সুকুমার রায় সমগ্র রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড)/নানা নিবন্ধ/আশ্চর্য আলো

উইকিসংকলন থেকে
পুণ্যলতা চক্রবর্তী, কল্যাণী কার্লেকর সম্পাদিত
(পৃ. ২০৮-২১০)
আশ্চর্য আলো

 আজকাল শহরে শহরে বিদ্যুতের আলো দেখা যায়। জাহাজে রেলগাড়িতে সবখানেই ‘বিজলীবাতি’র আমদানি হইয়াছে। জল জোগাইবার জন্য রাস্তায় যেমন নল বসানো হয়, ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পাঠাইবার জন্য সেইরকম লোহা বা তামার তার খাটাইতে হয়। জলের কারখানায় বড়ো-বড়ো দমকলের চাপে জল ঠেলিয়া উঁচুতে তোলে, সেই তোলা-জল শহরের নল বাহিয়া চারিদিকে ছড়াইয়া পড়ে। বিদ্যুতের ব্যবস্থাও কতকটা সেইরকম —বিদ্যুতের কারখানায় বড়ো-বড়ো কলে বিদ্যুৎ জমাইয়া রাখে, আর সেই বিদ্যুৎ আপনার চাপে তারের পথ ধরিয়া বহুদূর পর্যন্ত ছুটিয়া যায়। নলের মুখ বন্ধ থাকিলে যেমন জল আর চলে না, তেমনি তার কাটিয়া দিলে বা কোনোখানে তারের জোড় খুলিয়া গেলে বিদ্যুতেরও চলার পথ বন্ধ হইয়া যায়। কিন্তু জলের চাপ যদি খুব বেশি হয়, তবে সে অনেক সময়ে সকল বাধা ঠেলিয়া আপনার পথ করিয়া লয়-জলের তোড়ে রাস্তাঘাট ভাসাইয়া বিষম কাণ্ড উপস্থিত করে। সেইরকম বিদ্যুতের প্রবল স্রোত যদি সহজ পথ না পায় তবে সেও আকাশ চিরিয়া জোর করিয়া আপনার পথ কাটিতে জানে। ঝড়ের সময়ে আকাশ ফুঁড়িয়া মেঘে মেঘে বিদ্যুতের হানাহানি চলে, সেই পথহারা বিদ্যুৎ পৃথিবীর ঘাড়ে পড়িলে যে ভয়ানক কাণ্ড হয় তাহারই নাম ‘বাজ পড়া'। নর্দমা কাটিয়া যেমন জল সরায়, বুদ্ধিমান মানুষে তেমনি বাড়ির পাশে লোহার শিক খাড়া করিয়া বিদ্যুতের জন্য সহজ পথ করিয়া রাখে।

 পণ্ডিতেরা বোতলের ভিতরে এইরকম বিদ্যুৎ ছুটাইয়া অনেক আশ্চর্য পরীক্ষা করিয়াছেন। বোতলটাকে খালি করিয়া তাহার মধ্যে বিদ্যুৎ চালাইলে অতি অদ্ভুত রঙিন আলোর খেলা দেখা যায়। কেবল রঙের খেলা নয়, পণ্ডিতেরা তাহার মধ্যে এমন সব আশ্চর্য কাণ্ড দেখিতে পান যে তাহার আলোচনার জন্যই কত লোকে সারা জীবন ভরিয়া খাটিতেছেন।

 বোতলকে 'খালি' করার কথা বলিলাম কিন্তু তাহার অর্থ কি? সাধারণত, আমরা যাহাকে ‘খালি বোতল’ বলি তাহা মোটেও খালি নয়, কারণ, তাহার ভিতরটা আগাগোড়াই বাতাসে পোরা। সেই বাতাসকে কলে চুষিয়া বাহির করিলে যাহা থাকে পণ্ডিতেরা তাহাকে বলেন Vacuum অর্থাৎ ফাঁকা আকাশ। এইরকম একটা বোতলের দুই দিকে তার জুড়িয়া তাহার মধ্যে বিদ্যুতের ঝিলিক চালাইলে দেখা যায় যে সেই ফাঁকা বোতলের মধ্যে বিদ্যুতের এক নূতন চেহারা বাহির হয়। বিদ্যুতের তেজ স্নিগ্ধ জ্যোতির মতো বোতলের এক মাথা হইতে আর এক মাথায় ছড়াইয়া পড়ে, আর বোতলের ভিতরটা আশ্চর্য সুন্দর আলোয় ভরিয়া জ্বলজ্ব করিতে থাকে।

 দেখিবার জিনিস এবং শিখিবার জিনিস ইহার মধ্যে এত আছে যে সে-সব কথা আজ আর বলিবার সময় নাই, কেবল একটা আশ্চর্য ব্যাপারের কথা এখানে বলিব। তাহার কথা তোমরা অনেকে হয়তো শুনিয়াছ-তাহার নাম “রঞ্জনের আলো বা X-Ray (অজানা আলো)। ফাঁকা বোতলের মধ্যে বিদ্যুতের আঘাতে এই আশ্চর্য আলোর জন্ম হয়। কাঁচ ফুড়িয়া সেই আলো বাহিরে চলিয়া অসে, কিন্তু তাহাকে চোখে দেখা যায় না।

 কোনো কোনো জিনিস আছে, তাহারা নানারকম তেজ শুষিয়া সেই তেজে অবার আপনি আলো দিতে থাকে। একরকম পাথর দেখা যায়, তাহারা দিনের আলোক জমাইয়া রাখে আর অন্ধকারে জ্বল্জ্বল্‌ করে। রাত্রে সময় দেখিবার জন্য আজকাল একরকম ঘড়ি কিনিতে পাওয়া যায়, তাহার কাঁটা ও সময়ের অঙ্কগুলা আপনার আলোয় টিম্‌টিম্ করিয়া জ্বলিতে থাকে। আজকাল যুদ্ধেও এইরূপ মসলা-মাখানো একপ্রকার রঙের ব্যবহার হয়। যেখানে শত্রুর ভয়ে ভালোরকম আলো জ্বালিবার উপায় নাই সেখানে এই জ্বলন্ত রঙের চিহ্ন আঁকিয়া নানারকম সংকেত জানানো হয়, অন্ধকারে পথ দেখাইয়া চলাফেরার সুবিধা করা হয়।

 ফাঁকা বোতলের ঐ অদৃশ্য তেজ ধরিবার জন্যও নানারকম মসলা পাওয়া যায়। একটা পর্দার উপর সেই মসলা মাখাইয়া তাহাকে ঐ বিদ্যুৎ-পোর বোতলের কাছে অনিলেই পর্দাটা আলো হইয়া ওঠে। বোতলটাকে কালো কাগজে মুড়িয়া ফেল, তবুও পর্দা জ্বলিতে থাকিবে। বোতলের উপর কাঠের বাক্স চাপা দেও-কাঠ ভেদ করিয়া সে অদৃশ্য আলো মসলার পর্দাকে জ্বালাইয়া তুলিবে। কিন্তু বিদ্যুৎ চালানো একটিবার বন্ধ করিয়া বোতলের তেজ নিভাইয়া দাও, সেই সঙ্গে পর্দার আলো নিভিয়া যাইবে। পর্দার সামনে একখানা লোহার টুকরা ধর, তাহা হইলেও যেখানে লোহার আড়াল পড়িয়াছে সেইখানে পর্দা জ্বলিবে না—কারণ বোতলের আলো লোহার ভিতর দিয়া যাইতে পারে না। একটা পয়সা আনিয়া পর্দার সামনে ধর, তাহারও পরিষ্কার গোল ছায়া পড়িবে। এইরকম পরীক্ষা করিলে দেখা যায় যে, পর্দার উপর হাড়ের ছায়া পড়ে কিন্তু মাংস বা চামড়ার কোনো ছায়া পড়ে না।

 এইজন্য পর্দার সামনে তোমার জামাসুদ্ধ হাতখানা ধরিলে তোমার জামাও দেখিবে না আর নধরপুষ্ট মাংস-ভরাট আঙুলও দেখিবে না—দেখিবে কতগুলো হাড়ের ছায়া।

 একটি কাঠবিড়ালের ছবি তোল। হবিতে হাড়গোড় সবই উঠিবে—অথচ অমন জমকাল ল্যাজটির চিহ্নমাত্র থাকিবে না। জ্যান্ত জীবের এরকম কংকালছায়া সর্বপ্রথম দেখেন রঞ্জেন বা রণ্ট্‌গেন সাহেব (Rontgen), তিনিই ১৮৯৬ খৃস্টাব্দে, অর্থাৎ বাইশ বৎসর আগে ঐরূপ জ্বলন্ত পর্দার সাহায্যে এই আলো আবিষ্কার করেন। প্রথম যখন তিনি পর্দার সামনে হাতের আড়াল দিয়া দেখেন তখন তিনি স্বপ্নেও ভাবেন নাই যে কতগুলা হাড়ের ছায়া দেখিবেন। তাই হঠাৎ আপনার ‘হাড্ডিসার’ ছায়া দেখিয়া তিনি ভারি আশ্চর্যবোধ করিয়াছিলেন।

 তামাশা হিসাবেও এটা একটা দেখিবার মতো ব্যাপার, তাহাতে আর সন্দেহ কি? কাঠের বাক্সের মধ্যে চামড়ার ব্যাগ, কাগজ কলম, হাড়ের বোতাম, ছুচসূতা, চাবি ভরিয়া একবার পর্দার আলোর সামনে ধর—কাঠের বাক্স ছায়াতে কাঁচের মতো স্বচ্ছ দেখাইবে আর তাহার ভিতরকার ছুঁচ চাবি আর কলমের মুখটা স্পষ্ট হইয়া ধরা পড়িবে। বোতামের ফিকে ছায়া দেখা যাইবে কিন্তু কাগজ সুতা বা চামড়ার ব্যাগ খুঁজিয়া পাওয়া মুস্কিল হইবে-অথচ ব্যাগের ভিতর যদি টাকা পয়সা থাকে তাহারও পরিষ্কার ছায়া পড়িবে।

 কিন্তু পণ্ডিতেরা কেবল তামাশা দেখিয়াই সন্তুষ্ট থাকেন না, তাহারা ইহার নিয়মকানুন বাহির করিয়া ব্যাপারটাকে অনেকরকম কাজে লাগাইয়াছেন। ডাক্তারেরা এই আলোকের সাহায্যে রোগীর দেহ পরীক্ষা করিতেছেন, নানারকম কৌশল করিয়া জ্যান্ত মানুষের বুকের ধুক্‌ধুকানি আর পাকস্থলীর হজমক্রিয়া দেখিতেছেন, শরীরের ভিতরে কোথায় হাড় ভাঙিল, কোথায় গুলি লাগিল, কোথায় উৎকট রোগের সঞ্চার হইল, সব চোখে দেখিয়া তাহার ব্যবস্থা করিতেছেন। আজকালকার যুদ্ধে কত হাজার হাজার আহত সৈন্যকে এই আলোকে পরীক্ষা করিয়া আঘাতের রকমটা স্পষ্ট বুঝিয়া তাহার চিকিৎসা করা হইতেছে। ব্যবসা বাণিজ্যে নানা জিনিসের ভেজাল ধরিবার জন্য ও নানারকম খুঁত পরীক্ষার জন্যও এই আলোর ব্যবহার হয়। প্রথম যাহারা এই-সকল পরীক্ষা করিয়াছিলেন তাঁহারা বুঝিতে পারেন নাই, এ আলো কি সাংঘাতিক জিনিস। অদৃশ্য আলোয় ক্রমাগত কাজ করিতে করিতে অনেকের চোখ অন্ধ হইয়াছে, হাতে সাংঘাতিক ঘা হইয়া হাতটি নষ্ট হইয়াছে, এমন-কি, কেহ কেহ প্রাণ পর্যন্ত দিয়াছেন। এমন সর্বনেশে আলো।

তোমাদের কাহারও মনে কি এমন অহংকার আছে যে তোমার চেহারাটি খুব সুন্দর? যদি থাকে, তবে একটিবার এই আলোতে ঐ মুখখানির ফোটো তুলাইয়া দেখ। তাহা হইলে বোধ হয় আর রূপের দেমাক থাকিবে না।

সন্দেশ-বৈশাখ, ১৩২৫