সানাই/বাসাবদল

উইকিসংকলন থেকে

বাসাবদল

যেতেই হবে।
দিনটা যেন খোঁড়া পায়ের মতো
ব্যাগুেজেতে বাঁধা।
একটু চলা, একটু থেমে-থাকা,
টেবিলটাতে হেলান দিয়ে বসা
সিঁড়ির দিকে চেয়ে।
আকাশেতে পায়রাগুলো ওড়ে
ঘুরে ঘুরে চক্র বেঁধে
চেয়ে দেখি দেয়ালে সেই লেখনখানি
গেল বছরের,
লাল-রঙা পেন্‌সিলে লেখা—
'এসেছিলুম; পাই নি দেখা; যাই তা হলে।
দোসরা ডিসেম্বর।'
এ লেখাটি ধুলো ঝেড়ে রেখেছিলেম তাজা,
যাবার সময় মুছে দিয়ে যাব।
পুরোনো এক ব্লটিং কাগজ
চায়ের ভোজে অলস ক্ষণের হিজিবিজি কাটা,
ভাঁজ ক'রে তাই নিলেম জামার নীচে।
প্যাক করতে গা লাগে না,
মেজের 'পরে বসে আছি পা ছড়িয়ে।
হাতপাখাটা ক্লান্ত হাতে
অন্যমনে দোলাই ধীরে ধীরে।

ডেস্কে ছিল মেডেন-হেয়ার পাতায় বাঁধা
শুকনো গোলাপ,
কোলে নিয়ে ভাবছি বসে—
কী ভাবছি কে জানে।

অবিনাশের ফরিদপুরে বাড়ি,
আনুকূল্য তার
বিশেষ কাজে লাগে
আমার এই দশাতেই।
কোথা থেকে আপনি এসে জোটে
চাইতে না চাইতেই,
কাজ পেলে সে ভাগ্য ব'লেই মানে—
খাটে মুটের মতো ৷
জিনিসপত্র বাঁধাছাঁদা,
লাগল ক’ষে আস্তিন গুটিয়ে।
ওডিকলোন মুড়ে নিল পুরোনো এক আনন্দবাজারে।
ময়লা মোজায় জড়িয়ে নিল এমোনিয়া।
ড্রেসিং কেসে রাখল খোপে খোপে
হাত-আয়না, রুপোয় বাঁধা বুরুশ,
নখ চাঁচবার উখো,
সাবানদানি, ক্রিমের কৌটো, ম্যাকাসারের তেল।
ছেড়ে-ফেলা শাড়িগুলো
নানা দিনের নিমন্ত্রণের
ফিকে গন্ধ ছড়িয়ে দিল ঘরে।

সেগুলো সব বিছিয়ে দিয়ে চেপে চেপে
পাট করতে অবিনাশের যে সময়টা গেল
নেহাত সেটা বেশি।
বারে বারে ঘুরিয়ে আমার চটিজোড়া
কোঁচা দিয়ে যত্নে দিল মুছে,
ফুঁ দিয়ে সে উড়িয়ে দিল ধুলোটা কাল্পনিক
মুখের কাছে ধ'রে।
দেয়াল থেকে খসিয়ে নিল ছবিগুলো,
একটা বিশেষ ফোটো
মুছল আপন আস্তিনেতে অকারণে।
একটা চিঠির খাম
হঠাৎ দেখি লুকিয়ে নিল
বুকের পকেটেতে।
দেখে যেমন হাসি পেল, পড়ল দীর্ঘশ্বাস।
কার্পেটটা গুটিয়ে দিল দেয়াল ঘেঁষে——
জন্মদিনের পাওয়া,
হল বছর সাতেক।

অবসাদের ভারে অলস মন,
চুল বাঁধতে গা লাগে নাই সারা সকালবেলা—
আলগা আঁচল অন্যমনে বাঁধি নি ব্রোচ দিয়ে।
কুটিকুটি ছিঁড়তেছিলেম একে-একে
পুরোনো সব চিঠি—
ছড়িয়ে রইল মেঝের 'পরে, ঝাঁট দেবে না কেউ

বোশেখমাসের শুকনো হাওয়া ছাড়া।
ডাক আনল পাড়ার পিয়ন বুড়ো,
দিলেম সেটা কাঁপা হাতে রিডাইরেক্টেড ক'রে।
রাস্তা দিয়ে চলে গেল তপসি-মাছের হাঁক,
চমকে উঠে হঠাৎ পড়ল মনে—
নাই কোনো দরকার।
মোটর গাড়ির চেনা শব্দ কখন দূরে মিলিয়ে গেছে
সাড়ে-দশটা বেলায়
পেরিয়ে গিয়ে হাজরা রোডের মোড়।

হল ঘর,
দেয়ালগুলো অবুঝ-পারা তাকিয়ে থাকে ফ্যাকাশে দৃষ্টিতে
যেখানে কেউ নেই।
সিঁড়ি বেয়ে পৌঁছে দিল অবিনাশ
ট্যাক্সিগাড়ি-'পরে।
এই দরোজায় শেষ বিদায়ের বাণী
শোনা গেল ঐ ভক্তের মুখে-
বললে, আমায় চিঠি লিখো।
রাগ হল তাই শুনে
কেন জানি বিনা কারণেই।

[শান্তিনিকেতন
অগস্ট, ১৯৩৮]