সুকুমার রায় সমগ্র রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড)/জীবনী/ডারুইন

উইকিসংকলন থেকে

ডারুইন

 ছেলেবেলায় আমরা শুনিয়াছিলাম ‘মানুষের পূর্বপুরুষ বানর ছিল। ইহাও শুনিয়া- ছিলাম যে, ডারুইন নামে কে এক পণ্ডিত নাকি এ কথা বলিয়াছেন। বাস্তবিক ডারুইন এমন কথা কোনোদিন বলেন নাই। আসল কথা এই যে, অতি প্রাচীনকালে বানর ও মানুষের পূর্বপুরুষ একই ছিল। সেই এক পূর্বপুরুষ হইতেই বানর ও মানুষ, এ-দুই আসিয়াছে—কিন্তু সে যে কত দিনের কথা তাহা কেহ জানে না।

 তখন হইতেই আমার মনে একটা সন্দেহ ছিল, পণ্ডিতেরা এত খবর জানেন কি করিয়া? তাহারা তো সেই প্রাচীনকালের পৃথিবীটাকে চক্ষে দেখিয়া আসেন নাই, তবে তাহার সম্বন্ধে এত সব কথা তাহারা বলেন কিসের জোরে? যাহা হউক, আমরা তো আর পণ্ডিত নই, তাই অনেক কথাই আমাদের মানিয়া লইতে হয়। মানিতে হয় যে এই পৃথিবীটা ফুটবলের মতো গোল এবং সে লাট্টর মতো ঘোরে, আর সূর্যের চারিদিকে পাক দিয়া বেড়ায়—যদিও এ-সবের কিছুই আমরা চোখে দেখি না। হেনে- বেলায় ভাবিতাম, পণ্ডিতদের খুব বুদ্ধি বেশি তাই তাঁহারা অনেক কথা জানিতে পারেন। কিন্তু এখন দেখিতেছি কেবল তাহা নয়। বুদ্ধি তো চাইই, তা ছাড়া আরো কয়েকটি জিনিস চাই যাহা না থাকিলে কেহ কোনোদিন যথার্থ পণ্ডিত হইতে পারে না। তার মধ্যে একটি জিনিস, ঠিকমতো দেখিবার শক্তি। সাধারণ মোকে যেমন দু-একবার চোখ বুলাইয়া মনে করে ইহার নাম দেখা-পণ্ডিতের দেখা সেরকম নয়। তাঁহারা একই বিষয় লইয়া দিনের পর দিন দেখিতেছেন, তবু দেখার আর শেষ হয় মাখার উপর এত যে তারা সারারাত মিটমিট করিয়া জ্বলে, আবার দিনের আলোয় মিলাইয়া যায়, পণ্ডিতেরা কত হাজার বৎসর ধরিয়া তাহা দেখিতেছেন তবু তাঁহাদের তৃপ্তি নাই। বছরের কোন সময়ে কোন তারা ঠিক কোনখানে থাকে, কোন তারাটা কতখানি স্থির বা কিরকম অস্থির, তাদের রকমসকম কোনটার কেমন—এই-সবের সূক্ষ হিসাব লইতে লইতে পণ্ডিতদের বড়ো-বড়ো পুঁথি ভরিয়া উঠে। সেই-সব হিসাব ঘাঁটিয়া তাহার ভিতর হইতে কত আশ্চর্য নুতন কথা তাঁহারা বাহির করেন, যাহা সাধারণ লোকের কাছে অদ্ভুত ও আজগুবি শুনায়।

 আজ এক পণ্ডিতের কথা বলিব, তাঁহাকে কেহ বুদ্ধিমান বলিয়া জানিত না, মাস্টারেরা তাহার উপর কোনোদিনই কোনো আশা রাখেন নাই বরং সকলে দুঃখ করিত, 'এ ছেলেটার আর কিছু হইবে না।' অথচ এই ছেলেই কালে একজন অসাধারণ পণ্ডিত হইয়া সমস্ত পৃথিবীতে আপনার নাম রাখিয়া গিয়াছেন। ইহার নাম চার্লস ডারুইন। পড়ার দিকে ডারুইনের বুদ্ধি খুলিত না, একটা বিষয়ে তাহার অসাধারণ অগ্রিহ ছিল। সেটি কেবল নানা অদ্ভুত জিনিস সংগ্রহ করা। শামুক ঝিনুক হইতে আরম্ভ করিয়া, পুরাতন ভাঙা জিনিস বা পাথরের কুচি পর্যন্ত নানা জিনিসে তাঁহার বাক্স ও পড়িবার টেবিল বোঝাই হইয়া থাকিত। বালকের এই আগ্রহটা অন্য লোকের কাছে অন্যায় বাতিক বা উপদ্রব বলিয়াই বোধ হইত, কিন্তু তবু কেহ তাহাতে বড়ো-একটা বাধা দিত না। কারণ, ডারুইনের মনটা স্বভাবতই এমন কোমল এবং তাহার স্বভাব এমন মিষ্ট ছিল যে সকলেই তাহাকে ভালোবাসিত।

 ছেলেবেলায় পড়ার মধ্যে একটি বই ডারুইন খুব মন দিয়া পড়িয়াছিলেন—তাহাতে পৃথিবীর নানা অদ্ভুত জিনিসের কথা ছিল। সেই বই পড়িয়া অবধি তাহার মনে দেশ- বিদেশ ঘুরিবার শখটা জাগিয়া উঠে। কলেজে আসিয়া ডারুইন প্রথমে গেলেন ডাক্তারি শিখিতে। সে সময় ক্লোরোফর্ম ছিল না, তাই রোগীদের সজ্ঞানেই অস্ত্রচিকিৎসার ভীষণ কষ্ট ভোগ করিতে হইত। সেই যন্ত্রণার দৃশ্য দেখিয়া করুণহৃদয় ডারুইনের মন এমন দমিয়া গেল যে, তাঁহার আর ডাক্তারি শেখ হইল না। তখন তিনি ধর্মযাজক হইবার ইচ্ছায় স্কটল্যাণ্ড ছাড়িয়া ইংলণ্ডে ধর্মতত্ত্ব শিখিতে আসিলেন। শিক্ষার দশা এবারও প্রায় পুর্বের মতোই হইল—কারণ, বাল্যকালে তিনি গ্রীক প্রভৃতি যাহা কিছু শিখিয়াছিলেন, এ কয় বছরে তাহার সবই প্রায় ভুলিয়া বসিয়াছেন, ভুলেন নাই কেবল সেই নানা জিনিস সংগ্রহের অভ্যাসটা। কলেজে তাহার সহপাঠী বন্ধুরা দেখিত, ডারুইন সুযোগ পাইলেই মাঠে ঘাটে জঙ্গলে পোকামাকড় সংগ্রহ করিয়া ফিরিতেছেন। হয়তো সারাদিন কোনো পোকার বাসার কাছে পড়িয়া, তাহার চালচলন স্বভাব সমস্ত যারপরনাই মনোযোগ করিয়া দেখিতেছেন। এ বিষয়ে কেবল নিজের চোখে দেখিয়া তিনি এমন সব আশ্চর্য খবর সংগ্রহ করিতেন যাহা কোনো পুঁথিতে পাওয়া যায় না। বন্ধুরা এই-সব ব্যাপার লইয়া নানারকম ঠাট্টা-তামাশা করিত, কেহ কেহ বলিত, “ডারুইন পণ্ডিত হইবে দেখিতেছি।” ডারুইন যে পণ্ডিত হইতে পারেন, এটা কাহারও কাছে বিশ্বাসযোগ্য কথা বলিয়া বোধ হইত না।

 এইরূপে বাইশ বৎসর কাটিয়া গেল। ১৮৩১ খৃস্টাব্দে ‘বীগল' নামে এক জাহাজ পৃথিবী প্রমণে বাহির হইল—ডারুইন বিনা বেতনে প্রাণিতত্ত্ব সংগ্রহের জন্য তাহার সঙ্গে যাইবার অনুমতি পাইলেন। পাঁচ বৎসর জাহাজে করিয়া তিনি পৃথিবীর নানাস্থান ঘুরিয়া বেড়াইলেন এবং প্রাণিতত্ত্ব বিষয়ে এমন আশ্চর্য নুতন জ্ঞান লাভ করিলেন যে, তাহা তাঁহার সমস্ত চিন্তা ও জীবনকে একেবারে নুতন পথে লইয়া চলিল। ডারুইন বলেন ইহাই তাঁহার জীবনের সবচাইতে স্মরণীয় ঘটনা।

 তার পর কুড়ি বৎসর ধরিয়া ডারুইন এই-সমস্ত বিষয় লইয়া গভীরভাবে আলোচনা করিতে লাগিলেন। প্রাচীনকালে যে-সকল জীবজন্তু পৃথিবীতে ছিল, আজ তাহারা নাই, কেবল কতগুলি কঙ্কালচিহ্ন দেখিয়া আমরা তাহার পরিচয় পাই। আজ যে-সকল জীবজন্তু দেখিতেছি, তাহারাও ভুইফোড় হইয়া হঠাৎ দেখা দেয় নাই—ইহারাও সকলেই সেই আদিমকালোর কোনো-না-কোনো জন্তুর বংশধর। কেমন করিয়া এ পরিবর্তন হইল? এরূপ পরিবর্তন হইবার কারণ কি? যে গাছের যে ফল তাহার বীচি পুঁতিলে সেই ফলেরই গাছ হয়, তাহাতে সেইরূপই ফল ফলে, আমরা তো এইরূপই দেখি। আকার-প্রকার যেমন, তার ছানাগুলাও হয় সেরূপ। শেয়ালের বংশে শেয়ালই জন্মে। শেয়ালের ছানা, তার ছানা, তার ছানা, তার ছানা, এরূপ যতদূর দেখিতে পাই সকলেই তো শেয়াল। তবে এ আবার কোন সৃষ্টিছাড়া নিয়ম, যাহাতে এক জন্তুর বংশে ক্রমে এমন জন্তুর জন্ম হয়, যাহাকে আর সেই বংশের সন্তান বলিয়া চিনিবার জো থাকে না? ডারুইন দেখিলেন তিনি যে-সমস্ত নুতন তত্ত্ব জানিয়াছেন, তাহার মধ্য হইতেই নানা দৃষ্টান্ত দেখাইয়া এই-সকল প্রশ্ন ও সন্দেহের অতি চমৎকার মীমাংসা করা যায়।

 যাহারা ওস্তাদ মালী তাহারা ভালো-ভালো গাছের কলম করিবার সময়, বা বীজ পুঁতিবার সময় যে সে গাছের বীজ বা কলম লইয়া কাজ করে না। ভালো গাছ, ভালো ফুল, ভালো ফল বাছিয়া বাছিয়া, তাহাদের মধ্যে নানারকম মিশাল করাইয়া, খুব সাবধানে পছন্দমতো গাছ ফুটাইয়া তোলে। যেগুলা তাহার পছন্দসই নয়, সেগুলাকে সে একেবারেই বাদ দেয়। তাহার ফলে অনেক সময় গাছের চেহারার আশ্চর্যরকম উন্নতি ও পরিবর্তন দেখা যায়। একটা সামান্য জংলি ফুল আজ মানুষের চেষ্টা ও যত্নে সুন্দর গোলাপ হইয়া উঠিয়াছে—নানা লোকে গোলাপের চর্চা করিয়া আপন পছন্দমতো নানারূপ বাছাই করিয়া, নানারকম মিশাল দিয়া কত যে নূতনরকমের গোলাপ গড়িয়া তুলিয়াছে, তাহার আর অন্ত নাই। যাহারা ব্যবসার জন্য বা শখের জন্য নানারূপ জন্তু পালে তাহারা জানে যে, কোনো জন্তুর বংশের উন্নতি করিতে হইলে, রুগ্‌ণ কুৎসিত বা অকর্মণ্য জম্ভগুলাকে বাদ দিতে হয়। তাহার পর যেরূপ গুণ ও লক্ষণ দেখিয়া বাছিয়া বাছিয়া জোড় মিলাইবে, বংশের মধ্যে সেই-সব লক্ষণ ও গুণ পাকা হইয়া উঠিবে। লম্বা শিংওয়ালা ভেড়া চাও তো বাছিবার সময় লম্বা শিং দেখিয়া বাছিবে। তাহাদের যে-সব হানী হইবে, তাহাদের মধ্যে যেগুলার শিং ছোটো তাহাদের বাদ দিবে। এইরূপে ক্রমে লম্বা শিঙের দল গড়িয়া উঠিবে।

 ডারুইন দেখিলেন, মানুষের বুদ্ধিতে যেমন নানারকম বাছাবাছি চলে, প্রাণিজগতেও সর্বত্রই স্বাভাবিকভাবে সেইরূপ বাছাবাছি চলে। যারা রুগণ যারা দুর্বল, মরিবার সময় তাহারাই আগে মরে, যাহারা বাহিরে নানা অবস্থার মধ্যে আপনাকে বাঁচাইয়া রাখিতে পারে, তাহারাই টিকিয়া যায়। কাহারও গায়ে জোর বেশি, সে লড়াই করিয়া বাঁচে। কেহ খুব ছুটিতে পারে, সে শত্রুর কাছ হইতে পলাইয়া বাঁচে। কাহারও চামড়া মোটা, সে শীতের কষ্ট সহিয়া বাঁচে। কাহারও হজম বড়ো মজবুত, সে নানা জিনিস খাইয়া বাঁচে। কাহারও গায়ের রঙ এমন যে হঠাৎ চোখে মালুম হয় না, সে লুকাইয়া বাঁচে। বাঁচিবার মতো গুণ যাহার নাই সে বেচারা মারা যায়, অরি সেই-সব গুণ আর লক্ষণ যাহাদের আছে তাহারাই বাঁচিয়া থাকে, তাহাদেরই বংশ বিস্তার হয়, আর বংশের মধ্যে সেই-সব বাছা বাছা গুণগুলিও পাকা হইয়া স্পষ্ট হইয়া উঠে। এইরাপে আপনাকে বাঁচাইবার জন্য সংগ্রাম করিতে করিতে, বাহিরের নানা অবস্থার মধ্যে প্রত্যেক জন্তুর চেহারা নানারকম ভাবে গড়িয়া উঠে।

 ডারুইন দেখাইলেন, এইরূপে এবং আরো নানা কারণে, আপনা হইতেই এক-একটা জন্তুর চেহারা নানারকমে বদলাইয়া যায়। সেই কার গল্প তোমরা শুনিয়াছ, যার সবই ঠিক ছিল কেবল নলচে আর মালাটি বদল হইয়াছিল? এক-একটা জানোয়ারও ঠিক সেইরূপ নচে মালা সবই বদল করিয়া নূতন মতি ধারণ করে—তখন তাহাকে সম্পূর্ণ নূতন জন্তু বলিয়া ভুল হওয়া খুবই স্বাভাবিক।

 ডারুইনের কথা বলিতে গেলে দুটি গুণের কথা বিশেষ করিয়া বলিতে হয়—একটি তাঁহার অক্লান্ত অধ্যবসায় আর একটি তাহার মিষ্ট স্বভাব। তাহার শরীর কোনো কালেই খুব সুস্থ ছিল না—জীবনের শেষ চল্লিশ বৎসর সে শরীর একেবারে ভাঙিয়া পড়িয়াছিল। কিন্তু তাহার মনের শক্তি আশ্চর্যরকম সতেজ ছিল। প্রতিদিন ভোরের আগে ঘুম হইতে উঠিয়া তিনি বাগানে যাইতেন-সেখানে ফুল ফল মৌমাছি আর প্রজাপতির সঙ্গে পরিচয় করিতে করিতে কোনদিক দিয়া যে তাঁহার সময় কাটিয়া যাইত, কত সময় তাঁহার সে খেয়ালই থাকিত না।

 ডারুইনকে যাঁহারা জানিতেন, তাঁহারা বলেন যে, সকলকে প্রাণ দিয়া এমন ভালোবাসিতে আর কেহ পারে না। শুধু মানুষ নয়, পশুপক্ষী নয়, গাছের ফুলটিকে পর্যন্ত তিনি এমনভাবে স্নেহের চক্ষে দেখিতেন যে, লোকে অবাক হইয়া যাইত। ১৮৮২ খৃস্টাব্দে তিয়াত্তর বৎসর বয়সে তাঁহার মৃত্যু হইলে ইংরাজ জাতি সেই ‘অল্পবুদ্ধি’ ছাত্রকে পরম আদরে বিজ্ঞানবীর নিউটনের পাশে সমাধি দেন।