সুকুমার রায় সমগ্র রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড)/জীবনী/কলম্বস

উইকিসংকলন থেকে
পুণ্যলতা চক্রবর্তী, কল্যাণী কার্লেকর সম্পাদিত
(পৃ. ৭২-৭৪)

কলম্বস

 চারশো বৎসর আগে ইউরোপ হইতে ভারতবর্ষে আসিতে হইলে সকলেই পূর্বমুখে পারস্যের ভিতর দিয়া আসিত! তখন পণ্ডিতেরা সবেমাত্র পৃথিবীটাকে গোল বলিয়া বিশ্বাস করিতে আরম্ভ করিয়াছেন। ক্রিস্টোফার কলম্বস নামে ইটালি দেশীয় এক নাবিক ভাবিলেন, যদি সত্য সত্যই পৃথিবীটা গোল হয়, তবে তো পূর্ব মুখে না গিয়া ক্রমাগত পশ্চিম মুখে গেলেও, সেই ভারতবর্ষের কাছাকাছিই কোথাও পৌঁছানো যাইবে। এ-বিষয়ে তাঁহার বিশ্বাস এতদুর হইয়াছিল যে, তিনি ইহা প্রমাণ করিবার জন্য আপনার প্রাণ পর্যন্ত দিতে প্রস্তুত হইলেন। কিন্তু কেবল বিশ্বাস আর সাহস থাকিলেই হয় না -কলম্বস গরিব লোক, তিনি জাহাজ পাইবেন কোথা, লোকজন জোগাড় করিবেন কিসের ভরসায়। তিনি দেশে দেশে ধনীলোকেদের কাছে দরখাস্ত করিয়া ফিরিতে ফিরিতে পর্তুগালে আসিয়া হাজির হইলেন। ক্রমে তাহার মতলবের কথা রাজার কানে গিয়া পৌছিল- তিনি তাঁর মন্ত্রীদের উপর এই বিষয়ে তদন্ত করিবার ভার দিলেন। মন্ত্রীরা ভাবিল, এ লোকটার কথা যদি সত্য হয়, তবে খামকা এই বিদেশীকে সাহায্য না করিয়া, অমিরাই একবার এ চেষ্টাটা করিয়া দেখি-না-কেন? তাঁহারা কলম্বাসের কাছে তাঁহার হিসাবসুদ্ধ সমস্ত নকশা চাহিয়া লইলেন, এবং গোপনে কয়েকজন পর্তুগীজ নাবিককে সেই পশ্চিমের পথে পাঠাইয়া দিলেন। কিন্তু কিছুদূর না যাইতেই ঝড় তুফান আর কেবল অকূল সমুদ্র দেখিয়া তাহারা ভয়ে ফিরিয়া আসিল। কলম্বস যখন জানিতে পারিলেন যে, রাজকর্মচারীরা তাহাকে এইভাবে ঠকাইতে চেষ্টা করিতেছেন, তখন রাগে ও ঘূপায় তিনি সে দেশ ত্যাগ করিয়া স্পেন রাজ্যে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। সেইখানে সাত বৎসর রাজদরবারে দরখাস্ত বহিয়া, তার পর রানী ইসাবেলার কৃগায় তিনি তাঁহার এতদিনের ইচ্ছা পুর্ণ করিবার সুযোগ পাইলেন। ১৪৯২ খৃস্টাব্দে, অর্থাৎ ঠিক চারশো পঁচিশ বৎসর পর্বে কলম্বস ভারতবর্ষের সন্ধানে যাত্রা করেন।

 ক্রমাগত সত্তর দিন পশ্চিম মুখে চলিয়াও কলম্বস ডাঙার সন্ধান পাইলেন না। ইহার মধ্যে তাঁহার সঙ্গের লোকেরা কতবার নিরাশ হইয়া পড়িয়াছে, কতবার তাহারা বাড়ি ফিরিবার জন্য জেদ করিয়াছে, সমুদ্রের কূল-কিনারা না দেখিয়া কতজনে ভেউ ভেউ করিয়া কাঁদিয়াছে—এমন-কি, কলসকে মারিয়া ফেলিবার জন্যও তাহারা কতবার ক্ষেপিয়াছে। কিন্তু কলম্বাস অটল প্রশান্তভাবে সকলকে আশ্বাস দিয়াছেন, “ভয় নাই। আরেকটু ভরসা করিয়া চল, সমুদ্রের শেষ পাইবে।” একাত্তর দিনের দিন দূরে কূল দেখা দিল তখন সকলের অনিন্দ দেখে কে। পরদিন তাঁহারা নূতন দেশে এক অজানা দ্বীপে অজানা জাতির মধ্যে আসিয়া পড়িলেন। তার পর কী আনন্দে সে দেশ হইতে নানা ধনরত্ন অলংকারে জাহাজ ভরিয়া, সে-দেশী লোক সঙ্গে লইয়া, তাহারা সেই সংবাদ দিবার জন্য দেশে ফিরিলেন। তখন দেশে কলঘসের সম্মান দেখে ভাবিয়াছিলেন তিনি ভারতবর্ষের কাছে কোনো দ্বীপে আসিয়াছেন, কিন্তু বাস্তবিক তিনি যেখানে গিয়াছিলেন সেটা আমেরিকার বাহামা দ্বীপপুঞ্জের কাছে। ইহার পর তিনি আরো দুবার পশ্চিমে যান, এবং শেষের বার আমেরিকা পৌছিয়াছিলেন। কিন্তু শেষ-পর্যন্ত তাঁহার বিশ্বাস ছিল যে, তিনি ভারতবর্ষ আবিষ্কার করিয়াছেন। তাঁহার এই ভুলের জন্যই এখনো আমেরিকার লোকেদের “ইণ্ডিয়ান' বলা হয়-আর ম্যাপে ঐ দ্বীপগুলার নাম লেখা হল পশ্চিম ইণ্ডিজ।

 দুঃখের বিষয়, শেষজীবনে কলম্বসের অনেক শক্ত জুঠিয়াছিল, তাহারা রাজার কাছে সত্য-মিথ্যা কোনোরকম নালিশ করিয়া রাজাকে তাঁহার বিরুদ্ধে উতেজিত করিয়া তোলে। রাজা কলম্বসকে সভায় হাজির করিবার জন্য লোক পাঠান—তধন কম্বস ষাট বৎসরের বৃদ্ধ। রাজার লোক কলম্বাসের হাতে শিকল বাঁধিয়া, তাঁহাকে জাহাজে কয়েদ করিয়া রাজার কাছে চালান দিল। সৌভাগ্যক্রমে বুদ্ধের দুর্দশা দেখিয়া রাজার মনে কি দয়া হইল, তিনি তাঁহাকে ছাড়িয়া দিলেন। কিন্তু কলম্বস এ অপমানের কথা জীবনের শেষদিন পর্যন্ত ভুলিতে পারেন নাই। মানুষের অকৃতজ্ঞতার কথা ভাবিতে ভাবিতে দরিদ্র ও অনাদরের মধ্যেই এই কীর্তিমান পুরুষের জীবন শেষ হইল।

সন্দেশ—আশ্বিন, ১৩২৪