সুকুমার রায় সমগ্র রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড)/জীবজন্তর কথা/লড়াইবাজ জানোয়ার

উইকিসংকলন থেকে
লড়াইবাজ জানোয়ার

 এক-একজন মানুষ থাকে— কেবল সকলের সঙ্গে ঝগড়া বাধানো হচ্ছে তাদের স্বভাব। কথায় কথায় যেমন তাদের মুখ চলে তেমনি সঙ্গে সঙ্গে হাতও চলে। জানোয়ারদের মধেও এইরকম বদমেজাজী জীবের অভাব নাই। যে-সব বড়ো-বড়ো জন্তুরা পেটের দায়ে অন্য জন্তু শিকার করে বেড়ায়, আমরা তাদের বলি শ্বাপদ জন্তু, হিংস্র জন্তু। কিন্তু মানুষ যখন নিরীহ ছাগল ভেড়া বা হাঁস মোরগের গলায় ছুরি মেরে তাদের মাংস কেটে খায় তখন আমাদের মনেই হয় না যে আমরাও ঐ হিংস্র জন্তুর দলে। জানোয়ারদের মতো সাংঘাতিক নখ দাঁত বা শিং আমাদের না থাকতে পারে কিন্তু তার বদলে যে-সব ধারালো অস্ত্র আমরা ব্যবহার করি তাতে আমাদের হিংসা-বৃত্তির পরিচয়টা খুব ভালোরকমেই পাওয়া যায়।

 জানোয়ারদের মধ্যে যারা আমিষভোজী, অন্য জন্তুর মাংস না খেলে যাদের চলে না তারাই যে কেবল হিংস্র হয় তাও নয়। যারা নিরামিষ খায়, যেমন হাতি, গণ্ডার, বুনো মহিষ বা বরাহ—তাদের মেজাজও সব সময় নিরীহ তপস্বীদের মতো হয় না। আর সে মেজাজ বিগড়ালে বেশ বোঝা যায় যে সাংঘাতিক অস্ত্রশস্ত্রের ব্যবহারে তারাও কম ওস্তাদ নয়। মহিষের শিং, বরাহের দাঁত, গণ্ডারের খঙ্গ অস্ত্র হিসাবে এগুলি কোনোটাই বড়ো কম নয়। হাতিরও দাঁত আছে—কিন্তু তার চাইতে তার ঐ গোদা পায়ের চাপুনিটাই বোধ হয় বেশি মারাত্মক।

 ছোটোখাটো জন্তুদের আমরা হিংস্র জন্তু বলে বড়ো একটা গ্রাহ্য করি না, কারণ তাদের দিয়ে আমাদের বিশেষ কোনো অনিষ্ট হবার সম্ভাবনা কম। কিন্তু তাদের সমান জন্তুদের কাছে তারাও বড়ো কম ভয়ানক নয়। এমন যে নিরীহ কাঠবেড়ালী, যে সারাদিন অন্য জন্তুর ভয়ে ভয়ে থাকে, কোথাও একটু শব্দ পেলেই চমকিয়ে ছুটে পালায়, ছোটো-ছোটো পাখির বাসায় ডিমের সন্ধান পেলে সেও একজন রীতিমতো অত্যাচারী হয়ে উঠতে জানে। হঠাৎ তাড়া খেলে বা ভয় পেলে ইদুর বা ছুঁচোর মতো ছোটো জন্তও বেশ মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে। সেরকম অবস্থায় তারা মানুষকেও কামড়াতে ছাড়ে না। আর সে কামড়ও বড়ো সামান্য নয়। ছুঁচোর কামড় খেয়ে মানুষকে কখনো কখনো মাসের পর মাস জ্বরে ভুগতে দেখা গিয়েছে।

 কিছুদিন আগে এক সাহেব সাইকেল করে বিলাতের এক পাড়াগেঁয়ে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন। সন্ধার সময় পথের মাঝে নেমে তিনি সাইকেলের আলো জ্বালাচ্ছেন, এমন সময় ছোট্টো একটা বিলাতী বেজি ঘুরতে ঘুরতে তাঁর সামনে এসে উপস্থিত। সাহেবের কি খেয়াল হল, তিনি রাস্তা থেকে একটা ঢিল কুড়িয়ে নিয়ে বেজিটার গায়ে ছুড়ে মারলেন। মারতেই বেজিটা অদ্ভুত কিচকিচ্ শব্দ করে উঠল; আর তাই শুনে কোথেকে বারো-চোদ্দোটা বেজি এসে একসঙ্গে সাহেবকে আক্রমণ করে বসল। তারা ক্রমাগত লাফ দিয়ে সাহেবের গলার টুটি কামড়ে ধরবার চেষ্টা করতে লাগল। সাহেব একটুক্ষণ আত্মরক্ষার চেষ্টা করে তার পর প্রাণের ভয়ে সাইকেল চড়ে সেখান থেকে চম্পট দিলেন। বেজিগুলো তবু প্রায় দেড়মাইল পথ সাইকেলের পিছন পিছন তাড়া করে এসেছিল। হঠাৎ কি করে যে বেজিদের এতখানি তেজ আর সাহস হয়ে উঠল তার কোনো কারণ পাওয়া যায় না। কারণ, সাধারণত তারা মানুষের শব্দ পেলেই ছুটে পালায়।

 বেজিগুলো ইচ্ছা করলে খুব সহজেই সাহেবের পা কামড়াতে পারত, কিন্তু তা না করে তারা গলায় টুটির দিকেই বার বার তেড়ে উঠছিল; যেন তারা জানে যে ঐখানে কামড়ালে জখমটা হবে সাংঘাতিক। এরকম প্রায়ই দেখা যায় যে শিকারী জরা অন্য জন্তু মারবার সময় তাকে এমনভাবে মারে যাতে সে সহজেই কাবু হয়। 'হেজহগ’ (Hedgehog) বা

কাঁটাচুয়ার সারা গায়ে কাঁটা, তার গায়ে কোথাও কামড় দেবার জো নাই। কিন্তু তার গলার নীচটাতে কাটা নাই, সেখানে কামড় দিলে বেচারা আর আত্মরক্ষা করতে পারে না। ইদুরেরা তাই সুযোগ বুঝে তার গলায় কামড় বসাবার চেষ্টা করে। ভুলেও কখনো পিঠের উপর কামড় দিতে যায় না। বেজি যখন সাপের সঙ্গে লড়াই করে তখন তার দৃষ্টি থাকে সাপের ঘাড়ের কাছে, ঠিক ফণাটির পিছনে। সেখানে কামড় দিয়ে ধরলে সাপ আর উলটে ছোবল মারতে পারে না।

 ছোটো-ছোটো পোকামাকড়েরা পর্যন্ত এই-সব সংকেত জানে। তোমরা বোলতা আর মাকড়সার লড়াই দেখেছ? সে এক অদ্ভুত জিমিস। মাকড়সা জানে যে বোলতার একটি কামড় খেলে তার আর রক্ষা নাই, তাই সে কেবলই জালের আড়াল দিয়ে আত্মরক্ষার চেষ্টা করে। সেই জালের ভিতর থেকে সবগুলি পা একসঙ্গে বার করে সে বোলতাকে ভয় দেখবার চেষ্টা করে, কিন্তু কখনো তেড়ে গিয়ে আক্রমণ করবার সাহস পায় না। বোলতাও বার বার ভন্ভন্ করে জালের কাছ পর্যন্ত তেড়ে এসে আবার পালিয়ে যায়, কারণ সেও জানে যে ঐ জালের মধ্যে একবার আটকা পড়লে তার আর বের হবার উপায় নাই।

 কেবল যে অন্য জন্তুদের সঙ্গেই জানোয়ারদের লড়াই বাধে, তা নয়। ছাগলের লড়াই বেড়ালের ঝগড়া কিম্বা কুকুরের কামড়াকামড়ি তোমরা সকলেই দেখেছ। কাগে কাগে কিম্বা চড়াইয়ে চড়াইয়ে ঝগড়াও সর্বদাই দেখতে পাওয়া যায়। আমাদের ঘরে একটা ধাড়ি ঠিকটিকি আছে, সন্ধ্যার পর দেয়ালের বাতির কাছে, যে-সব পোকা বসে সে তাদের ধরে ধরে খায়। অন্য টিকটিকিকে ঘরের ত্রিসীমানার মধ্যে আসতে দেখলে সে তাকে তাড়া করে যায়, পাছে সে এসে তার খাবারে ভাগ বসায়। খাবারের জন্যে জানোয়ারদের মধ্যে রেষারেষি তো চলেই, বিয়ের জন্যেও রেষারেষি চলে। মনে কর জঙ্গলে একজন পরমাসুন্দরী গণ্ডারনী আছেন আর দুটি ছোকরা গণ্ডার আছে, তাদের দুজনেরই তাঁকে ভারি পছন্দ। এখন উপায়? উপায় হচ্ছে দস্তুরমতো লড়াই করে এর মীমাংসা করে নেওয়া। এরকম লড়াই হরিণদের মধ্যেও চলে, অন্যান্য অনেক জন্তুদের মধ্যেও চলে। পাখিদের মধ্যে তো খুবই চলে।

 এ ছাড়া এমন অনেক জন্তু আছে যারা কেবল লড়াইয়ের খাতিরেই লড়ে। যে-সব দলছাড়া হাতি একলা একলা জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায়, তাদের স্বভাবটা অনেক সময়েই এইরকম হয়। বুনো বরাহদের স্বভাবটাও নাকি অনেকটা এই ধরনের। আর-এক রকম ভিমরুলের কথা আমি জানি, সে থাকে খাসিয়া পাহাড়ে, তার গায়ে ডোরা ডোরা দাগ। তাকে কিছু না বললেও সে তেড়ে এসে বঁড়শির মতো হুল দিয়ে কামড় বসিয়ে দেয়। আমার মাথায় ভালো করে কামড়াতে পারে নি, তবু তিনদিন ব্যথার চোটে আমার ঘুমানো মুশকিল হয়েছিল।

সন্দেশ—অশ্বিন, ১৩২৯