সুকুমার রায় সমগ্র রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড)/জীবনী/পাস্তুর

উইকিসংকলন থেকে

পাস্তুর

 মানুষের যতরকম রোগ হয়, আজকালকার ডাক্তারেরা বলেন, তার সবগুলিই অতি ক্ষুদ্র জীবাণুর কীতি। এই জীবাণু বা মাইক্রোব’ (Microbe) গুলিই সকল রোগের পথেঘাটে বাতাসে মানুষের শরীরের ভিতরে বাহিরে ইহারা ঘুরিয়া বেড়ায়। আজকালকার চিকিৎসাশাস্ত্রে ইহাদের খাতির খুব বেশি। এই জীবাণুগুলির ভালোরূপ পরিচয় লওয়া, ইহাদের চালচলনের সংবাদ রাখা এবং এগুলিকে জব্দ করিবার নানাপ্রকার ব্যবস্থা করা, এখনকার ডাক্তারিবিদ্যার খুব একটা বড় ব্যাপার হইয়া পড়িয়াছে এবং তাহার ফলে চিকিৎসাপ্রণালী আশ্চর্যরকম উন্নতি লাভ করিয়াছে। এই-সমস্ত উন্নতি এবং এই নুতন প্রণালীর মুলে ফরাসী পণ্ডিত লুই পাস্তুর। পাস্তুর একা এ বিষয়ে নূতন আবিষ্কার ও নূতন চিন্তা দ্বারা মানুষের জ্ঞান ও চেষ্টাকে যে কতদূর অগ্রসর করিয়াছেন, ভাবিলে অশ্চির্য হইতে হয়।

 প্রায় চুরানব্বই বৎসর আগে পাস্তুরের জন্ম হয়। অতি অল্প বয়স হইতেই শিক্ষকদের মুখে তাঁহার বুদ্ধির প্রশংসা শুনা যাইত। সে সময়কার বড়ো-বড়ো বৈজ্ঞানিকদের কাছে তিনি বিজ্ঞানশিক্ষা করিয়াছিলেন এবং সেই সময় হইতেই রসায়নবিদ্যায় তাহার খুব নাম শুনা গিয়াছিল। পঁয়তাল্লিশ বৎসর বয়সে যখন তিনি অধ্যাপক নিযুক্ত হইয়া পারিসে আসেন তখনো লোকে তাঁহাকে খুব বড়ো রাসায়নিক পণ্ডিত বলিয়াই জানি। কিন্তু দেখিতে দেখিতে তাঁহার চোখ পড়িল আর-একটা ব্যাপারের উপরে-‘জিনিস পচে কেন? এই প্রশ্ন লইয়া তিনি ভারি ব্যস্ত হইয়া পড়িলেন। তাঁহার বন্ধুবান্ধবেরা এবং পুরাতন শিক্ষকেরা ইহাতে ভারি দুঃখিত হইলেন। সকলেই বলিতে লাগিলেন, “পারের এমন বুদ্ধি হিল, চেষ্টা করিলে সে রসায়নশাস্ত্রে কত কি করিতে পারিত। সে কিনা একটা বাজে বিষয় লইয়া সময় নষ্ট করিতে বসিল।”

 কিন্তু পাস্তুর ছাড়িবার লোক নহেন। তিনি ভাবিলেন ব্যাপারটা তলাইয়া দেখিতে হইবে। আগে লোকের ধারণা ছিল সব জিনিস বাতাস লাগিয়া আপনা-আপনি’ পটিয়া যায়। পাস্তুর দেখাইলেন, দুধে একপ্রকার জীবাণু থাকে যাহার জন্য দুধ উকিয়া নষ্ট হইয়া যায়। মাখন যে পচে তাহাও আর-এক প্রকার জীবাণুর কাণ্ড। ভাত চিনি বা ফলের রস পচাইয়া যে মদ প্রস্তুত হয়, সেখানেও জীবাণু। নানাপ্রকার জীবাণু বাতাসে ঘুরিয়া বেড়ায়, সেইজন্যে অনেক জিনিস আদুল রাখিলে তাহা শীঘ্র নষ্ট হইয়া যায়। পাস্তুর আরো দেখাইলেন যে, খুব গরম লাগাইলে এই জীবাণুগুলি মরিয়া যায়। এইরাপে জীবাণু নষ্ট করিয়া এক টুকরা মাংস বা খানিকটা দুধ একটা শিশির মধ্যে আঁটিয়া বন্ধ করিয়া দেখা গেল যে, এ অবস্থায় সেগুলি আর পচিতে পারে না। আজকাল লোকে দুধ জমাইয়া টিনে আঁটিয়া বিক্রি করে, নানাপ্রকার ফল চিনির রসে ফুটাইয়া মাসের পর মাস বোতলে পুরিয়া রাখে, কতরকম মাছ মাংস, কতরকম খাবার জিনিস বাতাসশুন্য পাত্রে করিয়া চালান দেয়। পাস্তুর যদি জীবাণু তাড়াইয়া জিনিস বাঁচাইবার সংকেতটি বলিয়া দিতেন, তবে এ-সকল কিছুই সম্ভব হইত না।

 এই সময়ে ফুান্সে রেশম পোকার একরকম রোগ দেখা দিয়া, রেশমের কারবারের ভয়ানক ক্ষতি আরম্ভ করিল। পাস্তুর এই ব্যাপারটার সন্ধান করিতে গিয়া দেখিলেন, এই রোগের মুলে একপ্রকার জীবাণু। সেই জীবাণুকে নষ্ট করিবার উপায় আবিষ্কার করিয়া তিনি রোগ দূর করলেন। ইহার পর পশুপাখির রোগের কথা আপনা হইতেই আসিয়া পড়িল। ঘেয়ো জ্বরের উৎপাতে দেশের ছাগল গোরু উজাড় হয় দেখিয়া তিনি সেই ঘেয়ো জ্বর দূর করিবার চেষ্টা করিতে লাগিলেন। ঘেয়ো জ্বরের জীবাণুর সন্ধান করিয়া তাহার উপর নানারূপ পরীক্ষা করিয়া দেখিলেন। ইহার ফলে তিনি যে চিকিৎসাপ্রণালী আবিষ্কার করিলেন, ডাক্তারমহলে এখনো তাহার জয়জয়কার চলিতেছে।

 তিনি বলিলেন, রোগের বীজকে কাহিল করিয়া সেই বীজের টীকা দাও—তাহাতেই রোগ সারিবে। যাহার রোগ হইয়াছে তাহার দেহ হইতে জীবাণু সংগ্রহ করিয়া সেগুলিকে সাবধানে রাখিয়া বাড়িতে দাও, তার পর অন্য প্রাণীর দেহে সেই জীবাণুর সাহায্যে রোগ প্রবেশ করাও। এই প্রাণীটি যখন রুগ্ন হইবে এবং তাহার দেহে লক্ষ লক্ষ জীবাণু দেখা দিবে—তাহার শরীর হইতেই টীকার বীজ পাওয়া যাইবে।

 পাগলা কুকুরে কামড়াইলে মানুষের ‘জলাতঙ্ক রোগ হয়। এই ভয়ানক রোগের জীবাণুগুলি এতই ছোটো যে, সেগুলি অণুবীক্ষণেও দেখা যায় না। কিন্তু পাস্তুর বলিলেন, “চোখে দেখা যাউক আর নাই যাউক, জীবাণু আছেই।” সেই অদৃশ্য জীবাণুর দ্বারা তিনি অন্য প্রাণীর মধ্যে রোগ জন্মাইয়া, তীকার বীজ প্রস্তুত করিলেন। একটি চাষার ছেলেকে নেকড়ে বাঘে কামড়াইয়াছিল—পাস্তুরের সর্বপ্রথম পরীক্ষা হইল তাহার উপরে। এই বালক যখন বাঁচিয়া গেল, তাহার পর হইতেই পাস্তুরের চিকিৎসাপ্রণালী ডাক্তারমহলে একেবারে পাকা হইয়া পড়িয়াছে। পারিস নগরে পাস্তুরের নামে যে বিজ্ঞানমন্দির প্রতিষ্ঠা করা হইয়াছে, তাহার সম্মুখে এই কৃষক বালকের একটি সুন্দর প্রতিমূর্তি আছে।

 এক সময়ে ডাক্তারেরা মানুষের দেহে একটু ছুরি চালাইতে হইলেই কত ব্যস্ত হইতেন, কিন্তু এখনকার অস্ত্রচিকিৎসক মানুষের হাত পা কাটিতেও আর ইতস্তত করেন না, কারণ তিনি জানেন, রোগের বীজ তাড়াইলেই আর ভয় নাই। তাই এত হাত ধোয়াধোয়ি, ফুটন্ত জলে ছুরি কাঁচি ডুবানো, এত সাবান আর এত কার্বলিক এসিড, নির্দোষ তুলা ও ব্যাণ্ডেজের জন্য এত কড়াকড়ি-দুষ্ট জীবাণু যাহাতে কোনো ফাকে ঢুকিতে না পারে। যুদ্ধের জায়গায় হাজার হাজার লোক আহত হইতেছে। তাহার শতকরা আশিজন বাঁচিয়া উঠিতেছে কেবল পাস্তুরের প্রসাদে। অজি বিশ বৎসর হইল পাস্তুর মারা গিয়াছেন। ফরাসি জাতি রাজসম্মানে তাহার সমাধি দিয়া, সেই সমাধির উপর তাহারই নামে বিতান মন্দির প্রতিষ্ঠা করিয়াছে, সেখানে এখনো নূতন নূতন আবিষ্কার চলিতেছে। পাস্তুরের শিষ্যেরা এখন পৃথিবীর চারিদিক ছাইয়া ফেলিয়াছেন, তাহারই পদাঙ্ক অনুসরণ করিয়া এখনো কত লোক কত কীর্তি সঞ্চয় করিতেছে।

 পাস্তুরকে জিজ্ঞাসা করা হইয়াছিল, “তুমি সারা জীবন ধরিয়া কি দেখিলে এবং কি শিখিলে?” পাস্তুর বলিলেন, “দেখিলাম, এ জগৎব্যাপারের সকলই আশ্চর্য, সকলই অলৌকিক।”

সন্দেশ—জ্যৈষ্ঠ, ১৩২৩