সুকুমার রায় সমগ্র রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড)/নানা নিবন্ধ/জলস্তম্ভ

উইকিসংকলন থেকে
পুণ্যলতা চক্রবর্তী, কল্যাণী কার্লেকর সম্পাদিত
(পৃ. ২৯০-২৯১)
জলস্তম্ভ

 স্রোতের জলে যে-জিনিস ভাসে, স্রোত যেদিকে যায় সে-ও সেইদিকে ভেসে চলে। জলের মধ্যে যদি দুটো স্রোত পাশাপাশি দুই দিকে চলতে থাকে তা হলে দুটো উলটো টানের মাঝে পড়ে একটি ঘূর্ণীপাকের সৃষ্টি হয়। ঘূর্ণীপাকের মধ্যে যা-কিছু এসে পড়ে সবই পাকের সঙ্গে চক্রের মতো ঘুরতে থাকে।

 জলে যেমন, বাতাসেও তেমনি। যদি একসঙ্গে দুটো বাতাসের স্রোত পাশাপাশি দুই মুখে চলতে থাকে তা হলেই বাতাসের মধ্যে একটি ঘোরপাক তৈরি হয়। খড়কুটো ধুলোবালি ধোঁয়া, যা কিছু সেই ঘোরপাকের মধ্যে পড়ে সব চর্কিবাজির মতো ঘুরতে থাকে। যদি দুই মুখেই বাতাসের বেশ জোর থাকে তা হলে সেই ঘোরপাক থেকে সাংঘাতিক ঘূর্ণীবায়ুর জন্ম হতে পারে। যেদিকে বাতাসের জোর বেশি, ঘূর্ণীবায়ু ঘোরপাক খেতে খেতে সেইদিকে ছুটে চলে। ছোটোখাটো ঘূর্ণীবায়ু তোমরা বোধ হয় সকলেই দেখেছ। হঠাৎ কোথা থেকে বাতাস উঠল আর সেই সঙ্গে খানিকটা ধুলো আর কাগজ আর শুকনো পাতা ঘুরতে ঘুরতে উড়তে লাগল। এইরকম তামাশা অনেক সময়েই দেখা যায়। কিন্তু এই ঘূর্ণীবায়ুই যখন আবার খুব বড়ো আকার নিয়ে দেখা দেয় তখন তার চেহারা অতি সাংঘাতিক হয়।

 ঘূর্ণীপাকের চক্র যখন নীচের দিকে নামতে থাকে তখন যদি সেই ঘুরন্ত বাতাসের চেহারাটা দেখতে পেতাম তা হলে দেখতাম ঠিক যেন একটা প্রকাণ্ড চুড়োওয়ালা টুপি উলটো করে ঝুলিয়ে রেখেছে। জলে যে ঘূর্ণীপাক হয় তার মাঝখানটায় যেরকম গর্ত হয় তেমনি এরও মাঝখানটা ফাঁপা। টুপির চুড়োটা যতই লম্বা হতে হতে মাটির কাছ পর্যন্ত নামে ততই নীচের সমস্ত হালকা জিনিসকে ঐ ফাঁপা জায়গাটুকুর মধ্যে শুষে নিতে থাকে।

 ‘হালকা জিনিস’ বললাম বটে, কিন্তু তেমন তেমন ঘূর্ণীবায়ু হলে তার কাছে প্রায় সব জিনিসই হালকা হয়ে যায়। খাটবিছানা, বাড়ির চালা, এ-সব তো উড়ে যায়ই, পাঁচ-সাতজন মানুষসুদ্ধ আস্ত মোটর গাড়ি পর্যন্ত শুকনো পাতার মতো ঘোরপাক খেয়ে শূন্যে উঠে পড়ে।

 অনেক সময়ে বাতাসের জল জমে ঘূর্ণীবায়ুর থলিটির মধ্যে জড় হতে থাকে। কিন্তু সে জল বৃষ্টি হয়ে নামতে পারে না, একেবারে হাজার হাজার মণ জল অন্ধকার মেঘের মতো আকাশে ঝুলে ঘুরপাক খেতে থাকে। বড়ো-বড়ো বিল বা নদী কিম্বা সমুদ্রের উপরেই সাধারণত এইরকম হয়। তখন কেবল যে উপরের বাতাস কালো থলির মতো হয়ে নীচের দিকে নামতে থাকে তা নয়। নীচের জলও চুড়োর মতো উঁচু হয়ে ঘুরতে ঘুরতে উপরদিকে উড়তে থাকে। নীচেকার চুড়োটি যখন উপরের ঘুরন্ত মেঘের সঙ্গে মিলে যায় তখনই বড়োবড়ো থামের মতো জলস্তম্ভের সৃষ্টি হয়। তখন দেখতে মনে হয়, যেন জল থেকে আকাশ পর্যন্ত এক-একটা প্রকাণ্ড থাম জলের উপর দিয়ে ছুটে যাচ্ছে।

 নৌকোই বল আর জাহাজই বল, সে যত বড় আর যত মজবুতই হোক-না কেন, জলস্তন্তের মধ্যে পড়লে তার আর রক্ষা নাই। জাহাজের কাছে জলস্তভ উপস্থিত হলে তার ঘূর্ণীটান এড়িয়ে চলা জাহাজের পক্ষে প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। চুম্বক যেমন লোহাকে টানে ঘুর্ণীজলের স্তম্ভ তেমনি করে জাহাজকে টেনে নেয়। স্তম্ভের ভিতরে ঢুকলে জাহাজের লোকদের আর কিছু করবার উপায় থাকে না। জাহাজ বন্‌বন্ করে ঘরতে থাকে-অনেক সময় জল ছেড়ে শূন্যে উঠে যায়-চারিদিক ভোঁ-ভোঁ শব্দে কানে তালা লেগে যায়, অন্ধকারে আর জলের ঝাপটায় কিছু দেখবার সাধ্য থাকে না।

 তার পর স্তম্ভ যখন ভীষণ শব্দে ফেটে যায় তখন হচ্ছে আসল বিপদ। একেবারে হাজার মণ জল বাজ-পড়ার মতো আওয়াজ করে মাথার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে জাহাজ-টাহাজ সব চুরমার করে দেয়। সমুদ্রের জল তার ধাক্কায় বহুদূর অবধি তোলপাড় হয়ে ওঠে। বহুদুরের জাহাজ পর্যন্ত তার সাংঘাতিক ঢেউয়ে টল্‌মল্ করতে থাকে।

 কিছুদিন আগে আমেরিকার এক সাহেব কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে এক প্রকাণ্ড মোটরে চড়ে একটা বিলের ধার দিয়ে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ তিনি দেখলেন আকাশ থেকে একটা কালো মেঘের মতো কি যেন ঘুরতে ঘুরতে নীচের দিকে নেমে আসল, আর বিলের উপর থেকে খানিকটা জল ছিটকে উঠে তার সঙ্গে মিলে একটা স্তম্ভের মতো হয়ে গেল। দেখতে দেখতে স্তম্ভটা বিলের উপর দিয়ে তেড়ে এসে মোটর গাড়ির উপর পড়ে, গাড়িটাকে সোঁ করে শূন্যে তুলে পাহাড়ের উপর দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিল। গাড়ির আরোহীরা কেউ মরল, কেউ সাংঘাতিক জখম হল আর প্রকাণ্ড গাড়িখানা ভেঙে চুরমার হয়ে গেল।

 যদি সর্বদাই যখন তখন এরকম বড়-বড়ো জলস্তন্ত দেখা দিত তা হলে সেটা খুবই ভয়ের কথা হত। কিন্তু সৌভাগ্যের বিষয় এই যে এরকম সচরাচর দেখা যায় না। তেমন বড়ো জলস্তম্ভ অতি অল্পই দেখা যায় আর তাও থাকে অতি অল্প সময়।

সন্দেশ-কার্তিক, ১৩২১