সুকুমার রায় সমগ্র রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড)/জীবজন্তর কথা/গোখুরো শিকার

উইকিসংকলন থেকে
গোখুরো শিকার

 এক সাহেবের আস্তাবলে ইঁদুরে বাসা বেঁধেছিল। তারা অস্তাবলের মেজের নীচে গর্ত খুঁড়ে খুঁড়ে একেবারে ঝাঁঝরার মতো করে ফেলেছিল। ইঁদুরের উৎপাতে সবাই ব্যতিব্যস্ত। কতদিন কল পেতে কত ইঁদুর ধরা পড়ল, তবু ইঁদুর আর ফুরায় না। তখন সাহেব ভাবলেন ইদুর মরিবার বিষবড়ি না বানালে আর চলছে না। কিন্তু তার পরেই হঠাৎ একদিন দেখা গেল, আস্তাবলের সব ইঁদুর কোথায় পালিয়েছে। সবাই বলল, “ব্যাপারখানা কি?” দুদিন না যেতেই বোঝা গেল, ব্যাপার বড়ো গুরুতর-ইঁদুরের গর্তে প্রকাণ্ড দুই গোখরো সাপ এসে আশ্রয় নিয়েছে। আস্তাবলে মহা হুলস্থুল পড়ে গেল, সহিস কোচম্যান সব চলতে ফিরতে সাবধানে থাকে, রাত্রে গাড়ি জুততে হলে লোকজন, লাঠি, মশাল নানারকম হাঙ্গামার দরকার হয়, তা নইলে কেউ ঘরে ঢুকতেই চায় না। সাহেব দেখলেন মহা মুশকিল, এর চাইতে ইদুরই ছিল ভালো।

 সাহেবের যে চাপরাসী, সে লোকটি ভারি সেয়ানা-সে বললে, “হুজুর, আমি সাপ তাড়াবার ফন্দি জানি। আমায় চার-আনা পয়সা দিন, আমি এখনি তার সরঞ্জাম কিনে আনছি।” পরের দিন চাপরাসী সেই চার-অনার সরঞ্জাম নিয়ে হাজির-একটা বঁড়শি আর ছিপ আর একটা ঠোঙার মধ্যে জ্যান্ত ব্যাঙ। দেখে সবাই হাসতে লাগল আর চাপরাসীকে ঠাট্টা। করতে লাগল। সাহেব বললেন, “বেয়াকুফ। তোকে সাপ মারতে বললাম, আর তুই মাছ ধরবার সরঞ্জাম এনে হাজির করলি?” চাপরাসী সে-সব কথায় কান না দিয়ে ব্যাঙটাকে বঁড়শিতে গেঁথে আস্তাবলের দিকে চলল। তামাশা দেখবার জন্য সবাই তার পিছন পিছন চলল। তার পর সেই ছিপে-গাথা ব্যাঙটাকে গর্তের মধ্যে ছেড়ে দিয়ে চাপরাসী শক্ত করে ছিপের গোড়ায় ধরে বসে রইল। খানিক পরে ছিপে টান পড়তেই অমনি সবাই ব্যস্ত হয়ে উঠল। আর চাপরাসী সেই আধ-গেলা ব্যাঙসুদ্ধ একটা প্রকাণ্ড সাপকে গর্তের মধ্যে থেকে হিড়হিড় করে টেনে বার করল। সাপেরা যখন খায় তখন ক্রমাগত গিলতেই থাকে, যা একবার গলায় ঢোকে তাকে আর ঠেলে বার করতে পারে না। কাজেই ছিপের অগীয় বঁড়শি, বঁড়শিতে গাঁথা ব্যাঙ আর ব্যাঙের সঙ্গে সাপ। এমনি করে গোখরোমশাই চার-অনার সরঞ্জামে ধরা পড়লেন। তার পর লাঠিপেটা করে তাকে সাবাড় করতে কতক্ষণ?

 একটা সাপ মারা পড়তেই আরেকটাকে ধরবার জন্য সকলের ভারি উৎসাহ দেখা গেল। কিন্তু একদিন দুদিন করে এক সপ্তাহ গেল, তব সাপ আর ধরা দেয় না। সবাই হয়রান হয়ে পড়ল। সাহেব যখন হতাশ হয়ে পড়েছেন, এমন সময় একটা চাকর দৌড়ে এসে খবর দিল সাপ ধরা পড়েছে। সাহেব ছুটে দেখতে গেলেন, গিয়ে দেখেন সাপ তখনো গর্ত থেকে বেরোয় নি। তাপসী ছিপ নিয়ে টানাটানি করছে। তার পর টানতে টানতে ক্রমে সাপের খানিকটা গর্তের বাইরে এসেছে, এমন সম চাপরাসীর টানে ব্যাঙটা তার গলা থেকে পিছলিয়ে বেরিয়ে এল। আর সাপটাও ফোঁস্ ফোঁস করতে করতে ছুটে আস্তাবলের বাইরে চলল। তখন সবাই তার পিছনে ছুটে লাঠি দিয়ে তাকে আচ্ছা করে পিটিয়ে শেষ করল। কিন্তু কি আশ্চর্য লাঠিপেটা করতেই তার পেটের মধ্যে থেকে কতগুলো ব্যাঙ বেরিয়ে পড়ল। তার মধ্যে দুএকটা তখনো বেঁচে ছিল—একটা তো একটু বাদেই লাফিয়ে লাফিয়ে চলতে লাগল। সাহেব তো এ কাণ্ড দেখে একেবারে অবাক। সাপের পেটে গিয়েও যে কোনো জন্তু বেঁচে থাকতে পারে, এটা তাঁর জানাই ছিল না। কিন্তু সাহেবের জানা না থাকলেও এটা কিছু নতুন খবর নয়। আমেরিকার শিংওয়ালা সাপের সম্বন্ধেও এইরকম গল্প শোনা যায়। সেই সাপগুলো এমন পেটুকের মতো খায় যে খাবার পরে আর তাদের নড়বার শক্তি থাকে না, তখন তারা যেখানে সেখানে মড়ার মতো পড়ে থাকে। সেখানকার প্রাচীন 'রেড ইণ্ডিয়ান’ জাতির লোক এই সময়ে তাকে দেখতে পেলে তার মাথায় ডাণ্ডা-পেটা করতে থাকে। তার ফলে অনেক সময়েই তার পেট থেকে অস্ত-গেলা জন্তুগুলো সব বেরিয়ে আসে। তার মধ্যে প্রায়ই দু-একটাকে জ্যান্ত পাওয়া যায়।

 যাহোক, সাহেব তো সাপ মারলেন। কিন্তু তখন আবার দেখা গেল যে, আস্তাবলের মেজের নীচে সাপের ছোটো-ছোটো বাচচায় একেবারে ভরতি হয়ে গেছে। এখন উপায় কি? দুটো সাপ মারতেই এত হাঙ্গামা, তবে এতগুলো যখন বড়ো হবে তখন কি হবে। আবার চাপরাসীর ডাক পড়ল। চাপরাসী বলল, “হুজুর, আমি এরও উপায় জানি।” এবারের উপায়টি আরো আশ্চর্য। এবার প্রকাণ্ড বড়ো-বড়ো কোলা ব্যাঙ এনে আস্তাবলে ছেড়ে দেওয়া হল। তারা মহা ফুর্তি করে পেট ভরে খেয়ে খেয়ে সাপের বংশ সাবাড় করে দিল। সাপকে দিয়ে ব্যাঙ খাইয়ে, তার পর ব্যাঙকে দিয়ে সাপ গেলানো। চমৎকার শিকার না?

সন্দেশ—আশ্বিন, ১৩২৪