সুকুমার রায় সমগ্র রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড)/নানা নিবন্ধ/নীহারিকা

উইকিসংকলন থেকে
পুণ্যলতা চক্রবর্তী, কল্যাণী কার্লেকর সম্পাদিত
(পৃ. ১৭৭-১৭৯)
নীহারিকা

 তোমরা আকাশে ‘কালপুরুষ' দেখিয়াছ? আজকাল অর্থাৎ এই ফাল্গুন মাসে প্রথম রাত্রে যদি দক্ষিণমুখী হইয়া দাঁড়াও তবে প্রায় মাথার উপর এই 'কালপুরুষ'কে দেখিতে পাইবে, আর একবারটি যদি তাহাকে চিমিয়া রাখ তবে আর কোনোদিন ভুলিবে না।

 পৃথিবীর যেমন মানচিত্র বা 'ম্যাপ' হয়, আকাশেরও তেমনি মানচিত্র আছে। এইরকমের অনেক মানচিত্রে আকাশের তারার সঙ্গে অনেক অদ্ভুত ছবি আঁকা থাকে। তাহার মধ্যে যদি কালপুরুষ বা Orion-এর ছবি খুঁজিতে যাও, তবে হয়তো দেখিবে একটা হাত-পাসুদ্ধ মূর্তি আঁকা আছে কিন্তু আকাশে খুঁজিলে অবশ্য সেরকম কোনো চেহারা পাইবে না—দেখিবে কেবল ঐ তারাগুলি।

 আকাশের গায়ে যে এত হাজার হাজার তারা জড়ানো রহিয়াছে, মানুষ অতি প্রাচীন কাল হইতেই তাহার মধ্যে নানারকম ছবি ও মুর্তির কল্পনা করিয়া আসিতেছে। কতগুলা তারা মিলিয়া হয়তো অর্ধচন্দ্রের মতো দেখায়, মানুষে বলিল 'ওটা ধনুকের মতো' কোনোটা হয়তো মুকুট, কোনোটা ষাঁড়ের মাথা, কোনোটা ভল্লুক, কোনোটা যমজ ভাই, কোনোটা যোদ্ধা, এইরূপ নানারকম কল্পনার মুর্তিতে সমস্ত আকাশটিকে ঢাকিয়া দেওয়া হইয়াছে। অনেক সময়েই এ-সকল কল্পনাকে নিতান্তই আজগুবি বলিয়া মনে হয় কিন্তু এই কালপুরুষের বেলা বোধ হয় কল্পনাটা বেশ খাটিয়াছে। দুই হাত দুই পা আর মাথা সবই মিলিতেছে, তার উপর আবার কোমরবন্ধ। তলোয়ারটি পর্যন্ত বাদ যায় নাই। এত কথা যে বলিলাম সে কেবল ঐ তলোয়ারটির জন্য। ঐ তলোয়ারটার দিকে একবার ভালো করিয়া দেখ দেখি। তিনটি তারার মধ্যে মাঝেরটি একটু কেমন কেমন দেখায় না? আর সবগুলি তারা পরিষ্কার ঝকঝকে হীরার টুকরার মতো, কিন্তু এটা যেন কেমন একটু ঝাপসা ঠেকে। শুধু চোখে এই পর্যন্ত। কিন্তু দুরবীন দিয়া দেখ, আরো তফাত দেখিবে। যত বড়ই দুরবীন কষো-না কেন, আর সব তারাগুলিকে কেবলই ঝিকমিকে হীরার মতো দেখিবে কিন্তু এই তারাটিকে দেখিবে যেন সাদা মেঘের মতো। আকাশে এইরকম মেঘের মতো জিনিস আরো অনেক দেখা যায়—ইহাদের নাম নীহারিকা, ইংরাজিতে বলে Nebula।

 পণ্ডিতেরা বলেন, এই নীহারিকাগুলা এককালে তারা হইবে এবং এই তারাগুলাও এককালে নীহারিকা ছিল। আমরা যাহাকে সৌরজগত বলি—এই সূর্য এবং গ্রহ উপগ্রহসুদ্ধ তাহার বিশাল পরিবারটি—এই-সমস্তই এককালে কোনো এক প্রকাণ্ড নীহারিকার মধ্যে খিচুড়ি পাকাইয়া ছিল। সে যে কত বড়ো ব্যাপার তাহা কল্পনাও করা যায় না। সেই নীহারিকা আকাশের একটা প্রকাণ্ড কোণ জুড়িয়া জ্বলন্ত বাষ্পের মতো দপ্‌দপ্ করিয়া জ্বলিত। তাহার মধ্যে না ছিল চন্দ্র সূর্য, না ছিল পৃথিবী।

 ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে কাহারও স্থির হইয়া থাকিবার নিয়ম নাই, একটা কণাপ্রমাণ বস্তু আর একটি কণাকে পাইলে এ উহাকে টানিয়া লয়, দশটা কণা একত্র হইলেই পরস্পরের দিকে ছুটিয়া জমাট বাঁধিতে চায়। সুতরাং এত বড়ো নীহারিকাটি যে স্থির হইয়া থাকিবে, এমন কোনো উপায় ছিল না—সে আপনার ভিতরকার টানাটানির মধ্যে পড়িয়া ঘুরপাক খাইতে লাগিল আর তাহার মধ্যখানে প্রকাণ্ড একটা বাষ্পের ঢিপি জমাট হইতে লাগিল। এই জমাট ঢিপিকেই এখন আমরা সূর্য বলি।  কালপুরুষের নীহারিকার চেহারা একবার দেখ-ঐ জমাট মেঘের মতো জিনিসটার ভিতর হইতে কত ডালপালা বাহির হইয়াছে। ঐ ডালপালাগুলি আবার আলগাভাবে জমাট বঁধিয়া গ্রহ উপগ্রহের সৃষ্টি করিবে। ঘুরন্ত চাকার গা হইতে যেমন করিয়া কাদা ছিটকাইয়া যায়, এক-একটা নীহারিকার চক্র হইতে ঠিক যেন সেইরকম জ্বলন্ত বাষ্পপিণ্ড ঠিকরাইয়া পড়িতেছে। দেখিতে অবশ্য সমস্ত নীহারিকাটি স্থির দেখা যায়—কারণ, জিনিসটা এত দূরে যে ঘটায় লক্ষ মাইল বেগে ছুটিলেও এখান হইতে তাহাকে একেবারে স্তব্ধ দেখা যাইবে।

 আকাশে এইরকম নীহারিকা কত যে আছে, তাহার আর অন্ত নাই। কোনোটা একেবারে ঝাপসা কুয়াশার মতো, কোনোটার মধ্যে সবে একটু জমাট বাঁধিতেছে, কোনোটা রীতিমতো গোলা পাকাইয়া উঠিতেছে। এক-একটার চেহারা ঠিক যেন ঘরন্ত চরকি বাজির মতো, মনে হয় যেন জ্বলন্ত চক্র হইতে আগুন ঠিকরাইয়া পড়িতেছে। আবার এমন নীহারিকাও আছে যাহাকে এখন দেখিতে ঠিক তারার মতোই দেখায়। সে যে এক সময়ে নীহারিকা হিল, তাহার প্রমাণস্বরূপ এখনো তাহার আশেপাশে অতি ঝাপসা কুয়াশার মতো নীহারিকার শেষ নিশ্বাসটুকু লাগিয়া আছে। সে এত ঝাপসা যে, অনেক সময় খুব বড়ো দূরবীক্ষণ দিয়াও তাহার কিছুমাত্র ধরা যায় না, ধরা পড়ে কেবল ফোটোগ্রাফের প্লেটে।

 ফোটোগ্রাফের প্লেটে কেমন করিয়া ছবি তোলে দেখিয়ছি তো? ক্যামেরার ভিতর হইতে সে টুক করিয়া একটিবারমাত্র তোমার দিকে তাকায় আর ঐ এক দৃষ্টিতেই তোমার চেহারার ছাপটুকু নিজের মধ্যে ধরিয়া লয়। সে একবার যাহা ভালো করিয়া ধরে তাহা আর ভুলিতে চায় না। এক মিনিট খুব ঝাপসা জিনিসের দিকে তাকাইলে মানুষের চোখ শ্রান্ত হইয়া পড়ে—সে তখন আর ভালো দেখে না। কিন্তু ফোটোগ্রাফের প্লেট যত বেশি করিয়া তাকায় ততই বেশি দেখিতে পায়। এমনি করিয়া ঘণ্টার পর ঘণ্টা অন্ধকার আকাশের দিকে তাকাইয়া সে ঐ অন্ধকারের মধ্যেই অনেক আশ্চর্য জিনিসের সংবাদ বাহির করে। এইরকম ফোটোগ্রাফ দেখিলে বোঝা যায় যে, সমস্ত আকাশটাই প্রায় নীহারিকায় ঢাকা-আকাশের যেদিকে তাকাও সেইদিকেই নীহারিকার জাল।

সন্দেশ-ফাগুন, ১৪২৩