সুকুমার রায় সমগ্র রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড)/ইস্কুলের গল্প/ডিটেক্‌টিভ

উইকিসংকলন থেকে
ডিটেক্‌টিভ

 জলধরের মামা পুলিসের চাকরি করেন, আর তার পিসেমশাই লেখেন ডিটেক্‌টিভ উপন্যাস। সেইজন্য জলধরের বিশ্বাস যে, চোর-ডাকাত, জাল-জুয়াচোর জব্দ করবার সবরকম সংকেত সে যেমন জানে, এমনটি তার মামা আর পিসেমশাই ছাড়া কেউ জানে না। কারও বাড়িতে চুরিটুরি হলে জলধর সকলের আগে সেখানে হাজির হয়; আর কে চুরি করল, কি করে চুরি হল, সে থাকলে অমন অবস্থায় কি করত এ-সব বিষয়ে খুব বিজ্ঞের মতো কথা বলতে থাকে। যোগেশবাবুর বাড়িতে যখন বাসন চুরি হল, তখন জলধর তাদের বলল, “আপনারা এইটুকু সাবধান হতে জানেন না—চুরি তো হবেই। দেখুন তো ভাঁড়ার ঘরের পাশেই অন্ধকার গলি, তার ওপর জানলার গরাদ নেই। একটু সেয়ানা লোক হলে এখান দিয়ে বাসন নিয়ে পালাতে কতক্ষণ? আমাদের বাড়িতে ও-সব হবার জো নেই। আমি রামদিনকে বলে রেখেছি, রোজ রাত্রে জানলার কাছে চাতালের উপর বাসনগুলো রেখে দিতে। চোরের বাছা যদি আসতে চান, জানলা খুলতে গেলেই বাসনপত্র সব ঝন্‌ঝন্ করে মাটিতে পড়বে। চোর জব্দ করতে হলে এ-সব কায়দা জানতে হয়। সে সময়ে আমরা সকলেই জলধরের বুদ্ধির খুব প্রশংসা করেছিলাম, কিন্তু পরের দিন যখন শুনলাম সেই রাত্রেই জলধরদের বাড়িতে মস্ত চুরি হয়ে গেছে, তখন মনে হল আগের দিন অতটা প্রশংসা করা উচিত হয় নি।

 জলধর কিন্তু তাতেও কিছুমাত্র দমে নি। সে বলল, “আমি যেরকম প্ল্যান করেছিলাম, তাতে চোর একবার বাড়িতে ঢুকলে তাকে আর পালাতে হত না। কিন্তু ঐ অহাম্মক রামদিনটার বোকামিতে সব মাটি হয়ে গেল। যাক, আমার জিনিস চুরি করে তাকে আর হজম করতে হবে না। বাছাধন যেদিন আমার হাতে ধরা পড়বেন, সেদিন বুঝবেন ডিটেক্‌টিভ কাকে বলে। কিন্তু যাহোক চোরটা খুব সেয়ানা বলতে হবে। যোগেশবাবুদের বাড়িতে যেটা গেছিল সেটা আনাড়ির একশেষ। আমাদের বাড়িতে এলে সে ব্যাটা টের পেত।” কিন্তু দুমাস গেল, চারমাস গেল, ক্রমে প্রায় বছরও কেটে গেল, কিন্তু সে চোর আর ধরা পড়ল না।

 চোরের উপদ্রবের কথা আমরা সবাই ভুলে গেছি, এমন সময়ে হঠাৎ অমাদের স্কুলে আবার চুরির হাঙ্গামা শুরু হল। ছেলেরা অনেকে টিফিন নিয়ে আসে, তা থেকে খাবার চুরি যেতে লাগল। প্রথম দিন রামপদর খাবার চুরি যায়। সে বেঞ্চির উপর খানিকটা রাবড়ি আর লুচি রেখে হাত ধুয়ে আসতে গেছে—এর মধ্যে কে এসে লুচিটুচি বেমালুম খেয়ে গিয়েছে। তার পর ক্রমে আরো দু-চারটি ছেলের খাবার চুরি হল। তখন আমরা জলধরকে বললাম, “কি হে ডিটেক্‌টিভ। এই বেলা যে তোমার চোরধরা বুদ্ধি খোলে না, তার মানেটা কি বল দেখি?” জলধর বলল, “আমি কি আর বুদ্ধি খাটাচ্ছি না? সবুর কর-না।” তখন সে খুব সাবধানে আমাদের কানে কানে এ কথা জানিয়ে দিল যে স্কুলের যে নুতন ছোকরা বেয়ারা এসেছে তাকেই সে চোর বলে সন্দেহ করে, কারণ সে আসবার পর থেকেই চুরি আরম্ভ হয়েছে।

 আমরা সবাই সেদিন থেকে তার উপর চোখ রাখতে শুরু করলাম। কিন্তু দুদিন না যেতেই আবার চুরি। পাগলা দাশু বেচারা বাড়ি থেকে মাংসের চপ এনে টিফিন ঘরের বেঞ্চের তলায় লুকিয়ে রেখেছিল, কে, এসে তার আধখানা খেয়ে বাকিটুকু ধুলোয় ফেলে নষ্ট করে দিয়েছে। পাগলা তখন রাগের চোটে চীৎকার করে, গাল দিয়ে ইস্কুলবাড়ি মাথায় করে তুলল। আমরা সবাই বললাম, “আরে চুপ চুপ, অত চেঁচাস নে। তা হলে চোর ধরা পড়বে কি করে?” কিন্তু পাগলা কি সে কথা শোনে? তখন জলধর তাকে বুঝিয়ে বলল, “আর দুদিন সবুর কর, ঐ নতুন ছোকরাটাকে আমি হাতে হাতে ধরিয়ে দিচ্ছি—এ-সমস্ত ওরই কারসাজি।” শুনে দাশু বলল, “তোমার যেমন বুদ্ধি। ওরা হল পশ্চিমা ব্রাহ্মণ, ওরা আবার মাংস খায় নাকি? দরোয়ানজিকে জিজ্ঞাসা কর তো?” সত্যিই তো। আমাদের তো সে খেয়াল হয় নি। ও ছোকরা তো কতদিন রুটি পাকিয়ে খায়, কই, একদিনও তো ওকে মাছমাংস খেতে দেখি না। দাশু পাগলা হোক আর যাই হোক, তার কথাটা সবাইকে মানতে হল।  জলধর কিন্তু অপ্রস্তুত হবার ছেলেই নয়। সে একগাল হেসে বলল, “আমি ইচ্ছে করে তোদের ভুল বুঝিয়েছিলাম। আরে, চোরকে না ধরা পর্যন্ত কি কিছু বলতে আছে—কোনো পাকা ডিটেক্‌টিভ ওরকম করে না। আমি মনে মনে যাকে চোর বলে ধরেছি, সে আমিই জানি।”

 তার পর কদিন আমরা খুব হুঁশিয়ার ছিলাম; আট-দশ দিন আর চুরি হয় নি। তখন জলধর বললে, “তোমরা গোলমাল করেই তো, সব মাটি করলে। চোরটা টের পেয়ে গেল যে আমি তার পেছনে লেগেছি। আর কি সে চুরি করতে সাহস পায়? তবু, ভাগ্যিস তোমাদের কাছে আসল নামটা ফাঁস করি নি।” কিন্তু সেইদিনই আবার শোনা গেল স্বয়ং হেডমাস্টার মহাশয়ের ঘর থেকে তার টিফিনের খাবার চুরি হয়ে গেছে। আমরা বললাম, “কই, হে? চোর না তোমার ভয়ে চুরি করতে পারছিল না? তার ভয় যে ঘুচে গেল দেখছি।”

 তার পর দুদিন ধরে জলধরের মুখে আর হাসি দেখা গেল না। চোরের ভাবনা ভেবে ভেবে তার পড়াশুনা সব এমনি ঘুলিয়ে গেল যে পণ্ডিতমশায়ের ক্লাশে সে আরেকটু হলেই মার খেত আর কি। দুদিন পরে সে আমাদের সকলকে ডেকে একত্র করল আর বলল তার চোর ধরবার বন্দোবস্ত সব ঠিক হয়েছে। টিফিনের সময়ে সে একটা ঠোঙায় করে সরভাজা, লুচি আর আলুর দম রেখে চলে আসবে। তার পর কেউ যেন সেদিকে না যায়। ইস্কুলের বাইরে যে জিমন্যাস্টিকের ঘর আছে সেখান থেকে লুকিয়ে টিফিনের ঘরটা দেখা যায়। আমরা কয়েকজন বাড়ি যাবার ভান করে সেখানে থাকব। আর কয়েকজন থাকবে উঠোনের পশ্চিম কোণের ছোটো ঘরটাতে। সুতরাং চোর যেদিক থেকেই আসুক, টিফিন ঘরে ঢুকতে গেলেই তাকে দেখা যাবে।

 সেদিন টিফিনের পর পর্যন্ত কারও আর পড়ায় মন বসে না। সবাই ভাবছে কতক্ষণে ছুটি হবে আর চোর কতক্ষণে ধরা পড়বে। চোর ধরা পড়লে তাকে নিয়ে কি করা যাবে সে বিষয়েও কথাবার্তা হতে লাগল। মাস্টারমহাশয় বিরক্ত হয়ে ধমক দিতে লাগলেন, পরেশ আর বিশ্বনাথকে বেঞ্চির উপর দাঁড়াতে হল—কিন্তু সময়টা যেন কাটতেই চায় না। টিফিনের ছুটি হতেই জলধর তার খাবারের ঠোঙাটি টিফিন ঘরে রেখে এল। জলধর, আমি অর দশ-বারোজন উঠোনের কোণের ঘরে রইলাম আর একদল ছেলে বাইরে জিমন্যাটিকের ঘরে লুকিয়ে থাকল। জলধর বলল, “দেখ, চোরটা যেরকম সেয়ানা দেখছি। আর তার যেরকম সাহস, তাকে মারধর করা ঠিক হবে না। লোকটা নিশ্চয়ই খুব ষণ্ডা হবে। আমি বলি সে যদি এদিকে আসে তা হলে সবাই মিলে তার গায়ে কালি ছিটিয়ে দেব আর চেঁচিয়ে উঠব। তা হলে দরোয়ান-টরোয়ান সব ছুটে আসবে। আর লোকটা পালাতে গেলেও ঐ কালির চিহ্ন দেখে ঠিক ধরা যাবে। আমাদের রামপদ বলে উঠল, “কেন? সে যে খুব ষণ্ডা হবে তার মানে কি? সে তো কিছু রাক্ষসের মতো খায় বলে মনে হয় না। যা র করে নিচ্ছে—সে তো কোনোদিনই খুব বেশি নয়।” জলধর বলল, “তুমিও যেমন পণ্ডিত। রাক্ষসের মতো খুব খানিকটা খেলেই বুঝি খুব ষণ্ডা হয়। তা হলে তো আমাদের শ্যামাদাসকেই সকলের চেয়ে ষণ্ডা বলতে হয়। সেদিন ঘোষেদের নেমন্তন্নে ওর খাওয়া দেখেছিলে তো! বাপু হে, আমি যা বলেছি তার ওপর ফোড়ন দিতে যেয়ো না। আর তোমার যদি নেহাত বেশি সাহস থাকে, তুমি গিয়ে চোরের সঙ্গে লড়াই কোরো। আমরা কেউ তাতে আপত্তি করব না। আমি জানি, এ-সমস্ত নেহাত যেমন-তেমন চোরের সাধ্য নয়—আমার খুব বিশ্বাস, যে লোকটা আমাদের বাড়িতে চুরি করেছিল, এ-সব তারই কাণ্ড!”

 এমন সময়ে হঠাৎ টিফিন ঘরের বাঁদিকের জানলাটা খানিকটা ফাঁক হয়ে গেল, যেন কেউ ভেতর থেকে ঠেলছে। তার পরেই সাদা মতন কি—একটা ঝুপ করে উঠোনের মধ্যে লাফিয়ে পড়ল। আমরা চেয়ে দেখলাম একটা মোটা হুলো বেড়াল, তার মুখে জলধরের সরভাজা। তখন যদি জলধরের মুখখানা দেখতে, সে এক বিঘৎ উঁচু হাঁ করে উঠোনের দিকে তাকিয়ে রইল। আমরা জিজ্ঞাসা করলাম, “কেমন হে ডিটেক্‌টিভ। ঐ ষণ্ডা চোরটাই তো তোমার বাড়িতে চুরি করেছিল? তা হলে এখন ওকেই পুলিসে দেই?”

সন্দেশ-কার্তিক, ১৩২৪