সুকুমার রায় সমগ্র রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড)/ইস্কুলের গল্প/জগ্যিদাসের মামা

উইকিসংকলন থেকে

জগ্যিদাসের মামা

 তার আসল নামটি যজ্ঞদাস। সে প্রথম যেদিন আমাদের ক্লাশে এসেছিল পণ্ডিতমশাই তার নাম শুনেই এক ধমক দিলেন, “যজ্ঞের আবার দাস কি? যজ্ঞেশ্বর বললে তবু নাহয় বুঝি।” ছেলেটি বলল, “আজ্ঞে, আমি তো নাম রাখি নি, নাম রেখেছেন খুড়োমশাই।”

 এই শুনে আমরা হো হো করে হেসে উঠতেই পণ্ডিতমশাই হঠাৎ আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “বানান কর যজ্ঞদাস।” আমি থতমত খেয়ে বললাম, “বর্গীয় জ”—পণ্ডিতমশাই বললেন, “দাড়িয়ে থাক।” তার পর একটা ছেলে ঠিক বানান বললে পর তিনি আরেক-

জনকে বললেন, “সমাস কর।” সে বেচারা ভয় পেয়ে বলল, যোগ্য ছিল দাস—হল যোগ্যদাস—অর্থাৎ” পণ্ডিতমশাই বললেন, “থাক, থাক আর বলতে হবে না।” এমনি করে জগ্যিদাস আমাদের ক্লাশে ভতি হল। দুদিন না যেতেই বোঝা গেল যে, জগ্যিদাসের আর কোনো বিদ্যে থাকুক আর নাই থাকুক, আজগুবি গল্প বলবার ক্ষমতাটি খুব অসাধারণ। একদিন সে স্কুলে দেরি করে এসেছিল, কারণ জিজ্ঞাসা করাতে সে বলল, “রাস্তায় আসতে পঁচিশটা কুকুর হা ঁহা ঁকরে আমায় তেড়ে এসেছিল। আমি ছুটতে ছুটতে, হাঁপাতে হাঁপাতে, সেই কুণ্ডুদের বাড়ি পর্যন্ত চলে গেছিলাম।” পঁচিশটা দূরের কথা, দশটা কুকুরও আমরা একসঙ্গে চোখে দেখি নি, কাজেই কথাটা মাস্টারমশাইও বিশ্বাস করেন নি। তিনি বললেন, “এত মিছে কথা বলতে শিখলে কার কাছে?” জগ্যিদাস বলল, “আজ্ঞে, মামার কাছে।” সেদিন হেডমাস্টারের ঘরে জগ্যিদাসের পড়েছিল, সেখানে কি হয়েছিল আমরা জানি না, কিন্তু জগ্যিদাস যে খুশি হয় নি সেটা বেশ বোঝা গেল। কিন্তু সত্যি হোক আর মিথ্যে হোক, তার গল্প বলার বাহাদুরি ছিল। সে যখন বড়ো-বড়ো চোখ করে, গম্ভীর গলায়, তার মামাবাড়ির ডাকাত ধরার গল্প বলত তখন বিশ্বাস করি আর না করি, শুনতে শুনতে আমাদের মুখ আপনা হতেই হা ঁহয়ে আসত। | জগ্যিদাসের মামার কথা আমাদের ভারি আশ্চর্য ঠেকত। তাঁর গায়ে নাকি যেমন জোর, তেমনি অসাধারণ তার বুদ্ধি। তিনি যখন ‘রামভজন’ বলে চাকরকে ডাক দিতেন, ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব পুলিশ নিয়ে ছুটে আসত। কুস্তি বল, লাঠি বল, ক্রিকেট বল, ফুটবল বল, সবটাতেই তাঁর সমান দখল। প্রথমটা আমরা বিশ্বাস করি নি, কিন্তু একদিন সে তার মামার ফোটো এনে দেখাল। দেখলাম, পালোয়ানের মতো চেহারা বটে! একেক বার দুটি হত আর জগ্যিদাস তার মামাবাড়ি যেত, আর এসে যে-সব গল্প বলত তা কাগজে ছাপবার মতো। একদিন ছুটি থেকে ফিরবার সময় স্টেশনে আমার সঙ্গে জগ্যিদাসের দেখা, একটা গাড়ির মধ্যে মাথায় পাগড়িবাধা চমৎকার জাদরেল চেহারার একটি কোন দেশী ভদ্রলোক ইলের গল্প ১০৫ স. -২-১৩ বসে! আমি স্কুলে ফিরতে ফিরতে জগ্যিদাসকে জিজ্ঞেস করলাম, “ঐ লোকটা কে রে?” জগ্যিদাস গম্ভীরভাবে বলল, “ঐতো আমার মামা!” আমি বললাম, “সে কি! তোমার মামার ফোটোতে তো দাড়ি ছিল না”- জগ্যিদাস বলল, “আজকাল দাড়ি রেখেছেন।” আমি বললাম, “ফোটোতে তো কালো দেখেছিলাম।” জগ্যিদাস বলল, “এবার দার্জিলিং গিয়ে ফর্সা হয়ে এসেছেন।” আমি ইস্কলে গিয়ে গল্প করলাম, “আজ জগ্যিদাসের মামাকে দেখে এলুম।” জগ্যিদাসও খুব বুক ফুলিয়ে, মুখখানা গম্ভীর করে বলল, “তোমরা তো ভাই আমার কথা বিশ্বাস কর না। আচ্ছা, নাহয় মাঝে মাঝে দুটো-একটা গল্প বলে থাকি, তা বলে কি আমার সবই গল্প। আমার জলজ্যান্ত মামাকে সুদ্ধ তোমরা উড়িয়ে দিতে চাও?” এ কথায় অনেকেই মনে মনে লজ্জা পেয়ে ব্যস্ত হয়ে বারবার বলতে লাগল, “আমরা কিন্তু গোড়া থেকেই বিশ্বাস করেছিলাম।”

 তার পর থেকে মামার প্রতিপত্তি ভয়ানক বেড়ে গেল। রোজই সব ব্যস্ত হয়ে থাকতাম মামার খবর শুনবার জন্য। কোনোদিন মামা যেতেন হাতি গণ্ডর বাঘ মারতে। কোনোদিন একাই তিনি পাঁচটা কাবলিকে ঠেঙিয়ে ঠিক করতেন! এইরকম প্রায়ই হত।

 তার পর একদিন সবাই আমরা টিফিনের সময় গল্প করছি, এমন সময়ে হেডমাস্টার মশাই ক্লাশে এসে বললেন, “যজ্ঞদাস, তোমার মামা এসেছেন।” হঠাৎ যজ্ঞদাসের মুখখানা আম্‌সির মতো শুকিয়ে গেল—সে আম্‌তা-আম্তা করে কি যেন বলতে গিয়ে আর বলতে পারল না। তার পর লক্ষী ছেলেটির মতো চুপচাপ মাস্টারমশায়ের সঙ্গে চলল। আমরা বললাম, “ভয় হবে না? জান তো কিরকম মামা!” সবাই মিলে উৎসাহ আর আগ্রহে ‘মামা’ দেখবার জন্য একেবারে ঝুঁকে পড়লাম।

গিয়ে দেখি, একটি রোগা, কালো, ছোকরাগোছের ভদ্রলোক, চশমাচোখে গোবেচারার মতো বসে আছেন। জগ্যিদাস তাঁকেই গিয়ে প্রণাম করল!

সেদিন আমাদের সত্যিসত্যিই রাগ হয়েছিল। এমনি করে ফাঁকি দেওয়া! মিথ্যে করে মামা তৈরি! সেদিন আমাদের ধমকের চোটে জগ্যিদাস কেঁদেই ফেলল। সে তখন স্বীকার করল যে ফোটোটা কোন এক পশ্চিমা পালোয়ানের। আর সেই ট্রেনের লোকটাকে সে চেনেই না। তার পরে কোনো অজিগুবি জিনিসের কথা বলতে হলেই আমরা বলতাম, “জগ্যিদাসের মামার মতো।”

সন্দেশ- শ্রাবণ, ১৩২৩