বিষয়বস্তুতে চলুন

সারদামঙ্গল/দ্বিতীয় সর্গ

উইকিসংকলন থেকে

দ্বিতীয় সর্গ।

গীতি।
[ রাগিণী কালাংড়া,-তাল ঘৎ।]

হারায়েছি—হারায়েছি রে, সাধের স্বপনের ললনা।
মানস-মরালী আমার কোথা গেল বলনা।
কমল কাননে বালা,
করে কত ফুলখেলা,
আহা, তার মালা গাঁথা হ’ল না!
প্রিয় ফুলতরুগণ,
সুধাকর, সমীরণ,
বল বল ফিরে কি আর পাবনা।
কেন এল চেতনা!
আহা সে পুরুষবর
জানি কেমন তর
দাড়ায়ে রজতগিরি অটল সুধীর!
উদার ললাট ঘটা,
লােচনে বিজলী ছটা,
নিটোল বুকের পাটা, নধর শরীর।


সৌম্য মূর্তি স্ফূর্ত্তি-ভরা,
পিঙ্গল বল্কল পরা,
নীরদ-তরঙ্গ-লীলা জটা মনােহর;
শুভ্র অভ্র উপবীত
উরস্থলে বিলম্বিত,
যােগপাটা ইন্দ্রধনু রাজিছে সুন্দর।


কুমিতা লতা ভালে,
শ্মশ্রুরেখা শােভে গালে,
করেতে অপূৰ্ব এক কুসুম রতন;
চাহিয়ে ভুবন পানে
কি যেন উদয় প্রাণে,
অধরে ধরেনা হাসি-শশীর কিরণ।

8
কি এক বিভ্রম ঘটা,
কি এক বদন ছটা,
কি এক উছলে অঙ্গে লাবণ্য-লহরী।
মন্দাকিনী আসি কাছে
থমকে দাড়ায়ে আছে,
থমকে দাড়ায়ে দেখে অমর অমরী।


নধর মন্দার রাজি
নবীন পল্লবে সাজি
দূরে দূরে ধীরে ধীরে ঘেরিয়ে দাড়ায়।
গরজি গভীর স্বরে
জলধর শির’পরে
করি করি জয়ধ্বনি চলে দুলে দুলে।
তড়িত ললিত বালা,
করে লুকাচুরি খেলা,
সহসা সমুখে দেখে চমকে পালায়।
অপ্সরী বাঁশরী করে
দাড়ায়ে শিখরী পরে
আনন্দে বিজয় গান গায় প্রাণ খুলে।

দিগঙ্গনা কুতূহলে
সমীর-হিল্লোল ছলে
বরষে মন্দার-ধারা আবরি গগন।
আমােদে আমােদময়,
অমৃত উথুলে বয়,
ত্রিদশ-আলয় আজি আনন্দে মগন।
জ্যোতির্ময় সপ্ত ঋষি
প্রভায় উজলি দিশি,
সন্ত্রমে কুমাঞ্জলি অর্পিছেন পদতলে।


সে মহাপুরুষ-মেলা,
সে নন্দনবন-খেলা,
সে চিরবসন্ত-বিকশিত ফুলহার,
কিছুই হেথায় নাই;
মনে মনে ভাবি তাই,
কি দেখে আসিতে মন সরিবে তােমার।


কেমনে বা তােমা বিনে
দীর্ঘ দীর্ঘ রাত্র দিনে
সুদীর্ঘ জীবন-জ্বালা সব অকাতরে,
কার আর মুখ চেয়ে
অবিশ্রাম যাব বেয়ে
ভাসায়ে তনুর তরী অকূল সাগরে!


কেন গাে ধরণী রাণী
বিরস বদনখানি,
কেন গাে বিষন্ন তুমি উদার আকাশ,
কেন প্রিয় তরু লতা
ডেকে নাহি কহ কথা,
কেন রে হৃদয় কেন শ্মশান উদাস।

কোন সুখ নাই মনে,
সব গেছে তার সনে;
খােললা হে অমরগণ স্বরগের দ্বার!
বল কোন পদ্মবনে
লুকায়েছ সংগােপনে,
দেখিব কোথায় আছে সারদা আমার।

১১
অয়ি, একি, কেন কেন,
বিষ হইলে হেন!
আনত আনন শশী, আনত নয়ন,
অধরে মন্থরে আসি
কপােল মিলায় হাসি,
থর থর ওষ্ঠাধর, ক্ষোরেনা বচন।

১২
তেমন অরুণ-রেখা
কেন কুহেলিকা-ঢাকা,
প্রভাত-প্রতিমা আজি কেন গাে মলিন।
বল বল চাননে,
কে ব্যথা দিয়েছে মনে,
কে এমন-কে এমন হৃদয়-বিহীন!

-১৩-
বুঝিলাম অনুমানে,
করুণা-কটাক্ষ-দানে
চাবে না আমার পানে,কবেও না কথা!
কেন যে কবে না, হায়,
হৃদয় জানিতে চায়,
সরমে কি বাধে বানী,মরমে বা বাজে ব্যথা!

-১৪-
যদি মর্ম্ম-ব্যথা নয়,
কেন অশ্রুধারা বয়?
দেববালা ছল-কলা জানে না কখন;
সরল মধুর প্রাণ,
সতত মুখেতে গান,
আপন বীনার তানে আপনি মগন!

-১৫-
অয়ি, হা, সরলা সতী
সত্যরূপা সরস্বতী!
চির-অনুরক্ত ভক্ত হয়ে কৃতাঞ্জলি
পদ-পদ্মাসন কাছে
নীরবে দাঁড়ায়ে আছে-
কি করিবে,কোথা যাবে,দাও অনুমতি!

স্বরগ-কুসুম-মালা,
নরক-জ্বলন-জ্বালা,
ধরিবে প্রফুল্লমুখে মস্তকে সকলি।
তব আজ্ঞা সুমঙ্গল,
যাই যাব রসাতল,
চাই নে এ বরমালা, এ অমরাবতী!

-১৬-
নরকে নারকী-দলে
মিশিগে মনের বলে,
পরাণ কাতর হলে ডাকিব তোমায়;
যেন দেবী সেইক্ষণে-
অভাগারে পড়ে মনে,
ঠেল না চরণে দেখো, ভুল না আমায়!

-১৭-
অহহ! কিসের তরে
অভাগা নরকে জরে,
মরু-মরু-মরুময় জীবন লহরী!
এ বিরস মরূভূমে-
সকলি আচ্ছন্ন ধূমে,
কোথাও একটিও আর নাহি ফোটে ফুল!

কভু মরীচিকা মাঝে
বিচিত্র কুসুম রাজে,
উঃ! কি বিষম বাজে, যেই ভাঙে ভুল!
এত যে যন্ত্রনা-জ্বালা,
অবমান,অবহেলা,
অবু কেন প্রাণ টানে! কি করি, কি করি!

১৮
তেমন আকৃতি, আহা,
ভাবিয়ে ভাবিয়ে যাহা-
আনন্দে উন্মত্ত মন, পাগল পরাণ;
সে কি গো এমন হবে,
মোর দুখে সুখে রবে,
কাঁদিয়ে ধরিলে কর, ফিরাবে বয়ান?

১৯
ভাবিতে পারিনে আর!
অন্ধকার-অন্ধকার-
ঝটিকার ঘূর্ণি ঘোরে মাথার ভিতর!
তরঙ্গিয়া রক্তরাশি
নাকে মুখে চোখে আসি
বেগে যেন ভেঙে ফেলে; ধর,ধ র,ধর!-

২০
ধর আত্মা, ধৈর্য্য ধর,
ছি ছি! একি কর কর,
মর যদি, মরা চাই মানুষের মত!
থাকি বা প্রিয়ার বুকে,
যাই বা মরণ-মুখে,
এ আমি,আমিই রব; দেখুক জগত।

২১
মহান মনেরি তরে
জ্বালা জ্বলে চরাচরে,
পুড়ে মরে ক্ষুদ্রেরাই পতঙ্গের প্রায়!

জ্বলুক যতই জ্বলে,
পর জ্বালা-মালা গলে,
নীলকণ্ঠ –কণ্ঠে জ্বলে হলাহল দ্যুতি!

হিমাদ্রিই বক্ষপরে
সহে ব্রজ অকাতরে!
জঙ্গল জ্বলিয়া যায় লতায় পাতায়!

অস্তাচলে চলে রবি,
কেমন প্রশান্ত ছবি!
তখনো কেমন আহা উদার বিভূতি।

২২
হা ধিক অধীর হেন!
দেখেও দেখ না কেন
দুখে দুখী অশ্রুমুখী প্রাণ-প্রতিমায়!
প্রণয় পবিত্র ধনে
সন্দেহ করো না মনে,-
নাগরদোলায় দোলা শিশুরি মানায়।

সারদা সরলা বালা,
সবে না সন্দেহ জ্বালা,
ব্যথা পাবে সুকোমল হৃদয়-কমলে!