সুকুমার রায় সমগ্র রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড)/নানা নিবন্ধ/ডুবুরী জাহাজ

উইকিসংকলন থেকে
পুণ্যলতা চক্রবর্তী, কল্যাণী কার্লেকর সম্পাদিত
(পৃ. ১৫৫-১৫৭)
ডুবুরী জাহাজ

 প্রায় চল্লিশ বৎসর আগে একজন ফরাসি লেখক একটা গল্প লিখিয়াছিলেন, তাহাতে এক অদ্ভুত জাহাজের কথা ছিল। সে জাহাজকে মাছের মতো জলের উপর বা নীচ দিয়া যেমন ইচ্ছা চালানো যাইত। সে সময়ে লোকের কাছে গল্পটা খুবই অসম্ভবগোছের শুনাইয়াছিল এবং অনেকে গল্পলেখকের ‘আজগুবি কল্পনার' খুব প্রশংসা করিয়াছিলেন। কিন্তু এখন আর এরূপ গল্পে লোকের আশ্চর্য হইবার কথা নয়, কারণ, বাস্তবিকই ঐরকম জাহাজ এখন অনেকগুলি তৈয়ার হইয়াছে। শুধু ইংলণ্ডেই এখন অন্তত পঁচাশিটা এইরূপ জাহাজ আছে।

 জাহাজটা যতক্ষণ জলের উপরে থাকে ততক্ষণ তাহার পিঠে নানারকম মাস্তুল দড়ি, কলকব্জা ইত্যাদি দেখা যায়, কিন্তু জাহাজ ডুব মারিবার আগে এ-সমস্ত গুটাইয়া লওয়া হয়। তখন কেবল দুটি চোঙা আর একটি টুপির মতো ঢাকনি জাহাজের উপরে থাকে। ঢাকনিটার গায়ে পুরু কাঁচের শার্শী দেওয়া থাকে, তাহার ভিতর দিয়া জাহাজের কাপ্তান বাহিরের সমস্ত দেখিতে পান। জাহাজটা যতক্ষণ আধ-ডোবা অবস্থায় থাকে ততক্ষণ এইভাবে দেখার কাজ চলিতে পারে, কিন্তু আর কয়েক হাত ডুবিলেই সে পথ বন্ধ। তখন ঐ চোঙা দুটিই চোখের কাজ করে—চোঙার আগায় আয়না ও কাঁচ সুদ্ধ একটি যন্ত্র বসানো থাকে, যন্ত্রটা ঘুরিয়া ঘুরিয়া চারিদিকে তাকাইতে থাকে—আর জাহাজের কাপ্তান নীচে বসিয়া সেই আয়নার সাহায্যে বাহিরের সমস্ত অবস্থা দেখিতে পান। দশ হাতের নীচে গেলে এই ‘দিকবীক্ষণ' যন্ত্রও ডুবিয়া যায়, তখন কেবল আন্দাজে আর কম্পাস দেখিয়া জাহাজ চালাইতে হয়।

 জাহাজের মধ্যে একটা লোহার চৌবাচ্চা থাকে—চৌবাচ্চাটা খালি থাকিলে জাহাজ জলের উপরে ভাসে কিন্তু চৌবাচ্চাটার মধ্যে জল ভরিলে জাহাজ ভারি হইয়া ক্রমে ডুবিয়া যায়। এইরকমে জল বাড়াইয়া বা কমাইয়া জাহাজকে অল্প বা বেশি ডুবানো যায়। তাড়াতাড়ি জল ভরিবার বা খালি করিবার জন্য জাহাজের মধ্যে বড়ো বড়ো ‘পাম্প'-কল রাখা হয়-তাহার সাহায্যে এক মিনিটের মধ্যে জাহাজকে পঞ্চাশ হাত জলের নীচে ভুবাইয়া দেওয়া যায়। জাহাজের দুই পাশে ও পিছনে মাছের উনি ও সেজের মতো হা বসানো থাকে, সেইগুলিকে ঘুরাইয়া ফিরাইয়া জাহাজের মুখ ডাইনে বাঁয়ে উপরে নীচে যেমন ইচ্ছা ফিরানো যায়। পিছন দিকে দুইটা পাখার মতো ইস্ক্রুপ ঘুরিতে থাকে তাহাই জল কাটিয়া জাহাজকে চালায়। জাহাজের ভিতরে বড়ো বড়ো লোহার বোতলে চাপ দিয়া বাতাস ভরিয়া রাখা হয়। তাহাতে জাহাজের বাতাস অনেকক্ষণ পরিষ্কার রাখিবার সুবিধা হয় এবং অন্যান্য কাজও চালান যায়। ক্রমাগত চব্বিশ ঘণ্টা জলের নীচে থাকিলেও জাহাজের লোকেরা কোনোরকম অসুবিধা বোধ করে না। জাহাজে এরূপ বন্দোবস্ত করা যায় যাহাতে একটা জাহাজ কোথাও না থামিয়া চারহাজার মাইল স্বচ্ছন্দে চলিয়া যাইতে পারে।  মনে কর অমরা এইরূপ একটা জাহাজের মধ্যে ঢুকিয়াছি—ঢুকিয়াই সকলের আগে চোখে পড়ে—জাহাজের এক মাথা হইতে আর এক মাথা পর্যন্ত কেবল চাকা আর লোহা কলকব্‌জা। চেয়ার টেবিল আসবাবপত্র নাই বলিলেই হয়। সমস্ত জাহাজটা যেন একটা প্রকাণ্ড বৈদ্যুতিক কারখানা। সেই বিদ্যুতে জাহাজ চলে এবং জাহাজের বাতি জ্বালা রান্না করা পর্যন্ত সমস্ত কাজ হয়। জাহাজের কাপ্তান কোথায়? ঐ যে তিনি জাহাজের টুপির নীচে বসিয়া দিকবীক্ষণ যন্ত্র দিয়া চারিদিক দেখিতেছেন।

 কাপ্তান উপর হইতে হুকুম করিতেছেন আর অন্য একটি কর্মচারী নাবিকদিগের দ্বারা সেই হুকুম তামিল করাইতেছেন। প্রত্যেক লোক তাহার নিজের নিজের জায়গায় প্রস্তুত হইয়া আছে-কখন কি হুকুম আসে। কাপ্তান বলিলেন ‘জাহাজ ডাইনে ফিরাও', অমনি একটা চাকা ঘুরাইবামাত্র জাহাজ ডাইনে ফিরিয়া গেল। 'থাম! টর্পিডোওয়ালা, প্রস্তুত হও।' টর্পিডো কেন? শত্রপক্ষের জাহাজ দেখা গিয়াছে। টর্পিডো বড়ো সাংঘাতিক অস্ত্র। একবার বিপক্ষের জাহাজে ভালোমতো টপিডো দাগিতে পারিলে আর দ্বিতীয়বার মারিবার দরকার হয় না। একটা প্রকাণ্ড ছুঁচোবাজির মতো তার চেহারা-তার ভিতরে বারুদ আর অদ্ভুত কল-কারখানা। ডুবুরী জাহাজের সামনেই টপিডোর কলখানা—সেই কলের চাবি টিপিলেই টর্পিডো ঘণ্টায় চারশো মাইল বেগে ছুটিয়া বাহির হয় এবং বিপক্ষের জাহাজে বা অন্য কোনো শক্ত জিনিসে ঠেকিয়া বাধা পাইবামাত্র ভয়ানক শব্দে ফাটিয়া ও জাহাজ ফাটাইয়া এক তুমুল কাও বাধাইয়া দেয়। বড়ো ডুবুরী জাহাজে তিন-চারটি পর্যন্ত টর্পিডো কল থাকে। 'টপিডোওয়ালা, প্রস্তুত হও!' হুকুম অসিবামাত্র তাহারা প্রস্তুত। সকলেই জানিয়াছে বিপক্ষের জাহাজ আসিতেছে-কাহারও মুখে টুঁ শব্দটি নাই। জাহাজের মধ্যে কেবল কলের বন্‌বন্ শব্দ ছাড়া আর কোনো আওয়াজ নাই।

 হুকুম আসিল 'চল্লিশ হাত নামাও’-বলিতে বলিতে জাহাজ ডুবিতে লাগিল। একটা কলের কাঁটা আস্তে আস্তে সরিয়া যাইতে লাগিল -কুড়ি হাত, পঁচিশ হাত, ত্রিশ হাত। চল্লিশ-এর দাগে কাঁটা নামিল। এখন আর বাহিরের কিছুই দেখা যায় না। কাপ্তান এখন ঘড়ির দিকে একদৃষ্টে তাকাইয়া আছেন। বিপক্ষের জাহাজটি ঠিক কোনদিকে এবং কত দূরে তিনি খুব ভালো করিয়া তাহার হিসাব লইয়াছেন—তাঁহার জাহাজ কিরকম জোরে চলিতেছে তাহাও তিনি জানেন–সুতরাং তিনি ঠিক বলিতে পারেন কোন মুহর্তে দুই জাহাজে কতখানি তফাত থাকিবে। নিঃশব্দে জলের নীচে জাহাজ চলিতেছে শত্রু জাহাজ কিন্তু তাহার কিছুই জানে না। 'জাহাজ উঠিতে দাও’-আবার কলের কাঁটা নড়িয়া উঠিল—“ত্রিশ হাত, বিশ হাত, দশ হাত–বাস।'—‘সম্মুখের টর্পিডো হঁশিয়ার হও। এতক্ষণে দিকবীক্ষণ যন্ত্র ভাসিয়া উঠিয়াছে-আবার সব দেখা যাইতেছে। আধ মাইল দূরে শত্রুর জাহাজ-প্রকাণ্ড যুদ্ধজাহাজ। প্রায় কুড়িটা ডুবুরীর সমান। কাপ্তান একমনেই হিসাব করিতেছেন জাহাজটা আরেকটু সামনে সরুক, আরেকটু, আরেকটু—বাস। 'ছাড়'! একটা ভয়ানক ধাক্কা লাগিল—ডুবুরী জাহাজ কাঁপিতে কাঁপিতে প্রায় কাত হইয়া গেল-হালের নাবিক তাড়াতাড়ি তাহাকে সামলাইয়া লইল। কিন্তু বিপক্ষের জাহাজে যে টর্পিডো লাগিল সে আর তাহা সামলাইতে পারিল না। জাহাজের গায়ে বিশ হাত গর্ত-জাহাজটা মাতালের মতো টলিতে টলিতে গব্গব্ করিয়া জল খাইতে লাগিল, তার পর মাথা নিচু করিয়া ডিগবাজী খাইয়া দেখিতে দেখিতে এত বড়ো জাহাজটা ডুবিয়া গেল।

 ডুবুরী কিন্তু সেখানে দাঁড়াইয়া থাকে নাই—সে একেবারে ডুব মারিয়া প্রাণপণে ছুটিয়াছে। যতক্ষণ সে তাহার ‘চোখ’টুকু মাত্র বাহির করিয়া চোরের মতো আসিতেছিল শত্রুরা তাহাকে দেখিতে পারে নাই, কিন্তু টর্পিডো ছাড়িবামাত্র জল তোলপাড় হইয়া উঠিল –আর সকলেই বুঝিতে পারিল ‘ঐ ডুবুরী'। বিপক্ষের কামান হইতে একটি গোলা যদি ডুবুরীর ঘাড়ে পড়ে তবে আর তার রক্ষা নাই। শুধু যে যুদ্ধের সময়েই ডুবুরী জাহাজের বিপদের ভয় থাকে তাহা নয়। জলের পথে চলাফিরা করিতে গিয়া তাহার যে কত সময় কতরকম দুর্ঘটনা ঘটে ভাবিলেও ভয় হয়। জলের নীচ হইতে উঠিতে গিয়া হয়তো কোনো জাহাজের সঙ্গে ধাক্কা লাগিয়া গেল। হয়তো কোনখানে এতটুকু ফাঁক কোথায় কলের কব্‌জা এতটুকু বেঠিক বসিয়াছে-আর অমনি জাহাজ বিগড়াইয়া একেবারে পাথরের মতো ডুবিয়া গেল—শত চেষ্টায়ও আর তাহাকে উঠানো গেল না। এরকম কতবার ঘটিয়াছে এবং কত লোক তাহাতে মারা গিয়াছে। জাহাজ ডুবিয়া গেল, ডুবুরী নামাইয়া দেখা গেল ভিতরে মানুষ বাঁচিয়া আছে, ঠক ঠক শব্দ করিলে তাহারা ভিতর হইতে সাড়া দেয়, অথচ তাহাদের বাঁচাইবার কোনো উপায় নাই। যাহাতে এরকম দুর্ঘটনা না হয়, তাহার জন্য প্রতি বৎসর কত নুতন নুতন বন্দোবস্ত করা হইতেছে এবং জাহাজ ডুবিলেও যাহাতে ভিতরের লোকেরা পলাইয়া আসিতে পারে তাহারও ব্যবস্থা হইতেছে।

সন্দেশ-শ্রাবণ, ১৩২১