সুকুমার রায় সমগ্র রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড)/নানা নিবন্ধ/পৃথিবীর শেষদশা

উইকিসংকলন থেকে
পুণ্যলতা চক্রবর্তী, কল্যাণী কার্লেকর সম্পাদিত
(পৃ. ২৩৫-২৩৮)
পৃথিবীর শেষদশা

 সংসারের কোনো জিনিসই চিরকাল একভাবে থাকে না-তা সে ছোটোই হউক আর বড়োই হউক। এই যে প্রকাণ্ড পৃথিবীটা যাহার উপর তোমার আমার মতো কোটি কোটি জীব এমন নিশ্চিন্তে বসিয়া দিন কাটাইতেছি, এই পৃথিবীটাও চিরকাল এমন ছিল না। এক সময়ে—সে কত লক্ষ বৎসর আগেকার কথা তাহা জানি না—এই পৃথিবী এমন গরম হিল যে, জীবজন্তু থাকা তো দূরের কথা, ইহার উপর বৃষ্টি পড়িবারও জো ছিল না। উপরের আকাশে বৃষ্টি জমিয়া নীচে পড়িতে না পড়িতে শূন্যেই বাষ্প হইয়া মিলাইয়া যাইত। যখন আরেকটু ঠাণ্ডা হইল তখন তেমন তেমন বৃষ্টি হইলে তাহা পৃথিবীতে আসিয়া পড়িত কিন্তু জল দাঁড়াইবার উপায় ছিল না। বৃষ্টিধারা ডাঙায় নামিবামাত্র টগ্‌বগ্ করিয়া ফুটিয়া উঠিত এবং চারিদিক গরম ধোঁয়ায় ঢাকিয়া আকাশের জিনিস আকাশেই ফিরিয়া যাইত। তখন দেখিবার কেহ ছিল না, শুনিবার কেহ ছিল না; ফুটন্ত বৃষ্টিধারার অবিশ্রাম গর্জনের মধ্যে ধোঁয়ায় ভরা আকাশ যখন পৃথিবীর উপর ঘনঘন বিদ্যুতের চাবুক মারিত তখনকার সে ভয়ংকর দৃশ্য কল্পনা করাও সহজ কথা নয়।

 তাহারও পূর্বে এক সময়ে পৃথিবীটা প্রকাণ্ড আগুনের পিণ্ডমাত্র ছিল। তখন তাহার শরীরটি ছিল এখনকার চাইতে প্রায় লক্ষগুণ বড়ো। বেশ একটি ছোটোখাটো সূর্যের মতো সে আপনার প্রচণ্ড তেজে আপনি ধক্‌ধক্ করিয়া জ্বলিত। তাহারও পূর্বেকার অবস্থা কেমন ছিল, সে কথা পণ্ডিতেরা আলোচনা করিয়াছেন। যাহা হউক, মোট কথা এই যে, পৃথিবীর বয়স অনেক হইয়াছে। মানুষের বয়স বাড়িয়া যখন সে বৃদ্ধ হইতে চলে তখন তাহার শরীরের তেজ কমিয়া যায়, গায়ের রক্ত ঠাণ্ডা হইয়া আসে। পৃথিবীর এটা কোন বয়স? সে কি এখন প্রৌঢ় বয়স পার হইতেছে? ভাবিবার কথা বটে। পৃথিবীর শেষ বয়সটা কিরকম হইবে, তাহার পক্ষে বার্ধক্যই-বা কি আর মৃত্যুই-বা কি, তাহার বিচার করা দরকার।

 মানুষের মরিবার নানারকম উপায় আছে। কেহ অল্পে অল্পে বৃদ্ধ হইয়া মরে কেহবা তাহার পূর্বেই মরে, কেহ বহুদিন রোগে ভুগিয়া মরে, কেহ দুর্ঘটনায় হঠাৎ মরে। পৃথিবীর বেলায় মৃত্যুটা কিরকমে ঘটিবে তাহা কে জানে? যদি বৃদ্ধ হইয়া পৃথিবীকে অল্পে অল্পেই মরিতে হয় তবে কোন অবস্থাকে তাহার মৃত্যুর অবস্থা বলিব? যখন জীবজন্তু থাকিবে না, মেঘ বাতাস থাকিবে না, নদী সমুদ্র থাকিবে না, পথিবী শুকাইয়া চাঁদের মতো কংকালসার হইয়া পড়িবে তখন বলা যাইবে ‘পৃথিবীটা মরিয়াছে'। সেরকম হইবার কোনো লক্ষণ দেখা যায় কি? যায় বৈকি! পৃথিবী যখন শূন্যে ছুটিয়া চলে তখন সে বাতাসটাকেও তাহার সঙ্গে সঙ্গে লইয়া চলে বটে, কিন্তু তবু কিছু বাতাস চারিদিকে ছিটাইয়া পড়ে তাহা শূন্যে উড়িয়া যায় যার পৃথিবীতে ফিরিয়া আসে না। সেই বাতাসের মধ্যে যেটুকু জল বাষ্প হইয়া থাকে তাহাও এইরপে আকাশে ছড়াইয়া পড়ে। এইভাবে যাহা নষ্ট হয় তাহার পরিমাণ খুবই সামান্য; কিন্তু সামান্য লোকসানও যদি ক্রমাগত লক্ষ লক্ষ বৎসর চলিতে থাকে তবে শেষে তাহার হিসাবটা খুবই মারাত্মক হইয়া পড়ে। নদী ও সমু্দ্রের মধ্যে যে জল আছে ডাঙার মাটি তাহাকে প্রতিদিনই অল্পে অল্পে শুষিয়া লইতেছে এবং তাহাতেও জলটা দিন দিনই কমিয়া আসিতেছে; সুতরাং আজ না হউক, হাজার বছরে না হউক, জল বাতাস সব একদিন শেষ হইবেই। তখন মেঘ থাকিবে না, কুয়াশা থাকিবে না, রামধনুকের শোভা, উদয়াস্তের রঙের খেলা কিছুই থাকিবে না কেবল নিস্তব্ধ নির্জন “মশানের মতো গথিবীর মৃত কংকাল পড়িয়া থাকিবে।

 কিন্তু দিনের পর রাত, রাতের পর দিন, এই যে আলো আঁধারের অবিশ্রাম খেলা, ইহাও কি চিরকাল থাকিবে না? না, তাহাও থাকিবে না। মোটামুটি আমরা যে দিনরাতের হিসাব ধরি সেই দিনরাতের হিসাবও ক্রমেই বাড়িয়া চলিতেছে। জোয়ার ভাঁটার আঘাত পৃথিবীকে প্রতিদিনই সহিতে হয়, জলের সঙ্গে ডাঙার ঘষাঘষি প্রতিদিনই বাধিয়া থাকে; তাহার ফলে, পৃথিবীর ঘোরপাকের বেগ ক্রমেই ঢিলা হইয়া পড়িতেছে। পাঁচলক্ষ বৎসরে দিনরাতের পরিমাণ এক সেকেণ্ডে বাড়িয়া যাইবে এবং ক্রমেই আরো বেশি করিয়া বাড়িবে। শেষে এমন দিন আসিবে যখন একপাক ঘুরিতে তাহার এক বৎসর লাগিবে। চাঁদ যেমন তাহার একই মুখ পৃথিবীর দিকে রাখিয়া পথিবীকে প্রদক্ষিণ করে, তাহার উলটা পিঠ আমাদের দেখিতেই দেয় না, পৃথিবীও ঠিক তেমনি করিয়াই ক্রমাগত একইভাবে সূর্যের দিকে মুখ ফিরাইয়া তাহার চারিদিকে ঘুরিতে থাকিবে। বুধ ও শুক্রগ্রহের আজকালকার অবস্থা ঠিক এইরূপ। এ অবস্থায় যেখানে রাত সেখানে বারো মাসই রাত, যেখানে দিন সেখানে বারো মাস দিনের আর শেষ নাই। একদিক রোদে পুড়িয়া ঝলসিয়া ঝামা হইয়া যায়, আর-একদিক শীতে জমিয়া এমন কন্কনে ঠাণ্ডা যে বাতাস জমিয়া বরফ বাঁধিয়া যায়। শেষ বয়সে, যতদিন সূর্যের তেজ থাকিবে, ততদিন এইরকম করিয়াই পৃথিবীর দিন চলিবে। তার পর সূর্যও যখন নিভিয়া যাইবে তখনো অন্ধকারে আকাশের গায়ে কত লক্ষ লক্ষ তারার আলো এমনি করিয়াই চাহিয়া থাকিবে, কিন্তু বহুদূরের সেই জ্যোতিতে আলোহারা সূর্যকে আর খুঁজিয়াই পাওয়া যাইবে না, পৃথিবী তো কোন ছার।

 পৃথিবীর মৃত্যুর কি আর কোনো উপায় নাই? হঠাৎ কোনো দুর্ঘটনা ঘটিয়া তাহার জীবনটা কি নষ্ট হইতে পারে না? ধুমকেতুকে এক সময়ে লোকে বড়োই ভয় করিত। নয় বৎসর আগে এই পৃথিবীটা যখন ‘হ্যালি'র ধমকেতুর ল্যাজের ভিতর ঢুকিয়া গিয়াছিন তখন আগে হইতেই কত লোকে ভয় পাইয়াছিল, কত লোকে বলিয়াছিল যে এইবার পৃথিবীর আর রক্ষা নাই! কিন্তু তবু তো পৃথিবীর কোনো ক্ষতি হয় নাই, বরং ধমকেতুর ধোঁয়াটে ল্যাজটাই ছিড়িয়া শূন্যে উড়িয়া গিয়াছে। এইরূপে কত ধমকেতু কত উল্কা বৃষ্টির হাত হইতে সে কতবার বাঁচিয়া আসিল, কিন্তু ধূমকেতুর চাইতে ভারি একটা কিছুর সহিত যদি তাহার ধাক্কা লাগে তাহা হইলে অবস্থাটা খুবই সাংঘাতিক হইতে পারে। সুতরাং সেই ‘একটা কিছু' আসা সম্ভব কি না, আর আসিলে কি হইবে, তাহার একটু খবর লওয়া যাক।

 পৃথিবীর দেহের বাঁধন ও চালচলন এমন হিসাব-মাফিক সুন্দর নিয়মে বাঁধা যে, হঠাৎ কিছু উলট-পালট হওয়া সম্ভব নয়। ভূমিকম্প ঝড় বৃষ্টি অগ্ন্যুৎপাত প্রভৃতি যে-সব ব্যাপারকে আমরা খুব ভয়ানক মনে করি, পৃথিবীর গায়ে সেগুলি সামান্য আঁচড় বা ফোস্কার মতো। চন্দ্র সূর্য গ্রহ উপগ্রহ প্রভৃতি সকলকেই অতি আশ্চর্য নিয়মের বাঁধনে নিরাপদ করিয়া বাঁধা হইয়াছে। সতরাং বাহির হইতে একটা কোনো উপদ্রবকে হাজির না করিলে সূর্যের এই প্রকাণ্ড সংসারটির বাঁধন ভাঙা সম্ভব বলিয়া বোধ হয় না। সুর্যদেব সপরিবারে শূন্যের ভিতর দিয়া ঘণ্টায় চল্লিশহাজার মাইল বেগে ছুটিয়া চলিয়াছেন-কিন্তু আকাশের কূল কিনারা নাই; লক্ষ লক্ষ বৎসর ক্রমাগত ছুটিয়াও তিনি যে কোনোদিন কোনো তারার উপর গিয়া পডিবেন, এমন আশংকার কোনো কারণ এ পর্যন্ত দেখা যায় নাই। কিন্তু চোখে দেখা যায় না এমনও তো অনেক বিপদ থাকিতে পারে। আকাশে যত তারা আছে তাহাদের সকলেরই যে আলো আছে এমন নয়। যাহাদের আলো নিভিয়া গিয়াছে আমরা তাহাদের কোনো খবর পাই না। সেইরূপ কোনো তারা যদি অন্ধকার পথে চলিতে চলিতে সূর্যের উপর আসিয়া পড়ে, তবে অবস্থাটা কেন হইবে? সেটা যে একেবারেই ভালো হইবে না, তাহা বুঝিতেই পার।  তেমন একটা তারা যদি আসে তবে সে সূর্যের রাজ্যের সীমানায় আসিবার পূর্বেই নেপচুন প্রভৃতি বহু দূরের গ্রহগুলির চালচলন বিগড়াইতে আরম্ভ করিবে। পণ্ডিতেরা ব্যস্ত হইয়া হিসাব করিতে বসিবেন, উপদ্রবটা কত বড়ো, কত দূরে এবং কোনদিকে। সূর্যের আলোয় সেই অন্ধকার তারা ক্রমে স্পষ্ট হইয়া উঠিবে, ক্রমে সে সৌরজগতের ভিতরে আসিয়া পড়িবে। ততদিনে বড়ো-বড়ো গ্রহেরা পর্যন্ত তাহাদের বহুদিনের অভ্যস্ত চাল ভলিয়া বেচাল চলিতে আরম্ভ করিবে। একদিকে সুর্য আর একদিকে নুতন অতিথি, এই দোটানায় পড়িয়া পৃথিবী টলমল করিতে থাকিবে। জোয়ারের বিপুল টানে নদীর জল ফুলিয়া উঠিবে, সাগরের তরঙ্গ ভীষণ বেগে পৃথিবীর উপর ছুটিয়া পড়িবে, ভূমিকম্পে পাহাড় পর্বত ধ্বসিয়া পড়িবে, বহুদিনের ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরি আবার জাগিয়া সহস্র মুখে আগুন ফুঁকিতে থাকিবে। আর জীবজন্তুর হাহাকার ডুবাইয়া ঝড়ের বাতাস পাগলের মতো ছুটিয়া ফিরিবে। তার পর যখন সূর্যে তারায় সংঘর্ষ বাধিবে তখনকার অবস্থা কল্পনা করাও অসম্ভব। মুহর্তের মধ্যে এক সূর্য কোটি সূর্যের তেজ ধারণ করিবে, সূর্যের আগুন অসম্ভব বেগে সমস্ত গ্রহ চন্দ্র পৃথিবীকে গ্রাস করিয়া ফেলিবে। আবার সেই আদিকালের নীহারিকার মতো জ্বলন্ত বাষ্পের আগুন সমস্ত সৌরজগতের আকাশ জুড়িয়া জ্বলিতে থাকিবে। তার পর কত যুগযুগান্তর পরে তাহার ভিতর হইতে আবার নূতন সূর্য বাহির হইয়া নূতন উৎসাহে নূতন সংসার পাতিয়া বসিবে। এ পৃথিবী তখন না থাকুক, আবার নূতন পৃথিবীর সৃষ্টি হওয়াইবা বিচিত্র কি?

 ইহার মধ্যে অসম্ভব কিছুই নাই। সেদিন যে হঠাৎ নতন তারা দেখা গিয়াছিল, তাহাও সুদূর আকাশে এইরূপ কোনো দুর্ঘটনার সামান্য একটু নমুনা মাত্র। আমাদের এই ছোটো জগৎটুকুর মধ্যে যদি তেমন কোনো প্রলয় আসিয়া পড়ে, তবে বিপদের সম্ভাবনা বুঝিবার পর সমস্ত শেষ হইতে প্রায় পঞ্চাশ বৎসর সময় লাগিবে। সুতরাং অন্তত আরো চল্লিশটা বছর তোমরা সকলেই খুব নিশ্চিন্তে থাকিতে পার।

সন্দেশ-মাঘ, ১৩২৬