সুকুমার রায় সমগ্র রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড)/নানা নিবন্ধ/আকাশবাণীর কল

উইকিসংকলন থেকে
আকাশবাণীর কল

 একজন বক্তা, তার তিনলক্ষ শ্রোতা। একজন কথা বলছে, বক্তৃতা করছে, গান গাইছে, বাজনা বাজাচ্ছে আর তিনলক্ষ লোক তার প্রত্যেকটি সুর পরিষ্কার করে শুনতে পাচ্ছে। কথাটা শুনতে কেমন অসম্ভব শোনায় না? কিন্তু আমেরিকার বড়ো-বড়ো শহরে এরকম আজকাল প্রতিদিনই ঘটছে। আরো আশ্চর্য এই যে, এই তিনলক্ষ লোক, যারা সকলে মিলে বক্তৃতা শুনছে তারা সব এক জায়গায় বসে থাকে না। কেউ দুই মাইল চার মাইল, কেউ বিশ মাইল পঁচিশ মাইল দুরে, যে যার ঘরে আরাম করে বসে বসে বক্তৃতা শোনে। এমন-কি, দেড়শো-দুশো মাইল দূর থেকেও লোকের বক্তৃতা শুনবার কোনো বাধা হয় না। দুবছর আগেও এরকম হওয়া সম্ভব বলে লোকে মনে করতে পারত না। কিন্তু আজকাল বিনা তারের টেলিফোন হওয়াতে এ-সব সম্ভব এবং সহজ হয়েছে।

 তুমি যখন কথা বল তখন তোমার গলার আওয়াজ চারিদিকে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। যতদূর পর্যন্ত সে আওয়াজ যায় ততদূর পর্যন্ত বাতাসে নানারকম ঢেউ খেতিয়ে যায়। মোটা গলার বড়ো-বড়ো ঢেউ সরু গলার ছোটো-ছোটো ঢেউ। চেঁচিয়ে বললে বাতাসে জোরে জোরে ঢেউয়ের ধাক্কা লাগে, আস্তে বললে সে ঢেউ বাতাস ঠেলে বেশি দূর এগোতেই পারে না। কিন্তু যেমন করেই কথা বল আর যত জোরেই বল, খানিক দূর পর্যন্ত গিয়ে সে ঢেউ আপনি মিলিয়ে যাবে। তার পরে আর তোমার আওয়াজ পৌঁছবে না।  যে কলের সাহায্যে গলার আওয়াজকে, অথবা অন্য যে কোনোরকম শব্দকে অনেক দূর পর্যন্ত পাঠিয়ে দেওয়া যায় তার নাম 'টেলিফোন’। আজকাল অনেক বড়ো-বড়ো শহরে টেলিফোনের কল দেখতে পাওয়া যায়। লোকে একটা হাতলের মতন জিনিস কানে লাগিয়ে তার চোঙার ভিতর কথা বলে, আর অনেক দূরের লোক সেইরকম আর-একটা কল কানে দিয়ে সে কথা শুনতে পায়। দুজনের মধ্যে খালি সরু তারের যোগ। সেই তারের ভিতর দিয়ে সারাক্ষণ বিদ্যুৎ চলে, আর সেই বিদ্যুতের স্রোত শব্দের ঢেউগুলোকে এক জায়গা থেকে আর-এক জায়গায় পৌঁছে দেয়, এই উপায়ে অনেক মাইল পর্যন্ত শব্দ পাঠানো সম্ভব হয়।

 কিন্তু গোড়ায় যে টেলিফোনের কথা বলা হয়েছে, যাতে তিনলক্ষ লোক একসঙ্গে টেলি-ফোনের আওয়াজ শুনতে পায়, তাতে তার-টার কিছুরই দরকার হয় না। তা যদি দরকার হত, তা হলে ভেবে দেখ কত লক্ষ মাইল তার বসাতে হত আর তার জন্য কত হাজার লক্ষ টাকা খরচ করতে হত। তার বদলে এখন কেবল ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ টাকা খরচ করলেই তুমি তোমার ঘরে বসে বহু দূরের কথা ও গান-বাজনা অনায়াসে শুনতে পার।

 আমেরিকায় এই-সমস্ত টেলিফোনের কল তৈরি করা আজকাল একটা মস্ত ব্যবসা হয়ে দাঁড়িয়েছে। যারা কল তৈরি করে তারা শহরের একটা কোনো জায়গায় গান বাজনা ও বক্তৃতার স্টেশন বসায়। সেখানে বড়ো-বড়ো কল থাকে, সেই কলে চোঙার সামনে দাঁড়িয়ে বক্তারা বক্তৃতা করে, গায়কেরা গান গায়। বাতাসে যেমন সর্বদাই শব্দের ঢেউ খেলছে; আকাশেও তেমনি আলোর তরঙ্গ, বিদ্যুতের তরঙ্গ সর্বদাই খেলে বেড়াচ্ছে। স্টেশনের কলগুলির কাজ হচ্ছে সমস্ত কথা ও সুরগুলিকে ধরে তা থেকে বিদ্যুতের তরঙ্গ সৃষ্টি করে তাকে আকাশময় ছড়িয়ে দেওয়া। বিদ্যুতের ঢেউগুলি শব্দের বাহন হয়ে চারিদিকে হাজার হাজার মাইল ছড়িয়ে পড়ে। সে শব্দ কানে শোনা যায় না, কারণ সে আর বাতাসের ঢেউ নয়, সে এখন বিদ্যুতের তরঙ্গ। সেই বিদ্যুতের তরঙ্গ যখন তোমার বাড়িতে তোমার টেলিফোনের যন্ত্রে এসে আঘাত করে তখন সে আবার শব্দের ঢেউ হয়ে তোমার কানের ভিতরে কথা ও সুরের সৃষ্টি করে। স্টেশনের যন্ত্রের সামনে যে কথা ও যেমন সুর শোনানো হয় ঠিক সেই কথা তেমনি সুরে অতি পরিষ্কারভাবে তুমি ঘরে বসেই শুনতে পারবে।

 প্রতিদিন কোন সময়ে কি হবে তা সব আগে থেকে ঠিক করে দেওয়া থাকে। যেমন মনে কর বিজ্ঞাপন দেওয়া আছে, সকাল বেলা আটটা থেকে নটা পর্যন্ত খবর শোনানো হবে। সেই সময়ে যদি টেলিফোনে কান দিয়ে থাকি তা হলে শুনতে পাবে যে একজন লোক পরিষ্কার গলায় সেদিনকার সব খবর শোনাচ্ছে। তার আগের চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে যত দেশ থেকে যতরকমের খবর এসেছে, একে একে সব বলে যাচ্ছে। কোথায় যুদ্ধবিগ্রহ হল, কোথায় বড়ো-বড়ো মন্ত্রিসভায় কি কি পরামর্শ স্থির হল, কোথায় কতরকমের কি দুর্ঘটনা ঘটল, এইসমস্ত খবর বলছে। তার পর ক্রিকেট, ফুটবল, ঘোড়দৌড় আর নানারকম খেলা ও আমোদের কথা বলছে। তার পর হয়তো নানারকম জিনিসের বাজার দর আর নানারকম ব্যবসাবাণিজ্যের কথা বলছে। সকলের শেষে সেদিন কখন কি হবে জানিয়ে দিচ্ছে—যেমন “আজ তিনটের সময় ঘোড়দৌড়ের ফল বলা হবে,” “পাঁচটার সময় অমুক বিষয়ে অমুক বক্তৃতা করবেন,” “সাতটা থেকে আটটা অমুক অমুক গাইয়ের গান শোনানো হবে, তার পর এক ঘণ্টা নাচের বাজনা হবে,” “নটার সময় ছোটো ছেলেদের জন্য গল্প শোনানো হবে।” আমেরিকায় এরই মধ্যে নানা শহরে সবসুদ্ধ কয়েক হাজার স্টেশন বসান হয়েছে। সেইসব টেশনের শ্রোতাদের সংখ্যা যে কত, তা এ থেকেই বুঝতে পারবে যে এক নিউইয়র্ক শহরেই তিনলক্ষের বেশি শ্রোতা প্রতিদিন বিনা তারে টেলিফোন শোনে।

 অনেকগুলো ষ্টেশন মিলে যখন একসঙ্গে আকাশে ঢেউ ছড়াতে থাকে তখন অনেক লোকের একসঙ্গে কথা বলার মতো একটা ভয়ানক গোলমালের সৃষ্টি হতে পারে। সেইজন্য স্টেশনওয়ালারা নিজেদের মধ্যে এরকম বন্দোবস্ত করে নিয়েছে যে এক-এক ষ্টেশন থেকে খালি এক-এক রকমের ঢেউ ছাড়া হবে। আকাশে যে বিদ্যুতের তরঙ্গ ওঠে তাকে স্টেশনওয়ালাদের ইচ্ছামতো ছোটো বা বড়ো করা যায়। যেমন একটা স্টেশন থেকে যদি একশো হাত লম্বা ঢেউ ছাড়া হয় তা হলে তার পাশের টেশন থেকে নব্বই হাত কি একশো দশ হাত লম্বা ঢেউ ছাড়তে পারে, কিন্তু একশো হাত ঢেউ ছাড়বার হুকুম তাদের নেই। শ্রোতারা যে টেলিফোনের কল ব্যবহার করে তাতে এমন বন্দোবস্ত থাকে যে সে কল খালি একরকম বিদ্যুতের ঢেউয়েতেই সাড়া দিবে। তার চেয়ে ছোটো বা বড়ো ঢেউ এলে কলে কোনোরকম স্পষ্ট আওয়াজ শোনা যাবে না। বেহালার কানে মোচড় দিয়ে যেমন তারের সুর অনেকটা নামানো বা চড়ানো যায় তেমনি টেলিফোনের শব্দ ধরবার যন্ত্রটিকেও নানারকম ঢেউয়ের তালে চড়িয়ে বা নামিয়ে বাঁধা যায়। মনে কর তোমার টেলিফোনের কল এখন যেভাবে বাঁধা আছে তাতে একশো হাত ঢেউওয়ালা ষ্টেশনের শব্দ শোনা যেতে পারে। কিন্তু তুমি বিজ্ঞাপনে দেখলে, আজ সন্ধ্যার সময় নব্বই হাত ঢেউয়ের স্টেশনেতে খুব বড়ো কোনোও ওস্তাদ গান করবে। তুমি ইচ্ছা করলে তোমার কলের বাঁধন বদলিয়ে তাতে নব্বই হাত তরঙ্গ ধরে সেই টেশনের গান শুনতে পার। যারা এই-সব টেলিফোনের কল ব্যবহার করে কেবল তাদের জন্য এর মধ্যেই নানারকম খবরের কাগজ আর মাসিকপত্র বের হতে আরম্ভ করেছে। তাতে কোথায় কোন নুতন ষ্টেশন হচ্ছে, কখন কোথায় কি হবে, টেলিফোন কলের কি কি নতুন উন্নতি হচ্ছে, এই-সমস্ত খবর থাকে। তা ছাড়া কলওয়ালাদের নানারকম বিজ্ঞাপন থাকে; আর টেলিফোনের কল সম্বন্ধে আর তার ব্যবহার সম্বন্ধে নানারকম উপদেশ থাকে।

 সাধারণত যে-সব টেলিফোনের কল ব্যবহার হয়, তাতে কানের উপর চাক্‌তির মতো বা চোঙার মতো টেলিফোনের মুখ বসিয়ে আওয়াজ শুনতে হয়। যতজন শ্রোতা ততগুলো চোঙা বা চাক্‌তি দরকার। কিন্তু আর একটু বেশি টাকা খরচ করলে আর একরকমের টেলিফোনের কল পাওয়া যায় যাতে গ্রামোফোনের চোঙার মতো একটা মস্ত চোঙার ভিতর দিয়ে পরিষ্কার আওয়াজ বেরোতে থাকে। পাঁচ-সাতজন বা বিশ-পঞ্চাশজন লোকে একসঙ্গে বসে সেই আওয়াজ শুনতে পার।

 বিনা তারের টেলিফোন হওয়াতে মানুষের যে কতদিকে কতরকম সুবিধা হচ্ছে তা আর বলে শেষ করা যায় না। ছোট্টোখাট্টো টেলিফোনের কলটি তোমার পকেটে করে সঙ্গে নিয়ে যাও, পথের মধ্যে যেখানে ইচ্ছা একটা বাতি বা থাম কিম্বা টেলিগ্রাফ-পোষ্টের গায়ে কলের তার ঠেকিয়ে নিলেই কতরকম আওয়াজ শুনতে পারবে। যদি নিজের বাড়িতে কিম্বা অফিসে একটি ছোটোখাটো ঢেউ পাঠাবার স্টেশন বসাও তা হলে বাড়ির লোকে বা অফিসের লোকে যখন ইচ্ছা তোমায় খবর পাঠাতে পারবে। তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে পার যে, যেখানেই তুমি থাক-না কেন, হঠাৎ বিশেষ কোনোও দরকার পড়লে কিম্বা কোনো বিপদ-আপদ ঘটলে তখনি তোমার কাছে তার খবর পৌছাতে পারবে।

 এমনি করে 'যে গান কানে যায় না শোনা', যে গান আকাশের তরঙ্গে চড়ে বিদ্যুতের মতো বেগে চারিদিকে ছুটে বেড়ায়, সেই অশব্দ গানকে আকাশময় ছড়িয়ে দিয়ে মানুষ আবার তাকে কলের মধ্যে ধরে আকাশের ভাষা ও আকাশের সুর শুনছে। আমাদের দেশে গল্প ও পুরাণে যে আকাশবাণীর কথা শুনতে পাই-এও যেন সেই আকাশবাণীর মতো কোথাও কোনো আওয়াজ নাই, জনমানুষের সাড়া নাই, অথচ কলের মধ্যে কান দিলেই শুনি আকাশময় কত কণ্ঠের কত ভাষা, কত বিচিত্র গান আর কত যন্ত্রের সুর।

সন্দেশ-ভাদ্র, ১৩২৯