সুকুমার রায় সমগ্র রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড)/ইস্কুলের গল্প/পালোয়ান

উইকিসংকলন থেকে
পুণ্যলতা চক্রবর্তী, কল্যাণী কার্লেকর সম্পাদিত
(পৃ. ১১৬-১১৯)
পালোয়ান


 তাহার আসল নামটি যে কি ছিল, তাহা ভুলিয়াই গিয়াছি—কারণ আমরা সকলেই তাহাকে 'পালোয়ান' বলিয়া ডাকিতাম। এমন-কি, মাস্টারমহাশয়রা পর্যন্ত তাহাকে ‘পালোয়ান’ বলিতেন। কবে কেমন করিয়া তাহার এরূপ নামকরণ হইল, তাহা মনে নাই। কিন্তু নামটি যে তাহাকে বেশ মানাইয়াছিল, এ কথা স্কুলসুদ্ধ সকলেই একবাক্যে স্বীকার করিত।

 প্রথমত, তাহার চেহারাটি ছিল একটু অতিরিক্ত রকমের হৃষ্টপুষ্ট। মোটাসোটা হাত-পা, ব্যাঙের মতো গোব্‌দা গলা—তাহার উপরেই গোলার মতো মাথাটি—যেন ঘাড়ে পিঠে এক হইয়া গিয়াছে। তার উপর সে কলিকাতায় গিয়া স্বচক্ষে কাল্লু ও করিমের লড়াই দেখিয়া আসিয়াছিল, এবং বড়ো-বড়ো কুস্তির এমন আশ্চর্যরকম বর্ণনা দিতে পারিত যে শুনিতে শুনতে আমাদেরই রক্ত গরম হইয়া উঠিত। এক-একদিন উৎসাহের চোটে আমরাও তাল ঠুকিয়া স্কুলের উঠানে কুস্তি বাধাইয়া দিতাম। পালোয়ন তখন পাশে দাঁড়াইয়া নানারকম অঙ্গভঙ্গি করিয়া আমাদের প্যাঁচ ও কায়দা বাতলাইয়া দিত। মাখনলাল আমার চাইতে আড়াই বছরের ছোটো, কিন্তু পালোয়ানের কাছে ‘ল্যাংমুচ্‌কির’ প্যাঁচ শিখিয়া সে যেদিন আমায় চিৎপাত করিয়া ফেলিল, সেইদিন হইতে সকলেরই এই বিশ্বাস পাকা হইল যে, পালোয়ান ছোকরাটা আর কিছু না বুঝুক কুস্তিটা বেশ বোঝে।

 ঘোষেদের পাঠশালার ছাত্রগুলা বেজায় ডানপিটে। খামখা এক-একদিন আমাদের সঙ্গে গায়ে পড়িয়া তাহারা ঝগড়া বাধাইত। মনে আছে, একদিন ছুটির পরে আমি আর পাঁচ-সাতটি ছেলের সঙ্গে গোঁসাইবাড়ির পাশ দিয়া আসিতেছিলাম, এমন সময় দেখি পাঠশালার চারটা ছোকরা তেল মারিয়া আম পাড়িতেছে। একটা ঢিল আরেকটু হইলেই আমার গায়ে পড়িত। আমরা দলে ভারি ছিলাম, সেই সাহসে আমাদের একজন ধমক দিয়া উঠিল, “এইও, বেয়াদব! মানুষ চোখে দেখিস নে?” ছোছকরাদের এমনি আস্পর্ধা, একজন অমনি বলিয়া উঠিল, “হাঁ, মানুষ দেখি, বাঁদরও দেখি।” শুনিয়া সব কটায় অসভ্যের মতো হো হো করিয়া হাসিতে লাগিল। আমার তখন ভয়ানক রাগ হইল, আমি অস্তিন গুটাইয়া বলিলাম, “পরেশ! দে তো আচ্ছা করে ঘা দুচ্চার কষিয়ে।” পরেশও দমবার পাত্র নয়, সে হুংকার দিয়া বলিল, “গুপে, আন তো ঐ ছোকরাটার কানে ধরে।” গোপীকেষ্ট বলিল,—“আমার হাতে বই আছে-ওরে ভুতো, তুই ধর দেখি একবার চেপে-”। ভুতোর বাড়ি বাঙাল দেশে—তার মেজাজটি যখন মাত্রায় চড়ে তখন তার কাণ্ডাকাণ্ড জ্ঞান থাকে না—সে একটা ছোকরার কানে প্রকাণ্ড এক কিল বসাইয়া দিল। কিল খাইয়াই সে হতভাগা একেবারে “গোব্‌রা দা” বলিয়া চীৎকার দিয়া উঠিল, আর সঙ্গে সঙ্গে বাকি তিনজনও “গোব্‌রা দা, গোব্‌রা দা” বলিয়া এমন একটা হৈ চৈ রব তুলিল, যে আমরা ব্যাপারটা কিছুমাত্র বুঝিতে না পারিয়া একেবারে হতভম্ব হইয়া রহিলাম। এমন সময় একটা কুচকুচে কালো মুতি হঠাৎ কোথা হইতে আসিয়া দেখা দিল। আসিয়াই আর কথাবার্তা না বলিয়া ভুতোর ঘাড়ে ধাক্কা মারিয়া, গুপের কান মুলিয়া, আমার গালে খামখা ঠাস্ ঠাস্ করিয়া দুই চড় লাগাইয়া দিল। তার পর কাহার কি হইল আমি খবর রাখিতে পারি নাই। মোট কথা, সেদিন আমাদের যতটা অপমানবোধ হইয়াছিল, ভয় হইয়াছিল তাহার চাইতেও বেশি। সেই হইতে গোব্‌রার নাম শুনিলেই ভয়ে আমাদের মুখ শুকাইয়া আসিত॥

পালোয়নের কেরামতির পরিচয় পাইয়া আমাদের মনে ভরসা আসিল। আমরা ভাবিলাম, এবার যেদিন পাঠশালার ছেলেগুলা আমাদের ভ্যাংচাইতে আসিবে, তখন আমরাও আরো বেশি করিয়া ভ্যাংচাইতে ছাড়িব না। পালোয়ানও এ কথায় খুব উৎসাহ প্রকাশ করিল। কিন্তু অনেকদিন অপেক্ষা করিয়াও যখন তাহাদের ঝগড়া বাধাইবার আর কোনো মতলব দেখা গেল না, তখন আমাদের মনটা খুঁৎখুঁৎ করিতে লাগিল। আমরা বলিতে লাগিলাম, “ওরা নিশ্চয়ই পালোয়ানের কথা শুনতে পেয়েছে।” পালোয়ান বলিল, “ঁহ্যা, তাই হবে। দেখছ না, এখন আর বাছাদের টুঁ শব্দটি নেই।” তখন সবাই মিলিয়া স্থির করিলাম যে পালোয়ানকে সঙ্গে লইয়া গোব্‌রার দলের সঙ্গে ভালোরকম বোঝাপড়া করিতে হইবে।

শনিবার দুইটার সময় স্কুল ছুটি হইয়াছে, এমন সময়ে কে যেন আসিয়া খবর দিল যে গোব্‌রা চার-পাঁচটি ছেলেকে সঙ্গে লইয়া পুকুরপাড়ে বসিয়া গল্প করিতেছে। যেমন শোনা অমনি দলেবলে হৈ হৈ করিতে করিতে সেখানে হাজির। আমাদের ভাবখানা দেখিয়াই বোধ হয় তাহারা বুঝিয়াছিল যে, আমরা কেবল বন্ধুভাবে আলাপ করিতে আসি নাই। তাহারা শশব্যস্ত হইয়া উঠিতে না উঠিতেই আমরা তিন-চারজনে মিলিয়া গোব্‌রাকে একেবারে চাপিয়া ধরিলাম। সকলেই ভাবিলাম, এ যাত্রায় গোব্‌রার আর রক্ষা নাই। কিন্তু আহাম্মক রামপদটা একেবারে সব মাটি করিয়া দিল। সে বোকারাম ছাতা হাতে হাঁ করিয়া তামাশা দেখিতেছিল। এমন সময় পাঠশালার একটা ছোকরা এক থাবড়া মারিয়া তাহার ছাতাটা কাড়িয়া লইল। আমরা ততক্ষণে গোরাচাঁদকে প্রায় চিৎপাত করিয়া আনিয়াছি, এমন সময় হঠাৎ আমাদের ঘাড়ে পিঠে ডাইনে বাঁয়ে ধপাধপ ছাতার বৃষ্টি শুরু হইল। আমরা মুহুর্তের মধ্যে একেবারে ছত্রভঙ্গ হইয়া পড়িলাম, আর সেই ফাঁকে গোব্‌রাও একলাফে গা ঝাড়া দিয়া উঠিল। তাহার পর চক্ষের নিমেষে তাহারা আমাদের চার-পাঁচজনকে ধরিয়া পুকুরের জন্মে ভালোরকমে চুবাইয়া রীতিমতো নাকাল করিয়া ছাড়িয়া দিল। এই বিপদের সময় আমাদের দলের আর সকলে কে যে কোথায় পলাইল, তাহার আর কিনারাই করা গেল না। সবচাইতে আশ্চর্য এই যে, ইহার মধ্যে পালোয়ান যে কখম নিরুদ্দেশ হইল—তাহাকে ডাকিয়া ডাকিয়া আমাদের গলা ফাটিয়া গেল, তবু তাহার সাড়া পাইলাম না । সোমবার স্কুলে আসিয়াই আমরা হা হা করিয়া পালোয়ানকে ঘিরিয়া ফেলিলাম, কিন্তু সে যে কিছুমাত্র লজ্জিত হইয়াছে, তাহাকে দেখিয়া এমন বোধ হইল না । সে খুব বোলচাল দিয়া লম্বা বক্তৃতা করিয়া বলিল, “তোরা যে এমন আনাড়ি, তা জানলে কি আমি তোদের সঙ্গে যাই ? আচ্ছা, গোবরা যখন তোর টুটি চেপে ধরল, তখন আমি যে ডানপটকান দে’ বলে এত চেচালাম-কই, তুই তো তার কিছুই করলি না । আর ঐ গুপেটা, ওকে আমি এতবার বলেছি যে ল্যাংমুচকি মারতে হলে পালটা রোখ সামলে চলিস—তা তো ও শুনবে না । এরকম করলে আমি কি করব বল ? ও-সব দেখে আমার একেবারে ঘেন্না ধরে গেল—তাই বিরক্ত হয়ে চলে এলুম। তার পর ভুতোটা, ওটা কি করল বল দেখি । আরে, দেখছিস যখন দোরোখা প্যাচ মারছে, তখন বাপু আহ্লাদ করে কাত হয়ে পড়তে গেলি কেন ?” ভূতো এতক্ষণ কিছু বলে নাই, কিন্তু পালোয়ানের এই টিপপনি কাটা-ঘায়ে নুনের ছিটার মতো তাহার মেজাজের উপর ছ্যাক করিয়া লাগিল । সে গলায় বাঁকড়া দিয়া মুখভঙ্গি করিয়া বলিল, “তুমি বাপু কানকাটা কুকুরের মতো পলাইছিলা ক্যান ?" সর্বনাশ ! পালোয়ানকে ‘কানকাটা কুকুর’ বলা । আমরা ভাবিলাম, "দেখ, বাঙাল মরে বুঝি এবার P পালোয়ান খুব গম্ভীর হইয়া বলিল, “দেখ বাঙাল ! বেশি চালাকি করিস তো চরকি প্যাচ লাগিয়ে একেবারে তুকি নাচন নাচিয়ে দেব ।” ভুতো বলিল, “তুমি নাচলে বান্দর নাচবা।” রাগে পালোয়ানের মুখ চোখ লাল হইয়া উঠিল। সে বেঞ্চি ডিঙাইয়া একেবারে বাঙালের ঘাড়ে গিয়া পড়িল । তার পর দুইজনে কেবল হুড়াহুড়ি আর গড়াগড়ি । আশ্চর্য এই, পালোয়ান এত যে কায়দা আর এত যে প্যাচ আমাদের উপর খাটাইত, নিজের বেলায় তার একটিও তাহার কাজে আসিল না। ঠিক আমাদেরই মতো হাত-পা ছুড়িয়া ,সে খামচাখামচি করিতে লাগিল । তার পর বাঙাল, যখন তাহার বুকের উপর চড়িয়া দুই হাতে তাহার টুটি চাপিয়া ধরিল, $ఏly সুকুমার সমগ্র রচনাবলী । ৭ তখন আমরা সকলে মিলিয়া দুজনকে ছাড়াইয়া দিলাম। পালোয়ান হাঁপাইতে হাঁপাইতে বেঞ্চে বসিয়া ঘাম মুছিতে লাগিল। তার পর গম্ভীরভাবে বলিল, “ছেলেবেলায় এই ডানহাতের কব্জিটা জখম হয়েছিল-তাই বড়ো-বড়ো প্যাঁচগুলো দিতে ভরসা হয় না-কি জানি হাতটা যদি আবার মচ্‌কে ফচ্‌কে যায়। তা নইলে ওকে একবার দেখে নিতুম।” ভুতো এ কথার কোনো উত্তর না দিয়া, তাহার নাকের সামনে একবার বেশ করিয়া 'কাঁচকলা’ দেখাইয়া লইল।

 ভুতো ছেলেটি দেখিতে যেমন রোগা এবং বেঁটে, তার হাত-পাগুলিও তেমনি লট্‌খটে, সুতরাং পালোয়নের পালোয়ানি সম্বন্ধে অনেকের যে আশ্চর্য ধারণা ছিল, সেইদিনই তাহা ঘুচিয়া গেল। কিন্তু পালোয়ান নামটি আর কিছুতেই ঘুচিল না। সেটি শেষপর্যন্ত টিকিয়া ছিল।

সন্দেশ-আষাঢ়, ১৩২৪