সুকুমার রায় সমগ্র রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড)/নানা নিবন্ধ/কাঠের কথা

উইকিসংকলন থেকে
পুণ্যলতা চক্রবর্তী, কল্যাণী কার্লেকর সম্পাদিত
(পৃ. ২৭২-২৭৪)
কাঠের কথা

 কেউ কেউ হয়তো বলবে, “দূর ছাই। কাঠের কথা আবার শুনব কি? ভারি তো জিনিস তাই নিয়ে আবার কথা!” তা বলতে পার কিন্তু কাঠ যে মানুষের কাজের পক্ষে কত বড়ো দরকারি জিনিস, তা একবার ভেবে দেখেছ কি? এখন নাহয় সভ্য মানুষে কয়লা, কেরোসিন, গ্যাস বা ইলেকট্রিক চুল্লির ব্যবহার শিখেছে। কিন্তু তার আগে তো জ্বালানি কাঠ না হলে মানুষের রান্নাবান্না কলকারখানা কিছুই চলত না, শীতের দেশে মানুষের বেঁচে থাকাই দায় হত। এই তো কিছুকাল আগেও কাঠের জাহাজ না হলে মানুষে সমুদ্রে যেতে পারত না, কাঠের কড়ি বরগা থাম না হলে তার ঘর বাড়ি তৈরি হত না।

 বলতে পার, এখন তো এ-সবের জন্য কাঠের ব্যবহার কমে আসছে। তা সত্যি। এমনকি, ঘরের দরজা জানালা আসবাবপত্র পর্যন্ত ক্রমে কাঠের বদলে অন্য জিনিস দিয়ে তৈরি হতে থাকবে তাতেও কোনো সন্দেহ নাই! আর পঞ্চাশ বছরের মধ্যেই হয়তো দেখবে, ঘরে ঘরে নানারকম ঢালাই-করা মেটে পাথরের আসবাবপত্র। কিন্তু তবুও দেখা যায় যে খব ‘সভ্য' জাতিদের মধ্যেও কাঠের ব্যবহার ক্রমেই বেড়ে চলছে, কমবার লক্ষণ একটুও দেখা যায় না। প্রতি বৎসরে এত কোটি মণ কাঠ মানুষে খরচ করে এবং তার জন্য এত অসংখ্য গাছ কাটতে হয় যে অনেকে আশঙ্কা করেন, হয়তো বেহিসাবী যথেচ্ছ গাছ কাটতে কাটতে কোনো দিন পৃথিবীতে কাঠের দুর্ভিক্ষ উপস্থিত হবে। এরকম যে সত্যি সত্যিই হতে পারে, তার প্রমাণ নানা দেশে পাওয়া গিয়েছে। আমেরিকার যুক্তরাজ্যে এক সময় এমন প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড বন ছিল আর তাতে এত অসংখ্য গাছ ছিল যে লোকে বলত এ দেশের কাঠ অফুরন্ত-এর সমস্ত পৃথিবীময় কাঠ চালান দিয়েও কোনোদিন এত গাছ কেটে শেষ করতে পারবে না। কিন্তু সে দেশের লোকে এমন বে-আন্দাজ ভাবে এর মধ্যে বন জঙ্গল সব কেটে প্রায় উজাড় করে ফেলেছে যে এখন তারা নিজেরাই অন্য দেশ থেকে কাঠ আমদানী করতে বাধ্য হচ্ছে।

 প্রতিদিন জাহাজ বোঝাই করা লক্ষ লক্ষ মণ কাঠ সাগর পার হয়ে নানা দেশ হতে, নানা দেশে চলেছে। এত কাঠ লাগেই-বা কিসে, আর আসেই-বা কোথা থেকে? কানাডা রুশিয়া নরওয়ে ভারতবর্ষ অস্ট্রেলিয়া-কত জায়গা থেকে কাঠ চলেছে ইউরোপ আমেরিকার বড়ো-বড়ো বন্দরের দিকে। যেখানেই নতুন রেলের লাইন হচ্ছে সেখানেই লাইনের নীচে দিবার জন্য ভারি ভারি কাঠের 'স্লিপার’ চাই—যেখানেই মার্টির নীচে খনি খোঁড়ার কাজ চলছে সেখানেই খনির দেয়ালে ছাদে ঠেকা দিবার জন্য বড়ো-বড়ো কাঠের গুঁড়ি কাঠের থাম দরকার হচ্ছে। ইউরোপের বড়ো-বড়ো শহরে রাস্তা বাঁধাবার জন্য কত অসংখ্য কাঠ ইঁটের মতো চৌকো করে কেটে বসানো হচ্ছে।

 কিন্তু কাঠকে কাজে লাগাবার জন্য আজকাল এর চাইতেও অনেক অদ্ভুত উপায় বের করা হয়েছে। কাঠ থেকে যে কাগজ তৈরি হয়, তা বোধ হয় তোমরা সকলেই জান। যত খবরের কাগজ দেখ, সে-সমস্তই কাঠের কাগজে ছাপা। কেবল কাগজ তৈরির জন্যই। প্রতি বৎসর প্রায় দশকোটি মণ কাঠের দরকার হয়। কাঠওয়ালারা কাঠকে পিটিয়ে থেঁৎলিয়ে সিদ্ধ করে একটা অদ্ভুত জিনিস বানায়, তার নাম ‘উড্‌পাল্প' (Wood-Pulp)। বাংলায় ‘কাঠের আমসত্ত’ বললে বর্ণনাটা নেহাত মন্দ হয় না। কাগজওয়ালারা নানা দেশ থেকে এই অপরূপ আমসত্ত কিনে এনে তা দিয়ে কাগজ বানায়। আগে এইরকমে কেবল সাধারণ সস্তা এবং খেলো কাগজই তৈরি হত কিন্তু আজকাল কাঠকে নানারকম প্রক্রিয়ায় ধুয়ে এমন পরিষ্কার এবং বিশুদ্ধ করা হচ্ছে যে তা থেকে খুব উচু দরের ভালো কাগজ পর্যন্ত তৈরি হতে পারে।

 কাঠের মধ্যে প্রধান জিনিসটি হচ্ছে সেলুলোস্ (Cellulose); কাঠকে বিশুদ্ধ করা মানে এই জিনিসটিকে খাঁর্টি অবস্থায় বের করা। পরিষ্কার সাদা তুলো দেখেছ ত? সেই তুলোও সেলুলোস্ ছাড়া আর কিছুই নয়। তুমি যে ধুতি পরে আছ সেও হচ্ছে সেলুলোসেরই ধুতি। কাঠ থেকে যে সেলুলোস্ বেরোয় তাতে তুলোর মতো আঁশ থাকে না কিন্তু তা থেকে খুব সস্তায় অনেক আশ্চর্য জিনিস তৈরি হচ্ছে। সেলুলোসকে রাসায়নিক উপায়ে বদলিয়ে একরকম আঠালো জিনিস তৈরি হয় তা থেকে টেনে সুতোর মতো সেলুলোসের আঁশ বার করা যায়। এই উপায়ে ইউরোপে প্রতি বৎসর কুড়ি লক্ষ মণ ‘নকল রেশম' তৈরি হয়। তার চেহারা অনেক সময়ে আসল রেশমের চাইতেও সুন্দর হয়। এই ‘রেশম’ দেশ-বিদেশে চালান দেওয়া হয়-আর কত শৌখিন লোকে সেই রেশমের পোশাক পরে বেড়ায়। তারা জানেও না যে তারা কাঠের পোশাক পরেছে।

 এই সেলুলোস্ থেকে নাকি খুব সস্তায় খাঁটি ‘স্পিরিট', অর্থাৎ আলকোহল (Alcohol) বা সুরাসার প্রভৃতি অনেক জিনিস তৈরি হতে পারবে। তখন মানুষের কলকারখানা এঞ্জিন মোটর জাহাজ সব নাকি কাঠের স্পিরিট জ্বালিয়ে চালানো হবে। অনেক হাজাররকম ওষুধপত্র আরক প্রভৃতি তৈরি করার কাজে এই সুরাসার না হলে চলে না। রাসায়নিক কারখানায় এমন দরকারি জিনিস খুব কমই আছে। সুতরাং কাঠের কুচি আর করাতের গুড়ো থেকে যদি এমন জিনিসটাকে সস্তায় পাওয়া যায় তবে তাতে যে কতদিকে মানুষের কতরকম সুবিধা হবে সে আর বলে শেষ করা যায় না। শোনা যায়, শীঘ্র নাকি বাজারে কাঠের চিনি বেরোবার সম্ভাবনা আছে। নকল চিনি নয়, সত্যিকারের চিনি।

 এতক্ষণ আমরা কাঠের গুণ ব্যাখ্যা করেছি, এখন তার জীবনচরিতের একটু পরিচয় নেওয়া যাক। পৃথিবীর নানা দেশে যত কাঠ আমদানী হয় তার মধ্যে কানাডার কাঠই সবচাইতে বেশি। সেদেশে শীতকালের গোড়াতেই গাছ কাটা আরম্ভ হয়। তার পর যখন বরফ পড়ে পথঘাট সব পিছল হয় তখন সেই পিছল পথের উপর দিয়ে গাছের গুড়িগুলোকে টেনে নিয়ে নদীর ধারে কিম্বা রেলের লাইনে নিয়ে হাজির করে। যে বৎসর খুব তাড়াতাড়ি শীত পড়ে যায় কিম্বা খুব অতিরিক্ত বরফ পড়ে সে বৎসর তাদের ভারি কষ্ট। একে শীতের কষ্ট, তার উপর আবার নরম বরফের মধ্যে দিয়ে কাঠ টানবার কষ্ট। কাঠ নেবার বন্দোবস্ত এক-এক জায়গায় এক-একরকম, পথ ঘাটের অবস্থা বুঝে কোথাও ঘোড়ায়-টানা বা গোরুতে-টানা গাড়িতে করে কাঠ নেয়; কোথাও গাছের গুঁড়িগুলো ভারি ভারি মজবুত তক্তার উপর চাপিয়ে সেই তক্তা হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে যায়। কোথাও গুড়িগুলোকে একটার পর একটা মালার মতো সাজিয়ে বেঁধে, সেই কাঠের মালা টেনে নেওয়া হয়। সঙ্গে লোক থাকে, তারা কেবল দেখে, যেন কোনোটা কিছুতে আটকিয়ে না যায়। অনেক জায়গায় কাঠ নেবার জন্য রীতিমতো রেলের লাইন পাতা হয়। আবার কোনো কোনো জায়গায় পিছল বরফের উপর বিনা লাইনেই এঞ্জিন চলে। সে এঞ্জিনের সামনে চাকা নাই, ‘প্লে’ গাড়ির মতো দুদিকে দুটো বাঁকানো লোহার ধনুক-দণ্ড।

 এমনি করে তারা জঙ্গলের গাছ কেটে এনে রেলের লাইন বা নদীর ধারে এসে হাজির হয়। তার পর গাছের গুঁড়িগুলোকে কারখানায় নিয়ে কেটে চিরে তক্তা বানিয়ে চালান দিতে হবে। নদীতে যদি বেশ স্রোত থাকে তা হলে এমন জায়গায় কারখানা বসানো হয় যে, কাঠগুলোকে ভাসিয়ে দিলে তারা আপনা-আপনি গিয়ে কারখানায় হাজির হবে। সেখানে কারখানার লোকেরা তাদের ঠেকিয়ে বড়ো-বড়ো লগি দিয়ে কারখানার ভিতরে নিয়ে পুরবে। কিন্তু সব জায়গায় সেরকম সবিধামতো নদী পাওয়া যায় না। হয়তো কোনো নদীতে তেমন স্রোত নেই, কিম্বা তাতে ওরকম কাঠ ছেড়ে দেবার হুকুম নেই। সেখানে মস্ত মস্ত কাঠের ভেলা বানিয়ে সেই ভেলাগুলোকে জাহাজে টেনে কারখানায় নিতে হয়।

 স্রোতে কাঠ ভাসিয়ে দেওয়া যে-সব সময়ে বড়ো সহজ কাজ, তা মনে কর না। অনেক সময়ে মাঝ পথে নদীর বাঁকে কাঠে কাঠে লেগে এমন জমাট বেঁধে যায় যে আবার রীতিমতো হাঙ্গামা করে তাদের জট ছাড়িয়ে না দিলে কাঠ আর চলতে পারে না। এ কাজে বিপদ খুবই; অনেক সময়ে হঠাৎ কাঠের জমাট খুলে গিয়ে কাঠগুলো এমন হুড়হুড় করে ভেসে আসে যে তার সামনে পড়ে অনেক মানুষের প্রাণ যায়। কারখানায় এলে পর সেখানকার লোকেরা কাঠগুলোকে এক-এক করে কারখানার মুখের মধ্যে পুরে দেয়, আর সেখানে করাতকলে কাঠগুলো আপনা-আপনি কেটে চিরে তক্তা হয়ে বেরিয়ে আসে। একদিকে ক্রমাগত গাছের গুঁড়ি ঢুকছে, আর-একদিকে ক্রমাগত কাটা তক্তা বেরিয়ে আসছে।

সন্দেশ-ফাগুন-চৈত্র, ১৩২৭