সুকুমার রায় সমগ্র রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড)/জীবজন্তর কথা/সিংহ শিকার

উইকিসংকলন থেকে
পুণ্যলতা চক্রবর্তী, কল্যাণী কার্লেকর সম্পাদিত
(পৃ. ৩৫৭-৩৫৮)
সিংহ শিকার

 আফ্রিকা হল সিংহের দেশ। ইউরোপ আমেরিকার বড়ো-বড়ো শিকারীরা সেখানে বন্দুক নিয়ে দলেবলে সিংহ শিকার করতে যান। তারা মনে করেন, যতরকম শিকার আছে তার মধ্যে সিংহ শিকার খুব একটা বড়ো ব্যাপার। কারণ তাতে শিকারীর সাহস এবং বাহাদুরির পরিচয়টা ভালো করেই পাওয়া যায়। যে শিকারী সিংহ মেরেছে লোকে তাকে ওস্তাদ শিকারী বলে মানে। সিংহ শিকারের বিপদ খুব বেশি। অজিকাল বন্দুকের এত যে উন্নতি হয়েছে, তবুও এখনো কত শিকারী সিংহের হাতে প্রাণ হারান। তিন-চারটা সাংঘাতিক গুলি খাবার পরেও একশো গজ দৌড়ে এসে সিংহ তার শিকারীকে শিকার করেছে, এমন ঘটনার কথাও শোনা যায়। তার মধ্যে একটি গুলি সিংহের হৃৎপিণ্ড ফুটো করে বেরিয়ে গিয়েছিল, তবু মরবার আগে সে তার মরণকামড়টি না দিয়ে ছাড়ে নি। তা হলে ভাব সিংহ কি জিনিস!

 এমন যে সিংহ তাকে আফ্রিকার ‘মাসাই’ ও ‘নান্দি’ জাতের নিগ্রোরা বল্লম দিয়ে শিকার করে থাকে। প্রেসিডেণ্ট রুজভেল্ট আমেরিকার যুক্তরাজ্যের সভাপতি এবং অসাধারণ মনস্বী লোক বলে সকল দেশে পরিচিত, কিন্তু শিকারী হিসাবেও তাঁর প্রতিপত্তি বড়ো কম নয়। তিনি নান্দিদের সিংহ শিকার স্বচক্ষে দেখে তার যে বর্ণনা লিখে গিয়েছেন, তা পড়লে অবাক হতে হয়।

 নান্দিদের শিকার দেখবার জন্য তিনি একদিন আফ্রিকার জঙ্গলে দলেবলে সিংহের খোঁজে বেরিয়েছিলেন। কথা ছিল, সিংহ পাওয়া গেলে নন্দিরা শিকার করবে; সাহেবরা কেউ সে শিকারে যোগ দেবেন না; কিছু বলতে পারবেন না। তারা কেবল দুরে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখবেন। ঝোপ জঙ্গল ঘেঁটে অনেক খোঁজার পর প্রকাণ্ড এক সিংহ পাওয়া গেল। তেমন সিংহ সচরাচর মেলে না। রুজভেট লিখেছেন, সিংহটাকে দেখে তাদের শিকার করবার লোভ জেগে উঠছিল, কিন্তু তা হলে তাদের কথা রক্ষা হয় না, আর নান্দিদের শিকারটাও দেখা হয় না, তাই তাঁরা দলেবলে সিংহটাকে ঘিরে একটু তফাতে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলেন। নান্দিরা একটু পিছনে পড়েছিল, দেখতে দেখতে তারা এসে হাজির হল। এক হাতে বল্পম, আর এক হাতে ঢাল—বিশাল দেহটি যেন কালো পাথরে তৈরি। মুখে দয়ামায়া দ্বিধা ভয়ের চিহ্নমাত্র নেই। সিংহ পাওয়া গিয়েছে শুনে তাদের আনন্দ দেখে কে? তার এক-এক পা চলে আর এক-একটি বিরাট লাফ দেয়। দেখতে দেখতে সিংহের ঝোপটিকে তার নিঃশব্দে ঘেরাও করে ফেলল।

 সিংহটাও এতক্ষণ চুপ করে ছিল না। সে ঝোপের আড়ালে বসে ছিল, আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল। দেখল কতগুলো মানুষ তার দিকে এগিয়ে আসছে। তারা সব ঢলের আড়ালে গুড়ি মেরে বল্লম বাগিয়ে দাঁড়াচ্ছে। এক-একটি ঢালের উপর দিয়ে এক-এক জোড়া কালো চোখ যমের কুটির মতো তার দিকে তাকিয়ে আছে। সে বেশ বুঝল যে তার জন্যই এত সব আয়োজন, তার গর্জনে সারা জঙ্গল কেঁপে উঠতে লাগল। তার ঘাড়ের কেশর খাড়া হয়ে দাঁড়াল, তার মুখখানা ভীষণভাবে বিকৃত হয়ে গেল, তার ল্যাজের বাড়িতে সমস্ত ঝোপটা চঞ্চল হয়ে উঠল। সে একবার এপাশ ফিরল একবার ওপাশ ফিরল, ডাইনে তাকাল বায়ে তাকাল, কোনদিকে লোক কম দেখে তার পর তীরের মতো সেইদিকে ঝাপিয়ে পড়ল।

 একটি লোকও সেদিক থেকে সরল না। সব ঢাল বাগিয়ে বল্লম তুলে প্রস্তুত হয়ে দাড়াল। দুপাশ থেকে শিকারীরা বল্লম হাতে দৌড়ে এল, দলের যে নেতা সে লাফ দিয়ে দৌড়ে সকলের সামনে গিয়ে পড়ল। তার হাত থেকে বল্লমখানি বিদ্যুতের মতো ছুটে গিয়ে সিংহের গায়ের মধ্যে বিধে গেল। সিংহটাও আঘাত লাগামাত্র তার সামনে যাকে পেল তাকেই আক্রমণ করে ধরল। সে লোকটাও তার জন্য প্রস্তুত ছিল, তার বল্লমের এক ঘায়ে সে চক্ষের নিমেষে সিংহটাকে একেবারে এপার ওপার ফুঁড়ে ফেলল—একদিকের ঘাড়ের মধ্যে ঢুকে বল্পমের আগাটা অন্য দিকে পেটের পাশ দিয়ে বেরিয়ে এল। কিন্তু তা সত্ত্বেও সিংহটা তার ঢালের উপর দিয়ে প্রচণ্ড এক থাবা মেরে, তার ঘাড়ের মধ্যে নখ দাঁত বসিয়ে মুহর্তের মধ্যে তাকে ধরাশায়ী করে ফেলল। অরি অমনি চার দিক থেকে বল্লমের পর বঙ্কম আগুনের ঝলকের মতো ছুটে এসে সিংহটাকে একেবারে অস্ত্রে অস্ত্রে গেঁথে ফেলল। এর মধ্যেও কিন্তু শেষ মুহর্তে সে আরো একটি শিকারীকে জখম করতে ছাড়ে নি। মরবার সময় একটা বল্লমকে সে এমন জোরে কামড়িয়ে ধরেছিল যে, লোহার বল্লমটা উলটে মুচড়ে বঁড়শির মতো বেঁকে গিয়েছিল। তার পর নান্দিদের উল্লাস দেখে কে। খানিকক্ষণ পর্যন্ত সিংহের চারি দিকে তাদের চীৎকার আর বিজয় নৃত্যের ঘটা চলল। সুখের বিষয়, আহত শিকারী দুজনেই বেঁচে উঠেছিল।

 সিংহের তেড়ে-আসা থেকে এত কাণ্ড শেষ হওয়া পর্যন্ত দশ সেকেণ্ডও সময় লাগে নি। সিংহের আক্রমণ, শিকারীর অস্ত্র বৃষ্টি, আঁচড় কামড় হুড়াহুড়ি আঘাত যন্ত্রণা ও মৃত্যু, ওর মধ্যেই সব এক ঝাপটায় শেষ। সিংহটা যখন পড়ল, তখন তার অবস্থাটি হয়েছিল ঠিক ভীষ্মের শরশয্যার মতো।
সন্দেশ—ভাদ্র, ১৩২৬