সুকুমার রায় সমগ্র রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড)/জীবজন্তর কথা/কুমিরের জাতভাই

উইকিসংকলন থেকে
কুমিরের জাতভাই

 টিকটিকি, গিরগিটি, বহুরূপী, তক্ষক, গোসাপ এরা সকলে হলেন কুমিরের জ্ঞাতিবর্গ। পৃথিবীর যে কোনো দেশে যাও, এঁদের কোনো-না-কোনোটির সাক্ষাৎ পাবেই। কিন্তু সাক্ষাৎ পেলেই যে সবসময়ে তাদের চিনতে পারবে, তা মনে কোরো না। অস্ট্রেলিয়ার সেই কাঁটাওয়ালা ভীষণমূর্তি জানোয়ার যে নিতান্ত নিরীহ গিরগিটি মাত্র, এ কথা আগে থেকে না জানলে কি কেউ বুঝতে পারবে? কেবল চেহারা দেখে যদি এর সম্বন্ধে কোনো মতামত দিতে হয়, তা হলে অনেকেই হয়তো বেচারির উপর অবিচার করবে। সমস্ত শরীরটি এর অস্ত্রে আর বর্মে ঢাকা, কিন্তু মেজাজটি যারপরনাই ঠাণ্ডা। দুপুরের রোদে শুকনো বালির উপর এরা পড়ে থাকে, ভয় পেলে তাড়াতাড়ি বালির মধ্যে ঢুকে যায়। অন্য জন্তুর অনিষ্ট করা দূরে থাকুক, সামান্য একটা পাখি দেখলেই এরা পালাবার জন্য ব্যস্ত হয়। এদের প্রধান খাদ্য পিঁপড়ে। সবচাইতে আশ্চর্য এই যে এক বাটি জলের মধ্যে যদি এই গিরগিটি ছেড়ে দাও, তবে দেখতে দেখতে এর গায়ের চামড়া সমস্ত জলে শুষে নেবে। শুকনো বালিতে থাকে কিনা, সবসময়ে তো স্নানের সুবিধা হয় না, তাই একবার স্নান করলেই সে অনেকদিনের মতো জল বোঝাই করে নেয়।

 এক সবুজ রঙের জন্তু রয়েছে-মাদাগাস্কারের টিকটিকি। এর বিশেষত্বের মধ্যে পায়ের আঙুলগুলি আর গায়ে রঙের বাহার তা ছাড়া রয়েছে বহুরূপী। বহুরূপীর গুণের কথা তোমরা সকলেই জান। তার সমস্ত গায়ের রঙ সে চটপট বদলাতে পারে। চোখে চেয়ে দেখছ তার দিব্যি ঘাসের মতো সবুজ রঙ, হয়তো এক মিনিট বাদেই দেখবে ফ্যাকাশে। তার পর ঘুরে এসে দেখ শুকনো পাতার রঙ কিম্বা সীসার মতো ময়লা। বহুরূপীর চালচলন ভারি অদ্ভুত। এক পা নড়তে হলে অতি সাবধানে ধীরে ধীরে সে পা ফেলে। হয়তো একটা পা অর্ধেকখানা তুলে পাঁচমিনিট চুপ করেই রইল। দেখে মনে হয় যেন পা ফেলবে কি না ফেলবে এর জন্যে তার কত হিসাব আর ভাবনাচিন্তা করতে হচ্ছে। এক সময়ে লোকের বিশ্বাস ছিল—অন্তত বিলাতে শিক্ষিত লোকেও এ কথা বিশ্বাস করত যে বহুরূপীরা শুধু হাওয়া খেয়ে থাকে। এরকম বিশ্বাসের কারণ এই যে, বহুরূপী একে তো খায় খুবই কম, তার উপর খাওয়া কাজটি তার চক্ষের নিমেষে এমন চট্‌পট্ শেষ হয়ে যায় যে, একটু ঠাওর করে না দেখলে অনেক সময় বোঝাই যায় না। যতটুকু প্রাণী, জিভটি প্রায় ততখানি লম্বা; সেই জিভটি তীরের মতো ছিটকিয়ে পোকামাকড়ের উপরে পড়ে আর পরক্ষণেই টপ করে মুখের ভিতর ফিরে যায়। এর মধ্যে যে শিকার ধরা, শিকার মারা এবং খাওয়া, এই তিন কাজ শেষ হয়ে গেছে—সেটা বুঝতে অনেক সময় দেরি লাগে।

 বহুরূপীর আর-একটি অদ্ভুত জিনিস তার চোখ দুটি। বড়ো-বড়ো চোখ দুটি এমনভাবে তৈরি যে একবার চোখ পাকালেই উপর নীচ ডাইনে বাঁয়ে ডাঙা এবং আকাশের প্রায় সব খানিই বেশ দেখে নিতে পারে। তার উপর দুইটা চোখ একেবারে আলগাভাবে গাঁথা। একটা যখন সামনের দিকে স্থিরভাবে তাকিয়ে আছে, আর-একটা হয়তো ততক্ষণ চারিদিক ঘুরে ঘুরে ঘরবাড়ি গাছপালা সব তদ্‌বির করছে।

 আর আছে বৃদ্ধ জরদ্গবের মতো এক জন্ত-আমেরিকার গেছো-গিরগিটি। গিরগিটি বললাম বটে কিন্তু গোসাপ বললেও চলত, কারণ এর এক-একটি নাকি প্রায় সাড়ে তিন হাত পর্যন্ত লম্বা হতে দেখা গিয়েছে। গলায় গলকম্বল, পিঠে সাংঘাতিক কাঁটা, তার উপর কোনো কোনোটার গায়ে মাথায় বড়ো-বড়ো আঁচিল, তাতে চেহারাটা কেমন কিম্ভুতকিমাকার হয় তা সহজেই কল্পনা করতে পার।

 খাঁটি গোসাপ-জাতীয় জন্তু আফ্রিকা, দক্ষিণ এশিয়া এবং অস্ট্রেলিয়ার প্রায় সব জায়গাতেই পাওয়া যায়। 'হিংস্র’ বলতে যা বোঝায় গোসাপেরা ঠিক তা নয় কিন্তু একবার গো ধরলে সেও ভয়ানক হয়ে উঠতে পারে। আমাদের দেশে কথায় বলে 'কচ্ছপের কামড়', সাহেবেরা বলেন ‘বুলডগের কামড়'—কিন্তু গোসাপ ক্ষেপলে পরে তার কামড় ছাড়ানোও বড় কম শক্ত নয়। হঠাৎ দেখলে মনে হতে পারে যে, গিরগিটিটাকে খুব বড়ো করতে পারলেই বুঝি ঠিক গোসাপ হয়ে দাঁড়াবে, কিন্তু বাস্তবিক গিরগিটি আর গোসাপের গড়নে কিছু তফাত আছে। গোসাপের ঘাড়টা অনেকটা লম্বা গোছের, আর তার জিভটা সাপের মতো চেরা, চলতে ফিরতে লকলক করে। গোসাপেরা আমিষ-খোর, সাপ, টিকটিকি, ইঁদুর, ব্যাঙ, পাখি, এই-সব খেয়ে থাকে-তাদের বিশেষ প্রিয় খাদ্য নাকি কুমিরের ডিম। আমাদের দেশে গোসাপ ডাঙায়ও থাকে জলেও নামে, তাই সাঁতারের সবিধার জন্য তাদের ল্যাজগুলি চ্যাটাল হয়। যে-সব গোসাপ কেবল শুকনো ডাঙায় বা গাছে থাকে, তাদের ল্যাজ হয় চাবুকের মতো গোল।

 আরেকরকমের জন্তু রয়েছে যার গায়ে চক্র চক্র দাগ, সেটি হচ্ছে মেক্সিকোর ‘বীভৎস গিলা’ (gila monster) বা বিষধর গিরগিটি। ছোটো ছোটো পা, তাতে শরীরটা মাটি থেকে আলগাই হয় না—তাকে সাপের মতো এঁকে বেঁকে মাটি ঘষে চলতে হয়। ছোট্টো দুটি চোখ, মুখভরা দাগের মধ্যে চট করে তাকে খুঁজে পাওয়াই মুশকিল। দুম্বা ভেড়ার মতো ল্যাজটি চর্বিতে ভরা। যখন খাবার জোটে না, তখন ঐ ল্যাজটা শুকিয়ে আসে, ল্যাজের চর্বি সমস্ত শরীরে শুষে গিয়ে শরীরটাকে তাজা রাখে। কিন্তু আসল দেখবার জিনিসটা ওর মুখের মধ্যে। সেখানে যদি খোঁজ করো তবে দেখবে, ঠিক সাপের মতো তার বিষদাঁত রয়েছে। সে বিষে ছোটোখাটো জন্তু বা পাখি তো মরেই, মানুষ পর্যন্ত মারা গেছে বলে শোনা যায়।  একরকমের অদ্ভুত গিরগিটি আছে যে মনে হয় রাগে একেবারে ফুলে উঠেছে। তার গলায় যে রঙিন ছাতার মতো রয়েছে, সেটা অন্য সময়ে গুটিয়ে গলার চার দিকে পর্দার মতো ঝুলানো থাকে, কিন্তু ভয় বা রাগের সময় খাড়া হয়ে ছাতার মতো ছড়িয়ে পড়ে। তখন তার মুখের চেহারাটিও ভয়ানক হয়ে ওঠে। লাল ছাতার নীচে আগুনের মতো চোখ, তার উপর ঐরকম ধারালো দাঁত আর টকটকে জিভ—আর সেই সঙ্গে ফোঁস্ ফোস্ শব্দ করে লাফিয়ে ওঠা—এতে বাস্তবিক ভয় হবারই কথা। এই গিরগিটি দু পায়ে ভর দিয়ে খাড়া হয়ে বেশ রীতিমতো ছুটতে পারে। স্যাজসুদ্ধ এক-একটা প্রায় দু হাত পর্যন্ত লম্বা হয়। এই জন্তুর বাড়ি অস্ট্রেলিয়ায়।

 মালয়দেশে এবং ফিলিপাইন দ্বীপে আর-এক-রকম গিরগিটি আছে, তাকে ‘উড়ুক্কু গিরগিটি' বলা যেতে পারে। এদের পাঁজরের কয়েকখানা হাড় বুকের চামড়া ফুটো করে দু পাশে বেরিয়ে থাকে, সেগুলো পাতলা পর্দার মতো চামড়া দিয়ে ঢাকা। পর্দাটাকে পাখার মতো ছড়িয়ে এরা এক গাছ থেকে আর-এক গাছ পর্যন্ত স্বচ্ছন্দে উড়ে যায়। ছোটোখাটো পোকা বা ফড়িং গাছের কাছ দিয়ে গেলে এরা চট্ করে তাদের উপর উড়ে পড়ে। এ ওড়া অবশ্য পাখির মতো ওড়া নয়, কারণ এরা রীতিমতো বাতাস ঠেলে উড়তে পারে না-লাফিয়ে বাতাসে ভর করে খানিকটা ভেসে যায় মাত্র। এরা থাকে বড়ো-বড়ো গাছের আগায়, কচিৎ কখনো নীচে নামে। এক গাছ থেকে আর-এক গাছে যেতে হলে এরা শূন্য দিয়েই যাতায়াত করে। এপর্যন্ত প্রায় কুড়িরকমের উড়ুক্কু গিরগিটি পাওয়া গিয়াছে—তাদের সবগুলোরই রঙ অতি চমৎকার-কোনো ফুল বা প্রজাপতির রঙও তার চাইতে সুন্দর বা উজ্জ্বল হয় না। সমস্ত গায়ে যেন রামধনুর নকশা করা। এরাও কিন্তু বেশ রাগতে জানে, আর রাগলে পরে এদের গলাটি ফুলে তাতে নীল লাল নানারকম রঙের খেলা দেখা যায়।

 এ ছাড়াও আরো কতরকমের গিরগিটি আছে, তাদের কথা বলবার আর জায়গা নেই। দাড়িওয়ালা গিরগিটি, শিংওয়ালা গিরগিটি, সাপের মতো গিরগিটি, মাছের মতো গিরগিটি, কত যে তাদের রকমারি তার আর অন্ত নেই। একটা আছে, তার কোন দিকটা ল্যাজ আর কোন দিকটা মাথা হঠাৎ দেখলে বোঝাই যায় না। আর-একটার হাত-পাগুলো লম্বা লম্বা কাঠির মতো। ল্যাজটা গোড়ায় সরু মাঝখানে মোটা আবার আগায় ছুঁচাল—ঠিক যেন কাঁচা লঙ্কাটি। এদের অনেকে আবার রঙ বদলাতে জানে-কউ কেউ এ বিষয়ে বহুরূপীর চাইতেও ওস্তাদ। কেউ ডিম পাড়ে, কারও-বা একেবারে ছানা হয়। আবার কেউবা এমন ঠু্ন্‌কো যে, ধরামাত্র তার হাড়গোড় ভেঙে যায়।

সঙ্গেশ-অগ্রহায়ণ, ১৩২৪