সিরাজদ্দৌলা (অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়, ১৯০২)/ইংরাজ-চরিত্র
দশম পরিচ্ছেদ।
ইংরাজ-চরিত্র।
হোসেন কুলীর হত্যাকাণ্ডে কলঙ্ক উপার্জন করাই সার হইল। লাভের মধ্যে রাজবল্লভ সতর্ক হইলেন এবং আত্মপক্ষ সবল করিবার জন্য নানা উপায়ে চেষ্টা করিতে লাগিলেন। রুগ্নশয্যাশায়ী বৃদ্ধ নবাব, দৌহিত্রের ভবিষ্যদাকাশ ঘনতমসাচ্ছন্ন দেখিয়া, কপালে করাঘাত করিতে লাগি লেন; এবং এই সময় হইতে সর্বদা সদুপদেশ দিয়া সিরাজ-চরিত্র সংশোধন ও তাহার কল্যাণসাধনের চেষ্টা করিতে লাগিলেন। আলি- বর্দ্দী যে সিরাজদ্দৌলাকে প্রাণের অধিক ভালবাসিতেন, মুসলমান ইতিহাসলেখক[১] বারম্বার সে কথার উল্লেখ করিয়া গিয়াছেন;—কিন্তু যৌবনোন্মত্ত সিরাজদ্দৌলা সে কথা প্রায়ই স্বীকার করিতেন না। আলিবর্দ্দী সেই সকল কথা স্মরণ করিয়াই সিরাজদ্দৌলাকে লিখিয়াছিলেন যে, 'যাঁঁহারা সংসার-সংগ্রামে স্নেহের অত্যাচার সহ্য করেন, তাঁহারাই যথার্থ বীরপুরুষ।'
সেই স্নেহপরায়ণ মাতামহ যখন চিরদিনের মত উদরীরোগে শয্যাশায়ী হইয়া পড়িলেন, যখন স্বার্থসাধনের জন্য ষড়যন্ত্রনিপুণ রাজবল্লভ আলিবর্দ্দীর সিংহাসনে নওয়াজে মোহম্মদকে বসাইয়া দিয়া সিরাজদ্দৌলার সকল অভিমান চূর্ণ করিবার আয়োজন করিতে লাগিলেন, তখন সিরাজদ্দৌলাও বুঝিলেন যে, আলিবর্দ্দীই তাহার একমাত্র অকৃত্রিম সুহৃৎ, এবং নিরাশ্রয়ের আশ্রয়স্থল! এই সময় হইতে সিরাজের সে দুর্দমনীয় হৃদয়বেগ ক্রমেই অবসন্ন হইয়া আসিতে লাগিল, প্রমোদকোলাহল শান্তিলাভ করিল, পার্শ্বচরদিগের পাশবনৃত্য তিরোহিত হইল, হিরাঝিলের প্রমোদকক্ষের মদিনোৎসাহিত অট্টহাস্য নীরব হইয়া পড়িল, সহসা তানলয়-পরিপুরিত প্রমোদসঙ্গীত অর্ধপথে স্তম্ভিত হইয়া কণ্ঠরোধ করিল!—সিরাজদ্দৌলা প্রতিনিয়ত মাতামহের রুগ্ন-শয্যাপার্শ্বে উপবেশন করিয়া, ভবিষ্যতের শাসননীতি এবং কার্যপদ্ধতির উপদেশ গ্রহণ করিতে আরম্ভ করিলেন।
মহারাষ্ট্রীয়দিগের সঙ্গে সন্ধিসংস্থাপন করায়, বর্গীর হাঙ্গামা চিরদিনের মত শান্তিলাভ করিয়াছিল; কিন্তু, উড়িষ্যা প্রদেশ চিরদিনের মতই নবাবের শাসন-বহির্ভূত হইয়া গিয়াছিল। পূর্ণিয়া প্রদেশে সাইয়েদ আহমদ রাজত্ব করিতেছিলেন,—সে দেশে সিরাজের হিতাকাঙ্ক্ষী কোথায়? ঢাকা রাজবল্লভের করতলগত, সেখানেই বা কে সিরাজদ্দৌলার স্বপক্ষে দাঁড়াইতে সাহস করিবে? বিহার প্রদেশের কিয়দংশ মহারাষ্ট্ৰকবলে উৎসর্গীকৃত হইয়াছে,— যাহা রাজা রামনারায়ণের শাসনাধীনে রহিয়াছে, তাহাতেও রামনারায়ণের সুশাসন ভাল করিয়া সংস্থাপিত হইতে পারে নাই। সিরাজদ্দৌলা বুঝিলেন যে, কেবলমাত্র মুর্শিদাবাদ প্রদেশেই যাহা কিছু সাক্ষাৎসম্বন্ধে নবাবের শাসনক্ষমতা বর্ত্তমান। কিন্তু সে প্রদেশের প্রতিভাশালিনী শাসনকর্ত্তী রাণী ভবানী, ধনকুবের জগৎশেঠ, বা অধ্যবসায়শীল ইংরাজবণিকের নিকট বিপদের দিনে সহায়তা লাভ করিবার সম্ভাবনা নাই! রাজবল্লভের চেষ্টায় রাজধানীর ক্ষমতাশালী পাত্রমিত্রগণ সকলেই অল্পাধিক পরিমাণে. সিরাজের শত্রুপক্ষের মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী হইয়া উঠিয়াছেন! সিরাজদ্দৌলার আর কি রহিল। একমাত্র স্নেহপরায়ণ মাতামহ, তিনিও যে অন্তিম-শয্যায় শয়ন করিয়াছেন, তাহা ত্যাগ করিয়া পুনরায় বীরদর্পে গাত্রোত্থান করিবার সম্ভাবনা নাই! তথাপি সিরাজদ্দৌলা ক্রমে ক্রমে তাঁহারই কণ্ঠলগ্ন হইয়া পড়িলেন।
সময় থাকিতে নিয়ত আলিবর্দ্দীর ন্যায় ধর্ম্মপরায়ণ প্রজাহিতৈষী প্রবীণ নরপতির সাধু দৃষ্টান্তের অনুকরণ করিলে, সিরাজ-চরিত্র যে অন্যবিধ উপাদানে গঠিত হইত, এবং বাঙ্গালা, বিহার, উড়িষ্যার বর্ত্তমান ইতিহাস যে অন্যবিধ আকার ধারণ করিত, তাহা সহজেই অনুমান করা যাইতে পারে। কিন্তু মুসলমানের পাপের ভরা পূর্ণ হইয়া আসিয়াছিল, বুঝি সেই জন্যই সময় থাকিতে সিরাজদ্দৌলার মোহনিদ্রা ভাঙ্গিল না।
মুসলমান ধর্ম্মে সিরাজদ্দৌলা কোনদিনই আস্থাশূন্য হন নাই; বরং ধর্ম্মানুরাগে অনুপ্রাণিত হইয়া, তিনি বহুযত্নে বহুব্যয়ে আরব দেশের মরুমরীচিকাবেষ্টিত মদিনা নগরের পবিত্র মৃত্তিকা ভারতবর্ষে আহা করিয়া তাহার উপর যে পুণ্য মসজেদ গঠন করিয়াছিলেন, তা বহুদিন পর্য্যন্ত ভাগীরথীতীরে সিরাজদ্দৌলার ধর্ম্মবিশ্বাসের সাক্ষিরূপে দণ্ডায়মান ছিল।[২] কিন্তু আস্থাবান মুসলমান হইয়াও, সিরাজদ্দৌলা তরুণজীবনে সঙ্গদোষে শাস্ত্রশাসন উল্লঙ্ঘন করিয়া সুরাপান অভ্যাস করিয়াছিলেন। সেই সঙ্গদোষেই সুরাসহচরীদিগের তরল লাবণ্য তাঁহাকে বাল্যজীবনেই আত্মহারা করিয়া তুলিয়াছিল! আলিবর্দ্দী সেই পাপ প্রবৃত্তি দমন করিবার জন্য এতদিন একবারও চেষ্টা করেন নাই। এখন অন্তিম সময় যতই নিকট হইতে লাগিল, সিরাজের পরিণাম চিন্তা করিয়া, আলিবর্দ্দী ততই ব্যাকুল হইয়া উঠিতে লাগিলেন। অবশেষে একদিন রুগ্নশয্যাপার্শ্বে সিরাজদ্দৌলাকে আহ্বান করিয়া, কোরাণ-শপথ পূর্ব্বক ধর্ম্মপ্রতিজ্ঞায় আবদ্ধ করিলেন; সেইদিন হইতে সিরাজদ্দৌলা চিরজীবনের জন্য সুরাপান পরিত্যাগ করিলেন! যে দুর্দ্দমনীয় হৃদয়বেগের বশীভূত হইয়া, সিরাজদ্দৌলা আপন হাতে আপনার সমাধি-গহ্বর খনন করিবার জন্য, শৈশবেই সুরাপাত্র গ্রহণ করিয়াছিলেন, সেই তেজস্বী-হৃদয়ের বীর প্রতাপেই, একবারমাত্র মাতামহের অন্তিম শয্যা স্পর্শ করিয়া, চিরদিনের জন্য সুরাপাত্র চুর্ণ করিয়া ফেলিলেন। ইংলণ্ডেশ্বর দ্বিতীয় জেম্স্ আমরণকাল দুর্নীতিপরায়ণ থাকিয়াও, ইতিহাসে ধর্ম্মপরায়ণ আদর্শ নরপতি বলিয়া প্রশংসালাভ করিয়াছেন, আর মোহান্ধ সিরাজদ্দৌল্লা অপরিণত জীবনে অতি অল্পদিনমাত্র পাপকুহকে আত্মবিসর্জ্জন করিয়া, সময় থাকিতে বীরপ্রতাপে আত্ম-সংশোধনে কৃতকার্য্য হইয়াও, জগতের চক্ষে, ইতিহাসের চক্ষে, তাঁহার স্বদেশীয় হিন্দু-মুসলমানের চক্ষে ‘সুরাপায়ী জঘন্য রুচির পরম-পাষণ্ড’ বলিয়া তিরষ্কৃত হইতেছেন,—ইহারই নাম অদৃষ্ট-বিড়ম্বনা!
সিরাজদ্দৌলা রাজকার্য্যে হস্তক্ষেপ করিয়া কিরূপভাবে রাজধর্ম্ম প্রতিপালন করিয়াছিলেন, তাহা অনেকের নিকটেই অপরিচিত। কেন না, যে সামান্য কয়েক মাস তিনি সিংহাসনে উপবেশন করিয়াছিলেন, তাহা কেবল যুদ্ধকোলাহলেই অতিবাহিত হইয়া গিয়াছিল; নিশ্চিন্তমনে রাজকার্য্য পরিচালনা করিবার অবসর ঘটিয়া উঠে নাই। সুতরাং সিরাজদ্দৌলার শাসনকার্যের সমালোচনা করিতে হইলে, নবাব আলিবর্দ্দীর শেষ জীবনে তিনি যখন প্রতিনিধিরূপে রাজ্যশাসন করিয়াছিলেন, সেই সময়ের ইতিহাসেরই আলোচনা করা আবশ্যক। সে ইতিহাসে সিরাজদ্দৌলা এবং ইংরাজ-বণিক, কে কিরূপ চরিত্রের পরিচয় রাখিয়া গিয়াছেন, তাহার তথ্যানুসন্ধান না করিয়া, অনেকেই বলিয়া থাকেন যে, সে কালের ইংরাজ দেবতা—আর সিরাজ অসুর, তাই অসুর দলনের জন্যই পলাশির সমরক্ষেত্রে ইংরাজ-দেবতা সঙ্গীনস্কন্ধে অবতীর্ণ হইয়াছিলেন!
ইংরাজ ইতিহাস-লেখকগণ বহুযত্নে সিরাজদ্দৌলার যে নৃশংসচরিত্র অঙ্কন করিয়া গিয়াছেন, ইংরাজ দপ্তরের কাগজপত্রে কিন্তু সেরূপ চরিত্রের পরিচয় পাওয়া যায় না। সিরাজ ইংরাজদিগকে বিশ্বাস করিতেন না; তাহাদিগকে দুচক্ষে দেখিতে পারিতেন না। তাহাদের ছল-চাতুরী ও কুটিল কৌশল ধরিতে পারিলে সাধ্যমত দণ্ডদান করিতেন। এসকলই সত্য কথা। কিন্তু রাজকার্য্যে লিপ্ত হইয়া সেই সিরাজদ্দৌলা ইংরাজদিগকে কোনদিনই ছল চাতুরী বা জাল জুয়াচুরী করিয়া অপদস্থ বা সর্বস্বান্ত করিবার চেষ্টা করেন নাই। বরং কোন কোন কার্য্যে স্পষ্ট বুঝিতে পারা যায় যে, ইংরাজিদিগের উপর-রাজা রা জমীদারগণ কিঞ্চিন্মাত্রও উৎপীড়ন করিলে, সিরাজদ্দৌলা কঠোরহস্তে জমীদারগণকে শাসন করিয়া, ইংরাজের বাণিজ্যরক্ষার সহায়তা করিতেন। ইহার দুই একটি দৃষ্টান্ত এখনও বর্ত্তমান আছে।
এখন যেমন কলিকাতা মহানগরী মফঃস্বলবাসী ধনী-সন্তানদিগের সাধারণ প্রমোদশালায় পরিণত হইয়াছে, সেকালে কলিকাতায় এরূপ কোন উৎকট প্রলোভন বর্তমান ছিল না। কেহ বাণিজ্যব্যবসায়ে অর্থোপার্জ্জন করিবার জন্য, কেহ বা বর্গীর হাঙ্গামায় নিরাপদ হইবার সম্ভাবনায় সময়ে সময়ে কলিকাতায় আসিয়া বাস করিতে আরম্ভ করিয়াছিলেন। বর্ধমানের মহারাজ তিলকচাঁদ বর্গীর হাঙ্গামায় উপর্য্যুপরি বিপর্যস্ত হইয়া, অবশেষে কলিকাতায় একটি রাজবাটী নির্ম্মাণ করিয়াছিলেন। অবসর সময়ে সেখানে আসিয়া দুই দশ দিন বাস করিতেন, অধিকাংশ সময় তাহা কর্ম্মচারিগণের রক্ষণাধীনেই পড়িয়া থাকিত। রামজীবন কবিরাজ নামে মহারাজের একজন তহশিলদার, গোপনে গোপনে ইংরাজদিগের সঙ্গে বাণিজ্যব্যাপারে লিপ্ত হইয়া, কিঞ্চিৎ কিঞ্চিৎ অর্থোপার্জ্জন করিতেন। যে কারণে হউক, রামজীবন একবার জন উড নামক একজন ইংরাজ-বণিকের নিকট কিছু ঋণগ্রস্ত হইয়া পড়েন। উড সাহেব রামজীবনের নামে কলিকাতার “মেয়রকোর্টে” ৬৩৫৭ টাকার এক ডিক্রী করিয়া রাখিয়াছিলেন।[৩] এই টাকার সহিত অবশ্যই বর্দ্ধমানরাজের কোন সংস্রব ছিল না। কিন্তু ইংরাজরণিক যখন সহজে রামজীবনের নিকট হইতে টাকা আদায় করিতে পারিলেন না, তখন ইংরাজ-আদালতের তৎকাল-প্রচলিত অদ্ভুত বিচার-কৌশলে রামজীবনের ঋণ আদায়ের জন্য বর্দ্ধমানের মহারাজের কলিকাতাস্থ রাজবাটী ক্রোক করিয়া তালাবন্ধ করিয়া ফেলিলেন। এই আকস্মিক অত্যাচারে বর্দ্ধমানের মহারাজ মর্ম্মপীড়িত হইয়া, উদ্ধত ইংরাজ-বণিককে শিক্ষা দিবার জন্য, নিজ অধিকার মধ্যে যেখানে যেখানে ইংরাজের বাণিজ্যালয় ছিল, তাহা তালাবন্ধ করিয়া গোমস্তাদিগকে কারারুদ্ধ করিলেন;—বর্ধমান প্রদেশে ইংরাজ-বাণিজ্য বন্ধ হইয়া গেল।[৪]আলিবর্দ্দীর শাসনসময়ে জমীদারগণ স্বাধিকার মধ্যে স্বাধীন হইয়া উঠিয়াছিলেন, সুতরাং বর্দ্ধমানরাজের এই কার্যে বিশেষ অপরাধ ছিল না। কিন্তু দোষ কাহার, তাহার অনুসন্ধান না করিয়াই ইংরাজ-দরবার স্থির করিলেন যে, মহারাজের ব্যবহার নিতান্ত অসঙ্গত এবং অপমানজনক-যেরূপে হউক, তাহার প্রতিকার করিতে হইবে।[৫]+ ইংরাজবণিক নবাবদরবারে অভিযোগ করিলেন। সিরাজদ্দৌলাই তখন প্রকৃত নবাব,—আলিবর্দ্দীর নামে তিনিই বঙ্গভাগ্য শাসন করিতেছিলেন। সিরাজদ্দৌলা জমিদার দিগের স্বাধীনশক্তিকে দমন করিবার জন্য যেরূপ লালায়িত, তাহাতে এই অভিযোগ শ্রবণ করিয়া তিনি বর্দ্ধমানের মহারাজকে বিলক্ষণ অপ্রতিভ করিবার অবসর পাইলেন। ইংরাজগণ যে নিতান্ত অসঙ্গতরূপে রামজীবনের ঋণের জন্য মহারাজের সম্পত্তি আটক করিয়াছিলেন, সে কথা পড়িয়া থাকিল। মহারাজ তিলকচাঁদ, কি জন্য নবাব-দরবারে অভিযোগ না করিয়া স্বয়ং তাহার প্রতিবিধান করিতে ব্যগ্র হইয়াছিলেন,—তাহারই বিচার উপস্থিত। সে বিচারে মহারাজ পরাস্ত হইলেন। নবাব-দরবারের আদেশে তাঁহাকে অবিলম্বে ইংরাজ বাণিজ্য রক্ষা করিতে হইল। এতদুপলক্ষে নবাব-দরবার হইতে যে মীমাংসাপত্র বাহির হইয়াছিল, ইংরাজগণ তাহার ইংরাজী অনুবাদ সযত্নে রক্ষা করিয়াছেন।[৬]
এই ব্যবহারের সঙ্গে রাজবল্লভের ব্যবহারের একটু তুলনা করা আবশ্যক। রাজবল্লভ ইংরাজদিগের নিকট বন্ধু বলিয়াই পরিচিত। ইংরাজ যখন সিরাজদ্দৌলার সঙ্গে প্রকাশ্য শত্রুতায় লিপ্ত হন, রাজবল্লভের পুত্র কৃষ্ণবল্লভ তখন ইংরাজ-দুর্গে আশ্রয় লইয়াছিলেন। কিন্তু রাজবল্লভ যখন ঢাকার নবাব বলিয়া পরিচিত ছিলেন, সে সময়ে তিনি বিনা কারণে ইংরাজদিগের দুর্গতির একশেষ করিয়া ছাড়িয়া দিয়াছিলেন। রাজবল্লভ একবার নজর তলব করিয়া পাঠাইলেন, ইংরাজ তাহাতে ভ্রূক্ষেপ করিলেন না;—অমনি রাজবল্লভ ইংরাজদিগের গোমস্তাবর্গকে কারারুদ্ধ করিলেন, ইংরাজের বাণিজ্য বন্ধ করিয়া দিলেন এবং বাখরগঞ্জ হইতে ঢাকা অঞ্চলে নৌকাপথে ইংরাজ-বণিকের যে সকল চাউল ধান আসিতেছিল, তাহা আটক করিয়া ফেলিলেন;রাজবল্লভের শাসনে লোকে সাহস করিয়া আর ইংরাজের চাকরী করিতেও স্বীকৃত হইল না![৭] রাজবল্লভ পার্ব্বণী আদায়ের বা নজর আদায়ের উপলক্ষ করিয়া প্রায় মধ্যে মধ্যেই এরূপ ব্যবহার করিতেন। তিনি মুর্শিদাবাদে চলিয়া আসিলে, তাঁহার পুত্র কৃষ্ণবল্লভ কিছু দিন ঢাকার নবারী করিয়াছিলেন। কৃষ্ণবল্লভের অধীনে মীর আবুতালেব নামে একজন নাএব ছিল। সে ওলন্দাজ বণিকদিগের একজন শ্বেতাঙ্গ কর্মচারীকেও কারারুদ্ধ করিয়া উৎপীড়ন করিতে ছাড়ে নাই! এই সকল কথা ইংরাজগণ কাগজপত্রে লিখিয়া রাখিয়াছিলেন, কিন্তু সিরাজদ্দৌলার বিরুদ্ধে পঙ্গধারণ বা লেখনী চালনা করিবার সময়ে ইহা স্মরণ করা আবশ্যক মনে করেন নাই।
রাজবল্লভের এবং কৃষ্ণবল্লভের উৎপীড়নে ইউরোপীয় বণিকগণ এরূপ বিপর্য্যন্ত হইতেন যে, সময়ে সময়ে তজ্জন্য নবাব-দরবারে সমুদায় শ্রেণীর ইউরোপীয় বণিকগণ সমবেতভাবে অভিযোগ উপস্থিত করিয়া পরিত্রাণ পাইতেন। কিন্তু অতি সামান্য সামান্য বিষয় লইয়া সেই ইংরাজেরাই আবার আশ্রয়দাতা মুসলমান নবাবের সঙ্গে কলহ করিতেও ইতস্ততঃ করিতেন না! কলিকাতাবাসী, কি হিন্দু কি মুসলমান, কেহ নিঃসন্তান অবস্থায় পয়লোক গমন করিলে, নবাব-সরকার হইতে তাদের ধনসম্পত্তি হস্তগত করিবার আয়োজন হইলে, ইংরাজগণ একটা না একটা ধূয়া ধরিয়া তখনই তাহাতে বাধা প্রদান করিয়া আসিয়াছেন।[৮]ফরাসীদিগের সঙ্গে ইংরাজের কুটুম্বিতারও অন্ত ছিল না। শত্রুতারও অবধি ছিল না। আলিবর্দ্দীর শাসনকালের শেষ দশায় ইউরোপে ইংরাজ এবং ফরাসীর মধ্যে যুদ্ধ বাধিবার উপক্রম হয়। সেই ধুয়া ধরিয়া ইংরাজগণ কলিকাতার দুর্গসংস্কার এবং সৈন্যদল গঠন করিবার চেষ্টা করিতে লাগিলেন। তাঁহারা যে নবাবের আশ্রয়ে নবাবের রাজ্যে নিরুদ্বেগে বাণিজ্য ব্যবসায়ে লিপ্ত হইয়া অর্থোপার্জ্জন করিবার অধিকার পাইয়াছেন, তাহার জন্য কৃতজ্ঞ হওয়া দূরে থাকুক, যাহাতে কলিকাতা নগরে নবাবের শাসনক্ষমতা প্রতিষ্ঠালাভ করিতে না পারে, সময় এবং সুযোগ পাইলেই তাহার জন্য প্রাণপণে যত্ন করিতেন!
আলিবর্দ্দী ইহা জানিতেন। কিন্তু বর্গির হাঙ্গামায় লিপ্ত হইয়া তিনি জানিয়া শুনিয়াও উচ্চবাচ্য করিতেন না। এখন ইংরাজ বণিকের ধৃষ্টতা ও অকুতোভয়তা লক্ষ্য করিয়া সিরাজদ্দৌলাকে সাবধান করিবার সময়ে স্পষ্টই বলিতে লাগিলেন যে, ইংরাজের রণশক্তি খর্ব করিতে না পারিলে, বাঙ্গালা রাজ্যের কদাচ মঙ্গল হইবে না।[৯] এতদিনের পর আলিবর্দ্দীর ন্যায় প্রবীণ ধর্ম্মশীল নরপতিকেও আপন মতের পোষকতা করিতে দেখিয়া, সিরাজদ্দৌলাও পুলকিত হইয়া উঠিলেন। কিন্তু সে পুলক কেবল ক্ষণিক পুলকমাত্র! যখন বাহুবল ছিল, ধনবল ছিল, দেশে দেশে আলিবর্দ্দীর প্রবল প্রতাপে শত্রুহৃদয় কম্পিত হইত, তখন যাহা সম্ভব হইত, এখন আর তাহা সম্ভব হইতে পারে না। আর সে দিন নাই।
ইংরাজ, ফরাসী, দিনামার, ওলন্দাজ—সকলেই বিদেশী বণিক; নবাব-সরকারের অনুকম্পায় বাঙ্গালাদেশে বাণিজ্য করিতেছেন। তাঁহাদের মধ্যে ইউরোপখণ্ডে যুদ্ধই হউক আর সন্ধিই সংস্থাপিত হউক, তাহার সঙ্গে বাঙ্গালাদেশের যে কিছুমাত্র সংস্রব থাকিতে পারে, সিরাজদ্দৌলা তাহা বুঝিতে পারিলেন না। ফরাসীর সহিত ইংরাজের ইউরোপখণ্ডে যুদ্ধ বাধিলে, বাঙ্গালাদেশে ইংরাজ-দুর্গ-সংস্কার . করিবার আবশ্যক কি? ইউরোপে যুদ্ধ বাধিয়াছে বলিয়া ফরাসীরা কি কলিকাতা লুণ্ঠন করিতে পারেন? সুতরাং সিরাজদ্দৌলা ভাবিলেন যে, দুৰ্গসংস্কার করাই ইংরাজের উদ্দেশ্য, ফরাসী-যুদ্ধের আশঙ্কার সংবাদ একটা ধূয়া মাত্র! ইংরাজগণ কেবল দুৰ্গসংস্কারের চেষ্টা করিয়াই নিরস্ত হইলেন না। তাহারা বিলাতের কর্তৃপক্ষীয়দিগের আদেশ পাইয়া, কলিকাতা রক্ষার জন্য অতিরিক্ত সেনাদল গঠন করিতে আরম্ভ করিলেন।[১০] এদিকে আলিবর্দ্দী উপদেশ দিতেছেন য়ে, ইংরাজের রণশক্তি খর্ব করিতে না পারিলে বাঙ্গালা রাজ্যের কিছুতেই কল্যাণ নাই, ওদিকে সেই ইংরাজ দিন দিনই রণশক্তি প্রবল হইতে প্রবলতর করিয়া তুলিতেছেন! সিরাজদ্দৌলা ইহা নীরবে সহ্য করিতে পারিলেন। প্রায় সর্ব্বদাই মাতামহের নিকটে আসিয়া ইংরাজদিগের বিরুদ্ধে অভিযোগ করিতে আরম্ভ করিলেন।
রাজবল্লভ ইংরাজদিগের রীতি নীতি ও কার্যপ্রণালী বিলক্ষণরূপে অবগত ছিলেন। তিনি এই সময়ে কাশিমবাজারের ইংরাজকুঠীর গোমস্তা ওয়াটস্ সাহেবকে হাত করিতে আরম্ভ করিলেন। ওয়াট কলিকাতার ইংরাজ দরবারে প্রায় প্রত্যহই সংবাদ পাঠাইতেন;ইংরাজ গবর্ণর তাহাতেই মুর্শিদাবাদ দরবারের প্রত্যেক কথা ঘরে বসিয়া প্রতিদিন পাঠ করিবার অবসর পাইতেন। রাজবল্লভ ওয়াটসকে হাত করায়, কলিকাতার ইংরাজ-দরবারও তাঁহার হাত হইয়া গেল। সিরাজদ্দৌলা এ সকল কথার সন্ধান পাইয়া, ইহা যে প্রকাশ্য শত্রুতার পূর্ব্বলক্ষণ, তাহা বুঝিতে পারিয়াছিলেন। কিন্তু বুঝিলে আর কি হইবে? আলিবর্দ্দীর উদরীরোগ ক্রমে অসাধ্য হইয়া উঠিল! মুমূর্ষু নবাবের অন্তিম সময়ে আর যুদ্ধকোলাহল উপস্থিত করিতে পারিলেন না। রাজবল্লভ এবং ইংরাজ বণিক সময় ও সুযোগ পাইয়া পরস্পরের সঙ্গে প্রীতিবন্ধন সুদৃঢ় করিতে আরম্ভ করিলেন। সিরাজদ্দৌলার ক্রোধাগ্নি নির্ব্বাপিত হইল না, তাহা ধীরে ধীরে প্রধূমিত হইতে লাগিল।[১১]
- ↑ Syed Golam Hossain.
- ↑ H.Beveridge. C. s.
- ↑ The Gomasta owed Rupees 6357 to a European; the payment: of which could not be secured."—Revd. Long.
- ↑ Consultations. 1 April, 1755.
- ↑ “Upon taking into consideration this affair, the Board are of opinion the Rajah has taken a step by no means warrantable and extremely insolent.”-Long's Selections
- ↑ পরিশিষ্টে দ্রষ্টব্য।
- ↑ They have received lately many insults from the Government there, and particularly in their giving public orders that no person there shall serve the factory.” -Long's Selections.
- ↑ “The Nawab Aliverdi Khan repeatedly claimed the property of Calcutta-Natives dying without male issue on the ground hat in such cases the Mongenal becomes heir."—Revd. Long
- ↑ “His last advice to his grandson was to deprive the English of Military power. -Holwell's Tracts, page 286.”
- ↑ Court's letter, 11 February, 1756.
- ↑ Thornton's History of British India, Vol. I.