বাঁচিবার সম্ভাবনা থাকে না।

 বন্ধুবান্ধবের সহিত কথাবার্ত্তা কহিতে কহিতে প্রতিমুহূর্তে আমাদের নূতন নূতন মত জন্মগ্রহণ করিতে থাকে। কোন বিষয়ে আমাদের যথার্থ মত কি, আমাদের যথার্থ বিশ্বাস কি, তাহা সহসা জিজ্ঞাসা করিলে আমরা বলিতে পারি না, আমরা নিজেই হয়ত জানি না, বন্ধুদিগের সহিত কথোপকথনের আন্দোলনে তাহারা ভাসিয়া উঠে। তখন আমরা তাহাদিগকে প্রথম দেখিতে পাই। সুতরাং তখনো আমরা আমাদের সেই কচি ভাবগুলিকে যুক্তির বর্ম্ম দিয়া আচ্ছাদন করিবার অবসর পাই নাই, তখনো তাহাদিগকে সংসারের কঠোর মাটির উপরে হাটাইতে শিখাই নাই, নানাশাস্ত্র হইতে আহরণ করিয়া তাহাদের অনুকূল মতগুলিকে বডিগার্ডের মত তাহাদের চারদিকে খাড়া করিয়া দিই নাই। এমন সময়ে যদি নৈয়ায়িক শিকারীর ইঙ্গিতে দেশী বিলাতী, আধুনিক প্রাচীন, যত দেশের, যত ন্যায়শাস্ত্রের, যতগুলা যুক্তির ক্ষুধিত খেঁকি কুকুর আছে, সকলগুলা একবারে দাঁত খিঁঁচাইয়া সেই অসহায়দের উপর আসিয়া পড়ে, Facts নামক ছোট ছোট ইট পাটকেল চারদিক হইতে তাহাদের উপর বর্ষিত হইতে থাকে, তবে সে বেচারীরা দাঁঁড়ায় কোথায়?
 তুমি নৈয়ায়িক, Facts নামক গোটাকতক সরকারী লাঠিয়াল তোমার হাতধরা আছে, তোমার যাহা কিছু আছে মান্ধাতার আমল হইতে তাহার যোগাড় হইয়া আসিতেছে, আর আমার এই ভাবশিশু এই মুহূর্তে সবে জন্মগ্রহণ করিয়াছে, ইহার প্রতি আক্রমণ করিয়া তোমার পৌরুষ কি? আর একটু বোস' এখনো ইহা কথোপকথনের কোলে কোলে ফিরিতেছে, যখন এ সাহিত্য ক্ষেত্রে রণভূমিতে দাঁড়াইবে, তখন ইহাতে তোমাতে বোঝাপড়া চলিতে পারিবে।  এই সকল ন্যাযশাস্ত্রবিদেরা রসিকতার কৈফিয়ৎ চাহেন, বিদ্রুপ করিয়া একটা অসঙ্গত সঙ্গত কথা কহিলে তর্কের দ্বারায় তাহার অযৌক্তিকতা প্রতিপন্ন করাইয়া দেন, কথায় কথায় যদি একটা ঐতিহাসিক Fact-এর উল্লেখ করি, সেটা আর সকল বিষয়ে যেমনই সঙ্গত হউক না কেন, তাহার তারিখের একটু ইতস্তত, হইলে তৎক্ষণাৎ তাহার পাঁঁচ Volume ইতিহাসের চাপে সেটাকে ছারপোকার মত মারিয়া ফেলেন, মুখে যদি একটা কিছুর সহিত কিছুর তুলনা করি, অমনি তিনি ফিতা হাতে করিয়া অত্যন্ত পরিশ্রমে তাহার মাপ জোক করি আরম্ভ করেন, আমি বলিলাম, অমুক লোকটা নিতান্ত গাধার মত, তিনি অমনি বলিলেন, সে কেমন কথা, তাহার ত চারটে পা নাই, আর তাহার কান দুটা কিছু নিতান্তই বড় নয়, তাহার গলার আওয়াজ ভাল নহে বটে, কিন্তু তাই বলিয়া কি গাধার সঙ্গে তাহার তুলনা হয়? আমি বলিলাম হে বুদ্ধিমান, গাধার বুদ্ধির সহিত আমি তাহলে বুদ্ধির তুলনা করিতেছিলাম, আর কোন বিষয়ে সাদৃশ্য আছে বলিয়া মনে হয় নাই। তিনি অমনি বলিলেন, তাহাও কি ঠিক মেনে? পণ্ড বস্তুই দেখিতে পার, কিন্তু বাস্তুব বস্তুত্ত্ব কি সে মনে করিতে পারে? সে শ্বেতবর্ণ পদার্থ মনে আনিতেও পারে, কিন্তু শ্বেতবর্ণ নামক পদার্থ অতিরিক্ত একটা ভাবমাত্র সে কি মনে ধারণা করিতে পারে? ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি কাতর হইয়া বলিলাম, দোহাই মাপ কর, আমার অপরাধ হইয়াছে, এবার হইতে গাধার সহিত তাহার বুদ্ধির তুলনা না দিয়া তোমার সহিত দিব। শুনিয়া তিনি সন্তুষ্ট হইলেন।  এইরূপ যাঁঁহারা তার্কিক বন্ধুদিগের সহবাসে থাকেন, তাঁঁহাদের ভাবের উৎস-মুখে পাথর চাপান' থাকে। বন্ধুত্বের দক্ষিণা বাতাস বন্ধুদিগের অনুকূল হাস্যের সূর্য্যকিরণের অভাবে তাঁঁহাদের হৃদয়কাননের ভাবগুলি ফুটিয়া উঠিতে পারে না। যে সকল বিশ্বাস তাহাদের হৃদয়ের অতি প্রিয় সামগ্রী, পাছ সেগুলিকে লইয়া যুক্তির কাকচিলগুলা ছেঁঁড়াছিড়ি করিতে আরম্ভ করে এই ভয়ে তাহাদিগকে হৃদয়ের অন্ধকারের মধ্যেই লুকাইয়া রাখেন, তাহারা আর সূর্য্যকিরণ পায় না, তাহারা ক্রমশঃই রুগ্ন অবস্থা প্রাপ্ত হইয়া কুসংস্কারের আকার ধারণ করে! কথায় কথায় যে সকল মত গঠিত হইয়া উঠিল, তাঁঁহারা চারিদিকে তর্কবিতর্কের ছোরাছুরি দেখিয়া ভয়ে আত্মহত্যা করিয়া মরে।

 তার্কিক বন্ধুদিগের সহবাসে থাকিলে প্রাণের উদারতা সঙ্কীর্ণ হইতে থাকে। আমি কাল্পনিক লোক, আমার জগৎ লাখেরাজ জমি, আমি কাহাকেও এক পয়সা খাজনা দিই না, অথচ জগতের যেখানে ইচ্ছা বিচরণ করিতে পারি, যাহা ইচ্ছা উপভোগ করিতে পারি। তুমি যুক্তি মহারাজের প্রজা, যুক্তিকে যতটুকু জমির খাজনা দিবে, ততটুকু জমি তোমার, যখনি খাজনা দিতে না পরিবে, তখনি তোমার জমি নিলামে বিক্রয় হইয়া যাইবে। তোমার তার্কিক বন্ধু পাশে বসিয়া ক্রমাগত তোমার জমি সার্ব্বে করিতেছেন, ও তাহার সীমাবন্দী করিয়া দিতেছেন; প্রতিদিন এক বিঘা, দুই বিঘা করিয়া তোমার অধিকার কমিয়া আসিতেছে।

 আমি যখন রাত্রিকালে অসংখ্য তারার দিকে চাহিয়া আমার অনন্ত জীবন কল্পনা করিতেছি, জগতের এক সীমা হইতে সীমান্তর পর্যন্ত আমার প্রাণের বিচরণভূমি হইয়া গিয়াছে, আমি যখন নূতন নূতন আলোক, নূতন নূতন গ্রহ মাড়াইয়া নূতন নূতন জীবকে স্বজাতি করিয়া, বিস্ময়-বিহ্বল পথিকের মত অনন্ত বৈচিত্র্য দেখিতে দেখিতে অনন্ত পথে যাত্রা করিয়াছি, বিচিত্র জগৎপূর্ণ অনন্ত আকাশের মধ্যে যখন আমার জীবনের আদি অন্ত হারাইয়া গিয়াছে, যখন আমি মনে করিতেছি এই কাঠা-তিনেক জমির চারদিকে পাঁঁচিল তুলিয়া এই খানেই ধূলির মধ্যে ধূলিমুষ্টি হইয়া থাকা আমার চরণ গতি নহে, জলবায়ু আকাশ, চন্দ্র সূর্য্য গ্রহ নক্ষত্র বিশ্ব-চরাচর আমার অনন্ত জীবনের ক্রীড়া ভূমি,−তখন দূর কর তোমাব যুক্তি, তোমার তর্ক— তোমার ন্যায়শাস্ত্র গলার বাঁঁধিয়া যুক্তির শানবাধান কুয়োর মধ্যে পরমানন্দে তুমি ডুবিয়া মর'। তখন তোমাকে কৈফিয়ৎ দিতে আমার ইচ্ছাও থাকে না অবসরও থাকে না। তুমি যে আমার অতখানি কাড়িতে চাও তাহার বদলে আমাকে কি দিতে পার? তোমার আছে কি? আমি যে জায়গায় বেড়াইতে ছিলাম, তুমি তাহার কিছু ঠিকানা করিয়াছ? সেখানকাব মেরুপ্রদেশের মহাসমুদ্রে তোমার এই বুদ্ধির ফুটো নারিকেল মালায় চড়িয়া কখনো কি আবিষ্কার করিতে বাহির হইয়াছিলে? পৃথিবীর মাটির উপর তুমি রেল পাতিয়াছ, এই ৮০০০ মাইলের ভূগোল তুমি ভালরূপ শিথিয়াছ, অতএব যদি আমি ম্যাডাগাস্কারের জায়গায় কামস্কাটকা কল্পনা করি, তাহা হইলে না হয আমাকে তোমাদের স্কুলের এক ক্লাস নামাই দিও, কিন্তু যে অনন্তের মধ্যে তোমাদের ঐ রেলগাড়িটা চলে নাই, কোন কালে চলিবে বলিয়া ভরসা নাই সেখানে আমি একটু হাওয়া খাইয়া বেড়াইতেছি ইহাতে তোমাদের মহাভারত কি অশুদ্ধ হইল?

 তোমরা ত আবশ্যকবাদী, আবশ্যকের এক ইঞ্চি এদিকে ওদিকে যাওনা। তোমাদেরই আবশ্যকের দোহাই দিয়া তোমাদিগকে জিজ্ঞাস করি, আমি যে অনন্তরাজ্যে বিচরণ করিতেছি, যুক্তির কারাগারে পুরিয়া আমাকে সে রাজ্য হইতে বঞ্চিত করিবার আবশ্যকটা কি? যাহাতে মানুষের সুখ, উন্নতি, উপকার হয়, তাহাইত সকল কার্য্যের উদ্দেশ্য? আমি যে অসীম সুখে মগ্ন হইতেছিলাম, আমার যে প্রাণের অধিকার বাড়িতেছিল, আমার যে প্রেম জগতে ব্যাপ্ত হইয়া পড়িতেছিল, ইহা সংক্ষেপ করিয়া দিয়া তোমাদের কি প্রয়োজন সাধন করিলে? মনুয্যের কি উপকার করিলে, কি সুখ বাড়াইলে? মানুষের সুখের আশা, কল্পনার অধিকার এতটাই যদি হ্রাস হয়, তবে তোমার এই মহামূল্য যুক্তিটা কিছুক্ষণের জন্য শিকায় তোলা থাকনা কেন?

 যুক্তির মানে কি? যোজনা করা ত? একটার সঙ্গে আর একটার যোগ করা। পতনের সঙ্গে হাত পা ভাঙ্গার যোগ আছে, সুতরাং পতনের পর হাত পা ভাঙা যুক্তিসিদ্ধ। চুপ করিয়া বসিয়া থাকিলে যে হাত পা ভাঙ্গিবে, ইহা যুক্তিসিদ্ধ নহে, কারণ, এই কার্য্যকারণের মধ্যে একটা যোগ পাওয়া যায় না। কিন্তু একটু ভাবিলেই দেখা যায়, আমরা কেবল কতকগুলি ঘটনাই দেখিতে বা জানিতে পাই, কোন কার্য্যকারণের যোগ আমাদের চোখে পড়ে! ঈশ্বর নামক সূক্ষ্ম পদার্থে ঢেউ উঠিলে আমলা যে আলো দেখিতে পাই, ইহার যুক্তি কি? এ দুইটি ঘটনার মধ্যে যোগ কোথায়? আমাদের মস্তিস্কের কতকগুলি পরমাণু ঘোরার সঙ্গে, আমাদের স্মৃতির, ভাবনার, মনোবৃত্তির কি যোগ থাকিতে পারে? এমন কি কার্য্যকারণশৃঙ্খলা আছে, যাহার পদে পদে missing links নাই? এইত তোমার যুক্তি! এই তৃণটি ধরিয়া তুমি অনন্ত নামক অকুল অতলস্পর্শ সমুদ্রে কি বলিয়া ভাসিতে চাও; যুক্তির গোটাকতক কাজ আছে তার আর ভুল নাই, কিন্তু তাই বলিয়া ঐ দাম্ভিকটা যে যেখানে সেখানে মোড়লা করিয়া বেড়াইবে সে কাহাল প্রাণে সয়? তার নিজের কাজই ঢ়ের বাকি পড়িয়া আছে, পরের কাজে ব্যাঘাত করিয়া সময় নষ্ট করিবার অবশ্যক?

 জগতো যেমন একদিকে সাম্য, অন্যদিকে অনন্ত, একদিকে তীর আর একদিকে সমুদ্র, আমাদের মনেরও তেমনি একদিকে সীমা আল একদিকে অসীম, সীমার রাজ্যে যুক্তির শাসন, অতএব সে রাজ্য যুক্তির শাসন লঙ্ঘন করিলে পদে পদে তাহার ফল ভোগ করিতে করিতে হয়, কিন্তু যখনি অসীমের রাজ্যে পদার্পণ করিলাম, তখনি আমরা আর যুক্তির প্রজা নহি, অতএব হে বন্ধু, হে তার্কিক, আমি যখন অসীমের রাজ্যে আছি তখন আমাকে যুক্তির আইনের ভয় দেখাইলে আমি মানিব কেন?

 তাই বলিতেছি, তুমি যে কথায় কথায় আমার সঙ্গে তর্ক করিতে আইস, সেটা আমার ভাল লাগে না, এবং তাহাতে কোন কাজও হয় না। তুমি আমি একত্র থাকাটাই অযৌক্তিক, কারণ, তোমাতে আমাতে কোন যোগই নাই। তোমাকে আমি হীন বলিতেছি না, ভূমি হয়ত মস্ত লোক, তুমি হয়ত রাজা, কিন্তু শাঙ্গরব দুষ্যন্তকে যেরূপ চক্ষে দেখিয়াছিলেন আমিও হয়ত তোমাকে সেইরূপ চক্ষে দেখিবঃ–

 “অভ্যক্তমিব স্নাতঃ, গুচিবগুচিমিব, প্রবুদ্ধইব সুপ্তম্” ইত্যাদি যুক্তির সৈন্য লইয়া তুমি তোমার নিজ রাজ্যে একজন দোর্দ্দণ্ড-প্রতাপ লোক, উহারই সাহায্যে তুমি কত রাজ্য অধিকার করিলে, কত রাজ্য ধ্বংশ করিলে, কিন্তু আমার বিস্তৃত রাজ্যের একতিলও তুমি কাড়িয়া লইতে পার না। তুমি আমাকে হাজার চোখ রাঙাও না কেন আমি ডরাই না। আমার অধিকারে আসিবার ক্ষমতা তুমি হারাইয়াছ, কিন্তু তোমার অধিকারে আমি অনায়াসেই যাইতে পারি। তোমাতে আমাতে বিস্তর প্রভেদ।

 আমার তার্কিক বন্ধু এই বলিযা আমার নিন্দা করেন যে, আমি এক সময়ে যাহা বলিয়াছি আর এক সময়ে তাহার বিপরীত কথা বলি; সে কথাটা ঠিক। কিন্তু তাহার একটা কারণ আছে। আমি যাহা বলি, তাহা প্রাণের ভিতর হইতে বলি, যুক্তি অযুক্তি খতাইয়া হিসাব পত্র করিয়া বলি না। আমি যাহার কথা বলি, মমতার প্রভাবে তাহার সহিত একেবারে মিশাইয়া যাই, সুতরাং কেবল মাত্র তাহার কথাই বলি তাহার উণ্টাদিকের কথাটা বলি না। প্রকৃতিতেও তাহাই হয়। প্রকৃতির দিন প্রকৃতির রাত্রের বিপরীত কথা বলিয়া থাকে,প্রকৃতির পূর্ব্বদিক প্রকৃতির পশ্চিমদিকের কথা বলে না। প্রকৃতির পদে পদে বিরোধী উক্তি দেখিতে পাওয়া যায় কিন্তু তাহারা কি বাস্তবিকই বিরোধী? তাহারা দুই বিপরীত সত্য। আমি আলো হইয়া আলোর কথা বলি, অন্ধকার হইয়া অন্ধকারের কথা বলি। আমার দুটা কথাই সত্য। আমি কিছু এমন প্রতিজ্ঞ করিয়া বসি নাই যে একেবারে বিরোধী কথা বলিব না, যে ব্যক্তি কোন কালে বিরোধী কথা বলে নাই তাহার বুদ্ধি ত জড়পদার্থ; তাহার কোন কথাব কোন মূল্য আছে কি? আমরা যে বিরোধের মধ্যেই বাস কবি। আমাদের অদ্য আমাদেব কল্যকার বিরোধী, আমাদের বৃদ্ধকাল আমাদের বাল্যকালের বিবোধী; সকালে যাহা সত্য বিকালে তাহা সত্য নহে। এত বিরোধের মধ্যে থাকিয়াও যাহার কথার পরিবর্ত্তন হয় না, যাহার মত অবিরোধে থাকে, তাহার বৃদ্ধিটাত একটা কলের পুতুল, যত বার দম দিবে ততবার একই নাচন নাচিবে!

 উপসংহাবে আর গুটিদুই কথা বলিয়া শেষ করি।

 যে পাড়ার ক্রোশ তিনেকের মধ্যে তার্কিক লোকের গন্ধ আছে, সেখানে বোধ করি, কোন ভাল লোক তিষ্ঠিতে পাবেন না। বোধ করি তার্কিক লোকের মুখ দেখিলেই ভাবের বিকাশ বন্ধ হইয়া যায়। অতএব যাঁহারা ভাবের চর্চ্চা করিতে চান, তাঁহারা কাছাকাছি এমন বন্ধু রাখিবেন যাঁহাদের সহিত মতের মিল আছে। অনুরাগের আবহাওয়ার মধ্যে থাকিলে মনের গূঢ় ক্ষমতাগুলি যেমন সতেজে মাটি ফুঁড়িয়া উঠে, এমন আর কোথাও নয়।

 একটা গাছে কতশত বীজ জন্মে। তাহার মধ্যে সবগুলা কিছু গাছ হয় না। কিন্তু গুটিকত গাছ জন্মাইবার উদ্দেশে বিস্তর নিষ্ফল বীজ জন্মানো আবশ্যক। আমাদেরও সকল ভাব কিছু সফল হইবে না। কিন্তু ভাবের প্রচুরতা আবশ্যক। গোটাকতক থাকিবে, অনেকগুলি মরিবে। কিন্তু প্রতিকূলতার প্রখর প্রভাবে যদি ভাবের বিকাশ একেবারেই বন্ধ হয় তবে আর কী হইল?

 তাই জিজ্ঞাসা করিতেছি সাহিত্যে প্রতিকূল সমালোচনা কি ভালো? ভালো বইয়ের ভালো সমালোচনা ভাল, কুরুচিবিকাশক হানিজনক বইয়ের নিন্দা করাও দোষের নহে,কিন্তু লেখকের ক্ষমতার অভাবে বা বুদ্ধির দোষে অসম্পূর্ণ গ্রন্থগুলিকে কঠোর ভাবে সমালোচনা করিলে তাহাতে কী ভাল হয় বুঝিতে পারি না।


সত্যের অংশ।

 সত্যকে আংশিক ভাবে দেখিলে অনেক সময়ে তাহা মিথ্যার রূপান্তর ধারণ করে। এক পাশ হইতে একটা জিনিসকে দেখিয়া যাহা সহসা মনে হয় তাহা একপেশে সত্য, তাহা বাস্তবিক সত্য না হইতেও পারে। আবার অপর পক্ষেও একটা বলিবার কথা আছে। কেহ সত্যকে সর্বতোভাবে দেখিতে পায় না। সত্যকে যথাসম্ভব সর্বতোভাবে দেখিতে গেলে প্রথমে তাহাকে আংশিক ভাবে দেখিতে হইবে, তাহা ব্যতীত আমাদের আর গতি নাই। ইহা আমাদের অসম্পূর্ণতার ফল। আমরা কিছু একেবারেই একটা চারি-কোণা দ্রব্যের সবটা দেখিতে পাই না– ঘুরাইয়া ঘুরাইয়া খণ্ড খণ্ড করিয়া দেখিতে হয়। এই নিমিত্ত উচিত এই যে, যে যে-দিকটা দেখিয়াছে সে সেই দিকটাই সম্পূর্ণরূপে বর্ণনা করুক, অবশেষে সকলের কথা গাঁথিয়া একটা সম্পূর্ণ সত্য পাওয়া যাইবে। আমাদের এক-চোখো মন লইয়া সম্পূর্ণ সত্য জানিবার আর কোনো উপায় নাই। আমরা একদল অন্ধ, আর সত্য একটি হস্তী। স্পর্শ করিয়া করিয়া সকলেই হস্তীর এক-একটি অংশের অধিক জানিতে পারি না। এই জন্যই কিছু দিন ধরিয়া হস্তীকে কেহ-বা স্তম্ভ, কেহ-বা সর্প, কেহ-বা কুলা বলিয়া ঘোরতর বিবাদ করিয়া থাকি; অবশেষে সকলের কথা মিলাইয়া বিবাদ মিটাইয়া লই। আমি যে ভূমিকাচ্ছলে এতটা পুরাতন কথা বলিলাম, তাহার কারণ এই– আমি জানাইতে চাই, একপেশে লেখার উপর আমার কিছু মাত্র বিরাগ নাই। এবং আমার মতে, যাহারা একেবারে সত্যের চারি দিক দেখাইতে চায়, তাহারা কোনো দিকই ভালো করিয়া দেখাইতে পারে না– তাহারা কতকগুলি কথা বলিয়া যায়, কিন্তু একটা ছবি দেখাইতে পারে না। একটা উদাহরণ দিলেই আমার কথা বেশ স্পষ্ট হইবে। একটা ছবি আঁকিতে হইলে, যথার্থত যে দ্রব্য যেরূপ ঠিক সেরূপ আঁকা উচিত নহে। যখন চিত্রকর নিকটের গাছ বড় করিয়া আঁকে ও দূরের গাছ ছোট করিয়া আঁকে, তখন তাহাতে এমন বুঝায় না যে বাস্তবিকই দূরের গাছগুলি আয়তনে ছোট। একজন যদি কোনো ছবিতে সব গাছগুলি প্রায় সম- আয়তনে আঁকে, তবে তাহাতে সত্য বজায় থাকে বটে, কিন্তু সে ছবি আমাদের সত্য বলিয়া মনে হয় না– অর্থাৎ তাহাতে সত্য আমাদের মনে অঙ্কিত হয় না। লেখার বিষয়েও তাহাই বলা যায়। আমি যে ভাবটা নিকটে দেখিতে পাই, সেই ভাবটাই যদি বড় করিয়া না আঁকি ও তাহার বিপরীত দিকের সীমান্ত যদি অনেকটা ক্ষুদ্র, অনেকটা ছায়াময়, অনেকটা অদৃশ্য করিয়া না দিই- তবে তাহাতে কোন উদ্দেশ্যই ভাল করিয়া সাধিত হয় না; না সমস্তটার ভাল ছবি পাওয়া যায়, না একাংশের ভাল ছবি পাওয়া য়ায়। এইজন্যই লেখক-চিত্রকরদিগকে পরামর্শ দেওয়া যায়, যে যে-ভাবটাকে কাছে দেখিতেছ তাহাই বড় করিয়া আঁক; ভাবিয়া চিন্তিয়া, বিচার করিয়া, সত্যের সহিত পরামর্শ করিয়া, ন্যায়কে বজায় রাখিবার জন্য তাহাকে খাট করিবার কোন আবশ্যক নাই।