সুকুমার রায় সমগ্র রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড)/জীবজন্তর কথা/তিমির ব্যবসা

উইকিসংকলন থেকে
তিমির ব্যবসা

 কথায় বলে ‘ঠেলায় পড়লে বাঘেও ধান খায়’। ১৮৭১ খৃস্টাব্দে জার্মানরা যখন পারিস শহর ঘিরিয়া ফেলিয়াছিল তখন পারিসের লোকেরা খাবারের অভাবে ঘোড়ার মাংস খাইতে বাধ্য হয়। তাহার আগে ইউরোপের লোকে ঘোড়ার মাংস খাইত না। কিন্তু এই সময় হইতে দেখা গেল যে ঘোড়ার মাংসটা খাইতে লাগে মন্দ নয়। এখন শুধু পারিসে নয়, ইউরোপের অন্যান্য বিস্তর শহরেও লোকে শখ করিয়া ঘোড়ার মাংস খাইয়া থাকে। তাহার জন্য আর ঠেলায় পড়িবার দরকার হয় না।

 এখন যে ভীষণ যুদ্ধ চলিতেছে, তাহাতেও খাদ্য-সমস্যা একটা মস্ত সমস্যা। চল্লিশ পঞ্চাশ বা ষাট লক্ষ লোক এক-এক দিকে যুদ্ধ করিতেছে, কেবল তাহাদের খাওয়া জোগাইলেই নিশ্চিন্ত হইবার জো নাই—সমস্ত দেশের লোক কি খাইবে, কি পরিবে, তাহার ভাবনাও প্রত্যেক দেশের শাসনকর্তাদের ভাবিতে হয়। ইউরোপের খাওয়া জোগাইবার ভার এখন অনেক পরিমাণে আমেরিকার উপরে পড়িয়াছে। ইউরোপের লোকেরা মাংস-খোর জাতি, প্রতি বৎসর তাহারা লক্ষ লক্ষ মণ মাংস খাইয়া শেষ করে। এত মাংস চালান দেওয়া কি কম কথা? বিদেশ হইতে জাহাজে করিয়া ইংলণ্ডে যে-সব খাবার জিনিস চালান আসে জার্মান জলদস্যু ডুবুরী জাহাজ সেইগুলিকে নষ্ট করিবার জন্য ঘুরিয়া বেড়ায়। তাহতেও কত খাবার সমুদ্রে ডুবিয়া নষ্ট হয়।

 আমেরিকার বুদ্ধিমান লোকে এই সমস্যার একটা মীমাংসা করিয়াছেন বড়ো চমৎকার। তাঁহারা তিমির মাংস প্রচলিত করিবার চেষ্টা করিতেছেন। ইহার মধ্যেই আমেরিকার নানা স্থানে এই মাংসের ব্যবসায় আরম্ভ হইয়াছে—তিমি ধরিয়া তাহার মাংস চালান দিবার জন্য বড়ো-বড়ো কারখানা বসিয়াছে। তাহার একটিমাত্র কারখানা হইতে বছরে ৯০০০ মণ মাংস টিনে ভরিয়া চালান দেওয়া হয়। নুতন কোনো খাওয়ার অভ্যাস মানুষ সহজে ধরিতে চায় না, সেইজন্য আমেরিকার একদল লোকে বক্তৃতা করিয়া, কাগজেপত্রে লিখিয়া, বায়োস্কোপে ছবি দেখাইয়া এ বিষয়ে মানুষের মনের বিরোধ ভাঙিতেছেন। আমেরিকার কোনো কোনো শহরে প্রকাশ্য বাজারে দশ-আনা সেরে তিমির মাংস বিক্রয় হইতেছে।

 গোরু ঘোড়া শুকর কিছুতেই যাহাদের আপত্তি নাই তাহার যে তিমি খাইতে বেশি দিন আপত্তি করিবে, এরূপ বোধ হয় না। যাঁহারা ইহার মধ্যেই ও জিনিসটা খাইতে অভ্যাস করিয়াছেন, তাহার বলেন—চমৎকার মাংস। ইউরোপের বাজারে ইহাকে গো-মাংস বলিয়া চালাইলেও কেহ কোনো তফাত বুঝিবে কিনা সন্দেহ।

 সবরকম তিমির মাংস খাইতে ভালো নয়। যেগুলি বিশেষভাবে খাওয়ার উপযোগী সেগুলি সাধারণ ছোটোখাটো তিমি-অর্থাৎ মোটে কুড়ি-পঁচিশ হাত লম্বা। মোম তিমি বা sperm whale লম্বায় খুব বড়ো হয়—এক-একটা ষাট হাত পর্যন্ত দেখা গিয়াছে। সব চাইতে বড় যে তিমি সেগুলি থাকে একেবারে উত্তরে, মেরু সমুদ্রের কাছে—তাহারা লম্বায় মোম তিমির সমান, কিন্তু অনেকখানি চওড়া ও মোটা এবং ওজনেও প্রায় দেড়। একএকটি বড়ো তিমির ওজন চারহাজার মণেরও বেশি হয়—অর্থাৎ ত্রিশ-চল্লিশটা বড়ো-বড়ো হাতির সমান। এই-সমস্ত অতিকায় তিমি আগে সমুদ্রের মধ্যে অনেক দেখা যাইত, কিন্তু মানুষের অত্যাচারে ইহাদের বংশ ক্রমে প্রায় উজাড় হইয়া আসিতেছে।

 তিমি নানারকমের হয়—তাহাদের মোটের উপর দুই দলে ভাগ করা যায়। এক দলের দাঁত নাই, আর এক দলের দাঁত আছে। যেগুলীর দাঁত নাই তাহাদের মুখের ভিতরে প্রকাণ্ড চিরুনির ঝালরের মতো একটা জিনিস থাকে, তাহাকে বলে কাঁচকড়া বা whale bone এই জিনিসটা মানুষের অনেক শৌখিন কাজে লাগে এবং বাজারে বিক্রয় করিলে বেশ দামও পাওয়া যায়। তা ছাড়া এক-একটা তিমির গায়ে যে পরিমাণ তেল বা চর্বি থাকে তাহার দামও বড়ো সামান্য নয়। যে মোম তিমির কথা আগে বলিয়াছি তাহার মুখে কাঁচকড়া নাই কিন্তু তাহার মাথার মধ্যে একটা প্রকাণ্ড চৌবাচ্চা ভরা মোম থাকে। এই মোমের চমৎকার বাতি হয় এবং নানারকম মলম প্রভৃতি হয়। এই মোম চবি ও কাঁচকড়ার জন্য মানুষে সমুদ্রের নানা স্থানে বড়ো-বড়ো তিমিগুলিকে নিঃশেষ করিয়া এখন ছোটোখাটো তিমির পিছনে লাগিয়াছে।

 যে-সব 'ছোটোখাটো’ তিমির কথা বলা হইল, তাহাদের এক-একটাকে মারিলে প্রায় তিন-চারশত মণ মাংস পাওয়া যায়। অজিকাল তিমির ব্যবসা অনেক কমিয়া গিয়াছে, কিন্তু তবু গত দুই বৎসরে কেবল উত্তর আমেরিকায় প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূলেই বারোশতের বেশি তিমি মারা হইয়াছে। এখন এ ব্যবসায়ে আরো লাভ হইবার কথা, কারণ এখন হইতে তিমির হাড় মাংস চর্বি চামড়া সমস্তই কাজে লাগানো চলিবে। এতকাল চর্বি ও কাঁচকড়া বাহির করিবার পর অত বড়ো প্রকাণ্ড দেহটাকে সমুদ্রে ফেলিয়া দেওয়া হইত তাহাতে কেবল হাজার হাজার জলজন্তুর খোরাক জুটিত। কিন্তু এখন সেই মাংসে মানুষের উদরপূর্তি হইবে। এইরূপ একটা তিমিকে মারিলে স্বচ্ছন্দে বিশ-ত্রিশ হাজার লোকের ভোজের আয়োজন হইতে পারে। তার পর কংকালটুকুও ফেলিবার জিনিস নয়—তাহাকে পোড়াইয়া চমৎকার জমির সার ও নানারকম ঔষধ তৈয়ারি হইবে। চামড়াটায় চর্বি ভরা

বলিয়া তাহাকে অনেকদিন পর্যন্ত কাজে লাগাইবার সুবিধা হয় নাই—এখন তিমির ছাল কলে পিষিয়া চবি বাহির করিয়া চমৎকার মজবুত চামড়া তৈয়ারি হইতেছে। সুতরাং মানুষের মতো এ-হেন অত্যাচারী রাক্ষসের হাত এড়াইবার জন্য তিমি গভীর সমুদ্রে পলাইয়া হয়তো এখনো বাঁচিতে পারেনা হইলে তাহার বংশ লোপ হওয়ার খুবই আশংকা আছে।

 এত বড়ো প্রাণীটা, কিন্তু মোটের উপর তাহার স্বভাবটি বেশ নিরীহ বলিতে হইবে। অনেক সময়ে দেখা যায় তিমির দল সমুদ্রের উপর ভাসিয়া আসিয়া খেলা করিতেছে। তাহাদের একটাকে মারিলে বাকিগুলা ব্যস্ত হইয়া চারিদিকে ভিড় করিয়া আসে। তখন একটার পর একটাকে বল্পমে গাঁথিয়া দলকে-দল মারিয়া ফেলা খুবই সহজ হইয়া পড়ে। কিন্তু সব তিমি সম্বন্ধে এ নিয়ম খাটে না। কোনো কোনো দাঁতওয়ালা তিমি আছে, তাহাদের মেজাজটা দস্তুরমতো বদরাগী। এ বিষয়ে মোম তিমির দুর্নাম সবচাইতে বেশি। মাঝে মাঝে এক-একটা দলছাড়া মোম তিমি দেখা যায়, তাহাদের ঘাটাইবার দরকার হয় না। জাহাজ দেখিলেই তাহারা তাড়া করিয়া যায়। তিমির তাড়া যে কেমন তাড়া, সে তাড়া যে খাইয়াছে সেই জানে। কখনো সে টু মারে, কখনো সে হাঁ করিয়া কামড়াইতে আসে, কখনো তাহার গায়ের ধাক্কায় জাহাজ চুরমার হয়—অথবা লেজের ঝাপটায় প্রলয় কাণ্ড উপস্থিত করে, এই ভয়ে মাঝি-মাল্লা ব্যতিব্যস্ত হইয়া পড়ে। আর যাহাদের ‘নিরীহ তিমি’ বলি, তাহারাও যখন মরিবার সময় সমুদ্র তোলপাড় করিয়া ছটফট করে তখন সেও প্রকটা কম সাংঘাতিক ব্যাপার হয় না।

 তিমির খাওয়ার মধ্যেও রকমারি দেখা যায়। যাহাদের দাঁত নাই, তাহারা সমুদ্রের মধ্যে ছোটো-ছোটো মাছের ঝাঁক খাইয়া বেড়ায়। এক-এক বার হাঁ করিয়া মাছের ঝাঁকসুদ্ধ সমুদ্রের জল মুখের ভিতর পুরিয়া লয়। তার পর সেই কাঁচকড়ার ঝালরের ভিতর দিয়া সেই জল ফুকিয়া বাহির করে-মাছগুলা সব এই অদ্ভুত ছাঁকনিতে আটকাইয়া থাকে। ইহাদের গলার ফুটা এত ছোটো যে নিতান্ত পুঁটি বাটা ছাড়া কোনো বড়ো মাছ গেলা ইহাদের সাধ্য নয়। কিন্তু দাঁতালো তিমিরা এরকম খুচরা খাইয়া সন্তুষ্ট হয় না। তাহারা বড়ো-বড়ো সমুদ্রের জন্তুকে মারিয়া খায়। মোম তিমিরা এক মাইল গভীর সমুদ্রে ডুব মারিয়া সেখানকার বড়ো-বড়ো বিদঘুটে জন্তুগুলাকে খাইতে ছাড়ে না। একবার একটা তিমির পেটে একটা প্রকাণ্ড অক্টোপাসের কিছু কিছু টুকরা পাওয়া গিয়াছিল। তাহার এক-একটি পা হাতির পায়ের সমান মোটা! সে জন্তুটা যে আট-দশটা হাতির সমান বড়ো ছিল, তাহাতে আর কোনো সন্দেহ নাই।

 ‘তিমি মাছ’ যে আসলে মাছই নয়, সে কথা তোমরা নিশ্চয়ই জান। ইহারা স্তন্যপায়ী জন্তু। ইহাদের এক-একটি ছানা হয় ঘোড়ার মতো মস্ত; তাহারা জন্মিয়া মায়ের দুধ খায়। মাছ যেমন অনায়াসে জলের নীচে ডুবিয়া থাকে—তিমি সেরকম পারে না। নিশ্বাস লইবার জন্য তাহাকে বার বার জলের উপরে উঠিতে হয়। কখনো কখনো জোরে নিশ্বাস ছাড়িবার সময় তাহার নাক হইতে গরম বাতাসের ঝাপটা ছুটিয়া সমুদ্রের উপর জলের ফোয়ারা উঠিতে থাকে। তাহা দেখিয়া শিকারীরা বুঝিতে পারে—ঐখানে তিমি।

সন্দেশ—কার্তিক, ১৩২৫