সাবাইস বুদ্ধি/প্রথম পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

সাবাইস বুদ্ধি

প্রথম পরিচ্ছেদ।

 আজকাল এদেশে পাশ্চাত্যশিক্ষার বহুল প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে কোন কোন সম্প্রদায়ের স্ত্রীলোকদিগের স্বাধীনতাও খুব বাড়িয়া, প্রায় ইংরাজ-রমণীগণের ন্যায় হইয়া উঠিয়াছে ও উঠিতেছে। হিন্দু বলুন, মুসলমান বলুন, কোন সন্ত্রাস্তবংশীয় স্ত্রীলোকগণ ইহার পূর্ব্বে ঘরের বাহির হইতেন না, পর-পুরুষের সম্মুখীন হইতে না, ইহা আমাদিগের জীবনের এক সময় দেখিয়াছি। এমন কি, বারবনিতাগণকেও যে কথন একাকী প্রকাশ্যভাবে কে মাত্র পুরুষ-মানুষ-সমাবৃত সভাসমিতি, কি অন্য কোন স্থানে বা কোন দোকান প্রভৃতি প্রকাশ্য স্থানে দেখিয়াছি, তাহাও মনে হয় না; সময় সময় তাহার কোন দ্রব্যাদি খরিদ করিবার নিমিত্ত দোকানদিতে গমন করিত সত্য, কিন্তু হয় কোন পুরুষ-মানুষ তাহাদিগের সঙ্গে গমন করিত, অথবা তাহার সমব্যবসায়ী অপর ২|৪ জন স্ত্রীলোকে সঙ্গে লইয়া সে তাহার বাড়ীর বাহির হইত। আজকালও তাহাদিগের মধ্যে অনেকটা সেইরূপ পদ্ধতি প্রবর্ত্তিত আছে; কিন্তু সম্প্রদায় বিশেষের মধ্যে ভদ্র স্ত্রীলোকদিগের স্বাধীনতা এতদূর বাড়িয়া উঠিয়াছে যে, কোন স্থানে গমনাগমন করিতে হইলে কাহাকেও আর সঙ্গে লইবার তাহাদিগের প্রয়োজন হয় না; সভা-সমিতিতে একাকীই গমন করিয়া সহস্রাধিক পুরুষের মধ্যে অনায়াসেই গিয়া উপবেশন করেন। গড়ের মাঠে শত শত ইংরাজ বাঙ্গালীর ও অপরাপর দেশীয় পুরুষবর্গের মধ্যে একাকীই বায়ু সেবন করিয়া থাকেন। দেশীয় ও বিদেশীয়গণের বড় বড় দোকানে একাকিনী গমন করিয়া দ্রব্যাদি খরিদ বিক্রয় করিতেও কিছুমাত্র কুণ্ঠিত হন না।

 সকল সম্প্রদায়ের স্ত্রীলোকমাত্রেই পুরুষ অপেক্ষা মাননীয়া, সুতরাং যে স্থানেই তাঁহার গমন করুন না কেন, পুরুষ অপেক্ষা সকলেই তাহাদিগকে একটু মান্য করিয়া থাকে। তাহাদিগের কার্য অগ্রেই সম্পাদিত হয় ও তাহাদিগের কথায় অনেকেই স্বভাবতঃ বিশ্বাস করিয়া থাকেন। কারণ, আপনি দেখিবেন যে, পুরুষগণ যেরূপ মিথ্যা কথা কহিয়া থাকেন, স্ত্রীলোকগণ তাহা অপেক্ষা অনেক অল্প পরিমাণে মিথ্যা কথা বলিয়া থাকেন। সুতরাং পূর্ব্বকখিত নবঅবগুণ্ঠন উদঘাটিতা স্ত্রীলোকগণ যে কার্য্যের নিমিত্ত যে স্থানে গমন করেন, তাহাদিগের সেই কার্য্য সর্বাগ্রেই সংগিত হইয়া থাকে।

 যে স্থানে ভাল আছে, মন্দও সেইস্থানে আছে। যে স্থানে প্রকৃত দ্রব্য পাওয়া যায়, সেই স্থানেই অপ্রকৃত দ্রব্যের অভার থাকে না। মূলকথায়, যে স্থানে আসল—সেই স্থানেই নকল দেখিতে পাওয়া যায়। কিন্তু আসল নকল চিনিয়া লইতে পারে, এরূপ জহুরি কয়জন আছে? মনুষ্য দেখিয়া তাহার হৃদয়ের উপাদান বাছিয়া লইতে সমর্থ হয়, এরূপ লোক সহজে কয়জন দেখিতে পাওয়া যায়।

 রাত্রি ১২টার পর আমি বড়বাজারের ভিতর দিয়া আসিতেছি। দেখিলাম, একথানি জহুরির দোকান সেই সময় ভিতর হইতে বন্ধ, কিন্তু দোকানের ভিতর আলো জ্বলিতেছে। ঐ দোকানখানি আমি পূর্ব্ব হইতেই জানিতাম, ও ঐ দোকানের অধিকারীর সহিত আমার পরিচয়ও ছিল। ইতিপূর্বে ঐ দোকান হইতে কয়েক সহস্রমুদ্রা মুল্যের জহরত চুরি হইয়াছিল। ঐ চুরি মোকদ্দমার অনুসন্ধান আমি করিয়াছিলাম, চোর ধৃত ৩ অপহৃত জহরতের পুনরুদ্ধারও হইয়াছিল। সেই সময় হইতে আমি ঐ জহুরির সহিত পরিচিত। রাত্রি ৯টার পর ঐ দোকান খোলা থাকে না, দোকানের একটা ব্যতীত সমস্ত দরজা ভিতর হইতে বন্ধ করিয়া দেওয়া হয়। অবশিষ্ট দরজাটীতে কেবল কয়েকটা তালা বাহির হইতে বদ্ধ থাকে। দোকানের ভিতর লোকজন কেহই থাকে না, পুলিসের অনুকম্পার উপর ঐ দোকান সমস্ত রাত্রি রক্ষিত হয়। আজ ঐ দরজাটী পর্য্যন্ত ভিতর হইতে বদ্ধ দেখিয়া ও উহার মধ্যে আলো জ্বলিতেছে দেখিয়া, আমার সম্পূর্ণরূপ বিশ্বাস হইল যে, ঐ দোকানের ভিতর চোর প্রবেশ করিয়াছে, ও আলো জ্বলিয়া নিশ্চয়ই মূল্যবান জহরতাদি অপহরণ করিতেছে। দরজার ফাঁক দিয়া ঐ দোকানের অভ্যন্তরীণ অবস্থা দর্শন করিবার বিশেষরূপে চেষ্টা করিলাম, কিন্তু কিছুই দেখিতে পাইলাম না। নিকটে কোন প্রহরীকেও দেখিতে পাইলাম না, অথচ সেইস্থান পরিত্যাগ করিয়া স্থানান্তরে গমন করিয়া কোনরূপ বন্দোবস্ত করিতেও সাহসী হইলাম না।  এইরূপ অবস্থা দেখিয়া সেই সময় কি করা কর্তব্য, সেইস্থানে দাঁড়াইয়া মনে মনে ইহা ভাবিতেছি, এরূপ সময় হঠাৎ ভিতর হইতে বদ্ধ দরজার একটা খুলিয়া একজন লোক সেই দোকান হইতে বহির্গত হইল। উহাকেই দেখিয়া চোর বিবেচনায় আমি দ্রুতপদে উহার নিকট গমন করিয়া তাহাকে ধরিলাম। হঠাৎ ধৃত হওয়ায় সে অতিশয় বিস্মিত হইল এবং আমাকে কহিল, “কেন মহাশয় আমাকে ধরিতেছেন?”

 উত্তরে আমি কহিলাম, “তুমি কে?” আমার কথা শুনিয়া সে কহিল, “আমি এই দোকানের একজন কর্ম্মচারী, বিশেষ কোন কার্য্য উপলক্ষে আমি বাহিরে যাইতেছি।”

 আমি। আপনি যে এই দোকানের কর্ম্মচারী, তাহা কে জানে?

 কর্ম্মচারী। দোকানের ভিতর আমার মনিব আছেন, তিনিই বলিবেন যে, আমি তাহার দোকানের কর্ম্মচারী কি না?

 আমি। আচ্ছা আসুন, আপনার মনিবের নিকট।

 এই বলিয়া ঐ ব্যক্তিকে সঙ্গে লইয়া আমি ঐ দোকানের ভিতর প্রবেশ করিলাম। দেখিলাম, বাস্তবিকই সেই দোকানের স্বত্বাধিকারী সেই স্থানেই বসিয়া আছেন, তাহার সহিত আরও দুই চারিজন লোক সেইস্থানে বসিয়া আছেন। আমাকে দেখিয়াই তিমি চিনিলেন ও বিশেষ অভ্যর্থনার সহিত আমাকে সেইস্থানে বসাইলেন। তাঁহার লোককে আমি ঐরূপে দোকানের মধ্যে লইয়া যাওয়ার নিমিত্ত আমি বিশেষরূপে লজ্জিত হইলাম। কি সন্দেহের উপয় নির্ভর করিয়া আমি তাঁহাকে ঐরূপে দোকানে লইয়া গিয়াছি, তাহা তাহাকে সমস্ত কহিলাম। তিনি আমার কথা শ্রবণ করিয়া বিশেষরূপ সন্তুষ্ট হইলেন। পরিশেষে কহিলেন, “আপনি এই সময় এখানে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছেন, ইহাতে আমার বোধ হইতেছে, আমার যে সর্বনাশ হইয়াছে, তাহার প্রতিকার আপনার দ্বারাই সম্পন্ন হইবে। এই নিমিত্তই ভগবান দয়া করিয়া এই অসময়ে আপনাকে এখানে আনিয়া উপস্থিত করিয়াছেন।”

 উহার কথা শুনিয়া আমি কিছুই অনুমান করিয়া উঠিতে পারিলাম না। সুতরাং আমাকে জিজ্ঞাসা করিতে হইল, “আপনার আবার কি সর্বনাশ হইল?”

 জহুরি। আমার প্রায় দশসহস্র টাকা অপহৃত হইয়াছে। তাহার উপর বোধ হয়, একটা জীবনও নষ্ট হইয়া গিয়াছে।

 আমি। এ কিরূপ কথা, ইহার কিছুই আমি বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছি না। কবে এরূপ ঘটনা ঘটিয়াছে?

 জহুরি। ইহা আজ সন্ধ্যার সময়ের ঘটনা।

 আমি। জীবন নষ্ট হইয়াছে, কথাটা কি?

 জহুরি। আমি সমস্ত অবস্থা আপনার নিকট বলিতেছি, শুনিয়া যাহাতে ইহার প্রতিবিধান হয়, তাহার চেষ্টা আপনাকে করিতে হইবে। এক সময় আপনি আমার বিশেষরূপ উপকার করিয়াছেন। এবারও আমাকে এই ঘোরবিপদ হইতে উদ্ধার করুন।

 আমি। কি ঘটিয়াছে বলুন দেখি।