সুকুমার রায় সমগ্র রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড)/নানা নিবন্ধ/ভূমিকম্প

উইকিসংকলন থেকে
পুণ্যলতা চক্রবর্তী, কল্যাণী কার্লেকর সম্পাদিত
(পৃ. ২১৭-২২১)
ভূমিকম্প

 দুপুরবেলায় দিব্য আরামে শুইয়া বিশ্রাম করিতেছি, এমন সময় দুর্‌দুর্ দুর্‌দুর্ করিয়া ঘরবাড়ি কাঁপিয়া উঠিল, ঝাড়-লণ্ঠন পাখা সব দুলিতে লাগিল, তার পর খাট চৌকি সবসুদ্ধ খটাখট্ করিয়া এমন ঝাঁকানি লাগাইয়া দিল যে, আর নিশ্চিন্তে বিশ্রাম করা সম্ভব হইল না। ততক্ষণে চারিদিকে লোকজনের ছুটাছুটি আরম্ভ হইয়াছে, শাঁখ কাঁসর ঘণ্টার শব্দ শুনা যাইতেছে আর সকলেই বলিতেছে ‘ভূমিকম্প, ভূমিকম্প'। পরের দিন কাগজে ভূমিকম্পের নানারকম বর্ণনা বাহির হইল—কেমন করিয়া বড়ো-বড়ো গির্জার চূড়াগুলি দুলিতে দুলিতে পড়ো-পড়া হইয়াছিল, কেমন করিয়া হাইকোর্টের জজসাহেব হইতে উকিল ব্যারিস্টার পেয়াদা পর্যন্ত সবাই ছুটিয়া বাহির হইয়াছিল, কেমন করিয়া দোকানের বাবুরা আর আপিসের বড়ো-বড়ো সাহেবেরা দোকানপাট কাগজপত্র সব ফেলিয়া রাস্তায় ছুটিয়া বাহির হইয়াছিল ইত্যাদি অনেক কথা। আর জানা গেল এই যে, কেবল যে কলিকাতাতেই ভূমিকম্প হইয়াছে তাহা নয়, বাংলার নিচু জমি হইতে আসামের পাহাড় পর্যন্ত সব জায়গাতেই সেই এক কাঁপুনি।

শাস্ত্রে যে বলে পৃথিবীটা স্থির আর ‘অচলা’, পণ্ডিতেরা সে কথা অনেকদিনই মিথ্যা প্রমাণ করিয়াছেন। পৃথিবী যে শূন্যের মধ্যে প্রকাণ্ড চক্র আঁকিয়া সূর্যের চারিদিকে ছুটিয়া চলে এবং চলিতে চলিতে লাটিমের মতো ঘুরপাক খায়, এ-সকল কথা আমরা সকলেই জানি। সে চলুক আর ঘুরুক, তাহাতে আমাদের আপত্তি নাই-কারণ সেটা আমরা টের পাই না, কিন্তু মাঝে মাঝে সে আবার গা-ঝাড়া দেয় কেন? পাহাড় পর্বত কাঁপাইয়া, জমি জঙ্গল ফাটাইয়া, বাড়ি ঘর দোর উলটাইয়া এ আবার কেমন উপদ্রব? সেদিন যে ভূমিকম্প হইল, সে তো নেহাৎ সামান্যরকমের। ১৮৯৭ খৃষ্টাব্দে এ দেশে যে ভয়ানক ভূমিকম্প হইয়াছিল, তাহাতে অনিষ্ট করিয়াছিল আরো অনেক বেশি। সেবারে পূর্ববাংলায় আর আসামে অনেক লোক মারা পড়িয়াছিল এবং কলিকাতা শহরেও বড়ো-বড়ো কোঠা দালান ভাঙিয়া পড়িয়াছিল। আর রেলপুলে টেলিগ্রাফের থাম কত যে নষ্ট হইয়াছিল তাহার আর সংখ্যা নাই।

ভূমিকম্প মানে মাটির কাঁপুনি। এ কঁপুনি তো বলিতে গেলে রোজই কতবার করিয়া হইতেছে। রাস্তা দিয়া দমকল ছুটিয়া গেল, ঘোড়সোয়ার পল্টন গেল, মাটি গুম্গুম্ করিয়া কঁপিতে লাগিল। এমন-কি, একজন মোটা লোক যদি সিঁড়ি দিয়া উৎসাহ করিয়া নামিতে যায়, তাহাতেও বাড়ির ভিতরে ছোটোখাটো রকমের ভূমিকম্প হয়। যদি বেশ সূক্ষরকম যন্ত্র দিয়া পরীক্ষা করিয়া দেখ, তবে পাশের ঘরে বিড়াল হাঁটিয়া গেলে এই ঘরে তাহার চলাফিরার সাড়া পাইবে। কিন্তু ভূমিকম্প বলিতে আমরা এরকম কাঁপুনি বুঝি না। মাটির ভিতর হইতে যে ধাক্কা আসে, মাটির তলে তলে যাহা বহুদূর পর্যন্ত ছড়াইয়া পড়ে, তাহারই নাম ভূমিকম্প। কোথায় খাসিয়া পাহাড়ের মধ্যে মাটির নীচে কোন গভীর তলে একটু নাড়াচাড়া পড়িয়াছে আর সমস্ত বাংলা দেশটা ভূমিকম্পের ধাক্কায় কঁপিয়া উঠিয়াছে। সিমলা পাহাড়ে আর লঙ্কা দ্বীপে পর্যন্ত কম্পনলিপি যন্ত্রে (Seismograph) তার স্পষ্ট সাড়া পাওয়া গিয়াছে। বাস্তবিক, যাঁহারা এই-সকল সক্ষম যন্ত্রের হিসাব লইয়া কারবার করেন, তাঁহারা বলেন প্রায় প্রতিদিনই পৃথিবীর নানাস্থানে ছোটো-বড়ো নানারকমের ভূমিকম্প চলিতেছে। কয়েক বছর আগে যখন আমেরিকার সানফ্রান্সিসকো নগরে বড়ো ভূমিকম্প হইয়াছিল তখন এখানকার যন্ত্রে তাহা ধরা পড়িয়াছিল। কম্পনলিপি যন্ত্রের কাঠি একটা কাগজের উপর সাদা আঁচড় কাটিয়া চলে। যতক্ষণ ভূমিকম্পের গোলমাল না থাকে ততক্ষণ সে বরাবর সোজারকমের রেখা টানিয়া যায়, কিন্তু মাটির তলায় কোথাও যদি ভূমিকম্পের ছোঁয়া লাগে, অমনি কলের কাঠি বিগড়াইয়া হিজিবিজি আঁচড় কাটিতে আরম্ভ করে।  বাহির হইতে এই মাটির দিকে চাহিয়া দেখ, মনে হয় তাহার মতো অটল স্থির আর কিছুই নাই। চারিদিকে সমুদ্রের অশান্ত ঢেউ খ্যাপার মতো লাফালাফি করিতেছে, মাথার উপরে চঞ্চল বাতাস দিনরাত ছুটিয়া মরিতেছে, কিন্তু পৃথিবী—সে ধীর গম্ভীর নিশ্চল। বড়ো-বড়ো গাছপালা হইতে সামান্য ঘাসটা পর্যন্ত তাহার গায়ে শিকড় বসাইয়া তাহার বুক ফুঁড়িয়া বাহির হইতেছে—পৃথিবী তাহাতে আপত্তিও করে না, বাধাও দেয় না। কিন্তু, কেবল বাহিরের মূর্তি না দেখিয়া যদি একবার গভীর মাটির নীচে ঢুকিতে পার তবে বুঝিবে তার ভিতরটায় কেমন তোলপাড় চলিতেছে। সেখানে গেলে মনে হইবে পৃথিবীর বুকের ভিতর যেন আগুন জ্বলিতেছে; যতই তার ভিতরে ঢুকি ততই গরম। সেই গরমে পাথর পর্যন্ত গলিয়া যায় তুমি আমি তো এক মুহর্তেই ঝামা হইয়া পুড়িয়া যাইব।

 পৃথিবীর এই মাটির খোলসটি আগাগোড়া সমান নয়। কত লক্ষ লক্ষ যুগ নানারকম পাথর স্তরের পর স্তর সাজাইয়া তবে এই খোলস গড়িয়া উঠিয়াছে। এই-সমস্ত কঠিন স্তর আগুনে গরম হইয়া, চাপে কঠিন হইয়া, দিনরাত ঠেলাঠেলি করিতেছে। কোথাও পাথর গলিয়াছে, জল ফুটিয়া বাষ্প হইয়াছে, তাহারা বাহির হইবার পথ চায়; কোথাও মাটির নীচে বড়ো-বড়ো ফাটল রহিয়াছে, পাশের মাটি উপরের চাপে তাহার মধ্যে ধ্বসিয়া পড়ে। কোথাও নীচেকার গরমের ঠেলায় উপরের মাটি ফাঁপিয়া ফুলিয়া উঠে। দিনরাত যুগের পর যুগ এইরকম চাপাচাপি ঠেলাঠেলি চলিয়াছে। গরমবাষ্প আর গলিত পাথর যদি বাহির হইবার সহজ পথ না পায় তবে তাহারা অনায়াসেই একটা ভূমিকম্প বাধাইয়া তুলিতে পারে। আগ্নেয়গিরির উৎপাতের কথা তোমরা শুনিয়াছ। এই-সব পাহাড়ের উৎপাত সকলের চাইতে সাংঘাতিক হয় সেই সময়ে যখন পাথর জমিয়া তাহার মুখ বন্ধ হইয়া যায়। তখন তাহাদের ভিতরের আগুন আর বাহির হইবার পথ পায় না, কেবল তাহার চাপ জমিয়া জমিয়া ভিতরে ভিতরে গুমরাইতে থাকে। ভিসুভিয়াসের অত্যাচারে পম্পিয়াই শহর ধ্বংস হইবার আগে এইরকম একটা কাণ্ড হইয়াছিল। সে সময়ে পাহাড় দেখিতে বেশ শান্ত ছিল, কিন্তু ক্রমাগত কয়েক বৎসর ধরিয়া গুমগুম্ শব্দ শুনা যাইত। মাঝে মাঝে এক এক জায়গায় মাটি কাঁপিয়া উঠিত, আর ঘন ঘন ভূমিকম্প হইত। কিন্তু সে সময়ে মানুষ বুঝিতে পারে নাই যে এই-সমস্তই পাহাড় ফাটাইবার আয়োজন। এইরূপে ভিতরের চাপ জমিয়া জমিয়া এমন ভয়ংকর হইয়া উঠে, যে পাহাড় আর তাহাকে ধরিয়া রাখিতে পারে না-জ্বলন্ত পাথর পাহাড় ভেদ করিয়া ফোয়ারার মতো ছুটিয়া বাহির হয়। এইরকম ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে কতবার ঘটিয়াছে তাহার অর সংখ্যা নাই।

 এক-একটা আগুনের পাহাড়কে অনেকদিন চুপচাপ থাকিতে দেখিয়া কত সময়ে লোকে মনে করে তাহার ভিতরকার আগুন মরিয়াছে-কিন্তু আবার যখন সে কুম্ভকর্ণের মতো ভয়ংকর মূর্তিতে জাগিয়া উঠে, তখন মানুষের আতংকের আর সীমা থাকে না। এইরকম যত উৎপাতের কথা শুনা গিয়াছে, তাহার মধ্যে ক্রাকাতোয়ার অগ্নিকাণ্ডই সকলের চাইতে ভয়ানক। সুমাত্রা ও যবদ্বীপের মাঝামাঝি একটা দ্বীপ আছে তাহারই নাম ক্রাকাতোয়া। সেই দ্বীপের মধ্যখানে প্রকাণ্ড পাহাড় ছিল—এককালে তাহার মাথায় আগুন দেখা যাইত। দুইশত বৎসর ধরিয়া সেই পাহাড় একেবারে ঠাণ্ডা হইয়া বিশ্রাম করিতেছিল, এই সুযোগে তাহার চারিদিকে গাছপালা গজাইয়া রীতিমতো বনজঙ্গল দেখা দিয়াছিল। এমন সময়ে ১৮৮০ খৃস্টাব্দে ভূমিকম্প আরম্ভ হইল। সে কম্প এক-একটি বড়ো সামান্য নয়, কারণ সমুদ্র পার হইয়া অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত মাঝে মাঝে তাহার ধাক্কা পৌঁছিত। তিন বৎসর ভূমিকম্পের পর সহস্র কামান গর্জনের মতো ভীষণ শব্দে পাহাড় ভেদ করিয়া আগুন আর গরম বাষ্পের প্রকাণ্ড স্তম্ভ বাহির হইল। সে-স্তম্ভ সাত মাইল উঁচু হইয়া চারিদিকে গরম ধুলা ছাই আর পাথর ছিটাইতে লাগিল। এইরূপে তিন মাস পাথর বৃষ্টি করিয়াও পাহাড়ের তেজ কমিল না। ১৮৮৩ খৃষ্টাব্দের ২৬শে আগস্ট সন্ধ্যার পরে সমুদ্র হইতে জাহাজের নাবিকেরা দেখিয়াছিল, পাহাড়ের চারিদিকে লাল ধোঁয়ায় আকাশ ঘিরিয়া রহিয়াছে, তাহার মধ্যে আগুনের গোলা ছুটিতেছে, বিদ্যুৎ চমকাইতেছে এবং ঘন ঘন বাজ পড়িতেছে। তাহার পরদিন ভোরবেলা একশত মাইল দূরে বাটাভিয়া শহরে গরম ধুলার বৃষ্টি হইল এবং তাহার কয়েক ঘণ্টা পরেই অসম্ভব ভয়ংকর শব্দে ক্রাকাতোয়ার প্রকাণ্ড পাহাড় আকাশে উড়িয়া গেল। আট মাইল ডাঙা বেমালুম শূন্যে মিলাইয়া গেল, গভীর সমুদ্র আসিয়া তাহার স্থান দখল করিল। সেই শব্দের ধাক্কা তিনহাজার মাইল দূর পর্যন্ত পৌঁছিয়াছিল, আকাশ তোলপাড় করিয়া সমস্ত পৃথিবীময় বাতাসের ঢেউ ছড়াইয়া পড়িয়াছিল; হাজার হাজার মণ পাথর চূর্ণ হইয়া ধুলার মতো আকাশের দিকদিগন্তে ভাসিয়া গিয়াছিল এবং পৃথিবীর সকল দেশে উদয়াস্তের সময় আশ্চর্য রঙের খেলা দেখাইয়াছিল।

 এখানেও তাহার শেষ হয় নাই। পাহাড় ফাটিবার সময়ে সমুদ্রের ভিতর পর্যন্ত আগুন ঢুকিয়াছিল এবং ভীষণ ভূমিকম্পে গভীর সমুদ্রকে তোলপাড় করিয়া তুলিতেছিল। তাহার উপর যখন পাহাড় উড়িয়া দূরে সমুদ্রের মধ্যে গিয়া পড়িল তখন সমুদ্র একেবারে প্রলয়মুর্তি ধারণ করিয়া, ফুলিয়া পাহাড় সমান উঁচু হইয়া ডাঙার উপর ছুটিয়া পড়িল। শহর গ্রাম ঘরবাড়ি গাছপালা চক্ষের পলকে কোথায় ভাসিয়া গেল। এই দুর্ঘটনার ফলে প্রায় চল্লিশ হাজার লোক মারা পড়ে, অনেক জাহাজ ডুবিয়া যায়, আর সুণ্ডা প্রণালীর চেহারা একেবারে বদলাইয়া যায়। সমুদ্রের ঢেউ এমন বেগে আসিয়াছিল যে একটা জাহাজকে পাওয়া যায় সমুদ্র হইতে তিন মাইল দূরে শুকনা ডাঙার উপরে। ইহার তুলনায় আমাদের সেদিনকার ভূমিকম্পটাকে অবশ্য নিতান্তই সামান্য ব্যাপার বলিতে হইবে। তাহার সঙ্গে অগ্নিবৃষ্টি, পাহাড়বৃষ্টি বা সমুদ্রের ঢেউ এ-সব কোনো হাঙ্গামা ছিল না।

 পৃথিবীর মাটি কেঁকড়াইয়া বড়ো-বড়ো পাহাড় পর্বতের সৃষ্টি হয়। সেই-সব পাহাড় উঠিবার সময়ে মাটির স্তরগুলোকে বাঁকাইয়া ফাটাইয়া ভাঙিয়া উলট-পালট করিয়া দেয়। যে মাটি সমানভাবে শোয়ানো ছিল তাহাকে খাড়া করিয়া ঝুলাইয়া দেয়। কঠিন পাথরকে ঠেলিয়া নরম মাটির মধ্যে বসাইয়া দেয়, নরম মার্টিকে চাপ দিয়া পাথরের ফাটলে ফোকরে ঢুকাইয়া দেয়, পাথরের গায়ে পাথরকে পিষিয়া ভঙিতে চায়। এইরূপে সমস্ত মিলিয়া এমন চাপাচাপি করিয়া থাকে যে কোথাও এতটুকু স্তর খসাইতে গেলে সমস্ত পাহাড়সুদ্ধ টলমল করিয়া উঠে। এই-সকল কাণ্ড প্রতি মুহর্তেই চলিয়াছে। ধীরে ধীরে যুগের পর যুগ পাহাড়ের স্তর সরিয়া সরিয়া একদিন হয় তো একেবারেই বেসামাল হইয়া টলিয়া পড়িল; নরম মার্টির ভিতর পাহাড় বসিতে বসিতে একদিন হঠাৎ পিছলাইয়া ধ্বসিয়া গেল। দুই দিকের উলটা চাপে ফুলিতে ফুলিতে একদিন পাহাড়ের দেমাক ফাটিয়া চৌচির হইল, এইরকমে বহুদিনের ঠাসাঠাসি ঠেলাঠেলি এক-একদিন হঠাৎ ভূমিকম্পের আকারে গা-ঝাড়া দিয়া বাহির হয়।

 ভূমিকম্পের ধাক্কা মাটির ভিতর দিয়া ঢেউয়ের মতো চারিদিকে ছড়াইয়া পড়ে। সেই ঢেউয়ের আঘাতে কেমন করিয়া পৃথিবী টল্‌মল্ করিতে থাকে, তাহার সামান্য একটু নমুনা তোমরা দেখিয়াছ। তাহাতে ঘরবাড়ি ভাঙিয়া পড়ে, পথঘাট ফাটিয়া যায়, রেলের লাইন মোচড়ইয়া বাঁকিয়া যায়। ১৭৯৭ খৃস্টাব্দে দক্ষিণ আমেরিকায় কুইটো শহরে যে ভূমিকম্প হইয়াছিল তাহাতে শহরের কোনো কোনো জায়গায় মানষগুলিকে ফুটবলের মতো ছুঁড়িয়া দিয়াছিল। তাহার একশত বৎসর পূর্বে পের্টিরয়্যালের ভূমিকম্পে বাজারের ভীড়কে ছিটাইয়া নীচে বন্দরের মধ্যে আনিয়া ফেলিয়াছিল। লিসবনের ভূমিকম্পে নদীতে বান ডাকিয়া শহরের অসংখ্য লোককে ডুবাইয়া দিয়াছিল। কয়েক বৎসর আগে সানফ্রান্সিসকো শহরে যে ভূমিকম্প হইয়াছিল সে কেবল বাড়ি ঘর ফেলিয়াই ক্ষান্ত হয় নাই, গ্যাসের নল আর বিদ্যুতের তার ভাঙিয়া জড়াইয়া সে শহরে আগুন লাগাইয়া দেয়। সে এমন সর্বনেশে আগুন যে শহরের সমস্ত দমকল মিলিয়াও তাহাকে কিছুমাত্র জব্দ করিতে পারে নাই। তার পরে শহরের কর্তা বোমাবারুদ ফাটাইয়া আগুনের আশেপাশে অনেকগুলা বাড়ি উড়াইয়া দিয়া মনে করিলেন আগুন আর ছড়াইতে পারিবে না। কিন্তু আগুন প্রায় সিকি মাইল ফাঁকা জমি টপকাইয়া শহরের আর একদিকে ফুটিয়া বাহির হইল। যাহা হউক, খানিক বাদে বাতাসের মুখ ঘুরিয়া গেল তাই রক্ষা, তাহা না হইলে শহরের চিহ্নমাত্র থাকিত কি না সন্দেহ।

 ভূমিকম্পে অনেক সময়ে পাখিরা ব্যস্ত হইয়া উড়িতে থাকে। ডাঙার জন্তু ভয়ে ছুটাছুটি আর চীৎকার করিতে থাকে। একটা হাতির কথা শুনিয়াছি, সে ১৭০৭ খৃষ্টাব্দের বড়ো ভূমিকম্পের সময়ে প্রথমটা অবাক হইয়া চারিদিকে তাকাইতেছিল, তার পর কাঁপুনি যখন বাড়িয়া উঠিল তখন সে প্রাণপণে চার পা ছড়াইয়া মাটি আঁকড়াইয়া চীৎকার করিতে লাগিল। গল্প শুনিয়াছি, একটা বাড়ির পাঁচিলের উপরে দুইটি বিড়াল মুখামুখি বসিয়া সুর ভাঁজিতেছিল, এমন সময়ে ভূমিকম্পের ধাক্কায় দুইজনকেই পাঁচিল হইতে ফেলিয়া দেয়। সংগীতচর্চায় হঠাৎ এরকম বাধা পাইয়া তাহারা পরস্পরকে আক্রমণ করিবার জোগাড় করিতেছিল, এমন সময়ে পাঁচিল ভাঙিয়া দু-চারখানা ইট পড়িতেই তাহাদের যুদ্ধের উৎসাহ থামিয়া গেল। আর এক নাবিকের পোষা টিয়াপাখির গল্প শুনিয়াছি, সে আশ্চর্যরকম কথা বলিতে পারিত। একবার ভূমিকম্পে সে খাঁচাসুদ্ধ ঘরচাপা পড়িয়াছিল। পরে শুনা গেল ভাঙা ঘরের তলা হইতে কে যেন চীৎকার করিয়া গালাগালি করিতেছে। তখন ইট সরাইয়া দেখা গেল, পাখিটা খাঁচার মধ্যে এক জায়গায় কোণঠাসা হইয়া বসিয়া আছে, আর বলিতেছে “বড়ো গরম, বড়ো গরম"।

সন্দেশ—আষাঢ়, ১৩২৫