সুকুমার রায় সমগ্র রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড)/নানা নিবন্ধ/অসুরের দেশ

উইকিসংকলন থেকে
পুণ্যলতা চক্রবর্তী, কল্যাণী কার্লেকর সম্পাদিত
(পৃ. ১৭৪-১৭৭)
অসুরের দেশ

 যে-জাতি শিল্পে বাণিজ্যে বেশ অগ্রসর, যাহারা লেখাপড়ার চর্চা করে, হিসাব করিয়া পাকা দালান ইমারত গাঁথিতে জানে এবং নানারূপ ধাতু ও অস্ত্রশস্ত্রের ব্যবহারে বেশ অভ্যস্ত, মোটের উপর তাহাকে সত্য জাতি বলা যায়। ইতিহাসের প্রাচীন যুগে যে-সকল সভ্য জাতির নাম পাওয়া যায় তাহার মধ্যে একটা জাতির কথা শুনি যাহার নাম অসুর বা আশুর। ইংরাজিতে তাহাকে বলে আসিরিয়া (Assyria)। এই অসুর দেশের নাম প্রাচীন বাইবেল প্রভৃতি পুরাতন পুঁথিতে অনেক স্থানে পাওয়া যায় এবং একশত বৎসর আগে এই দেশের সঙ্গে মানুষের ঐটুকু মাত্র পরিচয় ছিল। মানুষ অসুরের দেশ ও তাহার রাজধানী নিনেভের কাহিনী কেবল পুঁথিতেই পড়িয়া আসিত কিন্তু তাহার চেহারা কেহ চোখে দেখে নাই। কারণ, যেখানে শহর ছিল সে স্থানে খোঁজ করিতে গেলে কেবল মাটির টিপি আর প্রকাণ্ড ময়দান ছাড়া আর কিছুই দেখা যাইত না।

 এই অসুরের সঙ্গে আমাদের পুরাণের অসুরদের কোনো সম্পর্ক আছে কি না তাহা আমি জানি না। এখন মেসোপটেমিয়ার যেখানে ইংরাজের সহিত তুর্কির লড়াই চলিতেছে তাহার প্রায় তিনশত মাইল উত্তরে প্রাচীন অসুরের দেশ ছিল। ইহা কেবল আন্দাজের কথা নয়—বাস্তবিকই সেখানে ময়দান খুঁড়িয়া মানুষ সেই পুরাতন লুপ্ত শহরকে বাহির করিয়াছে। প্রায় সাড়ে চারহাজার বৎসরের পুরাতন শহর, সেখানে এই অসুর জাতি দু হাজার বৎসর রাজত্ব করিয়া পরে যুদ্ধবিগ্রহে একেবারে ধ্বংস পায়। সেও প্রায় আড়াই হাজার বৎসর আগেকার কথা—তখনো বুদ্ধের জন্ম হয় নাই।

 কথায় বলে ‘সুখে থাকতে ভূতে কিলোয়'। এক-একজন লোক থাকে তাহাদের অন্নবস্ত্রের অভাব নাই, সংসারে বিশেষ কোনো দুঃখ নাই অথচ তাহাদের কী যে খেয়াল, তাহারা ঘরবাড়ি ছাড়িয়া একটা কোনো হাঙ্গামা লইয়া ব্যস্ত থাকে। উত্তরে দক্ষিণে বরফের দেশে, আফ্রিকার মরুভূমিতে, পাহাড়ের চূড়ায় তাহারা অস্থির হইয়া ঘুরিয়া বেড়ায়। এইপ মাথা-পাগলা লোকের দ্বারা জগতের অনেক বড়ো-বড়ো আবিষ্কার হইয়া গিয়াছে। অসুরের রাজ্য আবিষ্কারও এইরূপেই হয়। লেয়ার্ড (Layard) নামে এক ইংরাজ সিংহলে কি একটা ভালো চাকরি পাইয়া এ দেশে আসিতেছিলেন। সোজা পথে জাহাজে চড়িয়া আসিলেই হইত, কিন্তু তাঁহার শখ হইল ডাঙার পথে মেসোপটেমিয়া, পারস্য প্রভৃতি দেখিয়া তিনি এ দেশে আসিবেন।

 কিন্তু ঐ-যে খেয়ালের মাথায় তিনি মেসোপটেমিয়া গেলেন, উহাতেই তাহার সব কাজকর্ম উলটাইয়া গেল। মেসোপটেমিয়ার উত্তরে বেড়াইবার সময় তাহার মনে হইল এই তো সেই প্রাচীন সভ্য জাতির দেশ, এখানে খুঁজিলে কি তাহাদের চিহ্ন পাওয়া যায় না? তাঁহার আর চাকরি করা হইল না-তিনি কতকগুলি মজুর লইয়া মাটি খুঁড়িতে লাগিলেন। খুঁড়িতে খুঁড়িতে তাঁহার সঙ্গের টাকাপয়সা সব ফুরাইয়া আসিল, তিনি আবার টাকা সংগ্রহ করিতে লাগিলেন। ইতিমধ্যে তাঁহার দেখাদেখি আরো দু-চারটি লোক আসিয়া মাটি-খোঁড়া ব্যাপারে যোগ দিল। তখন তুর্কি রাজকর্মচারীদের মনে সন্দেহ জাগিল, এই লোকগুলা খামকা ঘরবাড়ি ছাড়িয়া বিদেশে আসিয়া মাটি কাটিতে চায় কেন? নিশ্চয়ই ইহাদের মনে কোনো দুষ্ট মতলব আছে। সুতরাং তাহারা মার্টি-কাটা বন্ধ করিয়া দিতে চাহিল। তার পর যখন মাটির ভিতর হইতে নানারকম অদ্ভুত মূর্তি আর ঘরবাড়ি বাহির হইতে লাগিল তখন এই আশ্চর্য কাণ্ড দেখিয়া সে-দেশী মজুরগুলা এমন ঘাবড়াইয়া গেল যে, তাহারাও কাজ করিতে চায় না। ইহার উপর সে দেশে নানারকম হিংস্র জন্তুর অত্যাচার ও জ্বরজারির উৎপাত তো ছিলই।

 যাহা হউক, অনেক পরিশ্রম ও চেষ্টার ফলে—ইংরাজ ও ফরাসি গভনমেণ্টের সাহায্যে শেষটায় মাটির নীচ হইতে একেবারে অসুরের রাজধানী বাহির হইয়া পড়িল। সে এক আশ্চর্য দৃশ্য। কবে আড়াই হাজার বছর আগে সে শহর ধ্বংস হইয়াছে, লোকজন কোনকালে সে-দেশ ছাড়িয়া কোথায় চলিয়া গিয়াছে অথচ এতদিন পরে তাহাদের সেই পুরাতন কীর্তিগুলি আবার কঙ্কালের মতো মাটির নীচ হইতে মাথা তুলিয়া দাঁড়াইতেছে।

 সেকালের ইতিহাসে জানা যায় যে, নিনেভে শহর শত্রুর হাতে পড়িয়া আগুনে নষ্ট হয়-তাহার প্রমাণ এখনো চারিদিকে দেখিতে পাওয়া যায়। কিন্তু আগুনেও সব নষ্ট করিতে পারে নাই। এখনো কত মূর্তি, কত কারুকার্য আর পাথরে আঁকা কত ছবি আছে যাহা দেখিলে মনে হয় না যে এগুলি সেই লুপ্ত যুগের জিনিস। সেই সময়ে যে-সকল রঙ ব্যবহার হইত সেই রঙগুলি পর্যন্ত এক-এক জায়গার বেশ পরিষ্কার দেখা যায়। এক-একটি ঘরের ছাদ, দেওয়াল প্রভৃতি এমন অবস্থায় আছে যে, সমঝদার লোকে তাহা দেখিয়া বলিতে পারে নুতন অবস্থায় ঘরটি ঠিক কিরকম ছিল। এই-সকল ছবি ও মূর্তি দেখিলে বোঝা যায় যে, সে দেশের লোকদের বেশ সৌন্দর্যজ্ঞান ছিল। ছবির মধ্যে লড়াই ও শিকারের ছবিই খুব বেশি—মাঝে মাঝে রাজারাজড়ার ছবিও আছে। ছবি দেখিয়া সে দেশের লোকদের অস্ত্রশস্ত্র, পোশাক ও চেহারা সম্বন্ধে অনেক খবর জানা যায়। অসুরের দল আর তাহাদের শত্রুর দলের মধ্যে এ বিষয়ে কিরূপ তফাত ছিল, তাহাও অনেক ছবিতে পরিষ্কার দেখানো হইয়াছে। অসুরেরা বড়োই যুদ্ধপ্রিয় ছিল এবং প্রায়ই অন্যান্য জাতিদের সঙ্গে লড়াই লইয়া ব্যস্ত থাকিত।

 অসুরদের কথা বলিতে হইলে তাহাদের ভাষার কথাও বলিতে হয়। সে ভাষায় এখন আর কেহ কথা বলে না, সে দেশের লোকেরা পর্যন্ত তাহার সম্বন্ধে কোনোরূপ সংবাদ জানে না—ভাষার একমাত্র চিহ সেকালের অক্ষর। মাটির উপর বাটালি দিয়া তীরের ফলকের মতো অদ্ভুত সব আঁচড় কাটিয়া অক্ষর লেখা হইত! সেই মাটি পোড়ইয়া ইটের ‘পুঁথি’ তৈয়ারি হইত। একশত বৎসর আগে সে অক্ষর পড়িতে পারে এমন লোক পৃথিবীতে ছিল না। অথচ আজকাল পণ্ডিতেরা এই-সব আঁচড় পড়িয়া তাহা হইতে কত সংবাদ কত ইতিহাস উদ্ধার করিতেছেন। বিদ্যা বুদ্ধি ও বাণিজ্যে বাবিলনের লোকেরা অসুরদের চাইতে অনেক বেশি অগ্রসর ছিল, সুতরাং তাহাদের ভাষা ধর্ম শিল্প সাহিত্য আইনকানুন প্রভৃতি প্রায় সকল বিষয়েই অসুরেরা বাবিলনের অল্পাধিক অনুকরণ করিত। একটা উঁছু পাহাড়ের গায়ে বাবিলনের অক্ষরের পাশে পারস্যের অক্ষরে লেখা একটা যুদ্ধের বর্ণনা দেখিয়া একজন ইংরাজ পণ্ডিত এই দুয়ের তুলনা করিয়া বাবিলনের অক্ষরের সংকেত বাহির করেন। এইভাবে গ্রীক অক্ষরের সাহায্যে ইজিপ্টের অদ্ভুত ছবিওয়ালা অক্ষরের রহস্য বাহির করা হয়। এই-সকল পুরাতন অক্ষরে লেখা ইটের পুঁথি, কীর্তিস্তম্ভ বা খোদাই-করা পাহাড় প্রভৃতি হইতে অসুরদের ইতিহাসের অনেক কথা জানা গিয়াছে। অনেক রাজার নাম ও তারিখ, অনেক যুদ্ধবিগ্রহের বর্ণনা, ছোটো বড়ো নানা জাতির সহিত সন্ধি ও বিবাদের সংবাদ এ-সমস্তই যথেষ্ট পরিমাণে পাওয়া যায়। অসুরদের প্রধান অস্ত্র ছিল তীর-ধনুক। তাহারা ঘোড়ায় ও রথে চড়িয়া যুদ্ধ করিত, সঙ্গে পদাতিক সৈন্যও থাকিত। যেমন যোদ্ধা তেমনি শিকারী। আমাদের দেশের মতো অসুরের দেশেও সেকালের রাজারা মৃগয়া করিতেন। হিংস্র জন্তু নষ্ট করিয়া প্রজাকে রক্ষা করা রাজারই কর্তব্য বলিয়া গণ্য হইত।

অসুরে রাজাদের বীরত্বের কথা বলিতে গেলে একজনের কথা বিশেষভাবে বলা উচিত, তাহার নাম টিগলাৎ-পিলেসের। তিন হাজার বৎসর আগে ইনি অসুর দেশের রাজা হইয়া নানা দেশ জয় করেন। তাঁহার শাসনে অসুরের রাজ্য ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত ছড়াইয়া পড়িয়াছিল। ইনি যখন উত্তরে দিগ্বিজয় করিতে বাহির হন তখন বাবিলনের সৈন্যেরা তাঁহার রাজ্য আক্রমণ করে এবং রাজমন্দিরের দেবমূর্তি চুরি করিয়া লইয়া যায়। টিগলাৎ-পিলেসের ইহার প্রতিশোধের জন্য বাবিলন আক্রমণ করেন ও তাহার রাজধানী পর্যন্ত লুটিয়া অনেকখানি দেশ অধিকার করিয়া ফেলেন। একদিকে যেমন যোদ্ধা, অন্যদিকে টিগলাৎ-পিলেসের একজন অসাধারণ শক্তিশালী শিকারী ছিলেন। হাতি সিংহ প্রভৃতি ভয়ানক জন্তু তিনি নিজের হাতে তীর-ধনুক ও তলোয়ার লইয়া শিকার করিতেন। তিনি রথে চড়িয়া প্রকাণ্ড দশটা হাতি ও প্রায় আটশত সিংহ শিকার করেন -ইহা ছাড়া পায়ে হাঁটিয়া যে-সকল সিংহ মারেন তাহার সংখ্যাও একশতের উপর হইবে।

 টিগলাৎ-পিলেসের মারা গেলে পর অসুরদের অবস্থা ক্রমেই খারাপ হইয়া পড়ে। তাহাদের প্রকাণ্ড রাজ্য ক্রমেই ছোটো হইতে থাকে। প্রায় দুইশত বৎসর পরে আরো কয়েকটি শক্তিশালী রাজার আবির্ভাব হয় এবং ইহারা আবার দেশকে জাগাইয়া তোলেন। এই-সকল রাজাদের মধ্যে অসুর-নসির-পালের নাম বিশেষ উল্লেখযোগ্য। ইহার রাজত্বকালের নানারূপ চিহ্ন ও পরিচয় খুব প্রচুর পরিমাণে পাওয়া গিয়াছে এবং তাহাতে দেখা যায় যে, ইনি একদিকে যেমন শৌখিন, অপর দিকে যুদ্ধের সময় তেমনি হিংস্র ও নিষ্ঠুর ছিলেন। দেশ-বিদেশের লোক তাহার নামে ভয়ে কাঁপিত!

 ইহার রাজত্বের পর হইতে ক্রমে আবার অসুরদের অবনতি আরম্ভ হয়। তার পর অসুররাজকুলের শেষ যোদ্ধা মহাবীর অসুরবানি-পালের সময়ে আর একবার এ দেশ মাখা তুলিয়া উঠে। উৎসাহের চোটে অসুরেরা একেবারে আফ্রিকায় গিয়া ইজিপ্ট জয় করিয়া ফেলিল- দক্ষিণে আরবের মরুভূমিতে সসৈন্যে হাজির হইল। কিন্তু ইহাই তাহাদের শেষ কীর্তি। ক্রমাগত যুদ্ধ-বিদ্রোহের ফলে সমস্ত জাতি যখন অবসন্ন হইয়া পড়িল তখন প্রবল শত্রুরাও সুযোগ বুঝিয়া চারিদিক হইতে তাহাদের রাজ্য লুটিয়া লইল। অবশেষে পারস্যের দুর্দান্ত সেনাদল আসিয়া তাহাদের রাজধানী ঘিরিয়া ফেলিল। নিনেভে শহরের চারিদিকে প্রকাণ্ড দেওয়াল ঘেরা। এই দেওয়ালের জোরে অসুরেরা তিন বৎসর ধরিয়া তাহাদের প্রাচীন শহরের জন্য লড়াই করিল—কিন্তু অবশেষে হার মানিতেই হইল। তার পর এতদিনের সাধের শহর শত্রুর হাতে পড়িয়া একেবারে ছারখার হইয়া গেল।

 কোথায়-বা অসুর রাজ্য-আর কোথায়-বা সেই অসুর জাতি। দুহাজার বছর সারা দেশ কাঁপাইয়া যাহারা রাজত্ব করিল এখন কেই-বা তাহাদের খবর রাখে। অত বড়ো নিনেভে শহর, সেও মাটির নীচে কবর চাপা পড়িল। এখন আবার লোকে সেই কবর খুঁড়িয়া তাহার কংকাল বাহির করিয়াছে। সেখানে গিয়া দেখ শ্মশানের মতো দেশ, লোক নাই জন নাই, আছে কেবল মৃত শহরের জীর্ণ কংকাল, আর রাত্রের অন্ধকারে সিংহের হুংকার।

সন্দেশ-মাঘ, ১৩২৩